১)
ভাষা দেখিয়া বিষম খাইবেন না যেন। যে কাহিনী বলিতে যাইতেছি তাহার পরিপূর্ণ উপস্থাপন এবং যথার্থ রসাস্বাদন মনে করি এইরূপ ভাষাভঙ্গিই দাবী করিয়া থাকে। গৌরচন্দ্রিকা সংক্ষিপ্ত করিয়া মূল বক্তব্যে আসি। কাহিনী বেশ দীর্ঘ।
কয়েকদিন পূর্বের কথা। আমাদের আখ্যানের পার্শ্বনায়ক মতিলালের সেইদিন বাস্তবিক মতিভ্রম হইয়াছিল। তাহার বয়স স্বল্প, ত্রিশ স্পর্শ করিতে বিলম্ব আছে। তথাপি তাহার সাময়িক মতিনাশ হইল। কেন হইল, হয়ত ভগবান জানিবেন।
সেইদিন মতিলালের গৃহের দলিল সংক্রান্ত কি এক প্রয়োজনে আদালতে যাইবার কথা। আদালতে বলিতে আদালত চত্বরে উপস্থিত এক উকিলের কাছে। খুব যে দরকার এমন নহে, কিন্তু মতিলাল কাজ ফেলিয়া রাখিতে চাহে না। তাই সেইদিন আবহবিজ্ঞানীগণপ্রদত্ত প্রবল বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস এবং তদানুসারী মেঘমেদুর আকাশপটের নিরবচ্ছিন্ন ধূসরতাকে অগ্রাহ্য করিয়া সে বাড়ির বাহির হইয়াছিল। ছাতা সঙ্গে লইতে ভুলিল। খানিক দূর আগাইবার পশ্চাৎ ছাতা আনিবার কথা মনে পড়িলেও সে আর ঘরে ফিরিল না। মতিভ্রমের সূত্রপাত এখানেই।
আদালতের দূরত্ব মতিলালের আবাস হইতে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার। ত্রিশ কিলোমিটার ট্রেনযাত্রার পরে মতিলাল একটি রাসায়নিক তড়িৎকোষউদ্ভুত তড়িচ্চালিত পাঁচটি চাকাবিশিষ্ট শকটে, যাহাকে চলিতভাষায় ‘টোটো’ বলা হইয়া থাকে, চাপিয়া বসিল। ইহাই তাহাকে গন্তব্যে পৌঁছাইয়া দিবে। বলিয়া রাখি, গাড়িটিতে পূর্ব হইতেই দুইজন যাত্রী উপস্থিত ছিল যাহাদের ভিতর একজন আবার তরুণী বটে।
এইবার সূচনা হইল মতিচ্ছন্নতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের। সেশকটেউঠিয়াইবলিয়াবসিল, ‘ঘাট’ অর্থাৎ সে ঘাটে যাইতে চাহে। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই জানিয়া ফেলিয়াছি যে মতিলাল আজ আদালত যাইবার অভিপ্রায়ে ঘরের বাহির হইয়াছে। শকটের চালক তো তাহা জানেন না, তিনি ‘ঘাট’ শুনিয়া সম্মতিভরে মস্তক নাড়াইয়া গাড়ি চালাইয়া দিলেন। গাড়িখানাও দুলকি চালে শহরতলির রাস্তা ধরিয়া সম্মুখে চলিতে লাগিল। বাহিরে তখন ইলশেগুঁড়ি আরম্ভ হইয়াছে।
যে অঞ্চল দিয়া মতিলালের গাড়িখানি যাইতেছিল তাহা শহরের সমীপবর্তী হইলেও সেটিকে পুরোদস্তুর ‘শহর’ বলা চলে না। এখানে প্রকৃতির এখনও শ্বাস চলিতেছে। সে মরে নাই। তাই রাস্তায় সবুজ বৃক্ষলতা আর কৃষ্ণকায় বনচ্ছায়ার অভাব নাই। মধ্যে মধ্যে কয়েকটি পাকাবাড়িও চোখে পড়িয়া থাকে। এইসবের ভিতর দিয়াই আঁকাবাঁকা পথ। যাইতে মন্দ লাগে না। তা যাহাই হউক, বিদ্যুতের ঝলকের ন্যায় সহসা মতিলালের মনে পড়িল, সে ‘ঘাট’ বলিল কেন? সে তো আদালত যাইবে! কথাটা মনে আসিতেই মতিলাল একবার ভাবিল, চালককে জিজ্ঞাসা করিবে যে সে তাহাকে আদালতে লইয়া যাইতে পারে কি না , কিন্তু পরক্ষণেই মতিভ্রম ফিরিয়া আসিল। মতিলাল স্থির করিল, দরকার নাই। এমন করিলে সঙ্গের যাত্রীরা কি ভাবিবে! তাছাড়া সেই মেয়েটিও তাহাকে বিলক্ষণ পাগল ভাবিবে। না, এ ঠিক নহে। তাহার চাইতে ঘাটে পৌঁছিয়া বরং অন্য গাড়ি ধরিয়া বিপরীত পথে আদালতে আসা যাইবে। কিঞ্চিৎ অর্থনাশ হইবে , কিন্তু সম্মান বাঁচিবে।সেইটি বড় কথা। সুতরাং,মতিলাল নিশ্চুপই রহিল। তাহার যে সত্যই সেদিন কতখানি মগজবিভ্রম হইয়াছিল এতক্ষণে পাঠক নিঃসন্দেহে তাহা বুঝিয়াছেন।
ঘাটের নাম করিয়া গাড়ির চালক মতিলালকে যে স্থানে নামাইল তাহার ত্রিসীমানায় কোথাও ঘাটের একটি সোপান অবধি মতিলালের চোখে পড়িল না। সে চালককে কিছু জিজ্ঞাসাও করিল না।কারণ, মেয়েটি এবং বাকীরা কি ভাবিবে ইত্যাদি। সে নিরুত্তাপ মুখে ভাড়া মিটাইয়া দিল। গাড়ি চলিয়া গেল।
২)
