প্রতিভা দাস – মণিপুরি নৃত্যের প্রতি আপনার আগ্রহ তৈরি হল কীভাবে? শুনেছি আপনি প্রথমে গান গাইতেন। গান থেকে নাচ – এই পথচলাটা কীরকম?
কলাবতী দেবী – আমি প্রথমে আমার গানের গুরু গম্ভিনী দেবীর গ্রুপে গান গাইতাম। আমাদের মহিলা ও পুরুষদের সংকীর্তন গ্রুপ ছিল। সেই মহিলাদের গ্রুপে আমি গান গাইতাম। অন্নপ্রাসন থেকে বিয়েবাড়ি সব জায়গাতেই গান গাইত এই সংকীর্তন গ্রুপ। আমি পড়াশুনো তখন ছেড়ে দিয়েছি। গানের দিকে চলে গেছি। এটা সেই ১৯৫২ সালের কথা। প্রায় ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত আমি গান-বাজনার মধ্যেই রয়েছি। আমাদের ছিল আট রকমের নায়িকাভেদের গান। যেমন অভিসারিকা, বিপ্রলব্ধা, বাসবসজ্জিকা, উৎকন্ঠিতা, খণ্ডিতা, কহিনকারিতা, প্রোসিতভর্তিকা, সাধনভর্তিকা এই অষ্ট নায়িকাভেদের গান।এইভাবে গান করতে করতে একদিন আমার গুরু গম্ভিনী দেবী বললেন নৃত্যশিল্পী গুরু বিপিন সিং-এর কথা। আমরা যখন গান করতাম তখন অঙ্গভঙ্গী করে দেখাতে হয়। গম্ভিনী দেবী বললেন তুমি যদি নাচ শেখো তাহলে গানের পরিবেশনা আরও ভাল হবে। তখন উনি আমাকে গুরু বিপিন সিং-এর কাছে নাচ শিখতে পাঠালেন। গুরু গম্ভিনী দেবীও তখন তাঁর কাছে নাচ শিখছেন।
প্রতিভা দাস – তাহলে এভাবেই আপনার সঙ্গে গুরু বিপিন সিং-এর যোগাযোগ হল?
কলাবতী দেবী – হ্যাঁ, তখন ১৯৫৩ বা ৫৪ সাল। গম্ভিনী দেবী বললেন একজন বাইরে থেকে এসেছেন, নৃত্যশিল্পী গুরু বিপিন সিং – ওনার কাছে গেলে তোমার নাচ আরও সুন্দর হবে। তখন বোম্বেতে (আজকের মুম্বই) একটা খুব বড় অনুষ্ঠান মত হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে গম্ভিনীদেবী নাচের জন্য গিয়েছিলেন। মণিপুর থেকে গিয়েছিলেন গুরু বিপিন সিং। শুনেছি, বিরজু মহারাজও গিয়েছিলেন। তবে বিপিন সিং, বিরজু মহারাজ দুজনেই তখন খুব ছোট। তো গুরু বিপিন সিংয়ের কাছে নাচ শিখতে শুরু করলাম। তখন তো পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছি। শুধু নাচ আর নাচ। পাঁচ বছরের কোর্সটা তিন বছরে শেষ করে ফেললাম। তখন মাটিতে নাচতে হত, এখনকার মত সিমেন্টের ফ্লোর ছিল না। খুব কঠিন পরিশ্রম করেছি। এরপর গুরু বিপিন সিং আমাকে মুম্বই পাঠালেন। ওখানে জাভেরি সিস্টার্সদের ছিল মণিপুরি ডান্স গ্রুপ। ১৯৬০ সালের জানুয়ারি, আমি সেই ডান্স গ্রুপে গিয়ে যোগ দিলাম। আমার সঙ্গে আরও একজন ছিল। তখন জাভেরি সিস্টার্সদের খুব নাম। অমি গিয়ে উপস্থিত হলাম। জাভেরি সিস্টার্সদের সুনাম এখনও অটুট। এখন দর্শনা জাভেরি ছাড়া সকলেই মারা গেছেন। দর্শনা জাভেরির সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক এখনও অটুট। এই তো কয়েকমাস আগে (২০১৮) কলকতায় আমার কাছে ঘুরে গেলেন। আমিও তার কাছে যাই। ওনাদের সঙ্গে আমি সারা বিশ্ব ঘুরেছি। ওনারা গুজরাটি, ব্যবসায়ী পরিবার। সারা পৃথিবীতে ওনাদের আত্মীয় স্বজন ছড়ানো। সেই সূত্র আমরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। জাহাজে করে আমরা আফ্রিকা গিয়েছি। সে এক দারুন অভিজ্ঞতা। শুধু জল আর জল। কেনিয়ায় নানা অনুষ্ঠান ছিল। প্রায় দু মাস ছিলাম।
