বেশ কিছুদিন আগে ফেসবুকে একদা অভিন্নপল্লীনিবাসী ও অধুনা মুম্বাইপ্রবাসী ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু শ্যামল লাহার সঙ্গে বার্তালাপ চলছিল চ্যাটবক্সে…দুজন প্রৌঢ় মানুষের মধ্যে যেমন হয় আর কি…..আমাদের অক্ষর শহর শ্রীরামপুরের নানারকম পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ ! হঠাৎ দেখি শ্যামল মেসেঞ্জারে লিখেছে…..’আশিসদা আপনার কি ক্ষুদিরামকে মনে আছে ? সেই যে ক্ষুদিরাম….আমাদের স্কুলের টিফিনের সময়ে আমরা যার তৈরী ঘুগনি আর আলুরদম লাইন দিয়ে খেতাম ?’
তখনকার মতো শ্যামলকে কেবল জানিয়েছিলাম যে ক্ষুদিরামকে নিশ্চয়ই মনে আছে…ক্ষুদিরাম মানুষটা, তার সেই অসাধারণ আলুরদম আর ঘুগনি, শালপাতার দোনা, আলুরদমের জন্য কাঠি আর শালপাতায় বিশেষ ভাবে তৈরী ঘুগনীর চামচ…..মায় টিফিনের ওই ছেলেদের বিশৃঙ্খল ভিড়ের মধ্যে বিপর্যস্ত তার প্রায়-ব্যর্থ হাঁকডাক…..’লাইন দিয়ে এসো, লাইন দাও, লাইন দিয়ে এসো’…..
গত শতাব্দীর পাঁচের আর ছয়ের দশকে, শ্রীরামপুরের মতো ছোট মফঃস্বল শহরে, সেই বোধহয় আমাদের লাইনে দাঁড়ানোর প্রথম শিক্ষালাভ…..ক্ষুদিরামের ইস্কুলে! তখনও তো ইস্কুলে ইস্কুলে ক্লাস আরম্ভ হওয়ার আগে লাইন দিয়ে প্রার্থনা সংগীত বা ইংরেজী রাইম গাইবার রেওয়াজ প্রকট হয়নি ! নিয়ম করে বছরে তখন দুবার লাইন দিতাম আমরা……স্বাধীনতা দিবস আর গণতন্ত্র দিবসের প্রভাতফেরীতে ! সেই দুটো দিনেই সক্কালবেলায় মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা সাদা শার্ট প্যান্ট আর খড়ি দিয়ে সাদা করা কেডস জুতো পরে স্কুলে জমায়েত হয়ে তারপর সেই লাইন করে “উর্দ্ধগগনে বাজে মাদল” গাইতে গাইতে শ্রীরামপুর কোর্টের মাঠে গিয়ে নানারকম স্পোর্টস ! তারপর ঘড়ির কাঁটা মধ্যদিন পার করলে ছোট্ট প্যাকেটে একটা কেক আর দু-তিনটে লজেন্স প্রাপ্তি ও বাড়ী ফেরা ! গ্রেগরী গোমস যতদিন শ্রীরামপুরের এস ডি ও ছিলেন এই ব্যাপারটা প্রতি বছর চালু ছিল ! যতদূর মনে পড়ে ১৯৬২ সালে, বোধ হয় জুলাই মাসে, তিনি হুগলী জেলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে চুঁচুড়া চলে যান ! সেখানে গিয়েও জেলাস্তরে স্কুলভিত্তিক নানারকম প্রতিযোগিতা করাতেন, তাতে অংশগ্রহণও করেছি….কিন্তু সে অন্য গল্প !
