নিকানো উঠানে বসে আছে শতায়ুর প্রতীক্ষায় আমার ঠাম্মা । আমি তাকে এখনো বেশ দেখতে পাই । তার সাদা চুলে রাজঁহাসের শুভ্রতা । দাঁতহীন মাড়ি বার করে হাসলে সুখ ঝরে ঝরে পড়ত । আমাদের পরিবারের মুখ ছিল এই ঠাম্মা । তাকে ভাঙ্গিয়ে আমার দুষ্টুমি আর অবিবেচনা ক্ষমা পেয়ে যেত প্রায়ই । এই মানুষটাকে খুঁড়ে দেখার ইচ্ছা আমার বহুদিনের । এগারো বছরে – সম্ভবত ঋতুমতী হবার আগেই – দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিষ্ণুপুর থেকে গোটা চারেক জেলা ডিঙ্গিয়ে হুগলী জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে এক বিবাহ অভিজ্ঞ পাকা পুরুষের হাতে সঁপে দেওয়া হয়েছিল এই মানুষটিকে । সেই তিনগুণ বয়সী কাম উপোষী মানুসটি প্রথম রাতেই দুঃস্বপ্ন গেঁথে দিয়েছিল দুপায়ের মাঝে । তার গ্রামের সমবয়সী ফাগ প্রথম রাতেই গায়ে আগুন দিয়ে শেষ করে দিয়েছিল নিজেকে । এই মানুষটি কিন্তু আস্ত আস্তে উঠে দাঁড়িয়েছিল । তারপর গোটা আটেক সন্তানের জন্ম দিয়ে মানুষটি কেমন করে আরও সুন্দর হয়ে উঠল – তা মানবতত্ত্বের গবেষণার বিষয় । আমি জ্ঞান হতে এই ঠাম্মাকে দেখেছিলাম প্রায় যুবতী । প্রথম সন্তানের সন্তান জন্মানোর দু বছর পরেও নিজে সন্তান ধারণ করতে ও জন্ম দিতে কোনও কুণ্ঠা বোধ করেনি । আমার ছমাস ছোট কন্যা সন্তানটির বরাদ্দ মাতৃদুগ্ধ প্রায়ই আমার উদরস্ত হত । এসব আমার শোনা কথা । কিছু কিছু রমণী যাদের প্রকৃতি অকৃপন হাতে যৌবন ঢেলে দেয় –পুরুষের কামদৃষ্টি থেকে রেহাই মেলে না আমৃত্যু – আমার ঠাম্মা সেই গোত্রের । আমার মনে আছে, আমার চোখের সামনেই ট্রেনের কামরায় এক কামুক সহযাত্রীর লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছিল আমার ঠাম্মাকে – তার বয়স তখন তিন কুড়ি ছুঁই ছুঁই ।
ঠাম্মার নিজস্ব একটা গন্ধ ছিল । সেই গন্ধ যেখানে ঠাম্মা থাকতো তার আশেপাশে অনেক দূর পর্যন্ত ম ম করত। আমরা চোখ বুজে বলে দিতে পারতাম ঠাম্মা কোথায় বসে আছে । পরে বুঝেছি সেটা পান খাবার গন্ধ । ঠাম্মার চিবানো পান আমার আর আমার পিসির খুব প্রিয় ছিল । পান চাইলেই – মুখ থেকে চিবানো পান বের করে দিত – একটু লুকিয়ে । আমার মা’র ভয়ে । সে এক স্বর্গীয় স্বাদ । মা এই সব ন্যাকামি একদম পছন্দ করত না । পছন্দ করার কথাও নয় । যখন স্কুল বা হাইস্কুলে পড়ছি ঠাম্মার কাছে পান চাইলে নতন করে সেজে দিত । আমার একদম পছন্দ ছিল না সেই পান । বলতাম, তুমি চিবিয়ে মুখ থেকে একটু দাও । ঠাম্মা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যেত । তারপর বলত, কত রকমের রোগ আমার শরীরে বাসা বেঁধে আছে বাপু – ও কম্মটি আর করতে পারবো না । আজ বুঝি, সম্ভবত আমার মা ব্যাপারটা ঘেঁটে দিয়েছিল । একটু উচ্চ-রক্তচাপ ছাড়া ঠাম্মার আর কোনও রোগই ছিল না । এই উচ্চ-রক্তচাপের কথায় মনে পড়ল – ঠাম্মার একটা দ্বিপ্রাহরিক আড্ডা ছিল । দুপুর তিনটে থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যে পর্যন্ত চলত । এলাকার সব বৃদ্ধা এসে হাজির হত যথা সময়ে । বলা বাহুল্য ঠাম্মাই মধ্যমণি । একে তো আমাদের ছিল কোঠা বাড়ি । তার অপর ঠাম্মার কিছু অর্থ প্রাপ্তির উৎস ছিল । সবাই প্রায় নিরক্ষর এবং বিধবা । কেউ একজন একটা বিষয় অবতারণা করে শেষে যোগ করত, তুমি কি বল বিশের মা । আসরে সবার পরিচয় ছিল অমুকের মা । যার অনেক আগেই সন্তান মারা গেছে সেই সন্তানের নাম তার মার সঙ্গে জড়িয়ে এইভাবে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকত । তো ঠাম্মা খুব বিজ্ঞের মত একটা মতামত দিত । প্রশ্নকর্তৃ যারপরনাই সন্তুষ্ট হয়ে পাশে বসা বৃদ্ধাটিকে বলত, দেখলে তো পচার মা – আমি বলেছিলুম কিনা – যে বিশের মা এই কথাটাই বলবে । বৃদ্ধাদের মধ্যে প্রায় সবারই টুকটাক শরীর খারাপ লেগে থাকত । ঠাম্মা একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের মত সব শুনে সবার ক্ষেত্রে একটাই অসুখ ডায়গোনিসিস করত, হাই প্রেশার । এ জন্য ঠাম্মা বকাও খেত খুব । বিশেষ করে আমার সেজকাকার কাছ থেকে । ঠাম্মা নির্বিকার থাকত । ঝড় থেমে গেলে ঠাম্মা খুব নিরীহ মুখ করে বলত, কি জানি বাপু শুনে তো আমার হাই প্রেশারই মনে হল । সেজকাকা ছাড়ত না, তিন দিন ধরে লকা’র মা জলের মত বাহ্যে করছে – হাই প্রেশার – তোমার কথা শুনে নুন চিনি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে । আমরা আড়ালে হাসাহাসি করতাম । পরের দিন কারো হয়ত হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যাথা হয়েছে। ঠাম্মা গতকালের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে অই একই ডায়গোনিসিস করত , হাই প্রেশার ।
ওই আসরে আমারও মাঝে মাঝে ডাক পড়ত । মহাভারত পড়ে শোনানোর জন্য । তার জন্য ঠাম্মা আমায় ভালই তেল মারত ।আমিও দর দেখাতাম।তারপর বায়োস্কোপ দেখার পয়সা আদায় করে সুর করে করে ওই নিরক্ষর বৃদ্ধাদের মহাভারত পড়ে শোনাতাম । তখন আমি সম্ভবতঃ ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। আর জোরে জোরে বাংলা পড়ায় আমার বেশ সুনাম ছিল । খানিকটা পড়েই আমাকে থেমে যেতে হত । শুরু হত প্রায় নিরক্ষর জীবন অভিজ্ঞ এক ঝাঁক বৃদ্ধাদের মহাভারতের ব্যাখ্যা।এবং আমার মত এক শিশুর সামনে – আর শেষে , তুমি কি বল বিশের মা । সে ব্যাখ্যার কিছু কিছু এখনও আমার মনে আছে । যেমন দ্রোপদী সম্পর্কে, “কি মেয়েছেলে রে তুই – ভাশুরের সঙ্গে শুচ্ছিস আবার দেওরের সঙ্গেও – ছিঃ ছিঃ ছিঃ – তুমি যাই বল বিশের মা – এর চেয়ে সীতা আমাদের অনেক ভাল ।” ঠাম্মাও নিজের মত করে একটা উত্তর দিত । সে আজ আর মনে পড়ে না। তবে একটা জিনিষ আমি কোনও দিনও ভুলতে পারবো না । মহাকাব্যিক চরিত্রগুলো এই সব বৃদ্ধাদের কাছে কেমন মাটিতে নেমে আসত । তাদের চোখে দেখা মানুষদের সাথে কেমন করে যেন মিশে যেত যুধিষ্ঠির-অর্জুন-কর্ণ বা দুর্যোধনরা । বামুন পাড়ার সঙ্গে বাগদী পাড়ার দীর্ঘকালীন রেষারেষির সঙ্গে তারা কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধের মিল খুঁজে পেত ।