গাড়িটি রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হইবার পরে মতিলালের মনে হইল, এইবারে আদালতে যাইবার গাড়ি ধরিতে হইবে। আসলে মতিলাল ইহার আগেও এই স্থানে প্রয়োজনমাফিক কয়েকবার আসিয়াছে, প্রতিবারই নির্দিষ্ট পথে তাহার কার্য সমাধা করিয়াই পূর্ববর্তী মার্গ অনুসরণ করিয়া স্বগৃহে ফিরিয়া গিয়াছে। সুতরাং, একেবারে অচেনা না হইলেও এই অঞ্চলের সম্পূর্ণ অংশের পরিচয় মতিলাল এখনও পায় নাই। তথাপি ঘাট আর আদালতের মত দুইটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের মধ্যে অন্তত একটি যোগাযোগের মাধ্যম থাকিতে বাধ্য। অতঃপর মতিলাল গাড়ির অপেক্ষা করিতে লাগিল। দশ মিনিট অতিক্রান্ত হইল, একটিও গাড়ি আসিল না। মতিলাল চিন্তিত ও বিরক্ত হইল। এদিকে কি তবে গাড়ি মেলে না? ঘাটখানাই বা কোথায়? কাছেই হইবে কিন্তু একটা দিঙনির্দেশ তো লাগিবেই।এদিকে দূরে মেঘ গুড়গুড় করিতেছে। এখন নাই ঠিকই, কিন্তু যে কোন সময় পুনরায় বৃষ্টি নামিতে পারে।ছাতাটাও সঙ্গে আনা হয় নাই। না,কাউকে জিজ্ঞাসা করিতে হইবে। মতিলাল এদিক-ওদিক দেখিতে লাগিল। কাউকে দেখতে পাইল না। কাছাকাছি কোন লোকালয় নাই। কেবল অগভীর জঙ্গল, পাকা সড়ক আর পরিত্যক্ত কয়েকটি লাল ইষ্টকের বাড়ি।সেখানে নিশ্চই লোক থাকে না।
‘কাউকে খুঁজিতেছেন নাকি?’
পশ্চাৎ হইতে একটি অপরিচিত এবং সামান্য সরু কণ্ঠস্বর আচম্বিতে শুনিয়া মতিলাল সাময়িকভাবে অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু প্রশ্নকর্তার দিকে ভালো করিয়া তাকাইতেই সে পুনরায় স্বাভাবিক হইল। সাধারণ একজন প্রৌঢ়মাত্র। মাঝারি উচ্চতা, অস্বাভাবিক শীর্ণ দেহ,গাত্রবর্ণ নিশীথের অন্ধকারের ন্যায়। মলিন ফতুয়া এবং ততোধিক মলিনতর একখানি ধুতি পরনে। মাথায় সামান্য যে কয়টি চুল অবশিষ্ট রহিয়াছে সেগুলির সবক’টিই সাদা। চোখে চশমা, উজ্জ্বল চোখজোড়ায় এক ধূর্তপ্রকৃতির চাহনি। রাস্তার সহিত কিঞ্চিৎ বঙ্কিমভাবে ঝুঁকিয়া তিনি সটান তাকাইয়া আছেন আমাদের মতিলালের দিকেই।
‘কিছু বলিলেন না যে? কাউকে খুঁজিতেছেন?’
এইবারে উত্তর দিল মতিলাল। বলিল, ‘না… কাউকে খুঁজিতেছি না। আমি আসলে আদালতে যাইব।আপনি বলিতে পারেন, আদালতে যাইবার গাড়ি কোথা হইতে পাইব?’
লোকটি ভালো করিয়া নিরীক্ষণ করিল মতিলাল্কে। কিছুক্ষণ পরে বলিল, ‘আপনি তো বিপরীত পথে আসিয়াছেন দেখিতেছি। যাহাই হউক, আদালতের গাড়ি খান দিয়া যায় না। তবে ঘাট হইতে কিছু আদালতগামী গাড়ি পাওয়া যায় বটে।’
— ‘ও। তা… ঘাটটা ঠিক কোন দিকে পড়িবে?’
— ‘কাছেই। এই বামদিক ধরিয়া গেলে… আচ্ছা, আপনি আসুন আমার সঙ্গে। আমি ওইদিকেই যাইতেছি। আসুন।’
মতিলাল বয়স্কব্যক্তিটির পশ্চাদ্গমন করিল।
দৈবসংযোগ বলিয়া একটি বিষয় আছে। যাহাদের সাথে ঘটিয়াছে তাহারাই ইহার মর্ম বুঝিবেন এবং এরকমটা যে হইয়া থাকে, একমাত্র তাহারাই স্বীকার করিবেন। মতিলালের কপালেও সেইদিন এইরূপ একটি দৈবসংযোগ ঘটিয়া গেল। সে যেই ওই লোকটির সাথে যাত্রারম্ভ করিল সহসা আকাশের কোন এক কোণ হইতে একটি নধর কালো মেঘ উড়িয়া আসিল। চতুর্দিক একনিমেষে গভীরতর ছায়াচ্ছন্ন হইল। দুই-এক মিনিটের ভিতর একখানি দমকা হাওয়া উঠিল, এবং তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নামিল সজোর বৃষ্টি। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটিল যে মতিলাল কিছু বুঝিতেই পারিল না। সে হাঁটিতেই লাগিল।
সঙ্গের সেই বয়স্ক ব্যক্তিটি হাঁটিবার গতি বাড়াইয়া কয়েক-পা সম্মুখবর্তী একটি পোড়ো দালানে উঠিয়া আশ্রয় লইলেন। মতিলাল এখানেও তাঁহাকে অনুসরণ করিল। আজ তাহার নিজস্ব বিচারবুদ্ধি সব যেন কেহ তাহার মগজের প্রকোষ্ঠ হইতে ব্লটিং পেপার দিয়া শুষিয়া লইয়াছে। নিজে সে কিছুই করিতেছে না।