ক্ষুদিরামকে জানতাম আমি প্রায় বিশ বছরের বেশী ! তাকে চেনা বা ঠিক করে বলতে গেলে তার ঘুগনি আর আলুরদমের সঙ্গে প্রথম চেনা পরিচয়টা হোলো ১৯৫৬ সালের জানুয়ারী মাসে, যখন আমি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হলাম বাড়ির কাছেই পূর্ণচন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ! সেকালের ইস্কুল টাইম সকাল দশটা থেকে দুটো…মাঝখানে বারোটায় টিফিন টাইম ! আজও মনে আছে সেই টিফিনের ঘন্টার আওয়াজ শোনবার জন্য সেই দেড়শো দুশো অর্বাচীনের কি আকুল প্রতীক্ষা….. আর ঘন্টা শোনার পরমুহূর্তে ইস্কুলের ঘরগুলো থেকে কি তাদের নিষ্ক্রমণের বেগ…..রোজ তিন চারজন অসতর্ক বালখিল্যের মেঝেতে পতন ও গড়াগড়ি অবশ্য ঘটনা ! স্কুলের প্রথম দিন……টিফিনের ঘন্টা বাজার পর তীরবেগে ইস্কুলবাড়ীর বাইরে সামনের রাস্তায় এসে দেখেছিলাম ততক্ষনে বিরাট জটলা আর ঠেলাঠেলি লেগে গেছে একটা বেঁটেখাটো মানুষ আর তার সামনে ঝুড়ির মধ্যে বসানো এক বিরাট লাল কাপড় মোড়া হাঁড়িকে ঘিরে ! দারুন চেঁচামেচি চলছে, হাতে বাড়ানো দু পয়সা বা এক আনা ….’আমাকে দাও’…’ও ক্ষুদিরামদা এদিকে দাও’…’ও ক্ষুদিরামদা আমি আগে এসেছি আমাকে দাও’…আর সেই মানুষটা …যার নাম জানলাম ক্ষুদিরামদা…… তার হাত আর মুখ সমানে চলছে….একহাতে হাঁড়ির পাশ থেকে ক্ষিপ্রহাতে একটা করে পাতার দোনা তুলছে….আর অন্য হাতে করে সেই শালপাতার দোনায় দিচ্ছে হাঁড়ির ঘুগনি সমধিক আড়াই হাতা আর একটা শালপাতা দিয়ে তৈরী চামচ……সামনের অগণিত প্রসারিত আকুল হাতের মধ্য থেকে কোনো একটা ভাগ্যবান হাতে চলে যাচ্ছে সেই মহৎ খাদ্যবস্তু দু পয়সার বিনিময়ে…..আর সেই সঙ্গে মুখ তার চলছে সমানে……’লাইন দিয়ে এসো…….সবাই পাবে…..সব্বাই….সব্বাইকে দেবো….লাইন দাও …লাইনে এসো !’
ক্ষুদিরামের সঙ্গে সেই আমার প্রথম দূর থেকে একতরফা পরিচয় ! কিন্তু তার তৈরী অসাধারণ স্বাদের আলুর দম আর ঘুগনীর সঙ্গে মাখামাখি বন্ধুত্ব হয়ে গেলো প্রায় তার পরের দিন থেকেই ! পকেটমানি শব্দটা তখনও ঠিক সেভাবে চালু হয়নি মফস্বল শহর শ্রীরামপুরে ! আমাদের কাছে তার নাম ছিল টিফিনের পয়সা ! সেই ১৯৫৬ সালে, ক্লাস থ্রিতে, আমার জন্য বরাদ্দ হলো স্কুলের দিনপিছু সাকুল্যে এক আনা…ঢেউকাটা সোনালী রঙের কয়েন! ডেসিমেল পয়সা প্রায় তার পরপরই, বোধহয় ১৯৫৭ সাল থেকে শুরু হয়ে যায়……তখন সেই এক, পাঁচ, দশ, পঁচিশ পয়সার কয়েন গুলোকে বলা হত ‘নয়া’ পয়সা ! বেশ কয়েক বছর ওই ‘নয়া’ কথাটা চালু থাকার পর কবে যে সেসব সুন্দর কয়েনগুলো ‘পূরোনো’ হয়ে গেলো !!
