বালিগঞ্জ সারকুলার রোডের ওপর তিনহাজার স্কোয়ার ফিটের সুসজ্জিত আধুনিক ফ্ল্যাট । পাঁচতলায় । মধ্যিখানে বিশাল মাপের ড্রয়িংরুমে র একটি কোণে নিজের পছন্দের সোফাটায় সন্ধেবেলায় চুপ করে বসে আছেন মিত্রসাহেব । অরিন্দম মিত্র । বেঙ্গল এ্যালুমিনিয়াম ইন্ডাস্ট্রির দোর্দন্ডপ্রতাপ চেয়ারম্যান-কাম-ম্যানেজিং ডিরেক্টর । এককথায় সিএমডি । দীর্ঘ কর্মজীবনের প্রান্তে আজই অফিসে তাঁর ফেয়ারওয়েল হয়ে গেলো খুব ঘরোয়া পরিবেশে।
অনেকেই সেই সভায় ভাষণ দিলো । ইউনিয়নের সেক্রেটারি অরুময় বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে । তার মূল বক্তব্য ছিল যে ইউনিয়নের সঙ্গে লড়াই বা সমঝোতা – দুই পরিস্থিতিতেই মিত্রসাহেবের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব কোনোদিন তাদের নষ্ট হয়নি । একেবারে শেষে সকলের অনুরোধে দু-চার কথা বলতে এলেন ওনার দীর্ঘদিনের সেক্রেটারি মিসেস সুচরিতা গাঙ্গুলী। মানুষটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি । সে সুযোগ সবার হয়নি । তাই স্যারের কথা বলতে গিয়ে যেন আর থামতে পারছিলেন না , আবেগে আপ্লুত হলেন । ষ্পষ্ট উচ্চারণে আজ অনেক কথাই বলতে পারছেন । হঠাৎ যেন বাইরের আবরণটা সরিয়ে স্যার খুব কাছে চলে এসেছেন। ছোট ছোট ঘটনার কোলাজ দিয়ে সুচরিতা তার বক্তব্য সাজিয়ে তোলেন । বলে যান দীর্ঘদিনের কাজের সঙ্গী হিসেবে মানুষটির চলাফেরার ছন্দ । ছোট বড় সুখদু:খের । কখন যেন একটু একটু করে সেইসব অনতিতুচ্ছ অনুসঙ্গের অংশীদার হয়ে গিয়েছিলেন।
– সাহেব
মিত্রসাহেব হঠাৎ বাস্তবে ফিরে আসেন ।
– কিছু বলছিলে হরিদাস ?
হরিদাস এবাড়ির সবচেয়ে পুরোনো কাজের লোক।
– আজ্ঞে হ্যাঁ । কখন কফি দিয়ে গেছি, এতক্ষণে
বোধহয় ঠান্ডা হয়ে গেছে । আলো জ্বেলে
দেবো ?
