আজ এই আতঙ্কের দিনে তনুজার এতদিনের স্বপ্ন তাহলে পূরণ হলো? এলো সেই স্বপ্নের রাজকুমার?
তনুজা ওর আসল নাম নয়। নাম ছিল কালিন্দী। মায়ের দেওয়া। মাথাভর্তি একরাশ ঘন কালো কুচকুচে চুল নিয়ে নাকি জন্ম হয়েছিল । মা বলতো। হয়তো তাই।
সে কথা তো মনে থাকে না কারুর।
তবে স্পষ্ট মনে আছে সেই কালিন্দীর ঢেউয়ে ডুবতে এসেছিলো একজন। সেই বলতো ওর মুখটা ঠিক সিনেমার তনুজার মতো।
সে অবশ্য ডুবলো না।ডুবিয়ে গেলো ওকে। তাই কি তাকে ব্যঙ্গ করেই কালিন্দী তনুজা হলো? জানা নেই।
পাশের ঘরের মেয়েগুলো অবশ্য বলে প্রথম প্রেম তো, তাই সে নামাবলী করে তার দেওয়া নাম অঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে। বলে আর হেসে গড়িয়ে পড়ে তারা। অশ্লীল ইশারা আর মন্তব্যও চলে হাসির ফাঁকে। ও তাতে হাসে। প্রতিবাদ করে না আবার সায়ও দেয় না।
কি আর করবে এই তো জীবন। তার ফাঁকে যদি একটু হেসে নেওয়া যায়।
তবে একথা সত্যি মন সে একজনকেই দিয়েছে । প্রথমে অবশ্য ভালোলাগাটুকুই ছিল, ভালোবাসার মানুষটা তো তখনও চারপাশে ঘুর ঘুর করতো।
কিন্তু অয়ন চৌধুরীর কোন সিনেমা বাদ দিতো না।
সে অবশ্য অনেককালের কথা। সিনেমা কেন, তখন তো টিভি সিরিয়াল। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল ভালোলাগা।
ভালোলাগাই থেকে যেত হয়তো। যদি কালিন্দী হয়ে গেরস্থালি সামলাতো।
কিন্তু কালিন্দী হলো তনুজা। আর ভালোলাগা হলো ভালোবাসা।
ভালোবাসাই কি? নাকি দুনিবার আকর্ষণ?
এই তল্লাটের লোকজন বলে তার দেমাক ভারী। বড় বড় রইস আদমিরা তার ঘরেই আসে কিনা। মাসি দালাল সবাই তাই তাকে একটু তোল্লাই দেয়।
ও বাতিল করলে বা ‘বুক’ থাকলে, অন্যরা সুযোগ পায় ধাপে ধাপে।
সেই গুমোরের জোরেই প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিলো অয়নকে নিজের কাছে একবার আনতে।
পারেনি।
যাদের কাছে কথা পাড়লেই ফল হয়, তাদেরই ধরেছিলো।
তারা জিভ কেটে দু পা পিছিয়ে গেছে।
অয়ন চৌধুরী নাকি দেবতুল্য লোক।
ইন্ড্রাস্টিতে কোন বদনাম নেই। স্ত্রী অন্ত প্রাণ।
নেটকার্ড ফোনে ভ’রে দেখেছে সেই বৌয়ের মুখ।
নিতান্তই খেঁদি পেঁচি।
রেগে গেছে! কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে।
তারপর হাল ছেড়েছে।
অতি গোপনে, সন্তর্পণে যে চেষ্টা চালিয়েছিল তাও কি করে যেন ফাঁস হয়ে গেলো সবার কাছে !
চাপা হাসি মুখে মুখে । আত্মতৃপ্তির হাসিও।
সব কি পাওয়া যায় রে ছুঁড়ি? এমনি ভেবে বাকিরা সন্তুষ্ট।
পায়নি তো কি হয়েছে? ভালোবাসা কি যায় না?
ভালোবাসা বুকে ভ’রে নিয়েই তো কোনোমতে কাটাতে পারে নিষ্ঠুর রাতগুলো। পয়সা যখন নিংড়ে নিংড়ে নেয় প্রতিটি রক্তকণা।
দাঁতে দাঁত চিপে চোখ বুজে ভাবে অয়নের হাসিমুখ খানা। শতেক চুমুতে ভ’রে যায় সেই মুখ কল্পনায়।
সেই অয়ন আজ ওদের এলাকায় আসছে!
কি যে এক মুখপোড়া করোনা এসেছে না, তাই সব ঢেমনা বাবুগুলো দেখো সব বৌয়ের আঁচলের তলায় সেঁধোচ্ছে!
