‘একটু পেনটা দেবেন?আমার পেনটা আনতে ভুলে গেছি? কলেজ নোটিশ বোর্ড থেকে ক্লাশ রুটিনটা তুলে নেবো।’
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিন না। বলেই সমরেশ পেনটা এগিয়ে দিল ভদ্রমহিলার দিকে। চোখে চোখ পড়তে একটু মৃদু হাসলো।
অসম্ভব সুন্দরী। গায়ের রঙ দুধে আলতা। সেইসঙ্গে মানানসই শাড়ি আর ব্লাউজ। কপালে ছোট্ট একটা টিপ। চোখে পাওয়ার চশমা। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চোখ-মুখ।
– আপনার কোন ইয়ার? ‘ফার্স্ট ইয়ার’। ফিজিক্সে অনার্স।
– আমিও ফিজিক্সে অনার্স, ফার্স্ট ইয়ার। আমি সমরেশ দাস।
– আমি চন্দ্রমল্লিকা ঘোষ।
ক্লাশ রুটিন টুকতে টুকতে আলাপপর্ব চলতে লাগলো। এই নিন আপনার পেন, খুব উপকার করলেন।
– আরে না না, আমরা তো একই ইয়ারে ফিজিক্স অনার্সের ছাত্র-ছাত্রী। সুতরাং বন্ধু আমরা। তা বন্ধুর জন্য এইটুকু করতে পারবো না?
– ঠিক আছে, ঠিক আছে, কাল তো নবীন বরণ উৎসব। আমাদের দেখা হবে। আজ আসি – বলেই চন্দ্রমল্লিকা চলে গেল। সমরেশ এক দৃষ্টিতে ওর যাওয়াটা দেখতে লাগলো। একে সুন্দরী তায় বিজয়নীর মতো ধীর লয়ে দৃপ্ত পদচারণা। বোঝা যায় আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। কেমন একটা ভাল লাগা ওকে পেয়ে বসে। অনেকক্ষণ শুধু তাকিয়ে থাকা। ওর ধীর লয়ের হাঁটার ছন্দে, সাগরের বুকে ঢেউ তোলার ছন্দর মতো একটা আবেশ তৈরি হয় ওর মনে। সম্বিত ফিরে পায় বন্ধু ভাস্করের ডাকে।
– কি রে কি দেখছিস সামনের দিকে অমন তন্ময় হয়ে ?কতক্ষণ ধরে তোকে ডাকছি?
– ও! ভাস্কর! বল কি জন্য ডাকছিস?
– কালকে ফ্রেসার্স ওয়েলকাম আছে। কলেজ থেকে সিনিয়র দাদারা তোকে আর আমাকে ঠিক করেছে পুরো প্রোগ্রামটা সামলে দেওয়ার জন্যে।
ভাস্কর আর সমরেশ দুই বাল্য বন্ধু সেই স্কুল থেকে। স্কুল পেরিয়ে কলেজেও সেই বন্ধু থেকে গেছে। স্কুলে ভাস্কর পড়াশুনায় বেশ ভাল রেজাল্ট করতো। সমরেশও লেখাপড়ায় বেশ ভাল। সেইসঙ্গে খেলাধুলা, গান, কবিতায়, নাটকে এক্কেবারে অল রাউন্ডার। তুখোড় ছেলে, স্যারেদের চোখের মণি দুই বন্ধু। হরিহর আত্মা। ভাস্করের বাবা সরকারি ইঞ্জিনিয়ার। সমরেশের বাবা সরকারি আধিকারিক। সমরেশরা তিন ভাই দুই বোন। বোনেদের সকলের বিয়ে হয়ে গেছে। বড়দাদা ব্যাংকে কাজ করেন। সংসারী। ছোট ভাই স্কুলে পড়ে। ভাস্করের দুই ভাই। বড়দাদা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। বাইরে বাইরে থাকেন বেশিরভাগ সময়। সমরেশ ছোটবেলা থেকে খুূই ডাকাবুকো। গানের গলাটা ভারি মিষ্টি। রবীন্দ্রসংগীত যখন গাইতে বসে, রবীন্দ্র ভাবনায় তন্ময় হয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক পায় গান গাওয়ার জন্য। উদ্যোক্তারা টাকা দিতে চায়, কিন্তু নেয় না। বলে সংগীত বিক্রি করতে পারবো না। আর রবি ঠাকুরের গান – ‘সে তো মনের মাধুরী পাওয়ার জন্য, বাইরের হাততালি পাওয়ার জন্যে নয়। আমার ভাল লাগে তাই গাই। যেদিন ভালো লাগবে না, সেদিন আর গাইবো না।’
– তাড়া দিল ভাস্কর। চল সমরেশ, কলেজ ইউনিয়ন অফিসে দাদারা একবার আমাদের দেখা করতে বলেছে। কিভাবে প্রোগ্রামটা করবো আমরা, ওনারা জানতে চান। তাছাড়া প্রোগ্রাম করতে হলে তো টাকার দরকার। দাদারা টাকা নিয়ে আসতে বলেছেন।
– ঠিক আছে চল অফিসে। দুই বন্ধু অফিসের দোরগোড়ায়, সমরেশকে দেখে একজন সিনিয়র দাদা পল্টুদা বলে উঠলো, ‘এই সমরেশ, তোকে সকাল থেকে খুঁজছি। কোথায় ডুব মেরেছিলিস?’