মিত্রসাহেব বারণ করলেন । দরকার নেই । বেশ লাগছে সামান্য একটু অন্ধকার অন্ধকার এই প্রদোষকালের আলো-আঁধারি । মন অবগাহন করছে অতীতে । ডাউন মেমারী লেন ।
কয়েকদিন ধরেই চলছে এইসব । আজকে অফিসের ফেয়ারওয়েল ছিল বেশ ঘরোয়া আর আন্তরিক । এর আগে ছিল চেম্বার-অফ্-কমার্স আয়োজিত একটা গেট-টুগেদার । তারপরের দিন বেঙ্গল ক্লাবের বন্ধুরা এবং তার আগের সপ্তাহে বেশ কিছু কর্পোরেটের লোকজন একটা জমকালো পার্টি দিয়েছিল । আজ অনেক উপহার , ফুলের তোড়া এইসব নিয়ে সুচরিতা মিত্রসাহেবের সঙ্গে গাড়িতে উঠে পড়লেন এই পিতৃপ্রতীম মানুষটিকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবার জন্যে । সিঁড়ির পথে থেমে হরিদাসের হাতে দিয়ে দিলেন , ওপরে আর উঠলেননা । সাহেবের নির্দেশে ড্রাইভার তাকে ঐ গাড়িতেই বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলো ।
ফিরে এসে ড্রাইভার একবার জিজ্ঞেস করেছিল অন্যদিনের মতন ক্লাবে যাবেন কিনা । মিত্রসাহেব রাজি হলেন না । আজ বাড়িতে একা
চুপচাপ বসে থাকবেন । জীবনের একটা লম্বা অধ্যায় আজ শেষ হলো । জার্নিস এন্ড ।
প্রায় ঠান্ডা কফিতেই একটু চুমুক দিলেন । অফিসের বেশভূষা বদলে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে নিলেন । এখন অনেকটা হালকা লাগছে । এই বিশাল মাপের ফ্ল্যাটে বেশ কয়েকবছর ধরে অরিন্দম একা থাকেন । সব ছেলেমেয়ে প্রতিষ্ঠিত । তারা বাইরে থাকে । ছেলে সঞ্জয় থাকে বোষ্টনে , বিয়ে হয়ে গেছে । মেয়ে তোতা বরকে নিয়ে বহুদিন ধরে দিল্লী প্রবাসী । সঞ্জয় খুব ট্যালেন্টেড , তবে তোতা ঠিক উল্টো । কোনো বিষয়ে বেশি আগ্রহ বা মনের কিংবা স্বভাবেও তেমন গভীরতা নেই । সারাদিন শুয়ে বসে থাকা আর নানারকম ফ্যাশন ম্যাগাজিন পড়া বা ক্লাবে গিয়ে সময় কাটানোই তার অভ্যাস । যাইহোক , অরিন্দমের কোনো অভিযোগ নেই । যে যেখানে যেমন আছে ভালো থাক । মাঝেমধ্যে ছেলে বা তার বৌ দুচার লাইনের মেসেজ পাঠায় বা ফোন করে । বক্তব্য একই । শরীরের যত্ন নিও , প্রেসার , সুগার নিয়ম করে চেক করিও ইত্যাদি । এগুলো আজকাল বড়ই মামুলি মনে হয় । যেন তার শরীরের যত্ন কম নিলে তাদের রাতের ঘুম চলে যাবে । তা যাইহোক , তবু অরিন্দমের ইদানীং আর কোনো নালিশ নেই ।
বেঙ্গল এ্যালুমিনিয়াম ইন্ডাস্ট্রির সিএমডি অরিন্দম মিত্রের শৈশব , কৈশোর এবং যৌবনের
অনেকটা সময় কিন্তু কেটেছিল কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে । বাবা একটি স্কুলে পড়াতেন । বেশিরভাগ সময় পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন । মা তার স্বামী আর তিন ছেলেকে নিয়ে কেমন করে অত অল্প আয়ে হাসিমুখে সব সামলে নিতেন ভাবলে অবাক লাগে । বাবাকে সে একদিনের জন্যেও বিমর্ষ থাকতে দেখেনি । তিনি কখনো হীনমন্যতায় ভুগতেন না । বড়ো সৎ ও খাঁটি মানুষ ছিলেন তিনি । বাবার কথা মনে পড়তে মিত্রসাহেবের চোখে জল এসে গেলো । এই মানুষটিকে তিনি সমস্ত অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা করতেন ।
