“ টু রেগুলার চিকেন পিজ্জা” – অর্ডারটা দিয়েই আবার মোবাইলে মনোযোগ করল অমিত। ওপারের কণ্ঠস্বর একটানা কোণও এক কাহিনি বর্ণনা করে চলেছে ক্ষণিকের হাসির বিরতি সহকারে। অমিতের মুখটাও খুশির এক মায়াবী আভায় উজ্বল হয়ে উঠতে লাগল।
রেস্তোরা থেকে বেরিয়ে এসে পারকিং লট থেকে গাড়িটা বার করে অমিত সোজা চলে গেল একটা আইসক্রিম পার্লারে। সেখানেও দুজনের জন্য অর্ডার দিল সে। এই সেই আইসক্রিম পার্লার যেখানে সে রূপকথাকে প্রথমবার দেখেছিল। সত্যি, রূপকথা এসেছিল রূপকথার মতই, অমিতের আগোছালো জীবনকে গুছিয়ে পরিপাটি করে তুলতে। জানালার ধারের একটি চেয়ারে বসে ছিল সে। গালের উপর এসে পড়া চুলটিকে আঙুল দিয়ে আলতো করে কানের পাশে করতে দেখেই অমিতের মনে কোনও এক অজানা ডাক যেন সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তারপর আলাপ। দেখা সাক্ষাৎ, কফির পেয়ালা সাক্ষী হয়ে রইল দুটি মনের নিঃশব্দ ও অবিচ্ছেদ্য মিলনের।
আইসক্রিম কিনে যেই না গাড়িতে উঠতে যাবে অমনি বন্ধু অদ্রিজার ফোন– কিরে কেমন আছিস?
ভালো রে, তোর খবর কি?
এই চলছে; বলছি যে তুই ঠিক আছিস তো একটু এখন? অনেকদিন কোন দেখা সাক্ষাৎ নেই তাই জিজ্ঞেস করছি আর কি।
হ্যাঁ রে একদম ঠিক আছি। এই যে রূপকথার জন্য আইসক্রিম নিয়ে ফিরছি। সুকান্তদা কেমন আছে?
হ্যাঁ রে ভালো আছে। ওই তো মনে করাল যে আজ তোদের ……… মানে……
আনিভারসারি। কারেক্ট।
হুম।
শোন না; এখন আপাতত ফোনটা রাখছি। আবার পরে কথা হবে হ্যাঁ? টাটা।
ফোনটা কেটেই কান্নায় ভেঙে পরল অদ্রিজা। সুকান্ত সবে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে –
কি হল অদ্রিজা? অমিতকে ফোন করেছিলে? কি বলল? ও ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ। শোনো না; তুমি তো অনেক কেস সল্ভ করেছ, বল না তুমি অমিতকে সাড়িয়ে তুলবে?
চোখের জল মুছতে মুছতে অদ্রিজা বলল। মুখে কোন উত্তর না দিলেও মনরোগ বিশেষজ্ঞ সুকান্ত বর্মণ জানে যে অমিত এখন যেমন আছে, যা করছে সেটা আর পাঁচটা লোকের কাছে অস্বাভাবিক হলেও যদি ওই অস্বাভাবিকতা ওকে খুশি রাখে, বাঁচিয়ে রাখে তবে না হয় তাই হোক। দায়িত্বের কাছে না হয় আজকের দিনটার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেওয়া যাবে!
ফ্ল্যাটে এসে যেই না সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে; দোতলার রায় কাকিমার সাথে দেখা হল। রূপকথাকে বিয়ে করে যখন প্রথম এখানে এসে অমিত ওঠে, তিনিই একরকম গুরুজনের মত ওদের পাশে ছিলেন। বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিল ওরা দুজনে। জ্যোতিষী বলেছিল এই বিয়ে সুখের হবে না। অমিতের কাছে সেকথা শুনে রায়কাকিমা আশ্বাস দিয়েছিলেন –
ধুর! ওসব কিস্যু হয় না। অত কথায় কান দিয়ে কাজ নেই। তোরা যদি একে অপরের সাথে সুখী থাকিস; হাজারো ঝড়ঝাপটা, বাধা-বিপত্তির সামনে একে অপরের অবলম্বন হয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারিস; তবে এসব কথা মনে করে একদিন আপন মনেই হাসবি দেখিস!