– না গো পল্টুদা, কলেজ অফিসের নোটিশ বোর্ডে আমাদের ক্লাস রুটিনটা ঝুলিয়েছে, সেটা তুলতে গিয়েছিলাম।
– তা বেশ! ওদিকে নবীন বরণ উৎসবের কতদূর এগোলি তোরা?
– তোমাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। ওদিকে সব গুছিয়ে রেখে এসেছি। সিএলআরসি হলটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে আমাদের বন্ধুরা। ডায়াস রেডি। তুমি কিছু ভেবোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে।
– যাক নিশ্চিন্ত হলাম। প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপাল স্যারকে বলা আছে। ওনারা কাল দশটার মধ্যে চলে আসবেন। সায়েন্স, আর্টস, কমার্স স্ট্রিমের স্যারেদের বলা আছে। ওনারা ঠিক সময়ে চলে আসবেন।
– আচ্ছা পল্টুদা, কাল নবীন বরণ উৎসবে কে কে পারফর্ম করছে?তার কোন লিস্ট তোমার কাছে আছে না কি?
– হ্যাঁ, লিস্ট তো করেছি। উদ্বোধন সংগীতটা তুই গাইছিস। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসংগীত দিয়ে। তারপর দ্বিতীয় বর্ষের এক দাদার কবিতা আবৃত্তি। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রীর গান। এরপরে একজন ছাত্র মাউথ অরগ্যান বাজাবে। শ্রুতি নাটকের পরে সমবেত সংগীত। শেষে বিশিষ্ট শিল্পীদের গান। ও! হ্যাঁ, ফার্স্ট ইয়ার ফিজিক্স অনার্সে এক ছাত্রীর গান আছে। শুনেছি খুব ভাল গান গায়। আধুনিক, নজরুল গীতি, রবীন্দ্রসংগীত সব গানই গাইতে পারে। আমি অবশ্য ওর নাম আগে কখনো শুনিনি। তবে আমার বন্ধুরা শুনেছে কোন এক পাড়ার ফ্যাংশানে। ওরাই বলল, ভীষণ ভাল গান গায় মেয়েটি।
– কি নাম বলোতো?
– দেখনা, লিস্টে আছে। আমার ঠিক মনে পড়ছে না। সমরেশ চকিতে লিস্টের নামগুলো দেখতে দেখতে এক জায়গায় থমকে দাঁড়ালো। ফার্স্ট ইয়ার, ফিজিক্স অনার্স ছাত্রী – নাম : চন্দ্রমল্লিকা ঘোষ, আধুনিক গান গাইবে।
– চন্দ্রমল্লিকা?একটু আগে যার সঙ্গে পরিচয় হলো? ও গাইবে! একটু আনমনা হয়ে গেল সমরেশ।
– আবার তাড়া ভাস্করেরয কি রে, সব তো হলো, চল এবারে বাড়ির দিকে যাই। সেই কখন খেয়ে বেরিয়েছি।
– ঠিক আছে। কলেজ ক্যান্টিনটা ঘুরে গেলেই হয়।
– দূর! ওসব খাবার খেতে ভাল লাগছে না এখন। মা ফোন করে বলে দিয়েছেন, তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে, মটরশুটির কচুরি আর আলুরদম হচ্ছে। সেইসঙ্গে পান্তুয়া। আমাদের বাড়িতে খেয়ে তবেই যাবি।
– চল অগত্যা, মাসিমার ডাককে কোনদিন অবহেলা করেছি? তুই যেমন ওনার একটা ছেলে, আমিও তো তাই।
– বাড়িতে ফিরে দুই বন্ধু খেতে খেতে গল্প জুড়ে দিল। আচ্ছা সমরেশ, তুই সকালে কলেজ নোটিশ বোর্ডের কাছে ওই ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েটাকে কি বলছিলিস?
– ও! তোমারও চোখ চলে গিয়েছিল গুরু!
– যা বলিস, মেয়েটাকে দেখতে কিন্তু ফাটাফাটি, আর কি স্মার্ট।
– হ্যাঁ, ও কলমটা আনতে ভুলে গিয়েছিল। তাই আমার কাছে কলমটা চাইলো। রুটিনটা টুকে নেবে বলে।
– বা! বেশ বেশ কলম দিয়ে শুরু হ’ল প্রেমপর্ব।
– কি যা তা বলছিস! পেনটা চাইলো, পেনটা দিলাম। তারই ফাঁকে ও নিজের নামটা বলল।
– কি নাম রে?
– চন্দ্রমল্লিকা ঘোষ। বাবা! একেবারে চন্দ্রমল্লিকা ফুলের মতোই।
– হ্যাঁ, দেখতে বেশ ভালই। তবে লিস্টে দেখলাম কালকে ফ্রেসার্স ওয়েলকামে ও গান গাইবে। আধুনিক গান।
– আরে ব্যাস! আবার গানও পায়? রূপে গুণে একেব্বারে লক্ষ্মী সরস্বতী!