দালানটি পোড়ো বটে তবে বেশ বড়। বিশাল দোতলা বাড়ি একটি। পাশে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ঘন আগাছার জঙ্গল জমিয়া গিয়াছে। জঙ্গলের ভিতর আরেকটি একতলা ছোট ঘর দেখা যাইতেছে। সেটির অবস্থাও সঙ্গিন। এই বাড়ির সদর দরজার একটিমাত্র পাল্লা বর্তমান। উপরের জানালাগুলির অধিকাংশই বন্ধ, কেবল একটি জানালার অর্ধেক খোলা। হয়ত হাওয়ার দাপটে খুলিয়া থাকিবে। দেওয়ালের রঙ চটিয়া গিয়া স্থানে স্থানে শৈবাল আর নোনা ধরিয়া গিয়াছে। আলিশায় কতিপয় বট-অশ্বত্থের চারা সবুজ কৈশোরপ্রাপ্ত হইয়াছে। দোতলার বারান্দার একটি কোণের দিকের অংশ ধসিয়াও পড়িয়াছে। একবার বাড়িটিকে দেখিলেই বোঝা যায় যে এখানে বহুদিন কেউ থাকে নাই। কিন্তু আজ এই বৃষ্টির হাত হইতে ইহাই মতিলালদের বাঁচাইয়া দিল। কোনকালে সম্বিৎ ফিরিলে মতিলাল হয়ত ইহার কাছে কৃতজ্ঞতা মানিয়া লইবে।
মতিলাল বারান্দায় দাঁড়াইয়া এদিক-ওদিক তাকাইতে লাগিল। একসময় অন্য লোকটির সহিত তাহার চোখাচোখি হইয়া গেল। লোকটি বিবর্ণ দন্তরাশি উন্মুক্ত করিয়া একটি নিঃশব্দ হাসি হাসিয়া বলিল, ‘এইটি কিন্তু খুব প্রাচীন বাড়ি। এই এলাকার সবচেয়ে পুরাতন। ইংরেজ আমলে তৈরী। ‘
মতিলাল একটু তাল দিবার মত করিয়া কহিল, ‘তাই নাকি? তাহলে এ তো ঐতিহাসিক বাড়ি মশায়!’
লোকটি একটু ভাবিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ, তা ঐতিহাসিক বলা চলে। তবে সেটা নিতান্ত এই বাড়ির নিজস্ব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ইহা কিন্তু কিছুমাত্র রেখাপাত করে নাই।‘ একটু থামিয়া ফের লোকটি বলিল, ‘খুব বিচিত্র এর কাহিনী। আপনার হাতে সময় থাকিলে আমার শোনাইতে কোন আপত্তি নাই।’
মতিলাল একবার বাইরে চাহিল। সবেগে বৃষ্টি পড়িতেছে। মেঘের ঘনঘন চাপা গর্জনও কানে আসিতেছে। বাদলার শীতল হাওয়া চারপাশে দাপাইয়া বেড়াইতেছে। এই পরিস্থিতিতে খুব শীঘ্র বাহিরে যাইবার কোন আশা নাই। অন্ধকারে গোমড়ামুখে বসিয়া বিরস কালহরণ অপেক্ষা অপরিচিত পরিবেশে অপরিচিত এক ব্যক্তির নিকট অশ্রুত ইতিহাসের মলিন পৃষ্ঠা হইতে ধূলা ঝাড়িয়া জাগিয়া ওঠা আখ্যানের শ্রবণ মতিলালের কাছে অধিক মনোগ্রাহী বোধ হইল। সে বলিল, ‘বলুন না! সময়ের অভাব কি? বাইরের যা দশা …’ লোকটিও সুযোগ পাইয়া যেন খুশি হইল। পুনরায় হাসিয়া কহিল, ‘বেশ।জলের ছাঁট আসিতেছে। ভিতরে আসুন। বসিয়া গল্প করা যাউক।’ মতিলাল রাজী হইল। দু’জনে অরক্ষিত দরজা দিয়া গৃহে অনুপ্রবেশ করিল।
৩)
ঘরের ভিতর দরজাপ্রবিষ্ঠ বহিরালোক স্বল্প এবং ক্ষীণ। প্রায় কিছুই দেখা চলে না। সেই আবছায়ার রাজত্বেই দুইজনে স্যাঁতস্যাঁতে মেঝের উপরে বসিয়া পড়িল। মতিলালের মনে কোন ভয়-ভাবনার লেশমাত্র নাই। তাহার পরিবর্তে সে বাদলার এই রহস্যঘন পরিবেশে বেশ অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী শুনিবার পুলক অনুভব করিতেছে। সেই ছোটবেলার ন্যায়।
লোকটি বসিয়া পড়িয়া একবার সামান্য গলা ঝাড়িল তারপর ফতুয়ার পকেট হইতে একটি বিড়ি বাহির করিয়া সেটিকে নিজেরই অপর পকেটস্থ দিয়াশলাই প্রজ্বলিত করিয়া ধরাইয়া লইল। দিয়াশলাইয়ের স্বল্পস্থায়ী প্রভায় ঘরটির সুদীর্ঘ সময়কালের নিকষ অন্ধকারের অবগুণ্ঠনে কিঞ্চিৎ টান পড়িল মাত্র। আগুন নিভিতেই সেই কক্ষের এক আঁধারচারিণী সখী আসিয়া দ্রুত এবং নিপুণ হস্তে যেন পুনরায় সেই অন্তরাল টানটান করিয়া বহাল করিয়া দিল। লোকটির ঠোঁটস্থ বিড়ির আগুন ঘরখানায় জোনাকির ন্যায় জ্বলিতে লাগিল।
গলা ঝাড়িয়া গল্প শুরু করিল লোকটি, ‘এই গল্প আমি আমার ঠাকুরদার কাছে শুনিয়াছিলাম। তিনি কোথা হইতে শুনিয়াছিলেন তাহা জানি না। সে আজ থেকে দ্বিশত বৎসর আগের কথা। এইসব এলাকায় তখন ইংরেজ ঘুরিত। বাঙালি ধুতি পড়িত, মাথায় সরিষার তৈল লাগাইত এবং সুযোগ ঘটিলেই যাত্রা, পালাগান এইসব শুনিত।অফিসযাত্রী কেরানীশ্রেণীটি তখনও গড়িয়া ওঠে নাই।সে যাহাই হউক, এই যে বাড়িতে আমরা এখন বসিয়া আছি, এখানে এক ডাক্তার থাকিতেন। সেই সময় এটি একটি সুসজ্জিত বাগানবাড়ি ছিল। ডাক্তার বিলাত-ফেরত ছিলেন। কাজেই পসার ছিল সাংঘাতিক। তাঁহার পিতৃকুল সব জলপথে কাষ্ঠ আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করিয়া এবং ইংরেজদের সহিত সদ্ভাব রাখিয়া বেশ পয়সা করিয়াছিল। তাহার সামান্য দিয়াই এই বাড়ি।তাঁহারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। তবে যে সময়ের এই গল্প, তখন এই বাড়িতে সেই ডাক্তার একাই বাস করিত এক ভৃত্যের সহিত। এই বাড়ির পিছন দিকে যদি আপনি যান তাহা হইলে একখানি চওড়া নালা আপনার চোখে পড়িবে।এখন সেটি প্রায় শুকনো, অব্যবহারে অনেকখানি ভরাট হইয়া গিয়াছে। কিন্তু ঠাকুরদা বলিতেন, পূর্বে বর্ষা যৌবনপ্রাপ্তা হইলে সেটি একপ্রকার খালে রূপান্ত্রিত হইত।এই খালটি দিয়া নাকি সোজা অনতিদূরবর্তী গঙ্গায় পৌঁছানো যায়। সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে ডাক্তারের আমল পর্যন্ত নাকি এই খাল দিয়া এই বাড়ির সদস্যগণ নৌকা করিয়া যাতায়াত করিত।ভগ্নদশাপ্রাপ্ত একখানি জরাজীর্ণ তিনসিঁড়ির ঘাট নালার একপাশে জঙ্গলে ঢাকা অবস্থায় কিন্তু সত্য-সত্যই পড়িয়া আছে। গেলেই দেখিতে পাইবেন। এটি নিশ্চই কাষ্ঠ ব্যবসায় সুবিধার্থে ডাক্তারের পূর্বজগণ নিজস্ব কার্যের জন্য তৈয়ারি করাইয়াছিলেন এবং নিয়মিত ব্যবহারও করিতেন বিলক্ষণ।
তো কম বয়সেই ডাক্তারের সুনাম ছড়াইয়া গেল। বহু দূর থেকে রোগীরা তাকে দেখাইতে আসিত। অনেকসময় অন্য জেলার লোকও আসিয়া পড়িত। সরেস আর নিরুপায় রোগী হইলে ডাক্তারের ডাক পড়িত। তখন তিনি রাতবিরেতে নৌকা চাপিয়া এই খাল বাহিয়া রোগী দেখিতে ছুটিতেন। কখনও আবার রোগীর বাড়ি হইতে গরু বা ঘোড়ার গাড়ি আসিত। ডাক্তার চিকিৎসা করিতেন দারুণ অথচ পয়সাও খুব বেশি লইতেন না। ইহাতে তাঁহার খ্যাতি যে আরও অধিক বাড়িয়াছিল তাহাতে বিশেষ কোন সন্দেহ নাই। ডাক্তারের সামান্য সুরাপানের নেশা বাদে আর কোন বদখেয়াল ছিল না। সন্ধ্যের দিকে মাঝেমধ্যে তিনি সামান্য মদ্যপান করিতেন। কিন্তু তাহাকে কোনভাবেই মাতাল বলা যাইবে না। “সুরাপ্রেমী” বলা চলিতে পারে।
তখন ডাক্তারের বয়স আপনার মতই হইবে, একবার তিনি ডাক পাইয়া দক্ষিণের দিকে এক ছোট জমিদারবংশের বাড়ি গেলেন রোগী দেখিতে।জমিদারী যে বিরাট তাহা নহে, কিন্তু নিতান্ত তুচ্ছও নয়। গভীর রাত্রে ঘোড়ার গাড়ি চাপিয়া ডাক্তার সেই বাড়িতে পৌঁছাইলেন। রোগী স্বয়ং জমিদারের স্ত্রী, বয়স বড়জোর ত্রিশ-বত্রিশ হইবে। জলবসন্তের বাড়াবাড়ি হইয়াছে। অনেক রাত্রে বাড়ির কর্তা আর সেজ-হাতে জনা দুই ভৃত্যের সহিত ডাক্তার রোগীর ঘরে ঢুকিলেন।নাড়ি দেখিয়া ডাক্তার বুঝিলেন, এই রোগীকে বাঁচানো মুশকিল। বেশ হতাশ হইলেন। তাওনিয়মমাফিক একবার রোগীকে পর্যবেক্ষণের নিমিত্ত তাহার মুখের চাদর সরাইলেন। রোগীকে দেখিয়া তাহার মনের ভাব বদলাইয়া গেল। তাহার সঠিক মনের অবস্থা কহিতে পারিব না, তবে ডাক্তার মনে মনে পণ করিলেন যে যেমন করিয়াই হউক, ইহাকে তিনি বাঁচাইয়াই শান্ত হইবেন নচেৎ ডাক্তারি আর করিবেন না।
ইহার পরে টানা তেরো দিন ডাক্তার ওই জমিদার বাড়িতে রহিয়া রোগীর চিকিৎসা করিলেন। স্বয়ং জমিদার মহাশয়ও পূর্ণ সহায়তা করিলেন। ডাক্তারের অধ্যবসায়ের কাছে যমরাজ নত হইলেন কিন্তু পরাভব মানিলেন না। স্ত্রী যখন প্রায় সুস্থ হইয়াছেন তখন স্বামী জলবসন্তে শয্যাগত হইলেন। ডাক্তারের কোন প্রচেষ্টাই আর সফল হইল না। সাতদিনের মাথায় জমিদার ইহলোক পরিত্যাগ করিলেন। ডাক্তার মৃত্যুর সহিত ১-১ ফল করিয়া ঘরে ফিরিলেন।
ঘরে ফিরিলেও ডাক্তারের মন থেকে সেই জমিদারের স্ত্রীর মুখচ্ছবি বিদায় লইল না। সেই রাত্রে সেজের আলোয় অসংখ্য জলকণিকাকীর্ণ যে গোলাপটি তিনি দেখিয়াছিলেন, তাহার অনির্বচনীয় সৌরভ সমস্ত দিনের সমস্ত কাজে যেন তাহাকে ঘিরিয়া থাকিত। কেমন করিয়া ফের তাহার সাক্ষাৎ পাওয়া যাইবে, তাহার কাছে যাওয়া যাইবে এই চিন্তা ডাক্তারকে তাড়াইয়া বেড়াইতে লাগিল। তাহার নেশার মাত্রা সামান্য বাড়িয়া গেল। দিন কাটিতে লাগিল। তাহার পরে বছর দেড়েকের মাথায় একদিন জৈষ্ঠ্যের বিশুষ্ক প্রান্তরে আষাঢ়ের প্রথম জল বিনামেঘে আসিয়া পড়িল। সেই জমিদারবাড়ি হইতে একখানি চিঠি আসিল। সেদিনের সেই জমিদারের স্ত্রীর পক্ষ হইতে ডাক্তারকে পুনরায় সেখানে যাইতে অনুরোধ জানানো হইয়াছে। তাহার স্বাস্থ্য ঠিক নাই। ডাক্তার তাহাকে বাঁচাইয়াছিলেন তাই ডাক্তারের উপর ওনার বিপুল আস্থা ইত্যাদি। চিঠির নীচে জমিদারের স্ত্রীর নাম সহি রহিয়াছে— কমলিনী দেবী। আনন্দের প্রাবল্যে চিঠিটি বেশ কয়েকবার পড়িলেন ডাক্তার। কমলিনী— যোগ্য নাম বটে।মন কিঞ্চিৎ সংযত হইলে ঠিক করিলেন পরেরদিনই তিনি রওনা দিবেন। বিলম্ব করিবার মত সময় তাঁর কাছে একেবারেই নাই।‘