নষ্টালজিয়ায় ভেসে যাচ্ছেন মিত্রসাহেব ।
শৈশব থেকে বা অন্তত কৈশোরের প্রান্ত থেকে একটির পর একটি ক্ষনের উত্তোলন যেন জীবনের গভীর তাৎপর্যের নির্য্যাস যা নতুন মাত্রা নিয়ে আজ দেখা দিচ্ছে । চোখ বুঝে অরিন্দম অনুভব করার চেষ্টা করেন জীবনের ক্ষনে ক্ষনে যখন মাঝে মাঝে আঁধির অন্ধকার ছুটে এসেছে ভয় আর হতাশার মেঘ নিয়ে, তখনও কেমন করে সংহত বোধির এক দৃঢ় প্রত্যয় তাকে ঠিক পথে চালিত করেছে । চরিত্রের এই গুনটা অরিন্দম বোধহয় তাঁর বাবার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন । এদিকে বয়স যতো বেড়েছে , তত দ্রুত এসেছে কর্মজীবনে সাফল্য । অপরাহ্ন ভরে উঠেছে সাফল্যের সোনালী আলোয় । একেই বুঝি বলে ড্যাজলিং সানসেট । জীবন তাঁকে দুহাত ভরে দিয়েছে প্রচুর । কিন্তু তার বিনিময়ে কী দিতে হয়েছে তাঁকে । কতখানি মূল্য । ডাউন মেমারী লেন, স্মৃতির সরণী ধরে হঠাৎ এক লহমায় কঠিন বর্তমানে ফিরে আসেন অরিন্দম ।
ঘরের ভেতর কোনো আওয়াজ নেই । বারান্দার বাইরে গভীর অন্ধকার ।
ছেলেবেলা থেকেই অরিন্দম মেধাবী ছাত্র ছিলেন । বারবার স্কলারশিপ নিয়ে পড়েছেন । যখন যাদবপুরে মেক্যানিকালের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র , বাবা হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন । একটা সেরিব্রাল এ্যাটাকে শরীরের বাঁ দিকটা প্রায় অচল হয়ে গেলো । আংশিক পক্ষাঘাত শক্তপোক্ত কর্মঠ মানুষটিকে অকেজো করে দিলো । স্কুলে আর কাজ করতে পারবেন না । হাজার ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও তার এমটেক পড়াটা আর হলোনা । অনেকগুলি চাকরির ইন্টারভিউয়ের পর শেষমেশ এ্যাসিস্টেন্ট ইন্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দিলেন বেঙ্গল এ্যালুমিনিয়াম ইন্ডাস্ট্রিতে । দুই ছোট ভাই অজয় আর সুজয় তখনো স্কুলের ছাত্র ।
কয়েকবছর কাটলো । ইতিমধ্যে কাজের ক্ষেত্রে অরিন্দমের খুব সুনাম হয়েছে । প্রমোশন হয়েছে সিনিয়র ইন্জিনিয়ার পদে । একদিন অরিন্দমকে ডেকে বিয়ে করার ব্যাপারে বাবা তার মত জানতে চাইলেন । সেই সঙ্গে এটাও জানালেন ওঁর এক পরম বন্ধুস্থানীয় ভদ্রলোকের মেয়েকে উনি সাজেষ্ট করতে পারেন । প্রধানত বাবার রেকমেন্টেড বলেই অরিন্দম সহজেই রাজী হয়ে গেলো । স্বাগতা বৌ হয়ে এসেই অরিন্দমের জীবনে একটা ছন্দ , এক অন্য মাত্রা, এক ভিন্ন স্বাদ নিয়ে এলো । সংসারের দায়বদ্ধতায় আরো কমিটেড হতে শেখালো । একদিন সন্ধ্যায় দুজনে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলো। পাশে একটা দামী রেস্তোরাঁ দেখতে পেয়ে অরিন্দম দুম করে ঢুকে পড়লো । স্বাগতার কোনো আপত্তি শুনলোনা । খাওয়া সেরে বিল মিটিয়ে যখন বাইরে এলো , স্বাগতা মৃদু ধমকের সুরে বললো যে এরপর আপাতত এইসব খরচ বন্ধ ।