তবে সেই ১৯৫৬ সালে ওই ‘এক আনার বাজেট’ বরাদ্দ কিন্তু খুব খারাপ ছিলোনা ! ওই নাত্যল্প বিত্তের সুবাদে এক বার করে ক্ষুদিরামের দুপয়সার ঘুগনী বা আলুরদম খাওয়ার পর দুটো আলাদা আলাদা রঙের এক এক পয়সার বড়ো কাঠি লাগানো আইসক্রিম খেতে পারা যেত! প্রায় পাঁচ ইঞ্চি করে লম্বা প্যারালালোপাইপেড শেপের কাঠি-লাগানো আইসক্রিমগুলো পাওয়া যেত এক পয়সা করে…..আহা কি তার বাহারি রকমারি রং সব…..মনে পড়ে রামধনুর প্রায় সব রঙেই পাওয়া যেত….সোমবার দুপুরে খেলে মঙ্গলবার সকালের আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডেও জিভ দেখে বলে দেওয়া যেত আগের দিনে খাওয়া সেই আইসক্রিমের রঙ্গীন পরিচয় ! একটা মুশকিল ছিল যে সেই সুবৃহৎ আইসক্রিম কামড়ে না খেলে অল্পসময়ে সহজে শেষ হতো না ! ক্ষুদিরামের ঘুগনী বা আলুরদম তো শেষ হয়ে যেত দুতিন মিনিটে কিন্তু টিফিনের বাকি দশ-বারো মিনিটের মধ্যে দুটো আইসক্রিম শেষ করার আগ্রহাতিশয্যে আমাদের অনেকেরই দুহাতে থাকতো একটা করে আইসক্রিম…..ক্রমান্বয়ে চলতো লেহন……একবার কমলা তো আর একবার সবুজ…বাঁহাতে লাল তো ডানহাতে হলুদ !
আমার নিজের অবশ্য ছিল আইসক্রিম নিয়ে অন্য এক বিশেষ সমস্যা ! যেহেতু আমার বাবার দৃঢ় বক্তব্য ছিল যে ঐসব আইসক্রিম শুধু পুকুরের জল দিয়েই তৈরী হয় তাই আমার আইসক্রিম খাওয়াটা বেশ অস্বাস্থ্যকর গর্হিত কাজ বলে বাড়িতে ধরা হতো ! যদিও আইসক্রিমের জন্য প্রয়োজনীয় জলের অন্যান্য সম্ভাব্য উৎস সম্বন্ধে আমার সম্যক জ্ঞান থাকার কারণে ‘পুকুরের জলের’ অবশ্য-প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে আমার ঘোর সংশয় ছিল তবুও আমি কৈশোর বয়সের বুদ্ধিবলে সে সংশয় বাবার কাছে কখনো প্রকাশ করিনি, সম্ভবত টিফিনের পয়সার বাজেট নির্মূল হবার আশংকায়! তাই আইসক্রিম খেয়ে ধরা পড়ার ভয়ে আমি প্রায় প্রতিদিনই দ্বিতীয়বার ক্ষুদিরামের সামনে তার আলুরদম বা ঘুগনীর সেকেন্ড হেলপিংয়ের জন্য খুশীমনে দাঁড়িয়ে পড়তাম ! আর সেই থেকেই বোধহয় প্রাথমিক ভিড় হালকা হয়ে যাবার পর ক্ষুদিরাম তার এই লয়্যাল অর্বাচীন খদ্দেরটিকে একটু আলাদা করে নজর করার সুযোগ পেতো ! সেই ক্লাস থ্রীর সামান্য দুতরফা পরিচয় পরের বিশ বছরে বেশ পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে….গুম্ফসম্বলিত, কলেজ-পড়ুয়া আমার কাছে কখন ক্ষুদিরামদা-র দা-টুকু খসে গিয়ে সে হয়ে যায় ক্ষুদিরাম আর আমি তার কাছে হয়ে যাই ‘আশিসবাবু’!