তখনকার গ্রাম জীবনে কিছু কিছু মানুষকে পয়মন্ত ধরা হত । উল্টোটাও ছিল । কারো কারো মুখ সকালে দেখলেই নাকি হাঁড়ি ফেটে যেত । অর্থাৎ ভাত জুটত না । তাদেরকে এড়িয়ে চলা হত।কোনও শুভকাজে যাবার আগে তাদের মুখ দেখা মানে কেলেংকারীর একশেষ । যাক সে কথা । আমার ঠাম্মার হাত নাকি ছিল খুব পয়মন্ত। যে গাছ পুঁততো সে গাছে ফল হবেই । ঠাম্মার এ ব্যাপারে অনেক ক্লায়েন্ট ছিল । তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুমড়ো বীজ। লাউ বীজ, চালকুমড়ো বীজ বা বেগুন চারা, লঙ্কা চারা ইত্যাদী পুঁতে দিতে হত । সেই গাছের প্রথম ফলটা অবশ্যই ঠাম্মার প্রাপ্য । এক এক করে এরকম অনেক ফসল জমে যেত । সেগুলো আবার ব্যাপারীরা কিনে নিয়ে যেত । আমাদের বাড়ির উঠোন জুড়ে ছিল একটা পিয়ারা গাছ ঠাম্মার পোঁতা ।সেই গাছে বারোমাস অজস্র পিয়ারা হত। গাছের গোড়া থেকে প্রতিটি ডালের আগা পর্যন্ত।আর স্বাদ এখনো আমার মুখে লেগে আছে।গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আর সন্তান-সম্ভবা মহিলাদের কাছে খুব প্রিয় ছিল সেই পিয়ারা।তাদের কাছে খুব গোপনে ঠাম্মা পিয়ারা বিক্রি করত।গোপন, কেননা বাবা কাকারা জানতে পারলে ঠাম্মাকে বকা খেতে হত । পরবর্তী কালে দেখেছি তারা দেখেও না দেখার ভান করত।তাদের টান পড়লে ঠাম্মার কাছে হাত পাতলে বিফল হত না।এবার নটে গাছের কথা বলি।সে এক অদ্ভূত গাছ।রাস্তা থেকে তুলে এনে ঠাম্মা চারাটা পুঁতেছিল বাড়ির উঠোনের একটা বিশেষ জায়গায়। ঠাম্মার গাছেদের পরিচর্যা নিয়ে কোনও কথা হবে না।প্রতিটি গাছ ছিল ঠাম্মার প্রাণ।দুবেলা জল দেওয়া ছাড়াও ভাতের ফ্যান ঠাণ্ডা করে গাছের গোড়ায় দেওয়া ছিল ঠাম্মার নিত্য কাজ।প্রতিটি গাছের সঙ্গে ঠাম্মা কথা বলত। একবার একটা কুমড়ো গাছের পাতায় পোকা ধরেছিল।তার পরিচর্যা করতে করতে ঠাম্মার চোখে জল দেখেছিলাম। উঠোনে গোটা দশেক লঙ্কা চারা, একটা লাউ গাছ, একটা কুমড়ো গাছ, দুটো জবা ফুলের গাছ আর ছিল কয়েকটা সন্ধ্যামালতী । এগুলো মোটামুটি সারা বছরই থাকতো।শুকিয়ে গেলে বা মরে গেলে ওই জায়গায় আবার নতুন চারা লাগানো হত। এছাড়া একটা বিশেষ জায়গা ছিল। রান্নাঘরের ঠিক পিছন দিকে। সেখানে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারা লাগানো হত। একবার ঠাম্মা পুঁতেছিল লাল বরবটির গাছ।তাকে তোলা হয়েছিল রান্নাঘরের টালির চালে।তাতে এত বরবটি হয়েছিল যে রান্নাঘর ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম।সারা গ্রামকে বিলিয়েও শেষ করা যেত না।শেষে ফলন্ত অবস্থায় কেটে দেওয়া হয়েছিল। তার শোকে ঠাম্মা দুদিন খাওয়া দাওয়া করেনি ।তার শোক একটু ফিকে হতেই আবার মাটি তৈরি করে সেখানে লাগানো হল কুলি বেগুন চারা।