– মনে রেখো বাবা-মাকে দেখতে হবে । অজয়
আর সুজয়ের দায়িত্বও কিন্তু আমাদের ।
রোজ অফিসে বেরোবার আগে একটু নিভৃত কোনে গিয়ে অরিন্দম যখন তাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতো আর স্বাগতা সেই আবেশে ডুবে যেতো , তখন চুম্বনের শেষ রেখাটি আলতো মিলিয়ে যাবার আগেই মনে করিয়ে দিতো ,
– প্যাকেটে ছ’টা সিগারেট রেখেছি । কথা দাও
এর বেশি আর একটাও কিনে খাবেনা ।
একদিন অফিস থেকে শরীর খারাপ জানিয়ে দুপুরে বাড়ি চলে এলো অরিন্দম । শুনে স্বাগতা দৌড়ে এলো । তারপর ঘরের ভেতরে ঢুকে আদরের ঘটা দেখেই বুঝলো আসলে কিছুই হয়নি । সেদিন কিন্তু স্বাগতা কথা আদায় করেছিল আর কখনো এভাবে কাজে ফাঁকি দিয়ে সে চলে আসবেনা । গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল ,
– তোমাকে অনেকদূর যেতে হবে । অনেক
অনেক উঁচুতে উঠতে হবে ।
অরিন্দম বলে উঠলো ,
– ও: , তোমাকে হেডমিষ্ট্রেস হলে মানাতো
ভালো । দিলেতো মুডটা নষ্ট করে ।
পরে অবশ্য মনে মনে বলেছিল তোমার স্বপ্ন সার্থক করতে আমি অনেক উঁচুতে উঠবোই স্বাগতা । কথা দিলাম । শুধু তুমি আমার পাশে থেকো । ভাবে কতটা উঁচু আর সেখানে উঠতে গেলে কী কী ছাড়তে হয় সেটা কেউ জানেনা । জানা নেই জীবনের কোন মূল্যে সেই অধরাকে পাওয়া যায় ।
হঠাৎ বুকের একটি জায়গায় তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন মিত্রসাহেব । জীবনের অর্থাৎ কর্মজীবনের গতি উর্দ্ধমুখি হলে কিছুকি হারাতে হয় ? ছাড়তে হয় কি অনেক কিছু ? কিছু পাওয়া আর না-পাওয়া এই দুয়ে মিলে কি জীবনকে সার্থক ভাবা যায় ! নেহাতই খাপছাড়া গোছের একটা ছবি তার মাঝখানে ছোপছোপ রং লেগে আছে যেন কোনো ইউনিফর্মিটি বা কন্টিনিউটি নেই । হঠাৎ অরিন্দমের মনে একটা অদ্ভুত তুলনা ভেসে উঠলো ।মহম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন তিনি একটা গোটা পাকিস্তান চান , ট্রাঙ্কেটেড বা মথ-ইটন নয় । অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁকে সেই পোকায় খাওয়া টুকরো টুকরো পাকিস্তানই নিতে হয়েছিল ।
আজ স্মৃতিকাতরতা অরিন্দমকে পেয়ে বসেছে । রাতের তারার মতো অতীতের মূহুর্তগুলি যেন ভেসে আসছে পাখির ডানায় ভর করে । হঠাৎ বহুদিন আগের এক শিল্পীর আঁকা একটি ছবির কথা মনে এলো । শূন্য ঘরে একটা চেয়ার পাতা, চার দেয়ালে শুধু সাদা রং । ব্যস , আর কিছুই নেই । ছবির নাম – ” এমটিনেস্ ” । খাঁ খাঁ করছে একটি ঘরের মধ্যিখানে একটি শূন্য চেয়ার । অরিন্দমের সব হিসেব-নিকেশ কেমন গুলিয়ে যায় । সার্থকতা কী , ব্যর্থতাই বা কী , কতোটা পাওয়া আর কতোটা না-পাওয়া নিয়ে একটা জীবন সফল অথবা ব্যর্থ এ হিসেব মেলাতে পারেন না প্রায় কিংবদন্তি সাফল্যের শিখরে ওঠা বেঙ্গল এ্যালুমিনিয়ামের সিএমডি , চেম্বার-অফ-কমার্সের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অরিন্দম মিত্র ।
সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার থাকাকালীন কোম্পানীর একটা মর্ডারনাইজেশন প্রোজেক্টের কাজে কোম্পানী অরিন্দমকে বেশ বড় দায়িত্ব দিতে চাইলো । কাজটা কঠিন কিন্তু ভীষণ চ্যালেঞ্জিং । মূলত স্বাগতার প্রচণ্ড উৎসাহেই অরিন্দমের আত্মবিশ্বাস অনেকটা বেড়ে গেলো । সে মনপ্রাণ দিয়ে কাজটায় ঝাঁপিয়ে পড়লো । অফিসের পরেও প্রয়োজন হলে যাতে বাড়িতে কাজ করা যায় তার জন্যে বাড়ির একটা ঘর খালি করে সেখানে একটা টেবিল আর চেয়ার পাতা হলো ।
ইচ্ছে মতন কাজ করার সব ব্যবস্থা পাকা । অরিন্দমকে রাত পর্যন্ত কাজ করার সুযোগ করে দিয়ে তার শরীরের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখলো স্বাগতা । সে কখন কী খাবে , কখন জোর করে বিশ্রাম নেওয়াবে সব দিকে তার দৃষ্টি । সংসারের সব ছোটখাটো স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক সমস্যা সে একাই সামলে নিত । অরিন্দমকে এইসব থেকে আড়াল করে রাখতো । তার নিরবচ্ছিন্ন কাজের সুযোগ দরকার । তাকে সফল হতেই হবে । অনেক উঁচুতে উঠতে হবে – এইরকম একটা অনুচ্চারিত প্রতিজ্ঞা যেন স্বাগতা অরিন্দমের দেহের প্রতি রক্তবিন্দুতে সঞ্চারিত করেছে । অরিন্দম বুঝতে পারে তাকে নিয়ে স্বাগতা এক মস্ত বড়ো স্বপ্নকে ছুঁতে চাইছে ।
মডার্নাইজেশন প্রোজেক্ট অরিন্দমের অভূতপূর্ব সাফল্যের নজীর হয়ে গেলো । সিডিউলের আগে শেষ হয়ে প্রোডাকশন চালু হয়ে গেলো । সবাই মেনে নিল এই ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি কন্ট্রিবিউশান অরিন্দম মিত্রের ।
এরপর থেকে তার শুধু এগিয়ে যাবার পালা । বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে কোম্পানির সব উত্থান-পতন , টানাপোড়েনের সঙ্গে সে একাত্ম হয়ে গেছে । একটার পর একটা প্রমোশন এসেছে সহজেই । তার ব্যক্তিজীবনে অনেক যোগবিয়োগ , আনন্দবেদনা সবই সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে আসাযাওয়া করেছে । বাবা ও মা দুজনেই চলে গিয়েছেন ।অজয় আর সুজয় বড়ো হয়ে এখন নিজের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে । একজন থাকে কানপুরে আর সুজয় যথেষ্ট সফল ব্যবিবসায়ী , বাড়ি করেছে সল্ট লেকে । ছেলে সঞ্জয় আইআইটি তে ভর্তি হলো , পাশ করেই চলে গেলো বিদেশে । মেয়ে তোতা বিয়ের পর থেকেই দিল্লী প্রবাসী । এসব কিছুতেই অরিন্দমের ভূমিকা গৌন । স্বাগতা বুঝতে পারে অরিন্দম তার কর্মজগতে বন্দী । কাজ তাকে একটু একটু করে ছেলে মেয়ে ভাই সবার কাছ থেকেই অনেক দূরে সরিয়ে দিচ্ছে । এই নিরলস কর্মব্যস্ত মানুষটি যেন একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ । প্রতিটি ব্যস্ত দিনের শেষে ক্লান্ত শরীর আর মন নিয়ে তার কাছেই আশ্রয় খোঁজে একান্তভাবে ।
