মেরুদন্ড
গান্ধীজীকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন আমার দাদু !
আমাকে বললেন, ‘দ্যাখ, সেই পরাধীন যুগে, অত্যাচারী ব্রিটিশের সামনে আমাদের সকলকে, সব ভারতবাসীকে, মেরুদন্ড সোজা করে চলতে শিখিয়েছেন !’
আমার দুষ্টুবুদ্ধির বয়েস !
তর্কের গলায় বললাম , ‘কোথায় দাদু, ছবিতে দেখেছি, হাতে লম্বা লাঠি নিয়ে সামনে একটু ঝুঁকে হাঁটছেন ! বরং পেছনের লাইনের লোকগুলো ঘাড় মাথা সোজা করে ফলো করছে !’
বিচলিত না হয়ে দাদু উত্তর দিলেন, ‘ওঃ, ওই নোয়াখালিতে সাঁকো পেরোনোর ছবিটার কথা বলছিস ! তখন ওনার বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে !’
তারপর জানলার বাইরে দৃষ্টিটা দূরে আকাশের দিকে মেলে দিয়ে যেন একটু ক্লীষ্টস্বরে বললেন,
‘কি জানিস, কেউ ছিল না তো পাশে সেইসময় ! তেত্রিশ কোটি ভারতবাসীর ভার নিজেই বইছিলেন তো, তাই তোরা ওই একটু ঝুঁকে পড়া দেখছিস !’
তারপর ঘরের ভেতর দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে আমার দিকে তাকিয়ে একটু জোর দিয়ে বললেন, ‘ কিন্তু আমি ওঁর শিক্ষা আজও ভুলিনি ! আমিও তো সত্তর পেরিয়েছি ! সকালে আজও মেরুদন্ড সোজা রেখে হাঁটি !’
কাকভোরে দাদু লেকের ধারে হাঁটতে যান জানি আমি ! সেটা আমার বিছানা ছাড়ার সময় নয় !
দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় চাপলো আবার ! বললাম,
‘দাদু কাল সকালে যাবো তোমার সঙ্গে হাঁটতে ! দেখবো তুমি কিভাবে হাঁটো, শিখবো কি করে মেরুদন্ড সোজা করে হাঁটতে হয় !’
-‘সেতো খুব ভালো কথা !’ দাদুর চোখের কোণায় হাসির আভাস !
পরের ভোরে দুজনেই রেডি ! দাদু বললেন,
‘শোন বুল্টু, ফ্রিজ থেকে দুটো আপেল নিয়ে নেতো সঙ্গে !’
‘কেন দাদু, হাঁটা কমপ্লিট হলে বুঝি আমরা আপেল খাবো ? ও, তুমি রোজ খাও বুঝি ?’
এবার দাদুর মুখে দুষ্টু হাসি, ‘হ্যাঁ, খাবোই তো !”
শীত যেতে যেতে যাচ্ছে না, লেকের ধার ঘেঁষে গাছের সারির মধ্য দিয়ে সিমেন্টের টালি বসানো রাস্তাটা শেষ কুয়াশায় হারিয়ে গেছে কিছুদূরে গিয়েই !
এই কাকভোরে কেবল আমরা দুজন, কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না !
দাদু আমার হাত থেকে একটা আপেল নিয়ে নিজের বিরলকেশ মাথাটার ওপর বসিয়ে নিলেন !
তারপর সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে বললেন, ‘বুল্টু, তুই এইভাবে মাথায় আপেলটা বসিয়ে নিয়ে আমার পেছন পেছন আয় ! মেরুদন্ড সোজা করে হাঁটবি, দেখবি আপেলটা পড়বে না !’
আমি হাতে আপেলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম স্তব্ধ হয়ে !
আর মাথার ওপরে নিশ্চল আপেল নিয়ে আমার গান্ধীবাদী সত্তরোর্ধ দাদু মেরুদন্ড সোজা রেখে হাঁটতে হাঁটতে বিংশ শতাব্দীর কুয়াশার মধ্যে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলেন !
…………………..
দন্তকৌমুদী
শচীনদা বাঁদিকের গালের ওপর রুমাল চেপে ধরে ‘হুঁ…হুঁ…উরি বাবা…মরে গেলাম রে …মরে গেলাম’ করতে করতে অফিসে ঢুকলেন !
অফিস-আড্ডার মধ্যমণি শচীনকর্তার এহেন করুণরসসিক্ত এন্ট্রিতে সবাই একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লো, ‘কি হলো কি শচীনদা…আরে বুঝছিস না দাঁতে নিশ্চয়ই দারুণ ব্যথা হচ্ছে …আহা দাঁতব্যথায় বড়ো কষ্ট…গতমাসে আমার তো তিনরাত ঘুম হয়নি…আমার জানা একটা টোটকা আছে শচীনদা…জানিস আবার কানের পাশে ডিরাইভড পেন শুরু হয়ে যায়… চারপাশ থেকে প্রশ্ন আর মন্তব্য একেবারে গোলাগুলির মতো শচীনদার ওপর আছড়ে পড়লো !