ক্ষুদিরামের খ্যাতির মূল ভিত্তিটা ছিল তার আলুরদমের স্বাদে ! আর একটু বিশদে বলতে গেলে সেই আলুরদমের ‘জুস’-এর স্বাদে! আরও একটা বাড়তি ‘স্বাদ’ ছিল তার ‘ফাউ’ জুসের মধ্যে ! হ্যাঁ…..দু পয়সার চার পিস্ আলু-সম্বলিত সেই সুবিখ্যাত আলুরদম কিনলেই অন্তত একবার ‘ফাউ জ্যুস’ পাওয়ায় ছিল আমাদের জন্মগত অধিকার ! তাই বিশ মিনিট টিফিন পিরিয়ডের শেষ পাঁচ মিনিট ক্ষুদিরামের প্রায়ই কেটে যেত তার অগণিত ক্ষুদে খদ্দেরের “ফাউ জুসের” দাবী মেটাতে মেটাতে ! মনে হয় এই সেদিনের কথা…..চোখ বুজে একটু চেষ্টা করলেই আজও দেখতে পাই…পুরোনো লাল কাপড়ে মোড়া হাঁড়ির চারপাশ দিয়ে সাত-আটটা বাড়ানো পাতার দোনা আর সমবেত কোলাহল……’আমাকে দাও ক্ষুদিরামদা জ্যুস’…..’ও ক্ষুদিরামদা আমাকে এদিকে একটু জ্যুস’ …..’ক্ষুদিরামদা আমি কিন্তু একবারও পাইনি’…..আর দেখতে পাই ক্ষুদিরামের সেই রেজিমেন্টেড ফাউ জ্যুস বিতরণ…..পুরো হাতা জ্যুস হাঁড়ি থেকে তুলে নিখুঁতভাবে সামনে প্রসারিত দুটো দোনায় সেটা আধাআধি ঢেলে দেওয়া…..আর মুখ চলছে….’দিচ্ছি…দিচ্ছি….সব্বাইকে….সব্বাইকে দেব…ব্যাস একবার হয়ে গেছে….আর নয়…আর নয়….’
আমাদের প্রাইমারী ইস্কুলে দুপুর দেড়টায় ছুটি হয়ে যেত ! ছুটির পরে, ইস্কুলের বাইরে, রাস্তার ধারে পড়ে থাকা অজস্র পাতার দোনা ছাড়া টিফিন পিরিয়ডের হিরো ক্ষুদিরামদার কোনো চিহ্ন তখন আর নেই ! কয়েকদিনের মধ্যেই জেনে গেলাম আমাদের প্রাইমারী স্কুলের ছুটির সময়টায় ক্ষুদিরামদা চলে যায় কিছু দূরের ‘বাংলা স্কুলের’ সামনে, যে ইস্কুলটাকে সেসময় আমার বাবা বলতেন ‘এম. ই. স্কুল’ বা মিডল ইংলিশ স্কুল ! সেই বড়োদের মাধ্যমিক স্কুলের টিফিন পিরিয়ড ছিল একটায়! তাই বেলা একটা থেকে ক্ষুদিরামের আলুরদম আর ঘুগনীর টেম্পোরারী দোকান খুলে যেত বাংলা স্কুলের সামনে…..
দুবছর বাদেই ফাইভে উঠে বাংলা স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম ! তাই আমার সঙ্গে ক্ষুদিরামের দ্বিপ্রাহরিক সম্পর্কের বিচ্ছেদ তো ঘটলোই না বরং ঘটনাক্রমে স্কুলের সময়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে সখ্যতা আরও সময়ের বিস্তৃতি লাভ করলো ! কারণ প্রায়-ই সন্ধ্যের মুখে ক্ষুদিরাম আমাদের পাড়ার মোড়ে তার বিখ্যাত হাঁড়ি আর ফ্রেশ রসদ নিয়ে দেখা দিতে লাগলো ! লাইটপোস্টের তলায় হাঁড়ি-ঝুড়ি আর অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে গুছিয়ে বসে সে এক-দুবার হাঁক দিয়ে আর হাঁড়ির গায়ে ঘুগনি-আলুরদমের হাতাটা ঠুকে জানান দিতো তার আগমন আর উপস্থিতির! তবে আমাদের পাড়ার মধ্যে তার ক্লায়েন্টেল-টা ছিল একটু মিশ্র প্রকৃতির…..বালখিল্য বা কিশোরের সংখ্যার অনুপাতে দুই বিনুনী দোলানো কিশোরীরাই বেশী থাকতো ! সেই ষাটের দশকের প্রথমভাগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনো কিশোরী পাতা চেটে চেটে অতি সুখাদ্য ঘুগনী বা আলুরদমের জ্যুস খাওয়ার কথা বোধহয় ভাবতে পারতো না ! তাই তারা সঙ্গে নিয়ে আসতো হিন্ডলিয়ামের ( ব্যাপারটা বাজারে তখন নতুন…স্টেনলেস স্টিলের বাসনপত্র প্রায় বিরল ছিল ) বাটি বা ঢাকনা দেওয়া চ্যাপ্টা কৌটো……তার মধ্যে ঘুগনী বা আলুরদম নিয়ে ঝটিতি অদৃশ্য হয়ে যেত ! বছরের পর বছর ক্ষুদিরাম লাহিড়ীপাড়ার মোড়ে এইভাবে সন্ধ্যেবেলায় তার রসদের পসরা সাজিয়ে বিক্রি করে যেত…….আমি স্কুল শেষ করে কলেজ করতে লাগলাম….প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস শেষ করে ফিরতে ফিরতে প্রায়-ই সন্ধ্যে…..আমাকে আসতে দেখলেই হাঁড়ির গায়ে হাতাটা দুবার ঠোকা দিয়ে জিজ্ঞাসা করতো……” আজ ঘুগনী আছে আশিসবাবু…..নেবে তো”….
