চৈত্র মাসে জন্মেছিলেন বলে হিমানীশ গোস্বামী নিজেকে বলতেন চৈত্রদিনের ঝরা পাতা। আমরা ঠাট্টা করে বলতাম ঝরা পাতার রং তো সবুজ হয় না, কিন্তু তুমি তো চিরসবুজ। ছেলেবেলায় তিনি খুব ফরসা ছিলেন। বাড়িতে মেয়েরা সে সময় হিমানী স্নো ব্যবহার করতেন। স্নো-এর রং সাদা। তাই সবাই তাঁকে হিমানী বলে ডাকা শুরু করলেন। সে নাম শুনে ছোটপিসিমা মঞ্জু নামের শেষে শ জুড়েছিলেন।
হিমানীশের সেন্স অফ হিউমার মামাদের কাছ থেকে পাওয়া। পরে তিনি দাদাঠাকুর এবং শিবরাম চক্রবর্তীর কাছাকাছি আসেন। শিবরাম চক্রবর্তীর ‘পান’ তিনি যেমন পছন্দ করতেন, তেমনই পছন্দ করতেন একটা কথা শোনবার সঙ্গে সঙ্গে তার একটা মজার উত্তর দিতে। এ প্রসঙ্গে অতি সম্প্রতি শোনা একটা উত্তর আমার মনে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে বাবা ‘একদিন’-এর ‘নবপত্রিকা’-য় লিখছিলেন। লেখা নেওয়ার ব্যাপারে বরাবরই দেবজ্যোতি তাঁর সঙ্গে কথা বলত। একদিন দেবজ্যোতি ফোন করে বলেছে, ‘আমি ‘একদিন’-এর দেবজ্যোতি বলছি।’ বাবা এক সেকেন্ডের মধ্যে উত্তর দিলেন,’আমি বহুদিনের হিমানীশ।’
আমরা ছোটবেলা থেকেই বাবার এইসব ধরনের কথাবার্তার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। তিনি একবার ঠিক করলেন বেড়ালদের কথা বলা শেখাবেন। বাবা বললেন, ‘দাঁড়া দু’দিনের মধ্যেই ওদের সব শিখিয়ে পড়িয়ে দেব।’ আমি আর মা ভাবছি, ব্যাপারটা কীরকম দাঁড়াবে। বাবা বেড়ালকে আদর করে হাতের ওপর বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বল তো আমাদের দ্যাশের ভাষায় নৌকোকে কী বলে?’
বেড়াল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নাও।’
‘বেড়াল কেমন করে ডাকে?’
‘ম্যাও।’
‘চিনের চেয়ারম্যানের নাম কী?’
‘মাও।’
বাবা এবার আমাদের দিকে হাসিভরা মুখে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখলি কত তাড়াতাড়ি সব শিখে গেল?’
বাবা মাঝে মাঝে একেকটা অদ্ভূত প্রশ্ন করে আমাদের দিয়ে ভাবনাচিন্তা করাতেন তারপর তার একটা মজার সমাধান বলে দিয়ে সবাইকে হাসিয়ে দিতেন। এই কারণে বাবাকে সব বয়সের মানুষ এত পছন্দ করত। একবার হঠাৎ বললেন, ‘চট করে বল তো দেখি — রাম এমন একটা কাজ পারে যা রাবণ পারে না, আবার রাবণ এমন একটা কাজ পারে যা রাম পারে না।’
অনেক ভেবেও এইসব উদ্ভট প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যাবে না জেনে আমরা চিন্তাই করতাম না। উত্তরটা শোনার জন্যই উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। এই প্রশ্নের উত্তর হল, রাবণ কোরাস গাইতে পারে, রাম পারে না। আর রাম পাশ ফিরে শুতে পারে, রাবণ পারে না।
আজকে লিখতে বসে কত কথা মনে পড়ছে। দিন দশেক আগে একদিন সকালে ফোন করে বলছেন, ‘জানিস তো, আমার বিছানাটা একেবারে কাদা-কাদা হয়ে গেছে। চারিদিকে কাদা।’ একথা শুনে আমি তো খুব ভয় পেলাম। বাবার শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে তা বুঝতে পারছি। ভাবলাম বোধ হয় ভুল বকছেন। আমি কী হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আরে বাবা রাতে কড়া ঘুমের ওষুধ খাচ্ছি তো, ঘুমিয়ে একেবারে কাদা হয়ে গিয়েছিলাম, তাই বিছানায় কাদা লেগে গেছে।’
আশ্চর্য হয়ে ভাবলাম অসুস্থতার সঙ্গেও বাবা কেমন একটা হাসিঠাট্টার সম্পর্ক পাতিয়ে নিয়েছেন।
আমার ছেলেকে একবার বললেন, ‘আমাকে একটা জিনিস খাওয়াবি? তোর মা শুনলে অবশ্য খেতে দেবে না। গোপনে খাওয়াতে হবে।’
গোডো জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী এমন জিনিস যা মা তোমায় খেতে দেবে না? বলো আমাকে। তেমন হলে আমি এনে খাওয়াব।’ বাবা উত্তর দিলেন, ‘ক’-এর স্টু। এরকম খাদ্যের কথা কেউ কোনওদিন শোনেনি। তখন দাদু নাতিকে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘ক’ অর্থাৎ গোমাংস। ‘ক’-এর স্টু মানে বিফ স্টু।
আমার মা-র মৃত্যুর পর থেকে বাবার সব দায়িত্ব আমিই নিয়েছিলাম। বাবা আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আমার এই শোকের দিনে আমার এক বোন আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘তুমি মন খারাপ কোরো না — হিমানীশমেসো এতক্ষণে ব্রহ্মার চার মুখ নিয়ে রহস্য ধাঁধা তৈরি করে সবাইকে হাসিয়ে বেড়াচ্ছেন!’ ভাবছি ইস! সত্যিই তাই যেন হয়।
Tags: বাবার কথা, হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।