অরিন্দম মিত্রকে নিয়ে এখন কোম্পানির ছ’জন জেনারেল ম্যানেজার । তাপস সেন , আয়ার , ঘটক ইত্যাদি সবাই ওর থেকে অল্পবিস্তর সিনিয়র । সবাই জানে পরের মাসে বোর্ডমিটিং । সেখানে একজনকে ডিরেক্টর করা হবে । এই ছ’জনের মধ্যে অরিন্দম মিত্রকে ভয় পাচ্ছেন অনেকেই । তবে কাজের সুনামের দিক দিয়ে বিচার করলে এই রেসে টেক্কা দেবার কথা অরিন্দমের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আয়ার সাহেবের । সেও মনে মনে জানে যে বিপুল খরচ কমিয়ে এবং প্রোডাকশন বেড়ে যাবার ফলে এই কোম্পানি আজ যে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে তার বেশিরভাগ কৃতিত্বই অরিন্দম মিত্রের । বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যই এ বিষয়ে একমত ।
সেই নির্দিষ্ট বহুপ্রতীক্ষিত বোর্ড মিটিং আর একসপ্তাহ পরে । স্বাগতা রোজ এসবের খুঁটিনাটি খবর নেয় । তার দৃঢ় বিশ্বাসের কথা অরিন্দমকে জানায় । বলে যে সেই যে ডিরেক্টর হবে সে বিষয়ে সে নিশ্চিত । তার কয়েকবছর পরে এমডি । অরিন্দম আদর করে নাকটা মলে দেয় ।
সবকিছু প্ল্যান মাফিক চলেনা । পরের দিন হঠাৎ তোতার ফোন এলো দিল্লী থেকে । তার ছেলে ভীষণ অসুস্থ । কী অসুখ ডাক্তার ধরতে পারছেনা । রোজ জ্বর উঠছে চার , পাঁচ । সবরকম পরীক্ষা চলছে , তোতার ভয়ংকর ভয় করছে । কাঁদো কাঁদো হয়ে স্বাগতাকে বললো যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসতেই হবে । পরের দিন সকালের ফ্লাইটেই যাওয়ার ব্যবস্থা হলো । ভোরবেলা যাবার সময় এয়ারপোর্ট পৌঁছে স্বাগতা বললো ,
– চারদিন পরেই বোর্ড মিটিং । ঐদিন রাতে
ঠিক ন’টায় আমি নিজেই তোমাকে ফোন
করবো ।মোবাইলে নয়, ল্যান্ডফোনে । তখন
নিশ্চয়ই বাড়ি চলে আসবে । এসে চুপচাপ
বসে আমার ফোনের অপেক্ষা কোরো ।
কোনো টেনশন নেই । ঠিক আছে ?
নির্দিষ্ট দিনে বোর্ডমিটিং হয়ে গেলো । শেষ হতে সন্ধ্যা ছ’টা । তখনো দিনের আলো ছিটেফোঁটা একটু আছে । হৈ হৈ ব্যাপার । প্রথমেই দৌড়ে এলো আয়ার নিজে । খবরটা সেই প্রথম জেনেছে । পাঁচজনকে সুপারসিড করে ডিরেক্টর হয়েছে অরিন্দম মিত্র । একে একে সবাই দেখা করলো । অভিনন্দন আর করমর্দনের পর্ব শেষ করে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন অরিন্দম । রাস্তায় যেতে যেতে দেখতে লাগলেন ফাগুনের পড়ন্ত বিকেলের আলোয় উদ্ভাসিত দিগন্তের রং । মনে খুশি আর চেপে রাখতে পারছেন না । কখন বলবেন স্বাগতাকে । আজকের অরিন্দম মিত্রের সফল জীবনের রুপকার তো সেই । বাড়ি ফিরে স্নান সেরে নিজের বসার ঘরে চলে এলেন। কতো কথাই আজ মনে পড়ছে । তাদের লড়াইয়ের দিন, তাদের আনন্দের উজ্জ্বল মূহুর্তগুলি সব সব । অরিন্দম অপেক্ষা করতে লাগলেন । রাত ন’টায় স্বাগতার ফোন আসবে।
