জৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা। উৎসবের দিন। উৎসবের নাম জাগরণ। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বাৎসরিক উৎসব। প্রতিবছরের মত এবছরও জাগরণ পরবের আয়োজন করেছে রাজবল্লভবাটী গ্রামের আদিবাসী পাড়া। বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছেলেমেয়ে, মাঝবয়সী, বুড়োবয়সী, সবাই মেলায় আসে, পচাই খায়। নাচে, গান গায়, ধামসা, মাদস, কাঁসি বাজাতে বাজাতে বৃত্তের ব্যাসার্দ্ধের মতো লাইনে পুরুষরা পিছিয়ে যেতে থাকে আর মেয়েরা আর একটি ব্যাসার্দ্ধে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে যায়। এইভাবেই ওরা আনন্দ প্রকাশ করে।
সারাবছর ধরে মাঠে ঘাটেওদের খাটতে হয়। এই সময়টায় মাঠের কাজ কম থাকে। জমির পাট গাছগুলো বড় হয়ে যায়। বর্ষা নামলে আমনধান বোনার কাজ শুরু হবে। এই অবসর সময়ে একটু আনন্দ করে নাচ গান করতে, পাঁচুই খেতে কার না ভাল লাগে ? তাই ঐ দিন বাজনার আওয়াজে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে, চাঁদের আলোর বন্যা বয়ে যায়।
জাগরঁ পরবে বেশির ভাগ মেয়ে মরদ সঙ্গী নিয়ে আসে। যাদের সঙ্গী নেই তারা জাগরণ পরবে এসে সঙ্গী খুঁজে নিতে পারে। পরবে এসে কোন সঙ্গীহীন পুরুষের যদি কোন স্বজাতি মেয়েকে পছন্দ হয় তবে তার সিঁথিতে সিঁদুর ঘষে দিয়ে ঐ মেয়েকে সঙ্গী করে নিতে পারে। ঐ মেয়েটি সেই পুরুষের বৌ হয়ে গেল। সাঁওতাল সমাজে এই রকম রীতি চালু আছে।
অন্যবছরের মত এবছরও হিদেরামপুর থেকে ফুলকি এসেছে উৎসবে। ফুলকির সঙ্গী নেই। ফুলকির বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি পছন্দ হয়নি। তাই বরের বাড়ি যায় না, দাদা বৌদির কাছে থাকে। খেটে সংসারকে পয়সা দেয়। তবুও বৌদি চায়না ফুলকি ওদের সংসারে থাকুক। কয়েক বছর ধরে ফুলকি একা একাই মেলায় আসে। এদিক ওদিক ঘোরে। মেয়েদের সঙ্গে নাচে অংশ নেয়। পচাই খেয়ে একটু আধটু নেশা করে, কিন্তু কোনদিন বে সামাল হয়ে পড়ে না।
কুনুরামও মেলায় আসে মণিরামপুর থেকে প্রতি বছর তার বৌকে নিয়ে। এই জাগরণের মেলাতেই ডাংরিকে তার পছন্দ হয়েছিল। তার পছন্দের মেয়েটির মাথায় সিঁদুর ঘষে দিয়েছিল কুনুরাম। ডাংরিকে বৌ করে নিয়ে ঘরে ফিরেছিল। সাতবছর ঘর করল ডাংরির সঙ্গে। দুটি ছেলে হল। কিন্তু মাস ছয়েক আগে ডাংরির কি একটা জ্বর হল, তা কিছুতেই ছাড়ে না। কুনুরাম ডাংরিকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, সেখানে ভর্তি করে যাতায়াত করতে লাগল। ডাংরি মরে যাওয়ার পর তার শরীর ঠান্ডা হল, জ্বর ছাড়ল। তারপর থেকে কুনুরাম সঙ্গীহীন। এবছর তাই কুনুরামকে একা পরবে আসতে হয়েছে। মনটা ভাল নেই। ডাংরির কথা কেবলই মনে পড়ছে। জাগরণ পরবে এসেই তো সে ডাংরিকে পেয়েছিল। একটুন ন্যাসা করতি হবে। একটা ফাঁকা জায়গা খুঁজে নিয়ে ছাতাটা পাশে রেখে বসে পড়ে কুনু। বসে বসে মেলায় মেয়ে-পুরুষের নাচ দেখতে লাগল আর ডাংরির কথা ভাবতে লাগল। কুনুরাম লক্ষ্য করল একটু সোমন্থ মেয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। মেয়েটির সংগে কোন পুরুষ নেই। একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল। কুনুরাম ভাবল, ই মেয়েটাকে ত আগেই মেলায় দেখেচে। এখুনো বিয়া করে নাই না কিরে বাবা। লাঃ! একা একা ভাল লাগচে না মেয়েটার সাইতে একটু গল্প করা যাক না কেনে। তাইলে ডাংরিকে একটুন ভুলে থাকা যাবে। বড্ডই মন খারাপ লাইগচে ডাংরির জন্যি।
কুনুরাম ফুলকির পাশে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, ‘এই মেইয়ে। তু একা কানরে?সঙ্গে কেউ লাই?’