৪)
লোকটি ক্ষণিক থামিল। কিন্তু মতিলালের মন থামিতে পারিল না। কমলিনীর টান যেন তাহাকেও ইতিমধ্যে পাইয়া বসিয়াছে। সে সামান্য ধৈর্যহীনভাবে বলিয়া উঠিল, ‘কিন্তু তাহার পর কি ঘটিল?’
লোকটি যেন জানিত যে এই প্রশ্নটি আসিবে। সে সামান্য হাসিয়া বিড়িতে আরেকটি সুখটান দিয়া বাহিরের অবিরাম বৃষ্টিধারার সহিত সুর মিলাইয়া ফের বলিতে লাগিল, ‘তাহাই বলিতেছি, শুনুন। পরেরদিন নিজের নৌকা চাপিয়া ডাক্তার সেই জমিদার বাড়ির দিকে রওনা দিল।অগ্রহায়ণের পূর্ণিমারাত্রে কুন্তলকৃষ্ণনদীজলের উপর দিয়া সেই নৌকা চলিতে লাগিল পিঠের উপর গোলাকার চন্দ্রমা বহন করিয়া। নদীর প্রতি ঢেউয়ের শব্দে ডাক্তার কেবল “কমলিনী কমলিনী’’ ধ্বনি শুনিতে শুনিতে ছইয়ের ভিতর ঢুলিতে ঢুলিতে একসময় নিদ্রাপ্রাপ্ত হইলেন।
জমিদারের গ্রামের ঘাটে যখন নৌকা ভিড়িল তখন প্রত্যুষের আর বিলম্ব নাই।আলো ফুটিলে ডাক্তার জাগ্রত হইয়া ঘাটের সোপানে ক্রীড়ারতদুটি বালক মারফৎ জমিদার বাড়িতে তাহার আসার খবর পাঠাইয়া দিল। অবশ্যই পুরস্কারের বিনিময়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তারকে লইয়া যাইতে তিনজন লোক এবং একটি ঘোড়ার গাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল।
গাড়িতে উঠিয়া গন্তব্যে যাইতে যাইতে ডাক্তার জানিতে পারিলেন যে এই দেড় বৎসর ধরিয়া শোকের কারণে এবং সম্ভবত অনভ্যাসের হাতে সমস্ত জমিদারী সামলাইবার চাপের জন্য কমলিনী দেবী চূড়ান্ত অনিয়ম করিয়াছেন। এখন তাহার শরীর ভাঙিয়া যাইতেছে। কিছুই প্রায় হজম হয় না, খাইতে অরুচি লাগে। খাইলেও বমি হইয়া যায়। অনেকসময় রক্তক্ষরণ ঘটে। মাঝেমধ্যেই পেটে নিদারুণ যন্ত্রণা সঞ্চরিত হয়। এলাকার কোন ডাক্তার-কবিরাজ বাকী নাই, কিন্তু সকলেই বিফল হইয়াছেন। তারপর কমলিনী দেবীর আদেশেই তাহার কাছে নিমন্ত্রণ গিয়াছে। তিনিই এখন কমলিনী দেবী আর এই জমিদারির অন্তিম আশা।
ডাক্তার সব শুনিয়া অনুমান করিলেন যে কমলিনী দেবীর সম্ভবত পেটে ক্ষত হইয়াছে যাহাকে ডাক্তারি পরিভাষায় “পেপটিক আলসার” বলা হইয়া থাকে। মুখে কিছু কহিলেন না। গিয়া একবার ভালো করিয়া পরীক্ষা করিতে হইবে।
সেইদিন মধ্যাহ্নভোজে কমলিনী আর ডাক্তারের এই দফার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটিল। ডাক্তার দেখিলেন, গোলাপে শুষ্কতা ধরিয়াছে কিন্তু সৌন্দর্য বিনষ্ট হয় নাই। সামান্য দধি আর অন্ন মাখিয়া কমলিনী খাইলেন। তাহার এই দুর্গতি দেখিয়া ডাক্তারের মুখেও আর কিছু রুচিল না।
খাওয়ার পালা সাঙ্গ হইলে ডাক্তার কমলিনীকে পরীক্ষা করিলেন। কিন্তু করিয়া তিনি বিশেষ কিছুই ধরিতে পারিলেন না। লক্ষণ পেটের আলসারের মতই, কিন্তু কোথাও যেন বৈচিত্র্য আছে। এখনকার ন্যায় তখন অত পরীক্ষার সুযোগ ছিল না, অধিকাংশ রোগই অনুজদিগের কারও ছদ্মনাম লইয়া নিজের খেল দেখাইয়া চুপিসারে চলিয়া যাইত। কেহ জানিতেও পারিত না। এক্ষেত্রেও তাই। ডাক্তার ঠিক করিলেন আপাতত তিনি আলসার হিসাবেই চিকিৎসা এবং পথ্য করিবেন। তাহার পর দেখা যাইবে। তিনি সেইমত ওষধি আর পথ্য লিখিলেন। সঙ্গে বায়ুপরিবর্তনের পরামর্শ করিলেন। ইহা সে সময়ের চিকিৎসার অনুষঙ্গ ছিল।
কমলিনী দেবী ম্লান মুখে বলিলেন, “এত কাজ, প্রজা, জমি ফেলিয়া কেমন করিয়া যাইব ডাক্তারসাহেব? আর যাইতেও চাই যদি, যাইবই বা কোথায়? এই গ্রামের বাইরে আমার চেনা বিশেষ কোন জায়গা নাই। তাহার উপর সেইখানে গিয়া যদি রোগ বাড়িয়া ওঠে তখন কি হইবে বলিতে পারেন?”