অন্ধকার ঘন হয়ে এলে পড়ার টেবিল থেকে তার হাঁক ডাক আর হাতা ঠোকার আওয়াজ আর পেতাম না ! বুঝতাম হয়তো খালি হয়ে গেছে হাঁড়ি…সেদিনের মতো বেচাকেনা শেষ করে ক্ষুদিরাম বাড়ির পথ ধরেছে ! বাঁপাটা একটু ছোট ছিল ক্ষুদিরামের….দুলে দুলে চলতো মাথায় বিরাট হাঁড়ি নিয়ে….মুখের হাসিটা কিন্তু তার ছোট ছিল না….সামনের ভাঙা দাঁতের ফাঁক দিয়ে অনিবার ঝরে ঝরে পড়তো……
কলেজ করার দিনগুলোতে কখনো সখনো ক্ষুদিরামের ঘুগনী আলুরদম কিনতে কিনতেই লক্ষ্য করেছি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ক্ষুদিরামের সওদার আকর্ষণ যেন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে ! এই সময়েই কেউ আমাকে খবর দিলো ক্ষুদিরামের নাকি ডান হাতে ঘায়ের মতো দেখা যাচ্ছে এবং এই জন্যেই নাকি তার খদ্দের কমতে শুরু করেছে…..স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে নাকি সে আর বিক্রিবাটা করে না….কেবল সন্ধেবেলায় পাড়ার মোড়ে কিছুক্ষন বিক্রি করে….তবে সে প্রায় ভাঙা হাট !
ইউনিভার্সিটির চাপে বাড়ী ফিরতে প্রায়-ই রাত হয়ে যেত….এই সব খবরের সত্যতা যাচাই করার সুযোগ পেতাম না…..তবে আমার বাবা সংশয়ের সুরে আমাকে জানালেন যে ঘায়ের ব্যাপারটা সত্যি হলেও হতে পারে কারণ কেউ আর ওর তৈরী ঘুগনি আলুরদম খাচ্ছে না…..ব্যবসা বন্ধ…..ওকে বিশেষ দেখাও যাচ্ছে না !
