পোড়ামুখ
দোলের দিনে শ্যামসুন্দর-শ্রীরাধিকাকে ফাগ মাখাতে আজ সকলের সাথে চন্দ্রিমাও হাজির হয়েছে দোলমন্দিরে। চাতরার দোলমন্দির পাঁচশত বছরের পুরানো। ভগবান শ্রীচৈতন্যদেবের পবিত্র পাদস্পর্শ পড়েছিল ওই দোলমন্দিরে। নবদ্বীপ থেকে পুরিতে যাওয়ার পথে চাতরার দোলমন্দিরে এক রাত কাটিয়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে ভক্তরা দোলউৎসবের দিনে শ্যামসুন্দরের সঙ্গে রঙের খেলায় মাতোয়ারা হন। শ্যামসুন্দর তাঁর শ্রীরাধিকা সনে ভক্তদের নিয়ে সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত দোল খেলেন। ভক্তরা যে যার মতন রঙ, আবির ও গুলাল দিয়ে শ্যামসুন্দরের অঙ্গ স্পর্শ করে দোল উৎসবে মেতে ওঠেন। রাতে দোল খেলার শেষে পালকীতে চেপে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে ভাল করে স্নান সেরে পালকীতে ফিরে এসে সোজা গর্ভগৃহে প্রবেশ করেন। ভীড় ঠেলে এগোতে থাকে চন্দ্রিমা। ওর দুই বন্ধু ভীড়ের মাঝে পিছিয়ে পড়ে। হঠাৎ কে যেন ওর দুগালে তেলরঙ মাখিয়ে দ্রুত সরে যায় ভীড়ের মাঝে। কিছু বোঝার আগে অসহ্য যন্ত্রনায় কাতর হয়ে বসে পড়ে মাটিতে চন্দ্রিমা। তীব্র যন্ত্রণায় ছটপট করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শেষমেষ ভর্তি হাসপাতালে। কয়েকটা দিন যমে-মানুষে চলে লড়াই। ডাক্তার-সিস্টারদের অক্লান্ত পরিশ্রমে কিছুটা সুস্হ হয় চন্দ্রিমা। কিন্তু মুখটা অ্যাসিড রঙে পুড়ে গিয়ে বীভৎস কদাকার হয়ে যায়। চোখের জলে ভেসে বেডেতে শুয়ে চন্দ্রিমা ভাবে বসন্ত আর কোনদিন ফিরে আসবে না ওর জীবনে। ওই পোড়ামুখটা দেখাবে কি করে?
শবরীর প্রতীক্ষা
শান্তিকুঞ্জের আবাসিকদের আজ খুব আনন্দ। মহাষ্টমী উপলক্ষে ডাক্তারবাবু এসেছেন হোমে। প্রত্যেকের জন্যে এনেছেন নতুন জামা কাপড় আর বয়স্ক-বয়স্কাদের জন্যে ধুতি শাড়ি। সব আবাসিকবৃন্দই আজ খুশিতে ডগমগ। মধ্যাহ্নের ভুরিভোজও হয়ে গেছে ডাক্তারবাবুর সৌজন্যে। হোমের আবাসিকদের বেশির ভাগই শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। কয়েকজন আছেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বিভিন্নজনের অনুদানের উপর ভিত্তি করে দিন গুজরান হয় এদের। সরকারি অনুদান নামমাত্র পায়। হোমের দুরাবস্হা দেখে প্রতিদিনই কোন না কোন সংস্হার বদান্যে আবাসিকদের অন্নভোগের কষ্টটা কিছুটা লাঘব হয়। ডাক্তারবাবু মাসে দুবার করে আবাসিকদের শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষার বন্দোব্যস্ত করেন। এছাড়াও দায়ে-আদায়ে, রাত-বিরেতে আবাসিকদের শারীরিক অসুবিধে হলে ডাক্তারবাবুকে পাওয়া যায়। হোমেতে আজ ডাক্তারবাবুকে একটু চিন্তিত দেখাল। লক্ষ্য করলেন হোমের একটি বছর কুড়ি-বাইশের মেয়ে সারাক্ষণই হোমের বড় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকছে। মনে হয় যেন কারোর প্রতীক্ষায়। ডাক্তার বাবু কাছে গিয়ে জিঞ্জাসা করলেন, ‘তুমি কি কারোর অপেক্ষায় রয়েছো’? হ্যা, দাদার, সংক্ষিপ্ত জবাব।
দাদা কোথায় থাকেন?- কলকাতায়।
কি করেন?- চাকরি করেন। সরকারি অফিসে।
বাড়িতে কে কে আছেন?
মা আর দাদা।
তুমি তাদের কাছে না থেকে হোমে এসেছো কেন?
‘দাদা ছেড়ে দিয়ে গেছেন’।বলেছিলেন, ‘কয়েকদিন পরে এসে নিয়ে যাবে, মা খুবই অসুস্হ। তাই ভাল চিকিৎসার জন্যে অন্যত্র নিয়ে যেতে হবে। বাড়িতে কেউ থাকবে না বোনটিকে দেখভাল করার,এখানে সেজন্যে আমাক ছেড়ে দিয়ে গেছেন’।
এরপরে হোমের সিস্টার জানালেন – “মেয়েটির নাম অনন্যা।জন্ম থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী। কোথা থেকে খবর পেয়ে বোনকে আমাদের এখানে এনে অনেক অনুনয়-বিনয় করে জানিয়েছিলেন কটাদিন বোনকে রেখে যাচ্ছেন মাকে চিকিৎসার জন্যে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছেন বলে। ফিরে এসে বোনকে নিয়ে যাবেন। যাওয়ার আগে কিছু টাকা হোমকে অনুদান হিসেবে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মানবিক দিকটার কথা চিন্তা করে আমরা রাজি হয়েছিলাম অনন্যাকে হোমে রাখার। কিন্তু গত তিন চার মাস ধরে দাদার কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যাচ্ছে না। হোমে আসছেন না বা ফোন করলে ফোন সুউচট অফ জানাচ্ছে। উনার অফিসেও যোগাযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু ওখান থেকে জানানো হয় উনি চাকরী ছেড়ে দিয়ে কোথায় যে চলে গেছেন কেউ তা জানে না।”
এরপরে ডাক্তারবাবু হোমের রেজিস্টার থেকে বাড়ির ঠিকানাটা নিয়ে সোজা চলে যান কলকাতায় দাদার বাড়িতে। ওখানে গিয়ে পাড়া-পড়শীদের কাছ থেকে জানলেন অসুস্হ মায়ের মৃত্যু বাড়িতেই হয়েছে। চিকিৎসার জন্যে বাইরে কোথাও নিয়ে যান নি। মায়ের মৃত্যুর পরে বাড়ি সম্পত্তি সব বিক্রি করে দিয়ে টাকা-কড়ি নিয়ে বোনকে বঞ্চিত করে কোথায় যে চলে গেছেন ওনারা কেউ তা জানেন না। চিন্তাক্লিষ্ট মনে হোমে ফিরে ডাক্তারবাবু দেখেন, অনন্যা একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে হোমের বড় গেটটার সামনে দাদার প্রতীক্ষায়। এ যে শবরীর প্রতীক্ষা! কবে তার রামচন্দ্র এসে তাকে শাপমুক্ত করবে তা কি কেউ জানে?
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।