– তাইতো ভগবান যাকে দেন ছাপ্পর ফাটিয়ে দেন।
– যাক ওসব কথা বাদ দে। আমাদের মাঝে ওই মেয়েটা আসবে কেন? বলল ভাস্কর।
– মেয়েটা নয়, চন্দ্রমল্লিকা। এখন থেকে ও আমাদের বন্ধু। কালকেই দেখা হবে। এরপর থেকে প্রতিদিন একই ক্লাশে, বলল সমরেশ। আরও কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে সমরেশ ফিরে এল বাড়িতে।
মনের মাঝে একটা ভাল লাগার অনুভূতি কি জানি কেন ছুঁয়ে যাচ্ছে, বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে একটা পাজামা-পাঞ্জাবী পরে হালমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে বসলো। কয়েকদিন রেওয়াজ করা যায় নি। আগামীকাল গাইতে হবে উদ্বোধনী সংগীত।
এরপরে বেশ কয়েকটা রবীন্দ্রসংগীত গাইবার পরে গলার আওয়াজটা ঠিকঠাক হয়ে গেল। মা যে কখন থেকে ওর গান শুনছিল বুঝতে পারে নি। গান থামতে মা বললেন – ‘খোকন গান তুই কোনদিন ছাড়বি না। লেখাপড়া শিখে তুই হয়তো একটা ভাল চাকরি জুটিয়ে নিতে পারবি ঠিকই। তবে তোর গলার গান তোকে অনেক দূর পৌঁছে দেবে। তোর গান একসময় ঘরে ঘরে বাজবে রেডিও, টিভি, রেকর্ডের মাধ্যমে। তুই দেখে নিস।’
– মায়ের কথাটা শুনে গলাটা ভারি হয়ে গেল সমরেশের। চোখে জল চলে এল আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। মাকে একটা প্রণামের পরে জড়িয়ে ধরে বলল – ‘তুমি তো আমার শক্তি, অনুপ্রেরণাদাত্রী, তোমার আশীর্বাদ মাথায় থাকলে আমি ঠিক লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাবো।’
– যা, হাতমুখ ধুয়ে আয়। আমি তোর জন্যে জলখাবার নিয়ে আসছি।
– না গো মা। তার দরকার পড়বে না। ভাস্কর জোর করে ধরে নিয়ে গেছিল ওদের বাড়িতে। মাসিমা কচুরি, আলুরদম ও মিষ্টি খাইয়েছেন পেট পুরে। পেটে এখন আর জায়গা নেই। তবে তুমি যখন বলছো, একটু আদা-চা দিতে পারো, গলাটা ছেড়ে যাবে। তাহলে আরও কিছুক্ষণ রেওয়াজ চালিয়ে যেতে পারবো।
– ঠিক আছে, তুই একটু অপেক্ষা কর, আমি আদা-চা নিয়ে আসছি।
মায়ের হাতে চা খেয়ে ফুরফুরে মেজাজে আরও ঘন্টা খানেক রেওয়াজ করে নিল সমরেশ।
পরের দিন সকালে স্নানের পরে পুজো-অর্চনা সেরে প্রস্তুতি পর্ব শুরু করে দিল সমরেশ কলেজ যাওয়ার জন্যে। প্যান্ট-শার্ট না পরে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী পরে নিল। খেলাধূলো করতো বলে ওর শরীরটা বেশ শক্তপোক্ত। আর লম্বা চওড়া হওয়ার জন্য ধুতি-পাঞ্জাবীতে বেশ মানায়। বেরোবার মুখে মা চন্দনের একটা টিপ দিল কপালে আর বললেনম, আমার রাজপুত্তর ছেলেটার দিকে যাতে কেউ নজর দিতে না পারে সেজন্য চন্দনের টিপটা দিলাম।
– কি যে বলো মা, এখানকার দিনে ওসব কুসংস্কার কেউ বিশ্বাস করে? চারিত্রিক দৃঢ়তা থাকলে কেউ কিছুই করতে পারবে না। আর যে শিক্ষা তুমি আমাকে ছোটবেলা থেকে দিয়েছো, তাই ‘তোমার কোন ভয় নেই মা – আমরা তোমার শান্ত ছেলে, দস্যু এলে লড়তে জানি, তোমার ভয় নেই মা!’ – বলে গান গেয়ে মাকে প্রণাম করে বেরিয়ে এল সমরেশ। বাড়ি থেকে একটা টোটো নিয়ে সোজা শ্রীরামপুর কলেজে।