দুতিন মাসের মধ্যে তার বাড়-বাড়ন্ত এত হল যে রান্নাঘরের চাল ছোঁবার উপক্রম।কিছুদিন পর তাতে ফললো থোকা থোকা কুলি বেগুন। সে এক দেখার মত ব্যাপার।দূর দূরান্ত থেকে লোক আসতো দেখতে।আমি একবার বেগুনগুলো গোনার চেষ্টা করেছিলাম।চারশ মত গোনার পর ঠাম্মার বকা খেয়েছিলাম। গুনলে নাকি বাড় কমে যায়।গ্রামের প্রায় সবাই ওই গাছের রা নেবার আবদার করেছিল ঠাম্মার কাছে। যদিও ঠাম্মা চারা যোগাড় করত নর্দমার ধার বা বন-বাদার থেকে।সবাই যখন ঠাম্মার হাতযশের প্রশংসা করত – ঠাম্মার মুখে একটা গর্বের হাসি ফুটে উঠতো।সেই মুখ আজও আমার মনে আচ্ছে।বেগুন পর্ব শেষ হলে আবার মাটি তৈরি করে লাগানো হল নটে শাকের চারাটিকে।
এখন জাপানী বীজের কল্যাণে বিভিন্ন ধরনের নটে শাক দেখতে পাওয়া যায় । আমাদের সেই সময়েও নটে শাকের অনেক বিভিন্নতা ছিল । কঙ্কা নটে, গয়লা নটে, ডেঁয়ো নটে, লাল নটে, কাটোয়া নটে ইত্যাদি । কেউ তার শাকের জন্য বিখ্যাত কেউ আবার তার ডাঁটার(ডাল) জন্য । ঠাম্মার পোঁতা নটে গাছটির সঙ্গে উপরোক্ত কোনো নটে গাছের মিল ছিল না । আমাদের বাড়ির সদর দরজার পাশে একটা জলা জায়গায় খুব হেলেফেলায় চারাটি জন্মেছিল । ঠাম্মা সেখান থেকে তুলে উঠোনের সেই জায়গাটিতে চারাটিকে সযত্নে পুঁতে দেয় । চারাটি একটু ধরে যাওয়ার পর শুরু হল ম্যাজিক । গাছটি বাড়তে লাগলো নিজের ঐতিহ্য ভেঙ্গে। কদিনের মধ্যেই রান্নাঘরের চাল ছাড়িয়ে পিয়ারা গাছকে ধরে ফেলে আর কি।শুধু দৈর্ঘে নয় প্রস্থেও। নটে শাক সাধারণত গোড়া শুদ্ধু তুলে খাওয়া হয়।এর গোড়াটাই হয়ে গেল একটা কলা গাছের মত।মুখে মুখে সেই বার্তা রটে গেল ক্রমে।গ্রামের সবাই আসতে লাগলো গাছটিকে দেখতে।কোনো বিষ গাছ নয়তো।গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলল, কোনো পাখির মল থেকে বীজটা এসেছে এবং সেই পাখিটি নিশ্চিত আফ্রিকা থেকে উড়ে এসেছে।পরিযায়ী পাখিরা আমাদের গ্রামের আকাশ দিয়ে উড়ে যেত বামনমারির ঝিলে । পরে জেনেছি তারা আসত সাইবেরিয়া থেকে।আফ্রিকার কথাটা কেন এসেছিল জানিনা। সম্ভবতঃ আফ্রিকার অরণ্যের অজানা রহস্যই এর উৎস।ঠাম্মা একদিন সিদ্ধান্ত নিল যে গাছটির একটা ছোট ডাল কেটে রান্না করা হবে।হৈ হৈ পড়ে গেল।প্রায় সবাই বারণ করল।তবে তা জোরদার নয়।গাছটির তেজী পাতাগুলোর একটু হাল্কা লাল রঙের সঙ্গে সবুজের মিশ্রনে বেশ একটা আকর্ষণ ছিল।অনেকেরই চেখে দেখার লোভ ছিল। ঠাম্মা একদিন একটা ছোট ডাল ভেঙ্গে কেটেকুটে মাকে বলল রান্না করতে।মা রাজী হল না। ঠাম্মা বলল, ঠিক আছে তোমার হেঁসেল হলে বোলো – আমি নিজে রাঁধব। ঠাম্মা রেঁধেছিল খুব অল্প।যখন খেতে বসল তখন বাড়ির লোকেরা তো বটেই ঠাম্মার স্তাবকবাহিনীর সবাই ঠাম্মার পাত ঘেঁসে বসা।ঠাম্মা কুলগুরুকে উৎসর্গ করে প্রথমেই মুখে দিল সেই শাক ভাজা।সবাই আমরা ঠাম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে। ঠাম্মার মুখে একটা তৃপ্তির হাসি। সবাই উৎকণ্ঠিত, কি রকম বুঝলে। ঠাম্মা ভাত দিয়ে মেখে খেয়েই যাচ্ছে।