ফুলকিঃ লা গ। মোর সাইতে কেউ লাই। আমি একাই এসিচি।
কুনুরামঃ তুর নাম কি আচে বটে? আমার নাম কুনুরাম।
ফুলকি ভাবে, যাকগে। মেলায় একা এসিচি, তবু একটা গল্প করার সঙ্গী পাওয়া গেল বটে। ফুলকি উত্তর দেয়, ‘ফুলকি। মোর নাম ফুলকি আচে গ।’
কুনুরামঃ বেশ ভাল নাম আচে তুর।
ফুলকি লজ্জা পায়। বলে, ‘ভাল খারাপ জানিনা। মোর নাম ফুলকি আচে।’
কুনুরামঃ তুর বিয়া হয় নাই ফুলকি?একা ক্যানে?
ফুলকিঃ হাঁ। হইছিল ত। মুই মরদের ঘর করি লাই।
কুনুরামঃ চ ক্যানে। মোরা একটুন ন্যাশা করি। একা একা ন্যাশা করতি ভাল লাগেনা।
ফুলকিঃ দূর। মুই ন্যাশা করবনি। মুই একা আচি বটে। ন্যাশা করে কুতায় পড়ে থাকব।
কুনুরামঃ তা ক্যানে। এক হাঁড়ি পচাই কিনব। তু আর মুই খাব। একটুকুন পচাই খেইয়ে পড়ে থাকবি ক্যানে?
ফুলকিঃ মোর ভাল লাগচেনি। মুই ন্যাশা কইরব না।
কুনুরামঃ পরবে এসিচিস। ন্যাশা করবিনি ক্যানরে? চো চো, একটুন পাঁচুই খাই।
সঙ্গী যখন অতকরে বলছে, তখন রাজী হয় ফুলকি। এক হাঁড়ি পচাই কেনে কুনুরাম। তারপর মেলার বাইরে এসে একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে দুখানা থান ইঁট পেতে মুখোমুখি বসে দুজনে। কুনুরাম ফুলকিকে বলে – নে, তু আগে খা দেকি।
তারপর হাঁড়ির ফুটো দিয়ে ফুলকির মুখে পাঁচুই ঢালে। পুলকির খানিকটা খাওয়া হলে কুনুরাম বলে, দে। ইবার মুইকে দে ক্যানে। ফুলকি কুনুরামের মুখের মধ্যে পচাই ঢেলে দেয়। এক হাঁড়ি পচাই শেষ হলে কুনুরাম বলে, আর এক হাঁড়ি আনব নাকি রে ফুলকি? ন্যাশাটা ভাল করে জমেনে। কি বল?
ফুলকি আপত্তি করে না। বলে, ইবারটা মুই পয়সা দোব। এ্যাই নে। যা, আর এক হাঁড়ি পাঁচুই লিয়ে আয় ক্যানে।
ওরা আর এক হাঁড়ি পাঁচুই শেষ করে। এবার নেশাটা বেশ জমেছে। ওরা বসে বসে গল্প করে। উভয়ে উভয়ের বন্ধু হয়ে যায়। কুনুরাম ভাবে, ফুলকি মেয়েটা কিন্তু বেশ, তবে দস্যি আচে বটে। সুয়ামীকে লিয়ে ঘর করে লাই। কুনুরাম ফুলকিকে জিজ্ঞেস করে, ই ফুলকি, তুর ঘর কুতায় রে।
ফুলকিঃ মোর ঘর? মুই দাদার ঘরে থাকি বটে। হিদেরামপুর গিরামে মোর দাদার ঘর।
কুনুরামঃ হিদেরামপুর ? সি আবার কুতায় রে?
ফুলকিঃ কুতায় জেনে কি করবি। তু কি যাবি?
