অক্টোবর ১৪, ১৮৫৬, ‘সম্বাদ ভাস্কর’ পত্রিকায় রামনিধি গুপ্ত রচিত ‘গীতরত্ন’ বইয়ের বিজ্ঞাপনঃ ‘এক্ষণে নিধুবাবুর গীতরত্ন বলিয়া মধ্যে ২ যাহারা বিজ্ঞাপন করিতেছে সে প্রতারণা মাত্র। সে গ্রন্থ সটীক নহে, অবিকল ছাপাইতে না পারিয়া বিস্তর ভুল করিয়াছে তাহাতে ভাবের এত অধিক ব্যত্যয় জন্মিয়াছে যে কোন প্রকারে ভাবগ্রহ হয় না অতএব গ্রাহক মহাশয়েরা এমত গ্রন্থ লইতে সাবধান হইবেন।…অতঃপর আমারদিগের গীতরত্ন গ্রন্থ যাঁহারা গ্রহণ করিতে বাঞ্ছা করিবেন তাহারা কসাইটোলা ৬ নং মর্নিং ক্রনিকেল অফিসে, বালাখানা গলির মধ্যে ভাস্কর যন্ত্রালয়ে অথবা কুমারটুলি নন্দরাম সেনের গলির মধ্যে গ্রন্থকর্তার ২২/২ নম্বর ভবনে অন্বেষণ করিলে প্রাপ্ত হইবেন ইহা ব্যতীত আর কোনও স্থানে সটীক পাইবেন না। ইতি রাম্নিধি গুপ্তাত্মজ শ্রীজয়গোপাল গুপ্ত।’
বিশ শতকের গোড়া থেকেই বাংলা প্রকাশনার যে সংগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা বিকশিত হতে শুরু করে একটু একটু করে, সেই কাঠামো কিন্তু উনিশ শতকের শুরুতে ছিল না। কল্কাতায়১৭৮১ সালে অনারেবল কোম্পানিজ প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়, ১৭৮৫ সালে জন হে একটি বই বিক্রির দোকানও খোলেন। আরও পরে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা প্রকাশনার সঙ্গে বাঙালিরা ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলেন। তবে সুকুমার সেনের ভাষায় ‘বাঙালি পুস্তক প্রকাশকদিগের ব্রহ্মা’ হলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। গোড়ার দিকে বাংলা বইয়ের প্রকাশনা, বিপণন সবই ছড়িয়ে ছিল বটতলার বিরাট ভৌগলিক পরিসর জুড়ে। অধিকাংশ বই তখন গ্রন্থাকারে বাড়ি অথবা যে-প্রেসে বইটি ছাপা হত, সেখানে পাওয়া যেত। এমনকী বিশ শতকের গোড়ার দিকেও মুদ্রক ও প্রকাশক ছিলেন একই ব্যক্তি। উনিশ শতকের তিনের দশকে চিৎপুর অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় নৃত্যলাল শীলের বইয়ের দোকান — এন.এল.শীল এন্ড কোম্পানি। রামমোহন রায়ের বই ছাপা হত ফেরিস এন্ড কোম্পানি, ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেস ও সংস্কৃত প্রেসে। বঙ্গভাষানুবাদক সমাজের বইগুলি পাওয়া যেত ‘গরাণহাটার চৌরাস্তাস্থিত ২৭৬/১ সংখ্যক সমাজের পুস্তাকাগারে, মানিকতলা স্ট্রিট নং ৪৬/৪৭ সহকারি সম্পাদকের (মধুসূদন মুখোপাধ্যায়) বাটিতে, স্কুল বুক সোসাইটি, রোজারু কোম্পানি এবং কলিকাতাস্থ আর আর পুস্তক বিক্রেতাদের নিকট।’
যখন কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বইয়ের দোকানের সংখ্যা ছিল নগণ্য, তখন বই বিক্রির প্রধান উপায় ছিল বই ফিরি করা। বটতলার বই মুখ্যত ফেরিওয়ালাদের সাহায্যে কলকাতার অলিতে-গলিতে ও বাংলার গ্রামে-গ্রামান্তরে বিক্রি হত। উনিশ শতকের শেষদিক থেকে প্রকাশনা এবং বই বিপণনের ছবিটা বদলাতে শুরু করে। ঈশ্বরচন্দ্র বসু (আই.সি.বসু) ছিলেন স্ট্যানহোপ প্রেসের মালিক। আই.সি.বসু এন্ড কোম্পানি হয়ে ওঠে সেকালের প্রধানতম প্রকাশনা। মাইকেল মধুসূদনের বই, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের উদ্যোগে সচিত্র বিদ্যাসুন্দর নাটক, প্যারীচাঁদ মিত্রের গ্রন্থাবলির প্রকাশক ছিলেন এঁরা। সেই সময়ের আর একজন বিখ্যাত প্রকাশক ক্যানিং লাইব্রেরির যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। উনিশ শতকের শেষদিকে কলকাতায় সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান ছিল যোগেশচন্দ্রের এবং তাঁর ক্যানিং লাইব্রেরি ছিল একটি প্রধান প্রকাশন সংস্থা। আর একটি অন্যতম বই বিক্রির দোকান ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি। এরপরই বাংলা বই প্রকাশনা এবং বিক্রির ক্ষেত্রে যে প্রথিতযশা সংস্থাটির আবির্ভাব, তার নাম গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স। ১৮৮৫ সালে ২০১ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে গুরুদাস লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বইয়ের প্রকাশক ছিলেন তাঁরা। গুরুদাসের মৃত্যুর পর পুত্র হরিদাস চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন একসময়ে রবীন্দ্রনাথের বই ক্যানিং লাইব্রেরি এবং চীনাবাজারে পদ্মচন্দ্র নাথের দোকানে বিক্রি হত। পরে বিশ্বভারতী প্রকাশনের আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের বই প্রকাশ করেছেন বসুমতী সাহিত্য মন্দির, মজুমদার লাইব্রেরি এবং ইন্ডিয়া পাবলিশিং হাউস। বঙ্কিমচন্দ্রের শেষজীবনে লেখা বইগুলি তাঁর বাসস্থান ২ নং ভবানীচরণ দত্ত লেন অথবা ৫ নং প্রতাপ চাটুজ্যে লেন থেকে উমাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশিত হত। রামতনু লাহিড়ীর দ্বিতীয় পুত্র শরৎকুমার লাহিড়ী প্রতিষ্ঠা করেন এস.