সাবিত্রী রায়ের সাহিত্য-তপস্যা তাঁর নির্জনতার প্রসুন আর অপরদিকে তা সুপরিণত ফলও। পথ চলতি ঘাসের ফুল তাকে বলা চলবে না। একদিকে এ-নীরব অনুভূতি ফুলের মত ফুটে উঠেছে অন্তরের সূর্যালোকে আর অপরদিকে সেই সূর্যালোকে প্রাণদীপিত হয়েছে বহু মানুষের, বহু বনস্পতির, বহু তৃণের, বহু অরণ্যের। এত সব চরিত্র-চিত্রণ তাঁর পক্ষেই সম্ভব যিনি নিজেকে এতজনের মধ্যে দেখতে পান আবার এতগুলি চরিত্র তাঁর চরিত্র থেকে প্রাণ আহরণ করে তবে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। এ তপশ্চর্য্যার মধ্যে ক্রমশ একটা আত্মোত্তরণ বা অগ্রগতি আমরা লক্ষ্য করি – তাঁর রচনা ক্রমশঃই পরিণত থেকে সুপরিণত হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের একটা প্রথা আছে যে আমরা সততই মৃতকে দেবতা বানাই ও জীবনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকি। এই নঞর্থক ভাবনা ও চেষ্টা আমাদের ব্যক্তি জীবনের সংস্কার ও জাতীয় জীবনের নিয়তি। ইয়োরোপীয় জীবনাবাদের সঙ্গে এইখানেই তার বিরোধ। ত্যাগ-তপস্যার নামে একপ্রকার রুচিহীন যে দুঃখদায়ক পরিস্থিতি আমরা জীবনে ডেকে আনি তাকে সত্য শিব সুন্দর এসব নাম দেওয়া যায় না। বলা নিষ্প্রয়োজন যে আমাদের সাহিত্যেও এবম্প্রকার অশিব অসুন্দর অসত্যের করাল ছায়াপাতন অবশ্যম্ভাবী। মাত্র একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম দেখা যায়। সেটি রবীন্দ্রনাথ। আর এই মহাসূর্যের আশেপাশে অমন দুই চারিটি যে তারকা লক্ষিত হয় তা সহসা আমাদের চোখেও পড়ে না। চোখে না পড়া সেই অবহেলিত তারা কয়েকটির মধ্যে আমরা সাবিত্রী রায়ের রচনাকে ফেলতে পারি। তাঁর রচনা নিশ্চয়ই বেশী লোক পড়েননি বা তাঁর জীবিত কালের প্রাপ্য সম্মান তাঁকে দেননি। আমার আশা চিরাচরিত প্রথামত হয়ত এখন তাঁর লেখা পুনপঠিত হবে। অবশ্য এও সত্য সাবিত্রী রায় বেশী লেখেননি। তাঁর অন্বিষ্ট ছিল সততা। সেই মূলধনে যে বাণিজ্যিক সফলতার হাত পৌঁছয়নি এটা আমাদেরই সৌভাগ্য। প্রথম থেকে শেষ অবধি সেই বিশিষ্ট মূলধন তাঁর অটুট থেকে গিয়েছে।
সাবিত্রী রায়ের প্রথম দিকে কয়েকটি ছোট গল্প দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ও তদুত্তর সময়ে বার হয়ে থাকবে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘সৃজনে’র সুষ্ঠু সমালোচনা তৎকালীন আরও একজন সৎসাহিত্যিক ও সাহিত্যিকসুহৃদ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় করেছিলেন। ঐ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কঠিন পরিস্থিতি এবং মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ যন্ত্রণা ও জীবননাশের চিত্র তাঁকে কলম ধরায়। মানুষ শান্তিতে বাঁচতে চায়, তার স্বল্পদিনের জীবনে সে পরিশ্রম করে, অন্ন অর্জন করে প্রিয়জনের সঙ্গে তা ভোগ করে তুষ্ট হতে চায়। মানুষের এই চাওয়ার পথে বাধা প্রবল আর সেই বাধাও লুব্ধ মানুষের সৃষ্টি। এও সৃষ্টি – নাকি সৃষ্টির