এই কথায় ডাক্তারের মনে একটি মৃদু শব্দহীন বিস্ফোরণ ঘটিল।ফন্দি বলা ঠিক হইবে না, তবে কৌশল বলা চলে। ডাক্তার কমলিনীকে রোগের গুরুত্ব বুঝাইয়াবলিলেন যে কমলিনী চাইলে ডাক্তারের বাগানবাড়িতে আসিয়া কিছুকাল থাকিতে পারেন। ইচ্ছা করিলে তিনি সঙ্গে করিয়া না হয় অনুচর আনিবেন। কিন্তু ইহাতে তাহার বায়ু পরিবর্তনও হইবে আবার রোগ বাড়িলে চিকিৎসকের জন্য দূরে কোথাও ছুটিতেও হইবে না।ডাক্তারের মনের অভিলাষ আন্দাজ করা খুব কঠিন নহে। কমলিনী কিন্তু সামান্য উপরোধেই রাজী হইয়া গেলেন। ডাক্তারের খুশির আর অবধি রহিল না।
দিন বিষেক পরের এক গোধূলিতে একখানি নৌকা ওই ঘাটে আসিয়া লাগিল। সেদিনকার রঙিন আকাশের প্রেক্ষাপটে শ্বেতবস্ত্র পরিয়া কমলিনী দেবী তাঁহার একজন পাচক তথা বিশ্বস্ত সেবকসহ এই গৃহে পদার্পণ করিলেন। ডাক্তার পূর্ব হইতেই সব আয়োজন সারিয়া রাখিয়াছিলেন। তিনি কমলিনীকে এই বাড়িখানি ছাড়িয়া দিয়া নিজে ওই সামান্য দূরের একচালাটিতে গিয়া উঠিলেন। কথা হইল, দুইবেলা ডাক্তার কমলিনীকে পরীক্ষা করিবেন এবং পূর্বনির্ধারিত ঔষধের সহিত সেবনের জন্য স্বহস্তে একটি অনুপান বানাইয়া সেবকের হাত দিয়া অথবা নিজে গিয়া কমলিনীকে দিনে দুইবার প্রদান করিয়া আসিবেন। অন্য কোন প্রয়োজন উপস্থিত হইলে কমলিনী যে সেবকের মাধ্যমে তাহাকে অবিলম্বে খবর পাঠায়।
কয়েকদিনেই চিকিৎসা ফল দেখাইতে লাগিল। ডাক্তার দুইবেলা কমলিনীকে পরীক্ষা করেন। নিজের হাতে অনুপান প্রস্তুত করিয়া দেন। কখনও কখনও যাইতে অনিচ্ছাকৃত বিলম্ব হইলে কমলিনীর সেবক আসিয়া সেই অনুপান সংগ্রহ করিয়া লইয়া যায়। কমলিনীকে লইয়া ব্যস্ততার দরুন ডাক্তারের আর নেশা করা হয় না। তাছাড়া পাছে জানিতে পারিলে কমলিনী কিছু মনে করেন— এই ভয়টিও ছিল। ডাক্তার প্রথমে খুশি হইলেও পরে তাহার মনে হইল, এত শীঘ্র কমলিনীর ভালো হওয়া কি ঠিক? মন আর মগজে দ্বন্দ্ব বাধিয়া গেল। শেষে ডাক্তার ঔষধ আর অনুপানের শক্তিমাত্রা কমাইয়া দিয়া চিকিৎসার গতি সামান্য শ্লথ করিয়া দিলেন। তাহাতে কমলিনীরও ক্ষতি হইল না, ডাক্তারেরও মুনাফা বজায় থাকিল।
সেইবার শীত আসিবার প্রাক্কালে সমুদ্রবক্ষে সুগভীর নিম্নচাপ প্রস্তুত হইয়াছিল।বৃষ্টির আর বিরাম নাই। রাস্তাঘাট আর খেয়াঘাটকে আলাদা করিয়া চেনার উপায় ছিল না। এইরকম এক বৃষ্টিময় জনহীন সন্ধ্যায় অনুপান দিতে গিয়া মনের সমস্ত জোর কেন্দ্রীভূত করিয়া ডাক্তার কমলিনীর নিকট বিবাহপ্রস্তাব রাখিয়া বসিল।তাহার আশা ছিল কমলিনী সম্মত হইবেন। কমলিনীর মনে যদি ডাক্তারের প্রতি ভালোবাসা আর বিশ্বাস না থাকিত আহা হইলে কি তিনি এত দূরে একজন অর্ধপরিচিত পুরুষের ঘরে অভিভাবকহীনভাবে থাকিতেন? কদাপি নহে। সুতরাং কমলিনীও ডাক্তারকে ভালোবাসেন কেবল লজ্জার বেড়াজাল কাটিতে পারিতেছেন না। ডাক্তার তাই আগাইয়া আসিলেন। তাছাড়া বিধবা বিবাহে এখন আর কোন আইনি অসুবিধা নাই। বিধবা বিবাহ করিলে আধুনিকতা অর্জন হয়। আর ডাক্তার তো পূর্ব হইতেই অকৃতদার খ্রিস্টান। তাহারও ঝামেলা নাই।