কে.লাহিড়ী এন্ড কোম্পানি। ১৮৮৩ সালে শুরু হয়ে এঁদের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছিল। উনিশ ও বিশ শতকের অনেক প্রথিতযশা বাংলা পুস্তক প্রকাশনাই আজ বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে গেছে। উনিশ শতকের বেণীমাধব দে এন্ড কোম্পানি, বিহারীলাল শীল ও আনন্দলাল শীল, থ্যাকার স্পিঙ্ক এন্ড কোম্পানির পাশাপাশি বিশ শতকের যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি, কমলা বুক ডিপো, মহেন্দ্র দত্তের বাণী মন্দির, স্টুডেন্টস লাইব্রেরি, মিনার্ভা লাইব্রেরি, মনোমোহন লাইব্রেরি প্রভৃতির নাম করা যায়। ১৮৮৬ সালে মাত্র পঞ্চাশটি বই নিয়ে গিরিশ্চন্দ্র দাশগুপ্ত প্রতিষ্ঠা করেন দাশগুপ্ত এন্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। যা এখনও রীতিমতো চালু প্রতিষ্ঠান। এই বিপুল সংখ্যক প্রকাশনী থেকে বাছাই করে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বাংলা প্রকাশন সংস্থার ভিতরেই এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে, যেগুলি দীর্ঘ সময় পরিসর জুড়ে বাঙালির চেতনায় ও সাংস্কৃতিক পরিসরে ছাপ ফেলে গেছে।
বাংলা প্রকাশনা এবং বই বিপণনকে যাঁরা প্রথম সংহত প্রাতিষ্ঠানিক চেহারায় দাঁড় করাতে সাহায্য করেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান নাম ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স’। নদীয়া জেলার দাদপুর গ্রামের অতি দরিদ্র পরিবারের ছেলে গুরুদাসবাবু খুব অল্প বয়সেই হিন্দু হোস্টেলের কর্মচারী নিযুক্ত হন। মেডিক্যাল কলেজে পাঠরত আবাসিক ছাত্রদের জন্য ডাক্তারির বই এনে বিক্রির মাধ্যমে গুরুদাসের বইয়ের ব্যবসার সূচনা। ১৮৭৬ সালে বউবাজারে ঘর ভাড়া নিয়ে খুললেন বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরি। এরপর নিজেই বই প্রকাশ করবেন স্থির করলেন। প্রথম প্রকাশনা রজনীকান্ত গুপ্ত রচিত বিখ্যাত বই ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’-এর প্রথম খণ্ড (১৮৮৬)। এর পর বাকি চারটি খণ্ড প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৮৯২, ১৮৯৩, ১৮৯৭ এবং ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে। পাঁচ ভাগ মিলিয়ে মোট ১৫৫০০ পৃষ্ঠার বই। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বাবার জীবদ্দশাতেই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লেন দুই পুত্র সুধাংশু ও হরিদাস। বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথও বই বিক্রির ক্ষেত্রে গুরুদাসের শরণাপন্ন হলেন। ৮ জুন ১৮৮৯ লেখা চিঠিতে বঙ্কিম ভাইপো জ্যোতিষচন্দ্রকে লিখছেনঃ ‘জাল প্রতাপচাঁদ ফুরাইয়াছে। তুমি খরচপত্র করিয়া নূতন edition ছাপাইতে প্রস্তুত আছ কি? বোধ করি তাহা পারিবে না। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় নিজ ব্যয়ে এক edition (1000 Copies) ছাপিয়া লইতে চাহিতেছেন। কিন্তু আমাদিগকে কেবল ৬০ টাকা মুনাফা দিতে চাহেন। তাহাতে রাজি কিনা লিখিবে।’ জ্যোতিষচন্দ্রের বাবা বঙ্কিমের অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বই পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে বংশধরকে রয়্যালটি দিতে চাইছেন নতুন প্রকাশক। বিষয়টি নজর করার মতো। যখন গুরুদাসবাবু পুরোদস্তুর প্রকাশক হননি, কেবল বইবিক্রেতা হিসেবেই বিখ্যাত, তখনই রবীন্দ্রনাথ নিজের বই বিক্রির দায়িত্ব তাঁকে দিয়ে চুক্তি করছেন। ১২ জুলাই ১৮৮৪ তারিখের চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়কে বলছেনঃ ‘আমাদের ফর্দে লিখিত পুস্তকগুলি আমি আপনার নিকট দুই হাজার তিনশত নয় — ২৩০৯ টাকা মূল্যে বিক্রয় করিলাম।…এ সকল পুস্তক যতদিন না আপনার বিক্রয় শেষ হইবে ততদিন আর এগুলি পুনর্মুদ্রিত করিব না। পুস্তক আপনার ইচ্ছামত মূল্যে আপনি বিক্রয় করিতে পারিবেন।’
