১৯৪১ সালের জুলাই মাস নাগাদ গুরুদেব খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন, শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন অবস্থায়। প্রস্রাবে জ্বালা, অল্প অল্প প্রস্রাব হওয়া, বারে বারে বাথরুমে যাওয়া, সেই সঙ্গে ঘুসঘুসে জ্বর, ক্ষুধামান্দ, গা-বমি ভাব ইত্যাদি। নিজের চিকিৎসা হোমিওপ্যাথি-বায়োকেমিকে যখন কোন ফল মিলছে না, গুরুদেব বাধ্য হলেন অ্যালোপাথিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে। পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ রাম অধিকারী প্রথমে দেখেন গুরুদেবকে। তাঁর চিকিৎসায় সন্তোষজনক ফল না হওয়ায় বাড়ির লোকেরা পরামর্শ নেন আরও কয়েকজন বিশিষ্ট চিকিৎসকদের।এঁরা হলেন ডাঃ বিধানচন্দ্ররায়, ডাঃ নীলরতন সরকার, ডাঃ অমিয় ঘোষ, ডাঃ ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।এদের নিয়ে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়।তাঁরাই সিদ্ধান্ত নেন যে গুরুদেবের শরীরে অস্ত্রোপচার করাটা খুবই জরুরী।প্রেস্ট্রেট গ্রন্থির বৃদ্ধির জন্য ঐসব শারীরিক উপসর্গ গুলো দেখা দিয়েছে।প্রোস্ট্রেট গ্রন্থির বৃদ্ধির জন্য মুত্রাশয় নালীর পথ বাধাগ্রস্ত হয়ে প্রস্রাব নির্গমে অসুবিধার সৃষ্টি করছে।তাই তলপেটের উপরে মুত্রাশয় থলি থেকে আলাদা একটা রাস্তা বার করে প্রস্রাবের জায়গাটা খুলে দেওয়াটা খুবই দরকার।ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলা হয় সুপ্রাপিউবিক সিস্টোস্টমি অপারেশন।গুরুদেব অবশ্য আর একটি ক্রনিক অসুখে ভুগতেন।অর্শের অসুখে।মাঝে মধ্যে মলদ্বার দিয়ে রক্তপাত ও প্রচণ্ড ব্যথা বোধ করতেন।বেশ কাহিল হয়ে যেতেন।তবে তাঁর নিজস্ব হোমিওপ্যাথি-বায়োকেমিকে সে ধাক্কাগুলো সামলে নিতেন। যদিও ঐ টিমে স্যার নীলরতন সরকার ছিলেন, তিনি গুরুদেবের দেহে অস্ত্রোপচারে বিরোধী ছিলেন।তবে অন্যান্য চিকিৎসক সহকর্মীদের মতের বিরোধিতা করেননি। গুরুদেবও অনিচ্ছাসত্ত্বেও চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে সম্মতি দেন।সেই মত কবিকে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় আনার ব্যবস্থা করা হয় ১৪৪১ সালের ২৫ জুলাই। অপারেশনের সিদ্ধান্ত খুবই গোপন রাখা হয়েছিল।আনার সময় শান্তিনিকেতনের লোকজন যাতে অযথা হৈচৈ না করেন তাই গোপনে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়েজ অধিকর্তা নিবারণ চন্দ্র ঘোষের ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটা স্পেশাল বগিতে শুইয়ে কবিকে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আনা হয়।২৫ জুলাই সারাদিনটাই খুব ভ্যাপসা গরম ছিল।ট্রেনের ধকলে কবি খুবই কাহিল হয়ে পড়েন। ট্রেন থেকে স্ট্রেচারে শুইয়ে আনা হয়েছিল কবিকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।স্ট্রেচার থেকে খাটে তোলা সম্ভব হয়নি সেদিন কেননা কবি এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যেন ড়াচড়া করতে চাননি।থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল দোতলার পুরানো ঘরে যেটাকে ‘পাথরেরঘর’ বলাহত। কবি নিজেই চেয়েছিলেন বলে ঐঘরেই ওঁকে রাখা হয়। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুসারে ঐ ঘরটিকে ধোয়ামোছা, সাফসুতরো করে লাইজল পালিশ করে রোগজীবাণু মুক্ত করা হয়েছিল যাতে ঐ ঘরে অপারেশনের সময় কোন অসুবিধার সৃষ্টি না হয়। গুরুদেবের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন শ্রীমতী রাণী চন্দ।তিনিই গুরুদেবকে দেখা শোনা করতেন। সেবা যত্ন করতেন।পরদিন গুরুদেব কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। সকলের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন।ভাইপো অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে চলল সাহিত্য নিয়ে আলোচনা সারা দুপুর পর্যন্ত।বিকেলে গুরু দেবের ডানহাতের শিরায় গ্লুকোজ ইনজেক্শন দেওয়া হল।সুঁচ ফোটানোর সময় কিছুটা ব্যথা বোধ করায়, রাণী গুরুদেবের হাতে নুনের পুঁটুলি সেঁক দিতে শুরু করায়, কবির রসোক্তি, ‘দ্বিতীয়া, গেল সব জ্বলিয়া।’ ঐ কথা বলার পরই কবি ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন।কাঁপুনি আর বন্ধ হয় না।তিনচার জনে মিলে কম্বল চাপা দিয়েও কাঁপুনি বন্ধ করতে পারছেন না। আধ ঘন্টা বাদে কাঁপুনি বন্ধ হলে কবি ঘুমিয়ে পড়লেন।সারাটা রাত তিনি ঘুমের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছিলেন। ৩০জুলাই, অপারেশনের দিন। সকলেই খুব তটস্থ। শঙ্কিত। অপারেশন টেবিল বসানো হয়েছে ‘পাথরের ঘরে’। অপারেশনের সাজসরঞ্জাম সবই রাখা হয়েছে হাতের কাছে। সকাল সাড়ে দশটার সময় ডাঃ ললিত বন্দ্যোপাধ্যায় হাত ধুয়ে অপারেশনের জন্য তৈরি হয়ে নিলেন। কবি হকচকিয়ে গেলেন যে আজই ওঁর অপারেশন হবে। বেলা এগারোটার সময় কবিকে স্ট্রেচারে করে অপারেশন টেবিলে আনা হল। ওঁর মুখের সামনে একটা মোটা পর্দা ঝুলিয়ে দেওয়া হলো যাতে অপারেশনের সময় উনি সব কিছু দেখতে না পান। লোকাল অ্যানাস্থেশিয়া দেওয়া হয়েছিল। ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করা হয় নি। এগারোটা কুড়ি মিনিটে অপারেশন শেষ হয়। ব্যান্ডেজ ও সেলাই বাঁধতে বাঁধতে আরও আধঘন্টা সময় পেরিয়ে যায়। বেশ ভালভাবে অপারেশন শেষ হল। গুরুদেবকে ঘরে আনা হল অপারেশন টেবিল থেকে। ডাক্তারবাবুরা চলে গেলেন কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করেন। বিকেলের দিকে গুরুদেব জানালেন অপারেশনের আশেপাশের জায়গাটাতে ভীষণ জ্বালা করছে। জ্বর আছে সামান্যই। ডাঃ ললিত বন্দ্যোপাধ্যায় সন্ধে সাতটার সময় এসে দেখে গেলেন গুরুদেবকে। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র লিখে দিয়ে গেলেন। সেদিনটা ও পরের দিনটা কাটল গুরুদেবের ব্যথা, জ্বালা, যন্ত্রণা নিয়ে। জ্বরটা বাড়ল। ডাক্তাররা চিন্তিত। নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শে ব্যস্ত। বাড়ির লোকেরা ভীত, শঙ্কিত। ২ অগাস্ট। কিছুটা ভাল অবস্থায় গুরুদেব। দু-চারটে কথা বললেল। তবে খাওয়াতে দারুণ অরুচি। ৩ অগাস্ট একই রকম কাটলো গুরুদেবের আচ্ছন্নের মধ্য দিয়ে। সন্ধ্যের দিকে বৌঠান প্রতিমাদেবী এসে পৌঁছলেন শান্তিনিকেতন থেকে। ইশারায় দু-একটা কথা হল। ডাক্তাররা দুবেলা আসা-যাওয়া করছেন। ২-৩ জন ডাক্তার সব সময়ের জন্য বাড়িতে রয়েছেন। কেউ কিছু করতে পারছেন না। জ্বর ক্রমেই বেড়ে চলেছে। গুরুদেব ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ৫ অগাস্ট সারাদিন গুরুদেব ঘোরের মধ্যে কাটালেন। সন্ধ্যের দিকে ডাক্তার নীলরতন সরকার এলেন, সঙ্গে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। সব লক্ষণই গভীর মনোযোগ সহকারে দেখলেন। গুরুদেবের পাশে বসেছিলেন অনেকক্ষণ তার ডান হাতখানা হাতে নিয়ে। একসময়ে উঠে গেলেন কাউকে কিছু না বলে। রাতের দিকে স্যালাইন দেওয়া হল গুরুদেবকে। মুখে চোখে অন্তিম পর্যায়ের ছাপ ফুটে উঠেছে। পরদিন ৬ অগাস্ট। ভরা পূর্ণিমা। বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। গুরুদেবের কাশির দমকটা ক্রমেই বেড়ে চলল। সঙ্গে হিক্কার আওয়াজ। গুরুদেবের তরফ থেকে তেমন কোন সাড়াশব্দ নেই। বৌঠানের ডাকে একবার চোখ মেলে তাকালেন। ওইটুকুই পর্যন্ত। খাওয়া বলতে গ্লুকোজের জল আর ফলের রস। তাও ভয়ে ভয়ে খাওয়ানো হচ্ছে। পাছে বমি আর হিক্কা ওঠে। রাত বারোটায় গুরুদেবের অবস্থার খুব অবনতি হল। অক্সিজেন চালানো হল। হাতে স্যালাইনের বোতল। পরদিন ৭ অগাস্ট, ১৮৪১ সাল। বাংলায় ২২শে শ্রাবণ। গুরুদেবের শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুততর হল। গুরুদেবের কথা সম্পূর্ণ বন্ধ। কোমায় আচ্ছন্ন। গায়ের তাপমাত্রা আস্তে আস্তে কমে আসছে। দ্বিপ্রহরে বেলা ১২টা বেজে ১০ মিনিটে গুরুদেব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। চারিদিকে দারুণ কোলাহল। শেষবারের মত একবার দেখতে চান গুরুদেবকে সেই সঙ্গে জানাতে চান তাঁদের অন্তরের শেষ শ্রদ্ধা। একে একে এসে সবাই শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েগেলেন। অন্যদিক থেকে বেজে উঠলো ব্রহ্মসঙ্গীতের শান্ত সুর। সুরের সাগরে পাড়ি দিয়ে অমৃতলোকে চলে গেলেন আমাদের রাজার রাজা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।