২০০ বছরের কলেজ, সেই কবে ১৮১৮ সালে গোড়াপত্তন করেছিলেন উইলিয়াম কেরী, জেসুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড। শিক্ষা প্রসারের দিকে লক্ষ্য ছিল তাঁদের। অবশ্য ধর্ম প্রচারটা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। তাই বাইবেল বাংলা ভাষায় ছাপিয়ে প্রকাশনার কাজ শুরু করে দেন। এরপরে স্থানীয় ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বহু বই তাঁরা প্রকাশ করেন। এই উদ্দেশ্যে একটি কলেজ ‘অস্টিন হার্ডস’ অঞ্চলে গড়ে তুলে কাজ শুরু করে দেন। পরবর্তীকালে কলেজটি বর্তমান জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। স্থাপত্য শিল্প হিসেবে এই কলেজটি সারা বিশ্বের মাঝে সুপরিচিত। বড় বড় থাম ও বাড়ির নকশা নিয়ে। ঐতিহাসিক অক্ষর শহর শ্রীরামপুরে সর্বপ্রথম বাংলা কাঠের হরফ তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীরামপুরের সন্তান পঞ্চানন কর্মকার। বাংলা ভাষায় ছাপা বই এখন ঘরে ঘরে তাঁরই সৌজন্যে। এই শ্রীরামপুর শহরে পদচিহ্ন পড়েছিল শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর, নীলাচলে যাওয়ার পথে। শেওড়াফুলি নিমাইতীর্থ ঘাট থেকে স্নানের পরে পদব্রজে চাতরা গৌরাঙ্গ মন্দিরে একদিন রাত্রিবাসের পরে জগন্নাথ মন্দিরের পথ ধরে চলে গিয়েছিলেন নীলাচনের পুরিধামে। এই শহরে রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘রাধারাণী’ গল্পটি লিখে ফেলেছিলেন। এই শহরের বুকে পাদস্পর্শ পড়েছিল রবি ঠাকুর, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের। এই শহরে জন্ম নিয়েছিলেন কবি অমিয় চক্রবর্তী ও হরপ্রসাদ মিত্র ও বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামী গোপীনাথ সাহা। নীলদর্পণ নাটকের শ্রষ্ঠা নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র শ্রীরামপুরের বড় পোস্ট অফিসে পোস্টমাস্টার হিসেবে কাজ করেছিলেন। এই শহরেই ছিল রাজা রামমোহন রায়ের মামাবাড়ি। জনশ্রুতি এই যে মামাবাড়িতেই না কি রামমোহন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই স্মৃতিবিজড়িত শহরে এই শ্রীরামপুর কলেজের একজন ছাত্র হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছিল সমরেশের।
এলআরসি হলে পৌঁছে দেখে নিল ওর বন্ধুরা ও সিনিয়র দাদারা ইতিমধ্যে এসে পৌঁছে গেছে। ওকে দেখে একজন বলে উঠলো, ওই সমরেশ এসে গেছে। ‘গুরু! কি মাঞ্জা দিয়েছো, একদম চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। এক্কেবারে রমণীমোহন। আজ সব রমণীদের দৃষ্টি গুরু তোমার দিকে।’
– কি যা তা বলছিস! নে নে টেবিলটা ঠিক ঠিক সাজিয়ে রাখ। টেবিল ক্লথটা টান টান করে দে। ফুলদানিগুলোতে টাটকা রজনীগন্ধার স্টিকগুলো ভরে দে। চটপট কর। হাতে সময় নেই। প্রিন্সিপাল স্যার ঢুকলো বলে। মাইক সাউন্ডের ছেলেটাকে নিচুস্বরে কিছু নির্দেশ দিয়ে দিল মাইক্রোফোনটা চালু করার জন্য। দেখলো ফুলের তোড়া, উত্তরীয় ও উপহারগুলো এক এক করে ট্রেতে সাজিয়ে তুলছে বন্ধুরা। সব ঠিক আছে। ট্রেগুলো পাশের টেবিলে তুলে রাখতে বলে একটু মুখ তুলতেই সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে।
– দারুণ সেজেছে, সাদা ঘিয়ে রঙা শাড়ির সঙ্গে মানানসই সাদা ব্লাউজ। কপালে ছোট্ট একটা টিপ। মুখটা পালিশ করা। চুলগুলো শ্যাম্পু দিয়ে ফুলে ফাঁপিয়ে রেখেছে। গায়ে দামি বিলেতী পারফউমের সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে। ওর সাজ দেখে তো আর চোখ ফেরানো যাচ্ছে না।
– ‘সুপ্রভাত’!