সেই সময়টাই বাংলা পেশাদার রঙ্গমঞ্চ এবং বাংলা নাটকের স্বর্ণযুগ। রাজকৃষ্ণ রায়-সহ বহু নাট্যকারের বই সেযুগে ছেপেছেন তাঁরা। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স খ্যাতির শীর্ষে ওঠেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই প্রকাশ করে। এঁদের প্রকাশিত শরৎচন্দ্রের প্রথম বই ‘বিরাজ বৌ’। আবার শরৎচন্দ্রকে কেন্দ্র করেই এম.সি.সরকার অ্যান্ড সন্সের সঙ্গে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তুঙ্গে ওঠে। কারণ তাঁরাও শরৎচন্দ্রের বই একের পর এক ছাপতে থাকেন। প্রথমদিকে বই ছাপার ব্যাপারে তেমন কৃৎকৌশলগত যত্ন না থাকলেও শরৎচন্দ্রের বইগুলি শক্ত মলাট, মলাটে রেক্সিনের নীচে তুলোর প্যাড, রেক্সিনে এমবস করা গ্রন্থনাম, গ্রন্থকারের নাম, সোনার জলে প্রকাশকের নাম-সহ ছাপা হত। সুরেন্দ্রনাথ রায়, রজনীকান্ত সেন, জলধর সেন, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, শৈলবালা ঘোষজায়া, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রভাবতীদেবী সরস্বতী, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, বিজয়রত্ন মুখোপাধ্যায়, মানকুমারী বসু, সুরুচিবালা রায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, রাধারানী দেবী-সহ সে যুগের প্রায় সব প্রথম সারির লেখকদের বই বেরিয়েছিল এখান থেকে। তাঁদের আট আনা সিরিজের বইও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। লেখকদের মধ্যে ছিলেন নিরুপমা দেবী, জলধর সেন, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমনলিনী দেবী প্রমুখ। কেবল পুস্তকব্যবসায়ী নন, মানুষ হিসেবেও গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অনন্য। লেখকদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন তিনি। প্রতিবেশী (গুরুদাসের প্রকাশনা ছিল ২০৩/১/১ কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট) নাট্যকার মনোমোহন বসু (২০২ কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট, বর্তমান বিধান সরণি) গুরুদাসকে নিয়ে ছড়া লিখেছিলেনঃ
চাঁদের হাট পেতেছেন পাড়ায় গুরুদাস।
সোনার ছেলে-মেয়ে আপনি গিন্নী, তেম্নি শ্বশুর
তেমনি শ্ব্যাস।
কিবা শান্ত ছেলে হরি, মরি মরি কি মাধুরী
ও তায় দেখলে সাধ যায় কোলে করি
কথা শুনলে হয় উল্লাস
নন্দিনী তাঁর নন্দরানী, ফুল্ল কমল বদনখানি
যেন আনন্দময় ঠাকুরানী
এসেছেন ছেড়ে কেনাস…
গুরুদাসবাবুর দোকান আজ আর নেই। কেবল প্রকাশনার নামাঙ্কিত মর্মরফলকটি রয়েছে তাঁদের বিধান সরণির ঠিকানায়। শেষ উনিশ শতক এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে আর একটি সাড়া জাগানো প্রকাশনা কিন্তু আজও টিকে রয়েছে। সেটি ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’। প্রতিষ্ঠাতা উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। স্থাপিত ১৮৮০। ১৯ বৃন্দাবন বসাক লেনের একটি ক্ষুদ্র দোকানঘর থেকে শুরু করে অতি দ্রুত এটি হয়ে ওঠে সে যুগের জনপ্রিয় বাংলা প্রকাশনার এক অনন্য মাইলস্টোন। প্রথম প্রকাশিত বইয়ের নাম ‘যদুবংশ ধ্বংস যাত্রা’। লেখক উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। প্রকাশ তারিখ ৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৩। এর পরের বইটির নাম ‘দুর্গাপূজার আমোদ’, উপশিরোনাম ‘দুর্গাপূজা উপলক্ষে নিম্নশ্রেণীর লোকদের আমোদ দিবার জন্য পথসাহিত্য।’ ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৮-র ভিতর ‘বসুমতী’ থেকে প্রকাশিত সতেরোটি বইয়ের মধ্যে আটটি বই এই ধরনের চটুল রসের। বিপুল তাদের বিক্রির পরিমাণ। যেমন ‘দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ’, ‘ভোজবিদ্যা’, ‘সত্যনারায়ণ ব্রতকথা ও পুঁথি’, ‘সীতার বনবাস’, ‘বাসরযামিনী নাটক’ ইত্যাদি। ১ জুন ১৮৮৯ বেরোয় এক ঐতিহাসিক বই — ‘রাজভাষা’, ‘একটি উচ্চমানের ইংরাজি শিক্ষার বই’। পরের বছর বেরোয় ‘বিদ্যালয় পাঠ্য ইংরাজি শিক্ষার বই ইংরাজি বোধ’। কিন্তু পুরনো বটতলা ঘরানা থেকে আধুনিক বাংলা প্রকাশনার ধারায় দ্রুত প্রতিসরণ ঘটে ‘বসুমতী’র। বটতলা ধারায় এঁদের শেষ বই ‘সচিত্র সম্ভোগ তত্ত্ব’ (১৮৮৯)। এরপরই ‘বসুমতী’ বাংলার প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের গল্প-উপন্যাসের বিপুল সম্ভারকে পাঠকদের সামনে হাজির করেন অত্যন্ত স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে। প্রখ্যাত সাংবাদিক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্যঃ ‘বাংলা সাহিত্যের যাঁরা স্বনামধন্য লেখক…তাঁদের প্রায় সকলের রচনাই বসুমতীর এই সস্তা প্রকাশনীর মারফৎ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। মাইকেল মধুসূদন, দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র, ডি.