লকা’র মা বলে উঠল, ও বিশের মা-আরে খালাস কর না-কেমন বুঝলে।বেশ নাটকীয় ব্যাপার। ঠাম্মা নাটকের শেষ অঙ্কে পৌঁছে – খাওয়া শেষ করে পিয়ারা তলায় মুখ কুলকুচি করে- বেশ জম্পেশ করে আঁচল দিয়ে মুখ মুছে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।তারপর দরজা সামান্য ফাঁক করে প্রতিক্ষীয়মান জনতাকে জানাল, কাল সব খোঁজ নিও মরলুম কিনা।ব্যাস ট্রাজেডি নাটকের যবনিকা পড়ে গেল । এবার শুরু হল অন্য নাটক।ঠাম্মা বেশ শব্দ করেই খিল তুলে দিল। ঠাম্মা ওই ‘মরলুম’ শব্দটা আলোচনার বিষয় হয়ে গেল।লকা’র মা চিৎকার করে কেঁদে উঠল।মা তাকে একটা বড় রকমের ধাতানি দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলল। তারপর বলল, আমিও খেয়ে দেখেছি – খারাপ নয়- ওটা নটে শাকই। আবার আলোচনা ঘুরে গেল। এবার কেন্দ্রে মা।মা আবার ধাতানি দিয়ে বলল, নীচের ডালগুলো তো রোজ ছাগলে মুড়োচ্ছে- তারা তো বেশ বেঁচেবর্তে আছে – যান সবাই বাড়ি চলে যান- কিস্যু হবে না- বরং কাল সবাই একটা করে ডাল বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাঁধবেন – বেশ ভাল স্বাদ।
কিছুদিনের মধ্যেই গাছটির নীচের দিকের ডালগুলো ফাঁকা হয়ে গেল।দ্বিপ্রাহরিক আড্ডায় নটে গাছটিই মূল আলোচনার বিষয়।কে কে কেমন করে রেঁধেছে এবং সবাই খেয়ে কি বলেছে সেই সব গল্প ঠাম্মা বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে লাগলো।গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে নটে গাছটি বেশ জায়গা করে নিল।গাছটির যে ডালগুলো ভাঙ্গা হত , সেখানে আবার নতুন ডাল জন্মাত। সেই কচি ডালগুলোর ডগা মা বিউলির ডালে ছেড়ে দিত আর তার স্বাদ আজও আমার মুখে লেগে আছে।গাছটির যখন বছর তিনেক বয়স সেই সময় গ্রামের একজন উৎসাহী ভ্রমণার্থী ঠাম্মার দ্বিপ্রাহরিক সভার প্রায় সব বৃদ্ধাদের নিয়ে কাশীধাম বেড়াতে গেলেন।সেই সময় বাড়ির উঠোনের গাছগুলির জল দেওয়ার ভার স্বাভাবিক ভাবে মা’র উপরই বর্তায়।কিছুদিন বাদে লক্ষ্য করা গেল নটে গাছটি কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে।সেই তেজী ভাব আর নেই।সেদিনই জানা গেল, যে মাতব্বর এক ঝাঁক বৃদ্ধাদের কাশীধাম নিয়ে গেছলেন, তিনি ঐ বৃদ্ধাদের ওখানে ফেলে পালিয়ে গেছেন।খুব করুণ অবস্থা। প্রায় অনাহারে দিন কাটাচ্ছে অতগুলো অসহায় বৃদ্ধা।আমার মেজকাকা বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে কইয়ে বইয়ে।মেজকাকা আরও কজন লোক ধরে সবাই মিলে ছুটলো কাশী।গাছটি আরও শুকিয়ে যেতে লাগলো। মা’র যত্নের কোনও ত্রুটি ছিল না – তবুও।বেশ কিছুদিন পর মেজকাকা ঠাম্মাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এল।সঙ্গে সঙ্গে বর্ষাও শুরু হয়ে গেল। নটে গাছটিও বর্ষার জল পেয়ে কদিনের মধ্যে আবার সতেজ হয়ে উথল।