কেবল শচীনদার পাশের টেবিলে বিরূপাক্ষ কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে চোখ না তুলে নির্বিকার গলায় বললো,
‘দাঁতটা তুলে ফেললেই হয়…মায়া বাড়াচ্ছেন কেন ?’
-‘ গিয়েছিলাম রে ! বললো একটা দাঁত তুলবে পাঁচশো টাকা…বোঝ ! তাও যদি নতুন দাঁত গজিয়ে দিতে পারতো বুঝতাম !’ উহু-আহা-র মাঝে মাঝে শচীনদার উত্তর !
-‘আমার কাছে এক চিনে ডাক্তারের এড্রেস আছে, বড়বাজারে, কুড়ি টাকায় দাঁত তোলে, চান তো দিতে পারি !’
-‘ কুড়ি টাকা ! দে দে বিরু এড্রেসটা দে…দাঁত পিছু কুড়ি টাকা..উরি বাবা রে ! দে বাবা দে, একটা কেন, দু-তিনটে দাঁত তুলিয়ে নেবো রে !’
পরের দৃশ্য উঠলো ঘিঞ্জি বড়বাজারের তস্য গলির আড়াই তলায়, নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে, অন্ধকার করিডর পেরিয়ে দশ বাই দশ কুঠুরি…সস্তা সেলুনের মতো দুটো কাঠের উঁচু চেয়ার, চেয়ারের পেছনের ঠেসানের মাথায় টিনের শেডের পঁচিশ ওয়াট ফোকাস লাইট ফিট করা !
ক্লিনিকের মালিক ডক্টর চ্যাঙ ফু-র জম্মো-কম্মো সব কলকাতায়, সত্তরের ওপর বয়েস, চোখে বোতল-ভাঙা কাঁচ দেওয়া চশমা, চমৎকার বাংলা বলেন !
পার্কিনসন্স-এর আক্রমণে হাতদুটো একটু কাঁপে, তবে সেটা তেমন কিছু নয় !
শচীনদা দরজার নীচু চৌকাঠে মাথাটা জব্বর ঠুকে ঘরে ঢুকতেই ডক্টর চ্যাঙ ফু-র সাদর আমন্ত্রণ,
-‘আতুন, আতুন, বতুন ! দাঁত তুলবেন তো !’
এই না বলেই শচীনদা কিছু বোঝবার আগেই তাঁকে টেনে একটা চেয়ারে বসিয়েই কোত্থেকে একটা সাইকেলের চাকার টিউব বার করে তাকে আস্টেপিস্টে চেয়ারের হাতলের সঙ্গে বেঁধে ফেললেন !
চেয়ারের মাথায় ঘোলাটে আলো জ্বলে উঠলো !
তারপর ঝটিতি একটা সার্জিকাল সাঁড়াশি বার করে শচীনদার মুখটা হাঁ করিয়ে হাত কাঁপতে কাঁপতে ব্যথাজর্জরিত দাঁতটার পাশের দাঁতটা ধরে বেজায় টানাটানি করতে লাগলেন,
-‘থুব থকতো…থুব থকতো !’
টানাটানির খাটুনিতে বোতলভাঙ্গা চশমা নাকের ওপর ঝুলে পড়লো !
শচীনদা ব্যথায় অধীর হয়ে বললেন, ‘আহা ওটা না, ওটা না, পাশেরটা, পাশেরটা !’
-‘থরি, থরি, তাই এটা এতো থকতো !’
দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় কাঁপা হাতে চ্যাঙ ফু এবার ওপাশের একটা ভালো দাঁত নিয়ে জোরে টানাটানি করতে লাগলেন !
-‘ও মাই গদ, এটাও তো থকতো ! খুব থকতো !’
শচীনদা এবার চিৎকার করে উঠলেন, ‘ওরে বাবা, ওটা নয়, ওটা নয়, ওর পাশেরটা, পাশেরটা !’
এবার ডক্টর চ্যাঙ ফু ভীষণ রেগে গেলেন,
‘তুরি তাকায় দাঁত তুলবে, এতা না সেতা, সেতা না এতা ! যেতা ইচ্ছে সেতা তুলবো !’
বলেই না কাঁপা হাতে ঘ্যাঁক করে সাঁড়াশি দিয়ে শচীনদার নাকটা চেপে ধরলেন !
শেষ খবর যা পাওয়া গেছে, শচীনদা ডেন্টিস্টের সঙ্গে একজন সস্তার ইএনটি-রও খোঁজ করছেন !
Tags: অণুগল্প সংখ্যা, মেরুদন্ড ও অন্য গল্প, সিদ্ধার্থ সান্যাল
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।