চন্দ্রমল্লিকাও প্রতুত্তরে জানালো ‘সুপ্রভাত’। মুখে একটা মিষ্টি হাসি। ওর টানা চোখ দুটো যেন কি বলতে চাইছে। ওর মনের অতল গভীরে ডুব দেওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব নয়।
– সামনের কয়েকটা চেয়ার ছেড়ে একটু পেছনের দিকে বসে পড়ুন। ক্লাসের অন্য বন্ধু-বান্ধবীরা এসে বসে গেছেন। একটু পরে আমাদের ‘ফ্রেসার্স ওয়েলকাম’ শুরু হবে। বলল সমরেশ।
– আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি ? প্রশ্নটা শুনে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলো সমরেশ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।
– মনে মনে ভাবলো সমরেশ ওর সঙ্গটা তো ভালই লাগতো, তবে সিনিয়র দাদাদের ও অন্যান্য বন্ধুদের টিপ্পনীর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বলল, ‘না না, এখানের কাজ তো প্রায় শেষ। এখন লাগবে না। পরে দরকার হলে ডেকে নেবো আপনাকে।’
চন্দ্রমল্লিকা কিছুটা হতাশ হয়ে চলে গেল চেয়ার বসার জন্যে।
প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপাল ও অন্যান্য অতিথিরা এসে গেলেন। শুরু হয়ে গেল উৎসব পর্ব। দ্বিতীয় বর্ষের একটা মেয়ে ও তৃতীয় বর্ষের একটা ছেলের ওপর ভার পড়েছিল প্রোগ্রামটা সঞ্চালনা করার জন্যে। দুজনায় সঞ্চালনার কাজে বেশ সাবলীল ও চৌকস। বাংলার সঙ্গে ইংরেজিতে ভূমিকাটা ভালই বলল। উদ্বোধনী সংগীতের জন্যে সমরেশ নামটা ডাকতেই হঠাৎ হাততালির ঝড় বয়ে গেল সারা হলটা জুড়ে। কিছুটা ভাললাগা, কিছু লজ্জিত চিত্তে ধুতি-পাঞ্জাবী পরে উঠে এলো স্টেজে সমরেশ। নমস্কার করে দু-একটা কথায় সকলকে সম্ভাষণ জানিয়ে শুরু করলো উদ্বোধনী সংগীত : ‘ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত-অম্বর মাঝে/ … ভূবনমন্দিরে শান্তিসংগীত বাজে।’
গানের মধ্যে ঢুকলে সমরেশ যেন কোথায় হারিয়ে যায়। রবি ঠাকুরের গান হলে তো কথাই নেই। ভাষা আর সুরের অপূর্ব মেলবন্ধন। গান শেষ হওয়ার পরে আবার একদফা হাততালি। থামতেই চাইছে না।সমরেশ লক্ষ্য করলো চন্দ্রমল্লিকার চোখে মুখে এক অপূর্ব দ্যুতি খেলা করে যাচ্ছে আর উসখুস করছে – বিশেষভাবে সম্ভাষণ জানানোর জন্যে। চোখে মুখে এতটুকু কৃত্রিমতার ছাপ নেই, বরঞ্চ নিজেকে সঁপে দেওয়ার অভিব্যক্তি। মনে মনে ভাবল সমরেশ নিজে একজন সুগায়ক তো, তাই অন্যের গানের তারিফ করতে জানে। ওর মনে বোধহয় কিছুটা জায়গা করে নিতে পেরেছে বলেই ভালো লাগলো নিজেকে।
এরপরে একে একে কবিতা, নাচ, শ্রুতিনাটক, মাউথ অরগ্যান বাজানো পর্ব শেষ হলো। এবারে ডাক পড়লো চন্দ্রমল্লিকার। কিছুটা ধীর লয়ে হেঁটে চলল ডায়াসের দিকে। আবার মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে সমরেশ ওর বীরলয়ের শ্লথ গতির দিকে। কি যেন এক অপূর্ব ছন্দ লেগে থাকে ওর হাঁটাচলায়। ভগবান যেন ওকে এক বিস্ময়কর শিল্পী-মানবী বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন পৃথিবীতে। কথায় ছন্দ, হাঁটায় ছন্দ, রূপেতে ছন্দ আবার গানেতেও ছন্দ। গান গাইতে বসে একটার পর একটা আধুনিক স্বর্ণযুগের গান গাইতে লাগলো চন্দ্রমল্লিকা। সমরেশ তন্ময় হয়ে শুনতে লাগল ওর গান । গলা দিয়ে যেন মধু ঝরে পড়ছে। ওর গায়কির ভঙ্গিটাও অভিনব। কোন নাটুকেপনা নেই। নেই কোন আতিশয্যের বালাই। নেই কোন ম্যানারিজম। সত্যিকারের সুর সাধিকা। গান শেষ হ’ল বেশ কয়েকটা গাইবার পর। সময়ে প্রোগ্রামটা শেষ করতে হবে বলে ওকে আর গাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করা হলো না। স্টেজ ছেড়ে নামবার মুখে আবার চোখাচুখি। খুব ভাল গেয়েছেন, স্প্লেনডিড। আমি একেবারে অভিভূত, জানালো সমরেশ।
– থ্যাঙ্কস আপনাকে। আপনিও তো খুব ভাল গেয়েছেন।
– আমি তো মাত্র একটা গান গেয়েছি। তাও ব্রহ্মসংগীত।
– দেখুন, মেয়েরা জানে, ভাতের হাঁড়ির একটা ভাত টিপে বলে দিতে পারে যে ভাতটা সেদ্ধ হয়েছে কিনা। পুরো হাঁড়়ির ভাত দেখার দরকার পড়ে না।
– ঠিক আছে, ম্যাডাম, আপনি বসুন গিয়ে চেয়ারে। এবারে বরণ করে নেওয়া হবে।
– ও আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে।
এরপরে প্রিন্সিপাল স্যার এক এক করে ছাত্রছাত্রীদের নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী ডাকতে লাগলেন। পাশে দাঁড়িয়ে সিনিয়র দাদারা উত্তরীয়, পুষ্পস্তবক, উপহার ও মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে বরণ করে নিতে লাগলো প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের। নামের আদ্যক্ষর প্রথম থাকায় বন্ধু ভাস্করের ডাক পড়লো আমার আগে। এরপরে চন্দ্রমল্লিকা ও তার পরে ডাক পড়লো সমরেশের। দেখল সকলে হাততালি দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু চন্দ্রমল্লিকা সমরেশের নাম ডাকার সময়ে হাততালিটা একটা বেশিক্ষণ ধরে দিল।
– ‘দেখ সমরেশ, কলেজের প্রথম দিনে তুই ‘হিরো’ আর চন্দ্রমল্লিকা ‘হিরোইন’ হয়ে গেল’ – হাসতে হাসতে বলল ভাস্কর।
– হ্যাঁ, তোরা করলি বলে আমরা হলাম। না হলে কি আমাদের লেজ গজিয়েছিল?