তখনও আমরা নটে গাছটির সঙ্গে ঠাম্মার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা মনের মধ্যে স্থান দিই নি।তেমন কারণও ছিল না।এরপর আরও বছর খানেক কেটে গেল।নটে গাছটির আরও কলেবর বৃদ্ধি হয়েছে।মেজকাকার এক অফিস কলিগের ছেলে সদ্য বোটানী নিয়ে মাষ্টার ডিগ্রী পাশ করেছে। তখন সে গবেষণা করছে।সে একদিন এসে গাছটির কয়েকটা ছবি আর একটা শিশিতে মাটির নমুনা নিয়ে গেল।গাছটির কি একটা ল্যাটিন নাম বলেছিল। সম্ভবতঃ অ্যামারানথাসিয়া । তবে গোদা বাংলায় যা বলেছিল, সাধারণ ভারতীয় নটে গাছ – মাটিটা খুবই এবং সার যুক্ত, তাই এত বাড় বাড়ন্ত। আমি বেশ মুষড়ে পড়েছিলাম।তখনকার বয়সে সব কিছুকেই তুচ্ছ মনে হত।এ ব্যাপারেও মনে হয়েছিল, ও ব্যাটা কিচ্ছু জানে না।ঠাম্মার দ্বিপ্রাহরিক আড্ডারও এটাই সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।
এর কিছুদিন পর একটা কালবৈশাখী ঝড় হল।প্রচণ্ড তার দাপট। এখন হলে বোঝা যেত, গতিবেগ কত বা উৎসস্থল কোথায়।স্বাভাবিক চৈত্র মাসের শেষ দিকের ঝড়।ঠাম্মার শরীরটা কদিন যাবৎ খারাপ যাচ্ছিল।ঠাম্মা অবশ্য বেশ নিশ্চিন্তে ছিল, ও একটু হাইপ্রেসার – নুনটা না খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।রাত দশটা নাগাদ ঠাম্মার শরীরটা খারাপের দিকে গেল। চোখ উল্টে মুখে গাঁজলা বেরিয়ে ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল।ঝড় জলের মধ্যে মাইল পাঁচেক দূরে একজন ডাক্তারবাবুকে ডাকতে মেজকাকা বেরিয়ে গেল।রাত দুটো নাগাদ ফিরে এল- কটা পুরিয়া নিয়ে।ডাক্তারবাবু কাল সকালের আগে আসতে পারবেন না – পুরিয়াগুলো খাওয়াতে বলেছেন। চামচে জল দিয়ে ওষুধ মিশিয়ে বার দুয়েক দেওয়া হল।সকালে দেখা গেল নটে গাছটিকে যেন মুড়িয়ে ভেঙ্গে দিয়ে গেছে।সকালে ডাক্তারবাবু বললেন, স্ট্রোক- সেরিব্রাল।হাসপাতাল ছাড়া গতি নেই।হাসপাতালে ঠাম্মা আরও দিন সাতেক বেঁচেছিল।এরমধ্যে ভাঙ্গা নটে গাছটার কয়েকটা ডাল বাড়িতে রেখে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের বাড়িতে মা আর ঐ শাক রান্না করেনি।ঠাম্মা মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গেই অবশিষ্ট গাছটা সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেল। মা অনেক পরিচর্যা করা সত্বেও গাছটাকে বাঁচানো গেল না।ঠাম্মার শ্রাদ্ধ শান্তি উপলক্ষে উঠোন পরিষ্কার করার ব্যাপার ছিল।শুকনো নটে গাছটাকে যখন সমূলে তোলা হচ্ছে, মা ডুকরে কেঁদে উঠেছিল।
আমি এখনও মাঝে মাঝে দেশের বাড়ি যাই।বাড়িটার আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে । যেখানে নটে গাছটা ছিল সেখানে এখন চানঘর।কিন্তু আমার চোখে ভেসে ওঠে সেই অদ্ভূত নটে গাছ আর তার লালচে সবুজ পাতাগুলো যেন আমার দিকে চেয়ে হাসছে। আমি জানি আমার ছোটবেলার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পাতা চাপা পড়ে আছে ওই চানঘরটির নীচে।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।