কিন্তু ডাক্তার ভুল বুঝিয়াছিলেন। প্রতিটি বিশ্বাস, প্রত্যেক্টি ভালোবাসার সংজ্ঞা আলাদা হইয়া থাকে। বিবাহপ্রস্তাব শুনিয়া প্রথমে কমলিনী দেবীর মুখ বর্জ্রগর্ভমেঘের ন্যায় হইয়া গেল। অনতিবিলম্বে তিনি সংযম হারাইয়া ডাক্তারকে সুতীব্র কটুবাক্য শুনাইতে লাগিলেন। প্রিয়জনের নিকট হইতেমন্দকথা মন্দতর বলিয়া বোধ হয়। ডাক্তারেরও চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল। তিনি মাথা নামাইয়া রহিলেন। মনের তাপ কিঞ্চিৎ কমিলে কমলিনী শান্ত কণ্ঠে কহিলেন, “ডাক্তারসাহেব, আপনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। আপনি দুইবার আমার জীবন রাখিয়াছেন। কিন্তু আর কখনও এরকম কিছু মুখে আনা তো দূরের কথা,মনেও আনিবেন না। আমায় মাফ করিবেন। আমি কাল সন্ধ্যাবেলাই স্বগৃহে ফিরিতে চাহি, দয়া করিয়া ব্যবস্থা করিয়া দিন। আর আপনি এখন আসুন।“ ডাক্তার বিনা কথায় মাথা হেঁট করিয়া নিজের কক্ষে ফিরিয়া আসিলেন।
নিজের ঘরে আসিয়া খুব কাঁদিলেন ডাক্তার। সারা জীবনে এমন অপমান, এমন হৃদয়ভঙ্গ তাহার আর কখনও হয় নাই। তাহার ভালোবাসা যে এমন প্রতিদান আনিবে ইহা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তারের মন পালটাইয়া গেল। তাহার মনে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিবার উন্মত্ততা জন্ম লইল। সামান্য একটি মেয়ে কিনা তাহাকে প্রত্যাখ্যান করে? এত বড় স্পর্ধা? ঠিক আছে, তিনিও দেখিয়া লইবেন। ডাক্তার আলমারি খুলিয়া পেয়ালা আর জিনের বোতল বাহির করিয়া প্রতিশোধ লইবার মতলব আঁটিতে বসিলেন।
মতলব আসিতে দেরী হইল না। ডাক্তার একটি পাত্রে কমলিনীর জন্য অনুপান প্রস্তুত করিলেন। তাহার পর তাহাতে দুইটি এমন কড়া ঔষধ মেশাইলেন যাহা তীব্র বিষের ন্যায় ঘাতক। ভালোভাবে মিশ্রণটি প্রস্তুত করিয়া তিনি টেবিলে রাখিয়া দিলেন। তারপর ফের শয্যায় বসিয়া নেশা করিতে লাগিলেন। নিজের বুদ্ধিমত্তার জন্য নিজেকে অভিনন্দিত করিলেন কয়েকবার। কমলিনীর পরিণতি ভাবিয়া মধ্যে মধ্যে উচ্চস্বরে হাসিতেও থাকিলেন। রাত্রির আঁধার এবং মাদকের নেশা যখন সর্বাপেক্ষা গভীর হয় তখন আলো এবং সুবুদ্ধি উদয় হইয়া থাকে—- এমনটা অনেকে বলেন। ডাক্তারের সহিত কতকটা তাহাই ঘটিল। শেষরাত্রে তিনি বুঝিলেন যে তিনি অত্যন্ত গর্হিত কাজ করিতে চলিয়াছেন এবং ইহা করিলে সকল পক্ষেরই অনিষ্ট হইবে। তিনি তখনই ঠিক করিলেন যে ওই মিশ্রণ্টি তিনি এখনই ফেলিয়া দিবেন। সেইমত শয্যা ত্যাগ করিয়া তিনি যেই না উঠিতে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে নেশার ঘোরে পাক খাইয়া মেঝেতে পড়িয়া গেলেন। বার দুয়েক উঠিবার চেষ্টা করিলেন বটে কিন্তু তাহাতে একরত্তিও লাভ হইল না। দরজাও খোলা পড়িয়া রহিল। পড়িয়া রইল টেবিলের বিষমিশ্র। খালি ডাক্তারের চোখের সামনে একটি অন্ধকারের যবনিকা আগাম খবর না দিয়া কোন মহাশূন্য হইতে অকস্মাৎ খসিয়া পড়িল।
পরদিন প্রভাতে কমলিনীর সেবকের দূরাগত চিৎকারে নিদ্রা ভাঙিল ডাক্তারের। তিনি উঠিয়াই দেখিলেন তিনহাত দূরের শূন্য টেবিলখানাকে। সেবকের চিৎকার আর ফাঁকা টেবিলের কোলাজ এক লহমায় তাহাকে গতরাত্রের কথা মনে করাইয়া দিল। তাহার সুপ্তিদশায় কি হইয়াছে তাহা বুঝিতে ডাক্তারের সময় লাগিল না। তিনি দ্রুত ছুটিলেন কমলিনীর ঘরের অভিমুখে।
কমলিনীর ঘরে ঢুকিবামাত্র ডাক্তার বুঝিলেন যে তাহার আর কিছু করিবার নাই। জানালার একপাশে কমলিনী ঘাড় কাত করিয়া দেহ এলাইয়া পড়িয়া আছে। তাহার ডানহাতে এখনও ধরা রহিয়াছে সেই অনুপানের বিষপাত্রটি।প্রভাতের তরুণ আলো আসিয়া কমলিনীর মুখে পড়িয়াছে। কিন্তু সেই মুখের একটি পেশিতন্তুতেও আর প্রাণের লাবণ্য অবশিষ্ট নাই।