ক্ষুদিরামের সত্যিই দুরারোগ্য ব্যাধি হয়েছিল! ইউনিভার্সিটি থেকে একদিন বিকেল বিকেল ফিরছি হঠাৎ দেখি শ্রীরামপুর স্টেশনের আপ প্ল্যাটফর্মের ঢালের কাছে ক্ষুদিরাম বসে আছে একটা চটের টুকরোর ওপর…মুখে সেই ফোকলা দাঁতের হাসি, চোখে ঘষা কাঁচের মতো দৃষ্টি…..আর ডান হাতে, দুপায়ের আঙ্গুল-জোড়া কাপড়ের ব্যান্ডেজ ! আমাকে দেখেই মাথার ওপরে ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতটা তুলে বললো ‘এই তো আমার আশিসবাবু এসে গেছে’ ! আমার গলায় যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠলো……..’এই কি সেই মানুষটা যে প্রায় দুদশক আগে বিকালে দৌড়ে গিয়ে আমার মা-কে সবার আগে খবর দিয়েছিলো……’কালিবাবু হেডস্যার বলেছেন আশিস ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেছে……তখন তো আমি ওর কাছে ”আশিসবাবু’ ছিলাম না……’
কোনোরকমে গলাটা পরিষ্কার করে বললাম, ‘ক্ষুদিরাম….কতোদিন বাদে তোমাকে দেখলাম….কেমন আছো তুমি ?’….হাতটা আবার তুলে ফোকলামুখে হেসে বললো, ‘এই ভগমান যেমন রেখেছেন’ ! লক্ষ্য করলাম ওর সামনের চটের টুকরোয় অনেক সিকি আধুলি টাকা পড়ে আছে…..কিন্তু এ তো কোনো তিরুপতির হুন্ডি নয় যে দাতাদের ভিড় লাগবে আর ক্ষুদিরামও বলবে ‘লাইনে এস…লাইনে এস….লাইন দাও’…….ওর সেই ইস্কুল তো বিধাতার নির্দেশে কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো ! ক্ষুদিরামের চটের টুকরোতে সেদিন একটা টাকা নামিয়ে রাখতে গিয়ে যে কষ্ট পেয়েছিলাম তা এখনো মনে পড়ে….
তারপরে ইউনিভার্সিটির বাকি মাসগুলোতে প্রায় নিয়মিত ক্ষুদিরামের সঙ্গে দেখা হতে লাগলো! ক্ষুদিরাম তার অমলিন হাসিমুখ আর ঘসা চোখ নিয়ে আপ প্ল্যাটফর্মের ঢালের পাশে বসে থাকত……কখনো ভিক্ষা চাইতো না ! যে অগণিত ডেলি প্যাসেঞ্জার দিনের শেষে শ্রীরামপুরে নামতো, তাদের মধ্যে হয়তো শতকরা পাঁচজন কৈশোরে ক্ষুদিরামের ঘুগনী বা আলুর দমের ফাউ ‘জুস্’ খেয়ে আর ক্ষুদিরামের ইস্কুলে লাইন দেওয়া শিখে তারুণ্যে পৌঁছেছিল….তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো নিয়মিতভাবে ওর সামনে পাতা চটের টুকরোটাতে কিছু টাকা পয়সা রেখে যেত…..আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে একজন….আমাকে দেখলেই ওর মুখে সেই পুরোনো হাসিটা দেখতে পেতাম……ফোকলা হাসিমুখে ঘড়ঘড়ে গলায় বলতো, ‘এই যে আশিস বাবু এসে গেছে’…….
১৯৭৬-এর শেষে শ্রীরামপুর ছাড়লাম ! তারপর প্রথম ছুটিতে বাড়ি এসে আপ প্ল্যাটফর্মে আর ওকে দেখতে পেলামনা ! আমার ডেলি প্যাসেঞ্জার বাবা বললেন ‘আমিও বেশ কদিন দেখতে না পেয়ে খবর নিয়েছিলাম …..ক্ষুদিরাম আর নেই…….কবে যে চলে গেল সেটা কেউ-ই ঠিক বলতে পারে নি’…..বাবার শেষের কথাগুলো ঠিকমতো শুনতেই পেলাম না……
ক্ষুদিরাম এইভাবে চলে গেছে সে তো প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে গেলো ! আজও রাস্তার ধারের ঘুগনী আলুরদমের দোকান দেখলে ক্ষুদিরামকে মনে পড়ে যায়…….কে জানে স্বর্গে গিয়ে হয়তো আবার ঘুগনি আর আলুর দমের বিক্রিবাটাই শুরু করেছিল……নন্দন কাননের গেটের পাশে ! হাজার কিশোরের মন জয়-করা ওই কাজটাই তো ও সবচেয়ে ভালো জানতো !
Tags: ইস্কুলের ক্ষুদিরাম বা ক্ষুদিরামের ইস্কুল, সিদ্ধার্থ সান্যাল
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।