কুনুরামঃ তু যেদি বলিস ত যাব। যাব না ক্যানে।
ফুলকিঃ দাঁড়া, বলচি। একটুন পা ছড়িয়ে বইসে নি।
কুনুরামঃ বোস ক্যানে। আরাম কইরে বোস।
ফুলকিঃ এ কুনুরাম, তু ক্যানে একা এসিচিস?তুর বহুকে আনিস নাই ক্যানে?
কুনুরামঃ মোর বহু লাইরে। ছ মাস হল, মরে গেল জ্বরে।
ফুলকিঃ আহা গ! তুর বহুটা মরে গেল বটে।
কুনুরামঃ মনটায় বড্ড দুঃখু লাগছিল। তাইত ন্যাশা করলাম। উকে ভুলবার লিগে।
ফুলকিঃ তাইলে তুর মনে খু-ব দুঃখু আচে, বল?
কুনুরামঃ দুঃখু হবেনি। এই ম্যালাতেই ত সিঁদুর ঘষে বিয়া করলাম। আর আজকার ম্যালায় মোর বহুটা লাইরে।
ফুলকিঃ তা বটে। দুঃখু হবারই কতা।
কুনুরামঃ ই ফুলকি। তুর উখানে গেলি তু রাগ করবি?
ফুলকিঃ রাগ করব ক্যানে। তু যাস ক্যানে।
কুনুরামঃ তাইলে বল, কি করে যাব?
ফুলকিঃ এ্যাইত, ইখান থিকে বাসে করে দু ঘন্টা পরে হিদেরামপুর বাস ইষ্টাপজ-এ নাববি পিচ রাস্তার ধারে একটা পকুর আচে। নাম বামুন পকুর। পকুরের দিকে যাবি না। পেচুন দিকে হাঁটবি।
কুনুরামঃ তারপর বল ক্যানে, অ ফুলকি, তু ঘুম যাচ্চিস?
ফুলকিঃ হাঁ। খানিক গেলে পরে শিবতলা। পাশের পকুরটো মালি পকুর।
কুনুরামঃ ইবার কি করব?
ফুলকিঃ উত্তর দিকে মুখ করে হাঁটা দিবি। রাস্তার দু পাশে চারখান পকুর পাবি।
কুনুরামঃ তু শুদু পকুর পকুর করে যাচ্চিস। তুর ঘরকে কি করে যাব তাই বল না?
ফুলকিঃ পকুর আমার খুব ভাল লাগেরে। ছুট বয়েস থিকে রোজ পকুরে সাঁতার কাটতম। ডুবে ডুবে গুগলি তুলতম। এখুনো মুই রোজ পকুরে ডুব দিই।
কুনুরামঃ তুর গিরামকে তু খুব ভালবাসিস?
ফুলকিঃ হাঁ গ। মোর গিরাম ছেইড়ে মোর কু থাও ভাল লাগে না। মোর যিখানে বিয়া হইছিল সিখানে ধারে কাছে কুন পকুর লাই গ। খালি জঙ্গল আর জঙ্গল। লম্বা লম্বা শাল গাছ। মানুষ গুলানকে লাগত য্যান এক একটা বাঘ। মনে লাগত য্যান মুইকে খেইয়ে ফেলবে। উখানে মোর মন বসত না। তাইত মোর গিরাম ছেড়ে উখানে আর যাই লাই গ।
কুনুরামঃ ই ফুলকি। তুর মরদের ঘর করতি সাধ জাগেনা?
ফুলকিঃ মোর মরদ ত বিয়া করেচে। বহু লিয়ে সুকে ঘর করচে।
কুনুরামঃ তুর নতুন ঘর করতি সাধ যায় না ফুলকি?ই ফুলকি। তু ঘুম যাচ্চিস না কি?
ফুলকিঃ হিঁ। খুব সাধ যায়। সক্কলের ক্যামন মরদ আচে। ছেলেপুলান আচে। মা বলে ডাকে। দেকে আমার খুব ভাল লাগে।
কুনুরামঃ তু আবার বিয়া কর ক্যানে?
ফুলকিঃ তু মুইকে বিয়া করবি কুনুরাম? তুর ছেলেগুলাম মুইকে মা বলে ডাকবে। মুইকে তুর ঘরে লিয়ে যাবি?
কুনুরামঃ তু আমাকে বিয়া করবি? তু ত আবার তুর গিরামে পালিয়ে যাবি।
ফুলকিঃ হাঁ রে কুনু, তুর উখানে পকুর আচে? সবুজ মাট আচে?