এল.রায় পর্যন্ত যুগান্তকারী লেখকদের রচনা বাংলা দেশের ঘরে ঘরে প্রচারিত হয়েছিল।…মাত্র এক টাকা দামে বিখ্যাত ব্যক্তিদের গ্রন্থাবলী একসঙ্গে কিনতে পাওয়া নিঃসন্দেহে একটা দুর্লভ সুযোগের মতো ছিল।’ গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, মণিলাল চট্টোপাধ্যায়। দেবেন্দ্রনাথ রায়, দীনবন্ধু মিত্রর নাটক কখনও বিচ্ছিন্ন আকারে বেরিয়েছে এঁদের প্রকাশন থেকে। এমনকী একসময় থিয়েটার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি হিসেবে উচ্চদামের টিকিটের সঙ্গে বসুমতী সাহিত্য মন্দির প্রকাশিত একখণ্ড বই বিতরিত হত। সুলভ দামে চিরায়ত সাহিত্যের প্রচারেও বসুমতী ছিল অগ্রণী। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী, ১৯১৬-১৭ সালে স্বর্ণকুমারী দেবীর গ্রন্থাবলী তিন খণ্ডে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রন্থাবলী পাঁচ খণ্ড, ১৯১৯ সালে শরৎচন্দ্রের গ্রন্থাবলী প্রকাশিত হতে শুরু করে। মোট সাত খণ্ডে বেরোয় শরৎ গ্রন্থাবলী। বঙ্কিমচন্দ্রের বহু উপন্যাসের নাট্যরূপ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন অমৃতলাল বসু। নাট্যরূপ প্রকাশিত হয় ‘বিষবৃক্ষ’ এবং ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসেরও। সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের যে চুক্তি হয় তাতে লেখককে ২৫ শতাংশ রয়্যালটি দেওয়ার কথা বলা হয়। গোয়েন্দা গল্প এবং বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ প্রকাশেও বসুমতী ছিল অগ্রণী। ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হয় গোয়েন্দা গল্পের সঙ্কলন ‘নন্দনকানন সিরিজ’। মোট উনিশটি খণ্ড বেরিয়েছিল। গোয়েন্দা গল্প সিরিজ ‘লন্ডন রহস্য’র বেরোয় সাতাশ খণ্ড। ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয় দুই খণ্ডে শেক্সপিয়রের গ্রন্থাবলী। অনুবাদক ছিলেন সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ বসু, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, যতীন্দ্রমোহন ঘোষ, পশুপতি ঘোষ প্রমুখ। শরৎচন্দ্র মিত্র অনুবাদ করেন স্যার ওয়াল্টার স্কটের চারটি বই। আরও বেরোয় বিদেশি গল্পের অনুবাদ সঙ্কলন ‘বিলাতি গুপ্ত কথা’। ‘বসুমতী’ প্রকাশনের আরও কয়েকটি সমৃদ্ধ প্রকাশনা ছিল ধর্মগ্রন্থ, জ্যোতিষশাস্ত্র, মহাকাব্য, দৈনন্দিন চাহিদা বিষয়ক বইপত্রের। আর সমকালীন রাজনৈতিক প্রসঙ্গেও বসুমতীর বইপত্রের ছিল বিরাট সম্ভার। ১৯১০-এ প্রকাশিত হয় ‘সচিত্র ভারতসম্রাট বা এডওয়ার্ড চরিত’। ১৯১৫ সালে সরোজনাথ ঘোষ লেখেন ‘বিসমার্ক’এর জীবনী। ১৯১৯ সালে সরোজনাথই লেখেন ‘যুবরাজ বা জার্মানির ক্রাউন প্রিন্সের ইতিকথা’। ১৯২০-তে হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ লেখেন ‘কংগ্রেস’। ১৯২০-তেই বেরোয় ‘খেলাফৎ সমস্যা’। অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রকাশিত হয় ‘মহাত্মা গান্ধীর জীবনী’ এবং মহাত্মা গান্ধী ও ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বক্তৃতাবলী’। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পটভূমিতে বেরোয় ‘বলশেভিকবাদ বা রুসিয়ার বিপ্লব’ এবং ‘মহাপ্রলয়ে রুসিয়ার স্বাধীনতা’। লেখক, আবারও সরোজনাথ ঘোষ। প্রকাশকাল ১৯২০ এবং ১৯৩১। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিষয়ে ছাপা হয় ‘যুদ্ধ ইতিহাস’ (১৯১৪) এবং ‘বিংশ শতাব্দীর মহাসমর’ (১৯১৫)। বইয়ের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও ‘বসুমতী প্রকাশন’ স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রাখে। তখনও ততটা পরিচিত নন এমন লেখিকা আশাপূর্ণা দেবীর গ্রন্থাবলীর (১৯৫১) বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিলঃ ‘মনস্তত্ব বিশ্লেষণের সূক্ষ্ম নৈপুণ্যের দিক দিয়া বিচার করিতে গেলে তাঁহার রচনা সমারসেট মমের সহিত তুলনীয়। আধুনিক সাহিত্যের উদ্দাম ঝড়ের মধ্যে থাকিয়াও তাঁহার লেখনী যে সংযম ও শালীনতার পরিচয় দেয়, তাহা অপূর্ব।’