– ঠিক তো। ল্যাজ তো গজিয়েছে। তবে সেটা ছোট্ট ছিল, এখন বড় হয়ে গেছে। তবে এই ল্যাজ দেখা যায় না বাইরে থেকে। শুধু অনুভব করতে হয় – বলল ভাস্কর।
– ঠিক আছে , চল এখন বাড়ির দিকে যাওয়া যাক।
– ‘সে কি রে!এত তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবো? সবার সঙ্গে একটু আড্ডা মারা যাক। আজ তো আর পড়াশুনার ব্যাপার নেই। কাল থেকে ক্লাশ শুরু হবে।
বলতে বলতে ওরা পায়ে পায়ে কলেজ ক্যান্টিনে এসে পৌঁছালো। তখন ওখানে খুব ভিড়। সমরেশকে দেখে ওর সহপাঠীরা তো বটে, সিনিয়র দাদারা এসে পিঠ চাপড়ে বলে উঠলো: ‘সাবাস! সমরেশ, এক্কেবারে ফাটিয়ে দিয়েছো।’
– দাদা, আমি আর কি ফাটালাম। যা কিছু করেছে তো ওই চন্দ্রমল্লিকা। কথা শেষ হতে না হতেই, আমি এমন কিছু করিনি যাতে আমাকে নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গ উঠতে পারে। পেছন ফিরে তাকাতেই চোখাচোখি হ’ল চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে।
– না, না, আমি বদনাম করছি না। আমি আপনার সুনাম করছি মাত্র।
– আমি এমন কি করলাম যে এর মধ্যে সুনামীর ঢেউ আছড়ে পড়ছে ক্যান্টিন সহ কলেজের নানা প্রান্তে?
– সে কি! এত ভাল গান গাইলেন, এটাই তো আমাদের কাছে পরম প্রাপ্তি।
– গান গাইতে আমার ভাল লাগে, তাই গেয়েছি। ভাল মন্দ বুঝতে পারি না।
– সেজন্য তো গায়ক গায়িকারা তাঁর নিজের গানে কখনো সন্তুষ্ট হয় না বলেই তার পারফরম্যান্সটাকে ভাল থেকে ভালতর থেকে ভালতমে নিয়ে যেতে চান। এর ফলে তাঁর সেরা পারফর্মটা আমরা শ্রোতারা পেয়ে যাই।
– ভারি সুন্দর কথা বলেন আপনি। সত্যি আপনি একটা জিনিয়াস।
– আপনিও কম যান না।
– কথায় আপনার সঙ্গে পেরে উঠবো না। হার মানছি। বলুন কি খাবেন, আজ আমি খাওয়াবো।
– খাওয়াতে হলে আমাদের সকলকে খাওয়াতে হবে।
রাজি বলে মাথা নাড়লো। ওর মাথা নাড়াটা যে এত ছন্দময় হতে পারে, সমরেশ অবাক হয়ে দেখলো। ছন্দে ভরা সারাটা দেহ-মন-প্রাণ চন্দ্রমল্লিকার।
– গরম গরম শিঙারা, মিষ্টি আর চা দিয়ে ভোজনপর্ব শেষ হলে, কথাবার্তা, আলাপের মধ্যে দিয়ে ঠিক হলো এখন থেকে আপনি, আজ্ঞেও নয়, স্রেফ তুমি বা তুই চলতে পারে। আগামীকাল ফিজিক্স অনার্স ক্লাশে দেখা হবে প্রতিশ্রুতি নিয়ে যে যার চলল নিজ নিকেতনে।
– এতদিন যে সংযমের মধ্যে ছিল সমরেশ। রাতে তার ব্যাঘাত ঘটলো। আগে বিছানা নিলেই ঘুমে মরা হয়ে যেত। ঐদিন রাতে আর ঘুম আসতেই চায় না। চোখ বুজলেই বারেবারে ভেসে আসে চন্দ্রমল্লিকার মুখ, তার মিষ্টি হাসি। আর চোখেমুখে কি যেন বলার তাগিদ। সমরেশ ভাবে এটা কেন হচ্ছে তার? এতদিন তো বেশ ছিল। এটা কি টেলিপ্যাথি! চন্দ্রমল্লিকারও কি এই অবস্থা! একেই কি বলে প্রথম দর্শনে ভালবাসা, অর্থাৎ লাভ কামস এ্যাট ফার্স্ট সাইট? এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একসময়ে নিদ্রা দেবীর কোলে ঢলে পড়লো সমরেশ।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল অনেক দেরি করে। মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল । মায়ের হাতে চায়ের কাপ। ইস্ অনেক দেরি হয়ে গেছে মা, বলেই মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপটা একেবারে সরবত খাওয়ার মতো চা-টা খেয়ে নিল।