অমিতের চোখে চোখ পরতেই রায়কাকিমা মৃদু হাসলেন। বললেন-
গাড়ির আওয়াজ শুনেই মনে হয়েছিল তুই! আজকের দিনেও এত দেরি করলি বাবা? তোর জন্য … মানে তোদের জন্য পায়েস বানিয়েছি। নিয়ে যা।
মৃদু হেসে টিফিন বাক্সটা নিয়ে নিজেদের তিনতলার ঘরটার দিকে উঠতে লাগল অমিত। আঁচল দিয়ে নিজের চোখের জল ঢেকে দরজা বন্ধ করতে করতে ভগবানকে দুষতে লাগলেন রায়কাকিমা।
অমিত তখনও ফোনে কথা বলে চলেছে –
হ্যাঁ কিছু মনে কোরো না। এই তো পৌঁছে গেছি। আরে রায়কাকিমার সাথে দেখা হল। তোমায় কতই না ভালবাসেন দেখ। জানো আজ অরূপের সাথেও দেখা হয়েছিল। আরে অরূপ, তোমার সেই ছোট্ট ড্রইং স্টুডেন্ট, যাকে দেখিয়ে তুমি আমায় আড়ালে বলেছিলে ঠিক ওর মত মিষ্টি আর শান্ত স্বভাবের একটা ছেলে চাই তোমার। মনে পড়ে? হা! হা! সত্যি কিরকম ছেলেমানুষ ছিলে তুমি!
ঘরে ঢুকে আলো জ্বালল অমিত। ফোনটা তখনও কানে –
এই শোনো না, তোমার জন্য সবাই ফুল পাঠিয়েছে অফিস থেকে। বাড়ি ফিরে দেখি দরজার বাইরে সব পড়ে আছে। আচ্ছা সবাই ফুল কেন পাঠায় গো? আর নিজেরা আসে না কেন? অদ্ভুত জানো তো!
খাবার টেবিলে দুটো প্লেট সাজাল অমিত। হাত পা মুখ ধুয়ে এসে যেই না খাবারের প্যাকেটটা খুলতে যাবে, ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠল। মোবাইল ওভাবেই টেবিলে ফেলে রেখে চলে গেল অমিত। ওপারের মহিলা কণ্ঠস্বরটি তখনও একই ভাবে কথা বলে চলেছে-
আরে হ্যাঁ; সিট বেল্ট বেঁধেছি রে বাবা! তুমি না সত্যিই; আর বার বার এক কথা বোলো না তো; রূপকথা ফোনটা রাখো, রূপকথা ফোনটা রাখো, আরে কিস্যু হবে না; আমার কথা বলতে বলতে ড্রাইভ করা অভ্যেস আছে। আচ্ছা ছাড়ো সেসব কথা। এই শোনো না, তোমায় যে গুড নিউজটা সকালে দিয়েছি, রাতে মা বাবাকে পার্টি থেকে আলাদা করে ডেকে আমরা ওদেরকেও নিউজটা দেব কেমন? আজকের চেয়ে ভালো দিন আর কবেই বা হবে বল? ওরা যে এতগুলো বছরের অভিমান ভেঙে আমাদের ব্যাপারটা মেনে নিয়ে আসছে এই তো অনেক বল? …… আরে হ্যাঁ, তোমার ফেভারিট পিজ্জা আনছি …… আর আইসক্রিমও…… এই শোনো না ………
তারপর একটা ভীষণ সংঘর্ষের শব্দ ভেসে এল ফোনটা থেকে। তিনবার বিপ বিপ বিপ আওয়াজ করে কলটা ডিসকানেক্ট হয়ে যাওয়ার শব্দ হল আর রেকর্ডিঙটাও সেখানেই থেমে গেল।
Tags: অ্যানিভারসারি, দেবাশিস সাহা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।