বীভৎসা – কিন্তু অতি কঠিন সত্য। এক কথায় তাঁর রচনা ধীরে ধীরে সময়ের দলিল হয়ে ওঠে। তবু কিন্তু তা সাহিত্যই। এই চেতনার দুঃস্বপ্নও যাঁদের লেখার প্রেরণা দেয় তাঁদের মহৎ সাহিত্যিকের শ্রেণীতে ফেলতেই হয়। অনুরূপ সময়ের দলিল রয়েছে গোপাল হালদারের রচনা উনপঞ্চাশী, পঞ্চাশের পথ ও উনপঞ্চাশী উপন্যাসগুলির মধ্যে। যুদ্ধ, যুদ্ধের মুনাফা ও যুদ্ধের মধ্যে দেশপ্রেমিক বিদেশী যুবকের বেদনাময় আত্মদানের করুণ নির্মম চিত্র সেখানে মিলবে। প্রসঙ্গত জানাই এসব গ্রন্থও বহুপঠিত নয়। সকলের তৃষ্ণার জল ভিন্ন। অথবা ‘‘গাঙ্গং বারি মনোহারী’’ সতত হয় না এ কথার তাৎপর্যও বোঝা দরকার। আমরা কজন মনীষী রঁম্যা রঁল্যার রচনা সত্যই উপভোগ করি – একথা বিচার্য। সাহিত্যেও তাই শ্রেণীভেদের সঙ্গে সঙ্গে অধিকারভেদও মানতে হয়। সেই ‘শ্রেণী’ চেতনা নিয়েই সাবিত্রী রায়ের রচনার বিশিষ্টতা এবং বস্তুতঃ তা পাঠের ক্ষেত্রেও অধিকারী ভেদ স্বীকার করতে হবে।
সাবিত্রী রায় অাকৈশোর-যৌবন কোনও না কোনও রাজনীতি অন্দোলনের সঙ্গে অন্ততঃ মননের দিক থেকে জড়িত। যাঁদের স্বামীরা সক্রিয় রাজনীতি করেন সে সকল মানুষের স্ত্রীরাও কোনও না কোনও ভাবে রাজনীতির কবলে এসে পড়েনই। কেউ হয়ত সক্রিয় আন্দোলন করেন, কেউ হয়ত সক্রিয় চিন্তায় ব্যক্তিগত সমস্যা-ভাবনার পাশাপাশি আর সমজাতীয় মানুষের ব্যথা বেদনা সংগ্রামকে উপলব্ধি করেন। সাবিত্রী রায় এই দ্বিতীয় জাতের চেতনাময়ী। ঐ চেতনা তাঁকে সৃজনশীলা করেছে – সমৃদ্ধ করেছে। যে পটভূমি তাঁর রচনার বিষয়বস্তু তা অতি কঠিন বিষয়। তাঁকে বিবাহোত্তর জীবনে ঘরে-বাইরে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে তবেই কলম ধরতে হয়েছে। তাঁর কলম ধরা আবশ্যিক ও অপরিহার্য্য হয়ে উঠেছে। এও তিনি উপলব্ধি করেন যে এই সৃজনের পথই তাঁর পথ। এরপর থেকে তাঁর জীবন ও রচনা ভিন্ন খাতে হয়নি। রচনা ও জীবন রচনা একত্রিত অনুরাগে প্রসারিত হয়ে চলেছে সদর্থক শুভবোধ দিয়ে। এই কারনেই সাবিত্রী রায়ের রচনা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক উপন্যাস রচনা। তাতে আছে তৎকালীন সময় – অতীতের হিল্লোলিত দোলা এবং তৎসহ ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় স্বপ্ন। অথচ লক্ষ্য করার মত যে এ রচনা সত্যই রসোত্তরীর্ণতার সাহিত্য হয়ে উঠেছে। রাজনীতির কঠোরতা তার গতিকে কোথাও ভারাক্রান্ত করেনি। সময়ের অনুরূপ চেতনা গতিময়ী। সে গতি উপলব্যথিত গতি। সেই বাধাও সত্য এবং গতিও সত্য। সাবিত্রী রায়ের উপন্যাসে এসে দাঁড়ায় মানুষ – অসংখ্য মানুষ ও চেনামানুষ। পথচলা মানুষের মত তিনিও তাদের সঙ্গে পথ চলেন – চলতে চলতেই সম্পর্ক গড়েন, চলতে চলতেই তা কেটে যায়। চলার পথেই কেউ স্নিগ্ধ আতিথ্যে তাকে তৃপ্ত করেন। তিনি তা গ্রহণ করেন। কোথাও অনাবৃত আঘাত তাঁকে ক্ষত-বিক্ষত করে। চলতে চলতেই তিনি আত্মরক্ষা করেন। শুধু জীবধর্ম নয়, জীবনধর্ম তাঁকে চালনা করে। বলতে গেলে অতি সংবেদনশীল-স্নিগ্ধমধুর প্রকৃতির মানুষ সাবিত্রী রায় ক্ষণে ক্ষণেই বাস্তবের যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত হন। এ তাঁর প্রকৃতি – এ তাঁর নিয়তি। কিন্তু তাঁর রচনা অতিরঞ্জন নয়; মানুষের আত্যন্তিক শুভবোধের প্রতি বিশ্বাস তিনি হারাননি – না তাঁর জীবনে, না তাঁর রচনায়। পূর্বেই বলেছি তাঁর রচনা ও তাঁর জীবন এক অবিচ্ছেদ্য সামগ্রিক সূত্রে বাঁধা।
