ঘুমটা আসছে আবার আসছেও না। ঘুমের মত কিছু একটা। ঘুমিয়ে পড়লে এই মিষ্টি ঝিরঝির বৃষ্টির শব্দটা আমি শুনতে পাব না, তাই ঘুমও থমকে গেছে। যাই যাই করে এ শহরতলীতে হালকা ঠান্ডা এখনো। দরজার ওপারে অপেক্ষায় বসন্ত। সেদিন এক বিকেলে অবশ্য কোকিলের ডাক শুনতে পেয়েছিলাম। বারচারেক ডেকে সে বুঝে ছিল, দিনকাল বদলে গেছে। এখন আর তার ডাকের সমাদর হয় না আর ডাক নিয়ে কেউ কবিতাটবিতাও লেখে না। কালিদাস আর বঙ্কিময়ের পর এমন কি তাকে নিয়ে কেউ ঠেস দিয়েও কবিতা বা গল্প লেখেন নি।এ ছাড়া ইদানিং মানানসই শব্দটাই নেই।এটাই নাকি ফ্যাশন। যেমন এই রাতের অসময়ের বৃষ্টি।
এইসব ভাবতে ভাবতে চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল, আবার ভেঙেও গেল। ভাবছিলাম, ঘুমের যেমন ওষুধ বেরিয়ে গেছে, স্বপ্ন দেখার জন্য সে রকম কিছু থাকলে বেশ হত। ছোটগল্পের মত এক একটা ব্র্যান্ডেড স্বপ্ন দেখতাম। নাঃ ঘুমই আসছে না তা স্বপ্ন আসবে কি ভাবে। এপাশ ওপাশ করে আবার চেষ্টা।
খুটুস করে শব্দ। মাথার পাশে রাখা মোবাইলে দেখলাম, দেড়টা। একগুঁয়ে বৃষ্টিটা পড়েই চলেছে। হালকা শব্দকে মনের ভুল ভেবে পায়ের কাছে চাদরটা খুলে শুতে যাব, হঠাত শুনতে পেলাম ঘরের মধ্যে ফিসফিস করে মেয়েলি গলা, ‘হ্যালো … স্যর জি, গুড ইভনিং’। আর তো এভাবে শুয়ে থাকা যায় না। উঠে বসলাম বিছানায়। পুরনো জানলার ফাঁক দিয়ে রাস্তার আলো কিছুটা। আবছা দেখলাম, লেখার টেবিলের সামনের চেয়ারে আমার দিকে মুখ করে ডেনিম জিন্স আর গোলাপি টপে আবছা এক নারী। একবার ভাবলাম, স্বপ্ন নয় তো! এখুনি ধীরেধীরে জুমআউট হয়ে যাবে।কিন্তু ঘরময় বিদেশি পারফিউমের হালকা সুগন্ধ! স্বপ্নে কি ঘ্রাণের ব্যাপার থাকে? কি জানি, সবকিছু বদলে গেছে, থাকতেও পারে। এখনকার ব্যাপারটা অল্প আলোয় আর্ট ফিল্মের মত। আধো অন্ধকার, বৃষ্টির শব্দ, বেল বাজিয়ে সাইকেলের যাওয়া। সব মিলিয়ে এক ফিল্মি মন্তাজ।
মশারি থেকে মুখ বাড়িয়ে, আধো অন্ধকারে ভালো করে দেখলাম, সত্যি তো, একজন মহিলা। পেন্সিল হিলে পায়ের ওপর পা তুলে সিনেমার নায়িকার মত বসে। নাঃ আর বসে থাকা মানায় না। মশারি তুলে আসতে আসতে নামলাম। হাওয়াই চটিটা গলিয়ে পাশের দেওয়ালের সুইচবোর্ডে আঙুল ছোঁয়াতেই সারা ঘর আলোয় আলো। দেখি চেয়ারে বসে প্রিয়ঙ্কা চোপড়া! পাশের একটা চেয়ার সামনে এগিয়ে দিয়ে আদিখ্যেতার গলায় বললো, ‘বৈঠিয়ে না’। এখনকার সিনেমা বড়ো একটা দেখা হয় না, তবে এদের নামে চিনি। মাঝেমধ্যে ইউ টিউবে বা শুক্রবারের কাগজের পাতায়। এই তো একবার মিস ওয়ার্ল্ড হয়েছিল! সম্প্রতি বছর দশেকের ছোট আমেরিকান গায়ক কি এক জোন্সকে বিয়ে করেছে। একেই তো বরফি ছবিতে দেখেছি, বেশ অভিনয় করেছে। ভালো করে দেখলাম, প্রায় আমার বড়োমেয়ের বয়সি। কোনরকমে বললাম, ‘তুমি! এত রাতে আমার ঘরে’! যেন জানতো এই প্রশ্ন করবো।ঘাড় নেড়ে মৃদু হাসলো। আজকাল নায়িকারা শব্দ করে হাসে না আগের মত। সেই অব্যক্ত হাসি নিয়ে, বারগেন্ডি রঙের একঢাল ঝরনার মত বাই কালার চুল আঙুল দিয়ে পিছনে সরিয়ে নিটোল ডানহাতটি বাড়িয়ে দিল আমার দিকে, আমিও সৌজন্যে হাত বাড়িয়ে দিলাম। নরম ঠান্ডা হাত। প্রথমবার আমার বাড়িতে এসেছে, ভদ্রতা করে জিঙ্গাসা করলাম, কফি খাবে? সেলিব্রিটিরা বোধহয় সব কথার উত্তর দেয় না। জবাব না দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় হাস্কি গলায় আশ্চর্য করে বললো, ‘আমি আপনাকে চিনি। এই বৃষ্টির মধ্যে একটু পরে আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন, তারপর স্বপ্ন দেখবেন আমাকে নিয়ে উটি যাচ্ছেন। কী, যাবেন তো?” চমকে গেলাম। কি কনফিডেন্স! আমিও হতভম্ব হয়ে বোকার মত একবার ঘাড় কাত করলাম। বলতে চাইলাম, ‘ঠিক আছে’। শুনে খুশি হয়ে সেই ছড়ানো হাসি ছড়িয়ে দিল এই মধ্যবিত্ত ঘরে।
অহংকারি বৃষ্টি তখনো ঝিরঝির, অনেকটা প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার মত।
Tags: ধ্রুব বাগচী, স্বপ্নের মতো
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।