– আরে করছিস কি? গরমে যে জিবটা পুড়ে যাবে। মায়ের সাবধানবাণীতে কান না দিয়ে চা-টা শেষ করেই বাথরুমে ঢুকলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিটফাট হয়ে জানালো মা আজ আর হাতে সময় নেই খাওয়ার। কলেজ ক্যান্টিনে খেয়ে নেবো। দশটা থেকে ক্লাশ হেড ডিপের। প্রথম দিন ক্লাশটা মিস করতে চাই না।
– সে কি রে খালি পেট যাবি। ওই আমাকে দুটো বিস্কুট আর একটা মিষ্টি দিয়ে দাও। ওতেই হবে। পেট ভার আছে কালকে খাওয়া দাওয়া করে।
– ঠিক আছে। বলে মায়ের হাত থেকে কিছুটা জল মিষ্টি খেয়ে পড়িমড়ি করে দৌড়ালো সমরেশ কলেজের দিকে।
দোতলার ফিজিক্স অনার্স ক্লাশে ঢুকেই বন্ধুরা সবাই হৈ হৈ করে বলে উঠলো, ‘এই তো হিরো এসে গেছে।’ ক্লাশে বাম দিন ডানদিক দুটো সারিতে চেয়ার পাতা। বামদিকের দ্বিতীয় রো-তে চোখ পড়লে ডানদিকের একটি বেঞ্চিতে ঘর আলো করে বসে আছে চন্দ্রমল্লিকা। চোখাচোখি হতেই আবার সহাস্য মুখে জানালো, ‘সুপ্রভাত’।
ওকে সুপ্রভাত জানানোর আগেই হেড ডিপ ঢুকে পড়লেন ক্লাশ নেওয়ার জন্য। প্রথমদিন আলাপ পরিচয় পর্ব সারতে সারতে ক্লাশ শেষ হওয়ার ঘন্টা বেজে গেল। পরের ক্লাশ নেওয়ার স্যার না আসাতেই ওদের পোয়া বারো। সবাই এসে কলেজ ক্যান্টিনে ভীড় জমালো। আড্ডা আর মজলিস। বন্ধুরা সকলে আবদার জানালো চন্দ্রমল্লিকাকে একটা নিচু গলায় গান গাইবার জন্যে সময়টা যাতে কেটে যায়।
– গাইতে রাজি আছি যদি, সমরেশ আগে একটা গান গায় – বলল চন্দ্রমল্লিকা।
– কেন লেডিজ ফার্স্ট। সমরেশ বলে উঠলো।
ওসব কথায় চিঁড়ে ভিজবে না। সমরেশ আগে গাইবে তবে আমি গাইবো। এত তাড়াতাড়ি সম্পর্কটা আপনি থেকে তুমিতে চলে আসবে সমরেশ ভাবতে পারে নি। ওর মুখে সমরেশ নামটা শুনে মনের কোথাও যেন একটু অন্যরকম ঢেউ কেলে গেল সমরেশের। যাই হোক আর আপত্তি করলো না। পরপর তিনটে রবীন্দ্রসংগীত – ‘মনে রবে কিনা রবে আমারে’। ‘এপারে মুখর হল কেকা ওই’, ‘তুমি কোন্ ভাঙ্গনের পথে এলে সুপ্ত রাতে’ গেয়ে শেষ করলো। এবারে চন্দ্রমল্লিকার পালা। শুরু করলো, ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে।’, ‘বাণী মোর নাহি, স্তব্ধ … বিছায়ে চাহিতে শুধু জানি’, ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে, উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে।’ এর মধ্যে কেউ জানালো পরের ক্লাশের সময় শুরু হতে চলেছে। এখনই ক্লাশে যাওয়া দরকার। গানের আসর সেদিনের মতো শেষ হয়ে গেল।
পরপর কয়েকটা অনার্সের ক্লাশ নিলেন স্যারেরা পালাক্রমে। অনার্সের ক্লাশের পরেই হৈ হৈ করে বেশ কিছু বন্ধুরা মিলে কেমিষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ল্যাবে এসে হাজির হল। প্রথমদিন ডেমোনস্ট্রেটর শ্যামাদা কিছু নির্দেশিকা জানিয়ে ছেড়ে দিলেন। হঠাৎ গেটের বাইরে দেখা চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে। কণিকাকে সঙ্গে নিয়ে কার জন্য যেন অপেক্ষা করছে । দেখা হতেই চন্দ্রমল্লিকা বলে উঠলো, ‘আজ তো কলেজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরে করবো-টা কি?’