কুনুরামঃ হাঁ রে। সব আচে। একটা মস্ত বড় পকুর। তার নাম তালপকুর। তাল পকুরের উত্তপাড়ে মুইদের বাস। পকুরের পূব আর দখিন দিকে বাবুদের সেগুন গাছের বাগান। পচ্চিম দিকে সবুজ মাট। ধারে কাচে আরও অনেক পকুর আচে।
ফুলকিঃ ঠিক মোর গিরামের মতন?
কুনুরামঃ মোর গিরামকে আমার খুব ভাল লাগেরে ফুলকি।
ফুলকিঃ মোর ঘরও তচ হিদেরামপুরের মঙ্গলা পকুরের উত্তপাড়ে। আদিবাসী পাড়ার উত্তুরে, পূবে আর পশ্চিমে শুদুই মাট, বষ্যাকালে যা সোন্দর লাগে না, তুকে কী বলব। শুদ্দ সবুজ আর সবুজ।
কুনুরামঃ তাইলে মোর গিরামকেও তুর ভাল লাগবে রে ফুলকি।
ফুলকিঃ এ কুনুরাম, তু মোর মাতায় সিঁদুর ঘষে দেনা। মুই তুর সংগে থাকব রে। তুর ছেলে গুলাম আমারও ছেলে হবে। মুইকে মা বলে ডাকবে। তু মুইকে বিয়া করবি?
কুনুরামঃ তু কও ভালরে! তু যেদি চাস ত মোর কুন আপিত্ত থাকার কতা লয়।
ফুলকিঃ চাই, চাই রে। তুকে মোর মনে লেগেছে রে। মুই তুর সংগে থাকতে চাই।
কুনুরামঃ তু ঠিক বলচিস ত। তিন সত্যি কর।
ফুলকিঃ মুই তুর সাইতে থাকতে চাই। সত্যি, সত্যি, সত্যি।
কুনুরামঃ তাইলে মুই দুকান থিকে সিঁদুর কিনে আনি? তু বসে থাক ক্যানে। কুতাও চলে যাবিনি।
ফুলকি ওইখানেই বসে ঝিমোতে থাকে। আজকের চাঁদের আলোটা যেন বেশি রূপোলী মনে হচ্ছে ফুলকির। কুনুরাম মেলায় বসা দোকানে সিঁদুর কিনল। তারপর খাবারের দোকান থেকে পাঁপড় ভাজা কিনল। বালিতে ভাজা চীনা বাদম কিনল। তারপর, ওরা দুজনে যেখানে বসেছিল সেখানে ফিরে এল। দেখল ফুলকি চাঁদের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছে।
কুনুরাম বললঃ ই ফুলকি, উট উট, উটে দাঁড়া। দেকি তুর মাতাটা। এ্যাই, সিঁদুর ঘষে দিলম। আজ থিকে তু আমার বহু হয়ে গেলি।
ফুলকিঃ আর তু মোর সুয়ামী হয়ে গেলি।
কুনুরামঃ আয়, বোস। মোর পাশে বোস দিকিন। দুজনে মিলে পাঁপড় ভাজা খাই। এই দ্যাক চিনে বাদাম এনিচি।
ফুলকিঃ চিনে বাদামটা রেকে দে ক্যানে। ছেলে গুলান খাবে।
কুনুরামঃ নিশার ঝোঁকে তু শুদু পকুরের কতাই বলে গেলি। আর ক’টা পকুর আচে তাই বলনা ক্যানে।
ফুলকিঃ ছকাল হয়ে গেল বটে। ইবার ঘরকে যেতি হবে।
কুনুরামঃ হ্যাঁ। যেতি হবে।
ফুলকিঃ তু মোর গিরামে কবে যাবি তা বললিনি ত?
কুনুরামঃ তু আগে চ ক্যানে তুর নতুন ঘরে। তা-র পর তু, মুই আর ছেলে গুলান মিলে সব্বাই যাব তুর গিরামে।
ফুলকিঃ চ, ঘর চ। ছেলে গুলান একা একা আচে বটে।
কুনুরামঃ ছেলে গুলান ত মোর মায়ের কাচে রইচে। ইখন উরা নতুন মা পাবে। হাঁ।
ওরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায়। মেলায় নাচ গান চলেছে। দুপুর পর্যন্ত উৎসব চলবে। আদিবাসী মেয়ে পুরুষের দল মেলায় আসছে পরবে যোগদান করছে। অনেকে দল বেঁধে বাড়ি ফিরছে। গাড়ুম গাড়ুম ধামসা বাজছে। ধিতাং ধিতাং মাদল আর টুং টাং কাঁসির বোল মেলায় আসা মানুষের মনকে আনন্দের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
Tags: অমিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎসবের দিন
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।