বসুমতী প্রকাশন নানাবিধ ঝড়ঝাপটা উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে আজও টিকে আছে। নবকলেবরে বেরোচ্ছে ‘বসুমতী সাহিত্য পত্রিকা’।
‘এম.সি.সরকার এন্ড সন্স’ প্রকাশনা তার শতবর্ষ অতিক্রম করেছে অতি সম্প্রতি। প্রতিষ্ঠাতা মহিমচন্দ্র সরকার ছিলেন প্রভাবশালী আইনজীবী। ১৯১০ সালে তিনি ‘রায় এম.সি সরকার বাহাদুর এন্ড সন্স’ নামে একটি প্রকাশন সংস্থা খোলেন। ৭৫/১/১ হ্যারিসন রোড থেকে ১৪ বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রিটে চলে আসে এই প্রকাশনা ১৯৩৯ সালে। প্রথমদিকে আইনের বই ছাপা হলেও ১৯১৮ সাল থেকে তাঁরা গল্প উপন্যাসও ছাপ্তে শুরু করেন। ১৯২৯ সালে এই প্রকাশনা থেকেই ‘মৌচাক’ পত্রিকা বেরোয়। ক্রমে ‘মৌচাক’কে কেন্দ্র করেই এক শক্তিশালী লেখকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রকুমার রায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়রা ছিলেন ‘মউচাক’-এর লেখক। ১৯২৫ সালে ‘মৌচাক’-এর আড্ডায় প্রথম আসেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নরেন্দ্র দেব, চারু রায়। ‘যুগান্তর’ ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকার সম্পাদক তুষারকান্তি ঘোষ, প্রবোধকুমার সান্যাল, গজেন্দ্রকুমার মিত্র ছিলেন আড্ডার নিয়মিত সদস্য। পরশুরাম ও স্যার যদুনাথ সরকারের যাবতীয় বই প্রকাশের দায়িত্ব পায় এম.সি. সরকার। শিবরাম চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থ, অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘পথে-প্রবাসে’, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘লালকুঠি’, বুদ্ধদেব বসুর ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘বীরেশ্বর বিবেকানন্দ’, ‘বেদে’, ‘কল্লোল যুগ’, গীরেন্দ্রশেখর বসুর ‘স্বপ্ন’, ‘পুরাণ প্রবেশ’, ‘লাল কালো’। শম্ভু মিত্রের ‘চাঁদ বণিকের পালা’ ‘অয়দিপাউস ও পুতুল খেলা’, উৎপল দত্তের ‘শেক্সপীয়রের সমাজচেতনা’, ‘গিরিশ মানস’ প্রভৃতি সুপ্রসিদ্ধ বইয়ের প্রকাশক এম.সি.সরকার। এই প্রকাশনা থেকেই বেরোত ‘নাচঘর’ পত্রিকা। প্রথম সম্পাদক ছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায় ও প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। চলচ্চিত্র-যাত্রা-নাটক বিষয়ে একটিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা পত্রিকা। এ ছাড়াও ‘কুন্তলীন’এর এইচ বসুর পুত্র হিতেন্দ্রমোহন বসুর ‘হসন্তিকা’ পত্রিকা এবং দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের ‘বিদূষক’ পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন এঁরাই। এই প্রকাশনাই নববর্ষকে উপলক্ষ্য করে প্রথম সাহিত্যবাসর ও সাহিত্য পুরস্কার কপ্রথম প্রবর্তন করেছিল। ১৯৫৫ সালে প্রথম সাহিত্যবাসরে সভাপতিত্ব করেন যদুনাথ সরকার। ‘মৌচাক’ পত্রিকার পক্ষ থেকে শিশুসাহিত্যের জন্য ৫০০ টাকা পুরস্কারের প্রবর্তন করেন। এর পর থেকেই ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকাগোষ্ঠীও সাহিত্য পুরস্কার চালু করেন।
পাঁচ প্রজন্ম ধরে বাংলা বই প্রকাশনার ধারায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন ‘দেব সাহিত্য কুটীর’। বরোদাপ্রসাদ দেব মজুমদারের সুযোগ্য পুত্র আশুতোষ দেব মজুমদারের সক্রিয় কর্মোদ্যোগে এই প্রতিষ্ঠানের জয়যাত্রা শুরু। প্রথমদিকে অভিধান এবং স্কুলপাঠ্য বই প্রকাশ করতেন তাঁরা। সত্য চক্রবর্তীর দুটি উপন্যাস ‘প্রেমের হাট’ এবং ‘চাঁদের দেশে’ দিয়ে এঁদের ভিন্ন ধরনের বই প্রকাশের সূচনা। এই পরিবারের অন্যতম সদস্য সুবোধ দেব মজুমদার ১৯২৪ সালে হাইকোর্টের নিলামে উঠে যাওয়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যাবতীয় বইয়ের স্বত্ব কিনে নেন। ‘দেব সাহিত্য কুটীর’ ব্যানারে এই বইগুলোই প্রথম ছাপা হয়। পাশাপাশি এ.টি.দেব প্রেস, দেব সাহিত্য কুটীর ও পি.সি.