ইচ্ছে থাকলেও দিল্লিতে নিজে ফোন করলেন না। তোতার ছেলেকে নিয়ে নিশ্চয়ই সবাই খুব ব্যস্ত । অবশ্য গতকাল স্বাগতা খবর দিয়েছিল যে নাতি এখন অনেকটা ভালো । দু-চার দিন পরেই সে ফিরে আসবে । ফোনের পাশে অপেক্ষারত অরিন্দমের সময় আর কাটছেনা । আনন্দ আর উত্তেজনায় কেমন অস্থির লাগছে। রাত ন’টা বেজে গেছে । এবার চিন্তা হচ্ছে । তবে কি তোতার ছেলের নতুন করে কোনো সমস্যা হয়েছে ? রাত যখন পৌনে দশটা আর থাকতে না পেরে নিজেই একবার ডায়াল করলেন । কিন্তু নো রিপ্লাই । দশমিনিট পরে আবার চেষ্টা করলেন । এবারও নো রিপ্লাই । ভাবলেন নিশ্চয়ই তোতার ছেলের কিছু বাড়াবাড়ি হয়েছে তাই হয়তো নার্সিং হোমে গেছে । এবার মোবাইলে চেষ্টা করে শুনলেন ‘আউট অফ রিচ ‘। কোনো যোগাযোগ হলোনা ।
শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা । ঠিক করলেন স্বাগতা আর তোতাকে বলে দেবেন নাতি একটু ভালো হলেই তাকে নিয়ে সবাই কলকাতায় চলে আসুক । এখানেই সম্পূর্ণ চিকিৎসা হবে ।
ঠিক রাত এগারোটা । ফোন বাজলো । অরিন্দম লাফিয়ে উঠলেন । ওদিকে তোতার গলা পাওয়া গেলো । ভীষণ হাঁপাচ্ছে । প্রথমে চুপ করে রইলো । তারপর অস্ফুটে বললো ,
– বাবা
অরিন্দম এবারে অধৈর্য । বেশ জোরেই বললেন,
– হ্যাঁ , বলছি । আমাদের নাতিবাবু কেমন
আছে ? পরে সব শুনবো । এখন একবার
তাড়াতাড়ি তোর মাকে ফোনটা ধরতে বল্ ।
আবার সব চুপ । অরিন্দম এবার চেঁচিয়ে উঠলেন ,
– কী হলো । এখনই মাকে একবার ফোনটা
ধরতে বল্ ।
তোতা এবার যন্ত্রের মতো বলে গেলো,
– মা হঠাৎ
অরিন্দম চিৎকার করে উঠলেন ,
– কী , কী হয়েছে মায়ের ?
ওদিক থেকে তোতার উত্তর এলো ,
– সন্ধের সময় মায়ের হঠাৎ পরপর দুবার
ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক । ডাক্তাররা সবাই
আপ্রাণ…
বাকিটা আর শোনার মতো অবস্থায় ছিলেন না অরিন্দম । একটি উৎসবের রাত যেন হঠাৎ বর্ণহীন হয়ে গেলো । হাজার হাজার ওয়াটের আলো সহসা নিভে গেলে যেমন হয় । বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার , কোথাও কোনো শব্দ নেই । সবকিছু মিলে বুকের ওপর চেপে বসলো । একী হয়ে গেলো স্বাগতা , এমন তো কথা ছিলোনা।
বর্তমানে ফিরে আসেন মিত্রসাহেব । মুখের পাইপটা কখন নিভে গিয়ে ঠান্ডা হয়ে আছে। ধীরে ধীরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন । পরিস্কার আকাশে জ্বলজ্বল করছে অসংখ্য তারা । নীচে রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে সারি সারি গাড়ি । সব দৃশ্যই বড়ো চেনা , সব যেমন চলছিল ঠিক তেমনি চলছে ।
Tags: অনিলেশ গোস্বামী, অবসর
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।