গল্পের সময় ডেস্কঃ তিনি ছিলেন সাহিত্যিক, আবার কবিও। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিহারের ভাগলপুরে যে দুর্গাচরণ স্কুলে পড়তেন সেখানেই ছোটবেলায় পড়াশুনো করেছেন তিনি। স্কুল বয়সেই লেখালিখির শুরু হাতে লেখা ম্যাগাজিনে। সেই সময়েই ভাগলপুরের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ আয়োজিত একটি গল্প প্রতিযোগিতায় গল্প লিখে প্রথম পুরস্কার জিতে নেন বিচারক বনফুলের (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) কাছ থেকে। সেই সাহিত্যপ্রতিভাকে চিনতে ভুল করেননি বনফুল। বলেছিলেন তোমার লেখার হাত ভাল, চেষ্টা করো। একদিন সফল হবে। ভাগলপুরের সেই ছোট ছেলেটিই ভবিষ্যতে হয়ে উঠেছেন সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত।
তবে এলাম, লিখলাম আর জয় করলাম – লেখালিখির এরকম সহজ জীবন ছিল না দিব্যেন্দু পালিতের। ১৯৫৮ সালে বাবা মারা যেতেই জীবিকার প্রয়োজনে চলে আসেন কলকাতায়। উদ্বাস্তু বোঝাই শিয়ালদা স্টেশনেই রাত কাটিয়ে দেন কিছুদিন। প্রথমে বেলেঘাটায় মাসির বাড়ি, তারপর বন্ধুর মেস, শিয়ালদা স্টেশন হয়ে মাথাগোঁজার আস্তানা হয় চেতলার এক টুকরো ভাড়াবাড়িতে। জুটিয়ে নেন বাড়ি বাড়ি করা সমীক্ষার কাজ। এরপর পিজি হাসপাতালের সার্জন ভূমেন্দ্র গুহ’র (কবি) সঙ্গে আলাপ হওয়ায় উঠে যান তাঁর হাজরা রোডের ভাড়া বাড়িতে। সে বাড়িতে তখন চলছে জীবনানন্দ দাশের ট্রাঙ্ক ভর্তি পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধারের কাজ। সে এক বিচিত্র সময়। এরপর বুদ্ধদেব বসুর সান্নিধ্যে এসে ঢুকে পড়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের পাঠক্রমে। তারপর সাংবাদিকতার চাকরিতে। যোগ দিয়েছেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। করেছেন সম্পাদকের কাজ। সুস্থিতি ফিরেছে জীবনে। উঠে গেছেন গড়িয়াহাটের আকাশছোঁয়া মেঘমল্লারে। তবে সেই ভাগলপুর, শিয়ালদা স্টেশনের অভুক্ত রাত, একের পর এক বাড়ি বদল আর মেঘমল্লার – এই জার্নিটাকে একেক সময় মেলাতে না পেরে বিস্মিত হতেন তিনি।
জীবনের নানা টানাপোড়েন, সংঘাতের মধ্যেই গভীরভাবে লেখালিখির কাজটা চালিয়ে গেছেন দিব্যেন্দু পালিত। ১৯৫৫ সালে কলেজে পড়ার সময়েই আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে ছাপা হয় প্রথম গল্প ‘ছন্দপতন’। ঠিক তার পরের বছরই দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘নিয়ম’ নামের গল্পটি। এরপর কলকাতায় এসে চেতলার ভাড়া বাড়িতে বসে লিখে ফেললেন ‘শীত গ্রীষ্মের স্মৃতি’। কবিতা লিখতে শুরু করলেন ‘দেশ’, ‘কৃত্তিবাস’ এবং বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায়। জড়িয়ে পড়লেন বিমল করের ‘ছোটগল্প নতুন রীতি’ আন্দোলনে।
‘আমি ও আমার তরুণ লেখক বন্ধুরা’ গ্রন্থে বিমল কর লিখেছেন, ‘লেখার ব্যাপারে দিব্যেন্দুকে কোনদিন হেলাফেলা করতে আমি দেখিনি। সে বরাবরই পরিশ্রমী, খুঁতখুঁতে, সংযমী। তাছাড়া আমার অনেকবারই মনে হয়েছে তার অধিকাংশ লেখার মধ্যে কেমন এক বেদনার রাগিনী বেজে চলে। চট করে হয়ত তা ঠাওর করা যায় না। তবে সচেতন পাঠক সম্ভবত অনুভব করতে পারেন, আমাদের অস্তিত্বের মধ্যে যে টানাপোড়েন রয়েছে, রয়েছে দিবস ও যামিনীর দুই রূপ, আত্মসর্বস্বতার পাশাপাশি থেকে যায় যে অনুশোচনা, শেষ অবধি আত্মিক যন্ত্রণা – দিব্যেন্দু সেই বেদনাকে প্রকাশ করতে চেয়েছে বার বার। সে আর এক জাতের নীতি-বিশ্বাসী, যে নীতিকে আমরা মানব চিত্তের ধর্মজ্ঞান বলি। আমার তো মনে হয়েছে তার লেখার মধ্যে মানবজীবনের নৈরাশ্যের যে ছবি ফুটে ওঠে তার রেখাগুলি সযত্নে অঙ্কিত হলেও – ছবির তলায় রয়েছে কিছু আশা কিছু মমতা, আর ভালবাসা।’
কবিতার পাশাপাশি সাহিত্য জীবনে প্রচুর গল্প-উপন্যাস লিখেছেন দিব্যেন্দু পালিত। পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার। তাঁর গল্প নিয়ে বেশকিছু সিনেমাও তৈরি হয়েছে। যেমন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘গৃহযুদ্ধ’, রাজা দাশগুপ্তর ‘মুখগুলি’, তপন সিংহের ‘অর্ন্তধান’ ইত্যাদি। এসব সত্ত্বেও বহু পঠিত, পপুলার লেখক হয়ে ওঠেন নি দিব্যেন্দু পালিত। তার পাঠক ছিল নির্দিষ্ট। বোধহয় নিজের ইচ্ছেতেই এই অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। একটি সংবাদপত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন – লেখককে একটু আড়ালেই থাকতে হয়। শিল্পী যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রচার প্রিয় হয়ে ওঠেন তাহলে তাতে শিল্পকেই অপমান করা হয়। পাঠকদের নিজেদেরই তাকে (লেখককে) চিনে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।
দিব্যেন্দু পালিতের লেখালিখির গুণের কথা অকপটে জানিয়েছেন বিমল কর। তিনি লিখেছেন, ‘…পড়ে কী মনে হয় না, দিব্যেন্দু তার সমসাময়িকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার মার্জিত, ঝকঝকে, কাব্যময় গদ্য-রচনা, সযত্ন ও পরিচ্ছন্ন বাক্য গঠন – এসব গুণের কথা তেমন করে উল্লেখ করা হয় না। দিব্যেন্দুর লেখায় আধুনিক মানুষের ব্যক্তিত্বের যে সব সমস্যা ও যন্ত্রণার কথা বার বার উঁকি দেয় – তা এহ বাহ্য বলে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই।’
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।