মজুমদার এন্ড ব্রাদার্স — তিনটি সমান্তরাল প্রকাশনা চালাচ্ছিলেন তাঁরা। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাঙালি কিশোর কিশোরীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রকাশিত হয় ‘অনুবাদ সিরিজ’। এ ছাড়াও ‘প্রহেলিকা সিরিজ’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজ’, স্বপঙ্কুমার প্রণীত বিশ্বচক্র সিরিজের তুমুল জনপ্রিয়তা ‘৮০-র দশক অবধি বজায় ছিল। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বেরোল ছোটদের পত্রিকা ‘শুকতারা’। ছোটদের পত্রিকা হিসাবে ৬৫ বছর পেরিয়ে যাওয়া এই পত্রিকা আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মধুসূদন মজুমদারের নাম সম্পাদক হিসেবে থাকলেও বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রব্রত চট্টোপাধ্যায়। এই পত্রিকার পাতাতেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন নারায়ণ দেবনাথ তাঁর হাঁদাভোঁদার কাণ্ডকারখানা, বাঁটুল দ্য গ্রেট, বাহাদুর বেড়াল, গোয়েন্দা কৌশিকের কমিক্সের মাধ্যমে। মার্চ ১৯৬০-এ সুবোধচন্দ্র ও মধুসূদন মজুমদারের সম্পাদনায় বেরোয় ‘নবকল্লোল’ পত্রিকা। এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকে আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেন অভিনেতা উত্তমকুমার। বাংলা সাহিত্যের অসংখ্য উজ্জ্বল নক্ষত্রের সমাবেশ ঘটেছিল এই পত্রিকায়। অসংখ্য জনপ্রিয় কালজয়ী উপন্যাসের ধাত্রীভূমি এই পত্রিকা আজও রমরম করে চলছে। ‘দেব সাহিত্য কুটীর’-এর আর একটি বড়ো অবদান একের পর এক ‘পূজাবার্ষিকী’। ১৯৩১ সালে সুনির্মল বসুর সম্পাদনায় ‘ছোটদের চয়নিকা’ হল ‘দেব সাহিত্য কুটীর’-এর প্রথম পূজাবার্ষিকী হিসেবে প্রকাশিত হয়। তার পর থেকে প্রত্যেক বছর প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের সম্পাদনায় একটি করে পূজাবার্ষিকী প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৩১ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত পূজাবার্ষিকীগুলি নিয়মিত বেরিয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে ‘শুকতারা’র পূজাসংখ্যা বের হতে শুরু করে। আজও এগুলির জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের এমন কোনও রথী-মহারথী নেই, যিনি ‘দেব সাহিত্য কুটীর’-এর পূজাবার্ষিকীতে লেখেননি। অরুণচন্দ্র মজুমদার, প্রবীরকুমার মজুমদার হয়ে এই প্রকাশনার ব্যাটন ধরতে এগিয়ে এসেছেন রাজর্ষি মজুমদার ও পিনাকী মজুমদার। সিরিজ সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্যের বইগুলির বিপুল পুনর্মুদ্রণের মধ্য দিয়েই এঁদের জনপ্রিয়তা টের পাওয়া যায়।
বিশ শতকের গোড়ায় সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেওয়া গোপালদাস মজুমদার এবং বারীন্দ্রকুমার ঘোষের ‘বিজলী’ পত্রিকার ম্যানেজার বিধুভূষণ দে — দুই বন্ধুর মিলিত প্রয়াসে গড়ে ওঠে ডি.এম.লাইব্রেরি। বিধুভূষণ এবং গোপালদাসের পদবির আদ্যক্ষর মিলিয়ে (ডি এবং এম) এই নামকরণ। এই প্রকাশনের প্রথম বই ১৩২৯ বঙ্গাব্দে ‘বারীন্দ্রের আত্মকাহিনী’– বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের আত্মজীবনী। অরবিন্দ ঘোষ, চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতারা বিভিন্নভাবে জড়িয়ে ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ফলে পুলিশের নজরদারি প্রথম দিন থেকেই ছিল। অথচ অচিরেই এই প্রকাশনা হয়ে ওঠে সমকালীন প্রায় সব কটি প্রধান সাহিত্যিক গোষ্ঠীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক সংস্থা। নলিনীকান্ত গুপ্তর ‘স্বরাজ গঠনের ধারা’, শচীন সেনগুপ্তর ‘চিঠি’ এবং আরও কয়েকটি বই গোড়ার দিকে ছাপা হয়েছিল। এরপর কাজী নজরুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠল ডি.এম. লাইব্রেরির। নজ্রুল সঙ্গে করে নিয়ে এলেন বাংলা সাহিত্যের আরও অনেক তরুণ বিদ্রোহী সাহিত্যিকদের — প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ। তৎকালীন বড়ো প্রকাশকরা তখনও এঁদের বই বের করেননি। গোপালদাস মজুমদার কিন্তু পত্রিকায় লেখা পড়ে নতুন লেখকদের খুঁজে বের করে তাঁদের গল্প-উপন্যাস ছেপেছেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের প্রথম উপন্যাস ‘আগুন নিয়ে খেলা’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দিবারাত্রির কাব্য’, জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ এখান থেকেই ছাপা হয়েছে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নবেন্দু ঘোষ, সমরেশ বসুকে তুলে ধরেছিল ডি.