মামলা হইয়াছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে ডাক্তারের বিশাল কোন সাজা হইল না। কিন্তু তিনি নিদারুণ মানসিক আঘাত পাইয়াছিলেন। সেই দুর্ঘটনার পশ্চাৎ তিনি পুরামাত্রায় মদ্যপ হইয়া গিয়াছিলেন। সমস্তদিন নেশাগ্রস্ত থাকিতেন। রোগী দেখাও বন্ধ করিয়া দিলেন। ঘরের বাহির প্রায় হইতেনই না। খালি রাত্রে দোতলার একখানি জানালা খুলিয়া দূরে ঘাটের দিকে বিহ্বলনেত্রে তাকাইয়া থাকিতেন। নেশা দিনোত্তর বাড়িয়াই চলিল। শেষের দিকে নাকি মাথাও খারাপ হইয়াছিল। রাত-বিরেতে হাতে একখানি জ্বলন্ত সেজ লইয়া নদীর ঘাট এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় উদ্ভ্রান্তের ন্যায় হাঁটিয়া বেড়াইতেন আর ক্ষণে ক্ষণে “কমলিনী কমলিনী” বলিয়া কাতর ডাক পাড়িতেন। রাস্তার লোককে প্রশ্ন করিতেন, “কমলিনীকে দেখিয়াছেন?” অবশেষে একদিন সকালে তাহাকে এই খালের জলেই মৃত ও ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। কিন্তু কিভাবে তাহার মৃত্যু ঘটিল তাহা জানা যায় নাই। অনেকে বলেন ডাক্তার নেশার ঘোরে জলে ডুবিয়াছে আবার অনেকে কমলিনীর বিদেহী প্রেতাত্মাকে সন্দেহ করেন। মীমাংসা হয় নাই। সেই হইতে এই বাড়ি খালি পড়িয়া আছে।
তবে এখনও কোন কোন দিন অনেক রাত্রে নাকি সেই ডাক্তারকে হাতে আলো লইয়া নির্জন রাস্তায় চলিতে দেখা যায়। অনেকে দেখিয়াছেন। কাউকে সামনাসামনি পাইলে ডাক্তার আলোখানি মুখের কাছে তুলিয়া প্রশ্ন করেন, “কমলিনীকে দেখিয়াছেন?” কেহ যদি “হ্যাঁ” বলেন তাহা হইলে ডাক্তার তাহার পিছু নেন। যদি বলেন “না” তাহলে তাহার ঘাড় মটকাইয়া মারিয়া ফেলেন। কিন্তু নিরুত্তর থাকিলে নাকি দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া আলো হাতে করিয়া দূরে মিলাইয়া যান। এই তিনরকম ঘটনাই ইতিপূর্বে এই এলাকা প্রত্যক্ষ করিয়াছে। সন্ধ্যাকাল উত্তীর্ণ হইলে এই তল্লাটে তাই খুব একটা কেউ আসেই না।’
৫)
গল্প শেষ করিয়া লোকটি চুপ করিল। মতিলালও কিছু কহিতে পারিল না। শব্দ বলিতে কেবল বাহিরের মন্দীভূত বৃষ্টির ধ্বনি কানে আসিতেছে। বিচিত্র কাহিনী বটে। একেবারে চলচ্চিত্রের মত।
হঠাৎ লোকটি বলিল, ‘ডাক্তারের কবর দেখিবেন?’
একটু থতমত খাইয়া মতিলাল বলিল, ‘অ্যা! সে আবার কোথায়?’
‘এই তো, কাছেই। দোতলায় উঠিলেই দেখিতে পাইবেন। চলুন, দেখাইতেছি।‘
অন্ধকারে হাতড়াইতে হাতড়াইতে দুইজনে কাঠের সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে লাগিল। আগে মতিলাল, পিছনে লোকটি। পুরোনো দিনের ধাপগুলি আর্তনাদ করিয়া সতর্ক করিতে লাগিল। কিন্তু মতিলাল উৎসাহে বধির হইয়াছিল।
বেশ কিছুটা উঠিবার পরে সহসা পশ্চাৎ হইতে ‘ফস’ করিয়া চাপা একটি শব্দ হইল এবং মতিলালের জামায় মৃদু টান পড়িল। সে পিছন ফিরিতেই তাহার মুখের একেবারে সামনে একটি আগুন-উদ্ভাসিত ভাঙাচোরা মুখ আসিয়া ঘড়ঘড়ে গলায় প্রশ্ন করিল, ‘কমলিনীকে দেখিয়াছেন?’
মতিলাল বিহ্বল, বিভ্রান্ত মাথা অবশ্য ঘুরিতে দেরী করে নাই। তাহার চেতনাবিহীন দেহ সিঁড়ি দিয়া গড়াইয়া পড়িল।
সংজ্ঞা যখন ফিরিল তখন মতিলাল সেই সিঁড়ির নীচের ধাপে পড়িয়া আছে। কোমরে সামান্য চোট লাগিলেও বড় কোন অনিষ্ট হয় নাই। সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া নিজের দেহ পরীক্ষা করিয়া লইল। সেই সময়েই সে আবিষ্কার করিল যে তাহার পকেটের টাকা, হাতের আংটি এবং মণিবন্ধের ঘড়িখানি তাহার সঙ্গ ছাড়িয়াছে।
মতিলাল বুঝিল, একজন দুর্দান্ত গল্পকথক এবং সুদক্ষ শিল্পী নিভৃতে নিজস্ব পারিশ্রমিক লইয়া চলিয়া গিয়াছেন।
Tags: পূষন, মতিলালের মতিভ্রম
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।