চুমকি বলেছিলো দিন পনের আগে।
বিশ্বাস করেনি ও। তার আদ্ধেকবাবু তো বাঁধা খদ্দের। তারা আসবেই।
কিন্তু চুমকির কথাই ফললো। যে মহল্লায় রাতে ইঁদুরও ধাক্কা খেত বাবুদের ভিড়ে, সে আজ শুনসান শ্মশান!
তার টাকাপয়সা খাবার দাবার ছিল। ঘরে ফ্রিজে মাছ মাংস।
চালাল ক’দিন। ভাগও দিলো একটু একটু।
কিন্তু তাতে কি ভরে এতো পেট?
ভরছে না। শুকোচ্ছে অনেকে।
লোকে মাংস কিনতে এখন দিনের বেলা শুধু বাজারে যাচ্ছে, রাতে নয়।
অয়নের বুকে নাকি খুব বেজেছে এদের ব্যথা। গালভরা নাম দিয়ে পোস্টারও লিখে এনেছে।
” যৌনকর্মীদের পাশে দাঁড়াও, তাদের মুখে অন্ন তুলে দাও।”
পেটে ভাত না পড়লেও রসের কমতি নেই চুমকির !
গালে টুসকি মেরে কোমর বেঁকিয়ে হেসে জানিয়েছে , এই সুযোগ যেন সে না ছাড়ে। যত রকম অস্ত্র তূণীরে আছে তা দিয়ে যেন ঘায়েল করে অয়নকে আজ। যাতে অয়নের মনে যেন একটা ছাপ পড়ে যায় চিরকালের মত। এমনি দিনতো চিরটাকাল থাকবে না। সুদিন এলে অয়ন যেন এসে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে।
মনে মনে অনেক অনেক রিহার্সাল দিলো। তার কোন কোন ভঙ্গিমায় কে কে এযাবৎ কাল ঘায়েল হয়েছে সেই লিষ্টি মনে করলো। চাপা হাসিতে মুখে বিদ্যুৎ খেলে গেলো।
আজ লড়াই তনুজার সাথে খেঁদি পেঁচির।
দানপর্ব প্রায় মিটেই এসেছে। অয়ন ফেরার তোড়জোড় করছিলো। এমন সময় সেক্রেটারি তপন এসে বললো,”দাদা, আপনার সঙ্গে এখানকার একটি মেয়ে একবার দেখা করতে চায়. আপনার খুব বড় ফ্যান। একটিবার আপনাকে দেখতে চায়. তবে খুব কাছে আসবে না। নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনেই দাঁড়াবে।”
অগুণতি ফ্যান অয়নের। মেয়েরাই বেশি স্বাভাবিকভাবেই। তবুও এই সংকটকালে এই পরিবেশে ফ্যানের দেখা করতে চাওয়াটা একটু যেন কেমন লাগলো অয়নের।
সংস্কার? হবেই বা!
দূরে এসে দাঁড়ালো একটি মেয়ে। চুল খোলা। প্রায় নিরাভরণ। তাও রূপের দীপ্তিতে চোখ ঝলসে গেলো অয়নের।
দূরে দাঁড়িয়েছে অনেক গুলো মেয়ে। নিজেদের মধ্যে হাসি ইশারা আর চাপা ফিসফাসে কি যেন ষড়যন্ত্রের আভাস!
“আপনার খুব বড় মন, এই বিপদকালে আপনি আমাদের কথা ভাবলেন…. ”
অয়ন মৃদু হাসলো।
“আমার একখানা সাধ আছে, আপনি যদি পূরণ করে দ্যান তবে এই পাপজীবন সার্থক হয় ”
মেয়েগুলো এখন বাকরুদ্ধ। মেয়েছেলেটা কি লাজলজ্জার মাথা একেবারেই খেয়েছে? এই হাটের মাঝেই কি বিছানা পাতার গল্প ফাঁদবে?
” টিভির খবরে দেখছি ডাক্তারবাবুরা নার্সদিদিরা দিনরাত খাটছেন। তাদের পাশে দাঁড়াবার জন্যে অনেক লোক এগিয়েও আসছে ভলিন্টিয়ার হতে। আমাকে সেই রকম একটা কিছু সুযোগ করে দিন না ..অসুস্থ মানুষ গুলোর একটু সেবা যত্ন করার । এই পাপের জীবন চলে গেলেও তো কিছু এসে যায় না, তবু যদি কিছু করে যেতে পারি …….”
তনুজার জিভ দিয়ে এগুলো কি বেরোচ্ছে? মেয়েগুলো ঠিক শুনছে তো!
তনুজা নিজেই কি জানতো খানিক আগে এই কথাগুলো?
অয়ন ঝাপসা চোখে কি আম্রপালীকে দেখছে!
Tags: অদিতি ঘোষদস্তিদার, বড় সাধ জাগে
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।