– সমরেশ চলো না, আজ দুপুরের সিনেমাটা দেখে আসি। অবশ্য তোমার আপত্তি থাকলে পীড়াপীড়ি করবো না।
– আরে। তা নয়। বাড়িতে একটা জরুরী কাজ ছিল। ঠিক আছে, ম্যানেজ করে নেবো, চল সবাই মিলে আজ সিনেমাই দেখা যাক।
সিনেমা, গল্প, আড্ডা, পড়াশুনা, কলেজের সোশ্যাল এইসবের মধ্যে দিয়ে ওদের দুজনের সম্পর্কটা দিনকে দিন গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগলো। চন্দ্রমল্লিকা বাবার একমাত্র মেয়ে। বাড়ি শেওড়াফুলিতে। ছোটবেলা থেকে কোন অভাবই রাখেন নি ওর বাবা মা। তাই বলে আলালের ঘরে দুলালি নয়। সংসারের টুকিটাকি কাজকর্মও করে অবসর পেলে। এককথায় চৌকস মেয়ে।
সমরেশ ভাবে চন্দ্রমল্লিকাকে জীবনসঙ্গী করে নিলে ওর স্বভাব চরিত্র ও আচার আচরণে বাড়িতে কোন অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। মা ওকে সাদরে ছেলের বৌ হিসেবে বরণ করে নেবে। এখন ওর দরকার একটা ভাল কেরিয়ার। যাতে ভরণপোষণে কোন সংকট দেখা না দেয়।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর বিধাতা করেন আর এক।একদিন কেমিষ্ট্রির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশে সবাই ব্যস্ত প্র্যাকটিক্যাল করতে। চন্দ্রমল্লিকার পার্টনার এক অসতর্ক মুহূর্তে বিপদটা ঘটিয়ে ফেলল। জিংক নাইট্রিক অ্যাসিডের রাসায়নিক মিশ্রণটাকে হঠাৎ করে গ্যাস বার্ণারের ফ্লেমে ধরতেই দুম করে ফেটে ঘন অ্যাসিডের দ্রবণ ছিটকে লাগলো পাশে দাঁড়ানো চন্দ্রমল্লিকার চোখে মুখে। কণিকার হাতে পায়ে লাগলো। যন্ত্রণায় চন্দ্রমল্লিকা কাতরাচ্ছে।
কাজ ফেলে সবাই ছুটে গেল চন্দ্রমল্লিকা ও কণিকার কাছে। বাবা-গো, মা-গো, জ্বলে গেল জ্বলে গেল বলে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক জ্ঞানের কিছুটা চলল। ইতিমধ্যে স্যার ও প্রিন্সিপাল স্যারেরা এসে গেলেন। তাঁদের পরামর্শে গাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হ’ল ওদের দুজনকে। স্থানীয় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর বিনীত ভাবে জানালেন চিকিৎসক, ওই হাসপাতালে কোন বার্ণ ইউনিট নেই। তাই ওদের কলকাতার বড় হাসপাতালে রেফার করতে বাধ্য হতে হচ্ছে।
অনেক চেষ্টা চরিত্র করে চন্দ্রমল্লিকা আর কণিকাকে ভর্তি করা হল কলকাতার পিজি হাসপাতালের ওডবার্ন ইউনিটে। ডাক্তারবাবুরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দুজনকেই প্রাণে বাঁচালো। কিন্তু চন্দ্রমল্লিকার মুখের ক্ষতটা আর ঢাকা পড়লো না। অত সুন্দর মুখ দেখতে খারাপ হয়ে গেল। কণিকার অল্প হাতে পায়ের দাগ খুব একটা ওকে বিচলিত করলো না। কিন্তু চন্দ্রমল্লিকাকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়লো। কিছুই খেতে চায় না। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলতে চায় না, শুধুই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
সমরেশ পড়লো মহা চিন্তায়। এরকমটা চলতে থাকলে তো ওকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। চন্দ্রমল্লিকার বাড়ির লোকজন ও বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলো ওকে দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবে। ওর বাবা ঢালাও আশ্বাস দিলেন, টাকার চিন্তা তোমায় করতে হবে না, যত টাকা লাগবে আমি দিয়ে দেবো। ইন্টারনেট থেকে যোগাযোগ করে একদিন সমরেশ বিদেশে পাড়ি দিল চন্দ্রমল্লিকাকে নিয়ে। যাত্রা বিফলে গেল না। প্রথিতযশা প্লাস্টিক সার্জনদের দৌলতে চন্দ্রমল্লিকার মুখের চেহারা আবার আগের অবস্থায় ফিরে এল। চন্দ্রমল্লিকা আয়নায় নিজের মুখ দেখে খুব খুশি। ওরা দুজনায় ফিরল বিজয়িনীর বেশে। চন্দ্রমল্লিকার মুখে সেই স্মিত হাসি। তার সৌরভে সুরভিত হল আবার কলেজ প্রাঙ্গন, বন্ধুমহল ও আত্মীয় পরিজন।
সমরেশ ভাবে :‘সখি ভালোবাসা কারে কয়? সে কি কেবলি যাতনাময়।’
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।