‘পাকা ধানের গান’ পাকাহাতের কাজও। তিনখণ্ডের এই উপন্যাসের বিস্তৃতি বিশাল। তার সঙ্গে ‘মেঘনা পদ্মা’ যুক্ত করলে একেবারে প্রথমদিকের ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা বিপ্লবী দল থেকে ক্রমোত্তীর্ণ কমিউনিস্ট কর্মী নরনারীর সাক্ষাৎ মিলবে। কিন্তু জীবনের সুষম ছন্দ সেখানেও থাকে। অজস্র চরিত্রজাল। পার্থ, ভদ্রা, পার্থর মা, দেবকী ও তার দুশ্চরিত্র নিষ্ঠুর অত্যাচারী স্বামী রাজেন, দেবকীর বিধবা বড় জা আন্নাকে প্রাণ দিতে হয় সে স্নান করার কালে জলে ডুবে একটু তৃষ্ণার জল খেয়েছিল বলে। গ্রাম্য জীবনের কুৎসিত আঘাত তাকে বাধ্য করে গলায় দড়ি দিতে। গ্রামীণ পরিবেশে সেও রসাল ব্যাপার। দেবকীকে শ্বশুরবাড়ী থেকে তার দরিদ্র পিতার জন্য এবং মূলতঃ যন্ত্রণা দেবার জন্যই শিশুপুত্রটি কেড়ে নিয়ে বিদায় করে দেওয়া হয়। লতা-সুলক্ষণের জীবন অবশেষে তেভাগা আন্দোলন ও হাজাং বিদ্রোহের আত্মগোপনপর্ব শেষে গড়ে ওঠে। মুসলমান তরুণকে ভালবাসার অপরাধে বিধবা মেঘীকে গ্রামছাড়া হতে হয়। অবশেষে মেঘী তার প্রেমিকসহ মিলিত হয়ে ঘর পায়। দেবকী তার ভবিষ্যত গঠন করতে কলকাতায় আসে – অবশেষে সেও ত্রাণ পায় তার চিরাচরিত সংস্কার থেকে এবং সাংবাদিক কুরুপের সঙ্গে তার একটা মমতার বন্ধন গড়ে ওঠে। পার্থ, তার হাজং সাধী সারথী অকুস্থলে লড়াই করে। পার্থ আহত হয় ও মারা যায়। পার্থ একেবারে কৃষক সমাজ থেকে সমাগত – সে নিজেকে কমিউনিস্ট কর্মী জীবনের মধ্য দিয়ে শিক্ষিত করেছে। তার মধ্যে ফাঁকি নেই। তার সরল প্রেমের মধ্যে বিধবা ভদ্রা আশ্রয় খুঁজে পায়। উভয়েই যেন উভয়ের প্রতিপূরক হয়ে ওঠে। এসব চরিত্রের মধ্যে দিয়ে কাছাকাছি আসে আরও বহু পার্শ্বচরিত্র, তারা কিছুটা সাহায্যকারী প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিস্ট না হলেও। ভদ্রাও সেভাবেই কাছে এসে পরে কর্মী হল। ভদ্রার জীবন আশ্চর্য সততাসহ চিত্রিত হলেও এক আধটুকু অসুবিধায় পড়তে হয়। সে পূর্বজীবনে জমিদার ঘরের মেয়ে বা বধূও। পতিবিরহিত জীবনে সে ছিল বৃদ্ধ শ্বশুরের আশ্রয়স্থল। পার্থর সাহচর্যে এসে তার পরিবর্তন হল; শ্বশুর কীভাবে নিলেন – বা সেই বা শ্বশুরকে কি বলল, এগুলি নেপথ্যে থেকে যায়। একপ্রকার হয়ত তা ভালই। কিন্তু সমাজে সংসারে এভাবে তাই কি ঘটে?
প্রথম প্রকাশঃ দর্শক ॥ ২৭ বর্ষ ॥ ১৯ সংখ্যা ॥ ১৩৯৪/১৯৮৭ । লেখাটি ‘গ্রন্থালয়’ প্রকাশিত ‘সাবিত্রী রায় রচনাসমগ্র’ ২য় খণ্ড থেকে গৃহীত।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।