এম.লাইব্রেরি। বিভিন্ন সাহিত্যগোষ্ঠীর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব যাই থাক, গোপালদাসবাবুর কাছে ছিল সবার অবারিত দ্বার। ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে যেমন এসেছিলেন একদল নতুন সাহিত্যিক, তেমনই সজনীকান্ত দাশের ‘শনিবারের চিঠি’র সাহিত্যিকবৃন্দ, ‘দেশ’ পত্রিকার সাগরময় ঘোষের হাত ধরে তরুণ সন্তোষকুমার, বিমল কর, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীরাও ডি.এম.লাইব্রেরির পৃষ্ঠপোষণা পেয়েছেন। লাহোর থেকে রেঙ্গুন। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী যেখানেই বাঙালি বসতি ছিল, সেখানেই ডি.এম.লাইব্রেরির ব্যবসা ছিল প্রসারিত। আজও প্রতিষ্ঠানটি আছে। যদিও আগের মতো রমরমা নেই।
বয়সে কিছুটা ছোট হলেও আভিজাত্য গৌরবে ‘মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স’ অনন্য। গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও সুমথনাথ ঘোষ দুই সাহিত্যিক বন্ধুর উদ্যগে এই প্রকাশনীর পথ চলা শুরু ৯ মার্চ ১৯৩৪। ১১ নম্বর কলেজ স্কোয়ারে প্রকাশনা শুরু হলেও দ্রুত চলে আসে ১০ নম্বর শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটে। প্রথম বই সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের ‘রবি-দীপিতা’। দ্বিতীয় বই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘জাতি সংস্কৃতি ও সাহিত্য’, এরপর প্রবোধকুমার সান্যালের ‘দেশ দেশান্তর’। একে একে যুক্ত হলেন সুপ্রসিদ্ধ লেখকরা — কালিদাস রায়, কৃষ্ণদয়াল বসু, বুভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী। ‘মিত্র ও ঘোষ’ থেকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম বই ‘অভিযাত্রিক’। তারাশঙ্করের ‘প্রতধ্বনি’। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় সেসময় প্রবীণরা আড্ডা দিতে যেতেন এম.সি.সরকারে। আর তরুণ সাহিত্যিকরা বস্তেন ‘মিত্র ও ঘোষ’-এ। প্রমথনাথ বিশী প্রথমটির নাম দেন ‘হাউস অফ লর্ডস’ আর ‘মিত্র ও ঘোষ’-এর নাম দেন ‘হাউস অফ কমন্স’। কালিদাস রায় একদিন এই আড্ডা থেকেই একটি নতুন সাহিত্য পত্রিকা বের করার প্রস্তাব দেন। ১৯৪৯ সালের পুজোর আগেই বেরোয় ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকা। সেই থেকে ‘মিত্র ও ঘোষ’ প্রকাশনার এই মাসিক কাগজ চলছে নিয়মিত। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, জরাসন্ধ, সুমথনাথ ঘোষ, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, অন্নদাশঙ্কর রায়, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, মনোজ মিত্র, নীরদচন্দ্র চউধুরী, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের গর্বিত প্রকাশক ‘মিত্র ও ঘোষ’। ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার থেকে নির্বাচিত গল্প, ‘সবুজপত্র’, ‘প্রবাসী’, এবং ‘কল্লল’-এর গল্প সঙ্কলন এখান থেকে বেরিয়েছে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর ‘পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ’র অখণ্ড সংস্করণ ‘মিত্র ও ঘোষ’ থেকে বেরিয়ে জনপ্রিয়তার সব রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছিল।
নাম করতে হয় বাংলার সাম্যবাদী সাহিত্যের প্রধানতম প্রকাশনা ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’র। ২৬ জুন ৯৩৯ কয়েকজন দুঃসাহসী কমিউনিস্ট পার্টিকর্মীর অপরিসীম উদ্যোগে মার্কসবাদী সাহিত্য প্রসারের কেন্দ্র হিসেবে এই প্রকাশনার শুরু। প্রথমদিকে চিরায়ত মার্কসবাদী লেখালেখির বাংলা অনুবাদই বেশি ছাপা হত। গোপাল হালদার, চিন্মোহন সেহানবীশ, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল চট্টোপাধ্যায়, সুবিমল লাহিড়ী, দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অমল দাশগুপ্ত ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের লেখক-অনুবাদক তালিকায়। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘সহযাত্রী’, ‘মা’, নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ‘ইস্পাত’, আলেক্সেই তলস্তয়ের ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছাড়াও ‘স্পার্টাকাস’, ‘রত্নবলয়’ প্রভৃতি বিখ্যাত অনুবাদ গ্রন্থ বেরোয় এখান থেকে। ১৯৪৩ সালে পুরোদস্তুর কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশনা হিসেবে এই সংস্থার দায়িত্বে ছিলেন মুজফফর আহমদ, তাঁদের পার্টিসাহিত্য প্রচার, প্রকাশ, বিভিন্ন সাংগঠনিক স্তরে যোগাযোগের কাজে সাহায্য করতেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। চুয়াত্তর বছরে এন.বি.এ ৪০০০-এরও বেশি বই প্রকাশ ও পুনর্মুদ্রণ করেছে। সম্প্রতি পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলা কমিউনিস্ট আন্দোলন ও প্রাসঙ্গিক তথ্য।’ এ ছাড়াও অসংখ্য রাজনৈতিক পুস্তিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সমকালীন সময়কে মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের কাজ করে চলেছে এই সমৃদ্ধ প্রকাশনী।
আরও পুরনো বা পরবর্তী এবং এখনও সচল প্রকাশনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি (১৯১৪), অগ্রণী বুক ক্লাব (১৯৩৯), শিশু সাহিত্য সংসদ (১৯৪৯), প্রকাশভবন, বেঙ্গল পাবলিশার্স, এ.মুখারজ্জী, সিগনেট প্রেস (আনন্দ পাবলিশার্স কর্তৃক বর্তমানে অধিগৃহীত)। ইংরেজি প্রকাশনার ক্ষেত্রে ‘দাশগুপ্ত এন্ড কোম্পানী’ এবং ‘শরৎ বুক হাউস’। বাংলা-ইংরাজি উভয় প্রকাশনায় ‘রূপা এন্ড কোং’ অগ্রণী প্রতিষ্ঠান। বিগত দেড়শো বছরের ইতিহাসে অনেক সাড়া-জাগানো বাংলা প্রকাশনার উদয় এবং অস্ত প্রত্যক্ষ করেছে বাংলা সাহিত্য। শিশির পাব্লিশিং-এর একচেটিয়া প্রকাশনা ছিল ‘দস্য মোহন সিরিজ’। মোট দুশো ছ-টি বই বেরিয়েছিল এবং অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তার রেকর্ড ছুঁয়েছিল সেইসব বই। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো প্রকাশক, প্রকাশনার ধরন, পাঠরুচি, লেখক-প্রকাশক সম্পর্কও আজ বদলে গেছে।
উনিশ শতকের শেষদিকেও বাংলা প্রকাশনার মূল এলাকা ছিল চিৎপুর, হেদুয়া, সিমলা, ঠনঠনিয়া অঞ্চল। বিশ শতকের গোড়া থেকেই এই বইব্যবসার মূল স্থান সরে গেছে কলেজ স্ট্রিট পাড়ায়। চিৎপুর অঞ্চলে পুরনো ঘরানার যে একটিমাত্র প্রকাশনা ও বইয়ের দোকান আজও বেঁচে আছে তার নাম ‘ডায়মন্ড লাইব্রেরি’। প্রতিষ্ঠাতা স্বনামধন্য নদেরচাঁদ শীল, ১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ সওয়াশো বছর ধরে এঁরা মূলত যাত্রা এবং নাটকের বই প্রকাশ করে চলেছেন। একসময় ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ, ব্রজেন্দ্রকুমার দে, প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, কানাই নাথ, বিজয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায়, পাঁচকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় নাটক ও পালার রচয়িতাদের অসংখ্য বই ছেপেছেন এঁরা। বর্তমানে দুই ভাই গণেশ্চন্দ্র শীল এবং বৈদ্যনাথ শীল কোনওক্রমে চালিয়ে জাচ্ছেন ব্যবসা। তাঁরা আক্ষেপ করেন, আজকের যাত্রাপালার বদলে যাওয়া চাহারায় তাঁদের আর কন্ট্রিবিউট করার তেমন কিছু নেই। তবুও শৌখিন নাটকের দলগুলির জন্য তাঁরা আজও নতুন নতুন সামাজিক-ঐতিহাসিক-পৌরাণিক যাত্রাপালা প্রকাশ করে চলেছেন। ‘ভাত পায় না ভাগের মা’, ‘কে আসামী স্ত্রী না স্বামী’, ‘জ্বলছে চিতায় সিঁথির সিঁদুর’, ‘জ্বলছে সমাজ পুড়ছে নারী’, ‘মা রেখেছি মাইনে করে, বৌ রেখেছি পায়ে ধরে’, ‘প্রেমের ঘাটে নৌকাডুবি’র মতো নিত্যনতুন টাইটেল ছাপছেন তাঁরা। এই দোকানেই পাওয়া গেল শ্রী স্বপনকুমার প্রণীত প্রায় অজ্ঞাত ‘রকেট সিরিজ’-এর বই — ‘তুফান আর তরঙ্গ’, ‘দস্যু প্রদ্যম্নের রণহুংকার’। দুই ভাইয়ের আক্ষেপ, বদলে যাওয়া সময়ে তাঁদের ব্যবসা আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে। একদিকে চিৎপুর রোড (রবীন্দ্র সরণি), অন্যদিকে কলেজ স্ট্রিট পুরনো বাংলা প্রকাশনার এক স্পষ্ট উল্লম্ফন ও বদলের ইতিহাস্কে ধারণ করে রেখেছে এভাবেই।
(তথ্যঋণঃ তাপস ভৌমিক ও ‘কোরক’ পত্রিকা, গণেশ্চন্দ্র শীল, আশিসগোপাল মজুমদার)
Tags: অর্ণব সাহা, পুরনো বাংলা প্রকাশনা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।