প্রতিভা দাস – গুরু বিপিন সিং নিজে কীভাবে তার নৃত্যশিক্ষা শুরু করেছিলেন সে বিষয়ে যদি আমাদের আলোকপাত করেন।
কলাবতী দেবী – আমি এ বিষয়ে অতটা বলতে পারব না। তবে ওনার মুখে শোনা একটা ঘটনা সংক্ষেপে বলছি। বিপিন সিংয়ের বাড়ি ছিল শিলচরে। তখন বিপিন সিংয়ের ১২ বছর বয়স। অঙ্কে ভাল ফল না হওয়ায় বাবা খুব বকাঝকা করলে অভিমানে ১২ টাকা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে ট্রেনে চড়ে কলকাতায় চলে আসেন। তখন মৃদঙ্গ বাজাতে পারতেন। গান-বাজনায় আগ্রহ থাকায় এক ব্যক্তির সহায়তায় একটা গ্রুপে জয়েনও করেন। কিন্তু তাতে সুবিধে হল না। পালিয়ে গেলেন বোম্বে। ওখানেই গুজরাটি জাভেরি সিস্টার্সদের পেলেন। তাদের শেখাতে শুরু করলেন। তারপর ফের ফিরে গেলেন মণিপুরে। সেখানে নিজেকে মণিপুরি নৃত্যের এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের কাছে একজন শিক্ষার্থী হিসবে তালিম নিতে শুরু করলেন। তিনি হলেন আমোদন শর্মা।
প্রতিভা দাস – কিংবদন্তী মণিপুরি নৃত্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু ব্যক্তির নাম। তবুও গুরু বিপিন সিংকে মণিপুরি নৃত্যের অন্যতম স্মরণীয় ব্যক্তি বলে মানা হয় কেন?
কলাবতী দেবী – সেটা নৃত্যজগতের মানুষরাই ভাল বলতে পারবেন। তিনি মণিপুরি নৃত্যের প্রচার করেছেন। কঠিন কঠিন তালের কম্পোজিশন করেছেন। তাঁর উপস্থাপনা মানুষের নজর কেড়েছে। তাঁর লেখা বই বা তাঁকে নিয়ে লেখা বই থেকেও মানুষের কাছে গুরু বিপিন সিংয়ের কাজ সম্পর্কে জানাটা সহজ হয়েছে। সম্মেলক নৃত্যের ধারাকে একক নৃত্যে রূপান্তরিত করার কাজটা গুরু অমুবী সিংহের পাশাপাশি গুরু বিপিন সিংও করেছিলেন।
প্রতিভা দাস – মণিপুরি নৃত্য প্রচারে এবং প্রসারে জাভেরি সিস্টার্সদের সামনে এনেছিলেন গুরু বিপিন সিং। জাভেরি সিস্টার্সদের কথা যদি আমাদের একটু বলেন?
কলাবতী দেবী – তাদের কথা আগেই বলেছি। তবুও বলি, জাভেরি সিস্টার্সরা ছিলেন গুজরাটি। তখনকার দিনে কথাকলি শিখতেন ওরা। চার বোনের মধ্যে ছিলেন নয়না, রঞ্জনা, সুভনা ও দর্শনা। ওরই মণিপুরি নৃত্যকে মানুষের কাছে অনেকটা জনপ্রিয় করেছেন। ওনাদের বাবা শিল্প-সংস্কৃতি নৃত্য এসব ভালবাসতেন। আলাপ হওয়ার পর বিপিন সিং ওনাদের মণিপুরি নৃত্যে অনুপ্রাণিত করান। মণিপুরি শিখতে ওনারা মণিপুরে যানও। দ্বিতীয়বার যখন ওনারা মণিপুরে যান তখন আমি ওনাদের দেখি। সবিতা মেহেতা বলে আর একজনও তখন মণিপুরি শিখতেন। এটা ৬০ সালের কথা বলছি। তখন আমি নর্তন বিশারদ হলাম। আমাদের ইনস্টিটিউশনের নাম ছিল গোবিন্দজী নর্তনালয়। মণিপুরে গোবিন্দজী মন্দিরে আমাদের নৃত্য প্রশিক্ষণ হত। আর এই নর্তনালয় ছিল রাজাদের। ওখান থেকেই আমি আর আমার বন্ধু বিনোদিনী নর্তন বিশারদ পাশ করলাম। তখন আমাদের দুজনকে গুরু বিপিন সিং জাভেরি সিস্টার্সদের কাছে পাঠান। ওদের সঙ্গেই সারা পৃথিবী ঘুরেছি আমি।
প্রতিভা দাস – আপনি কলকাতায় কীভাবে এলেন?
কলাবতী দেবী – আমি জাভেরি সিস্টার্সদের সঙ্গে দীর্ঘ বছর (১৯৬০ থেকে ১৯৭২) পর্যন্ত কাজ করেছি। বম্বে বসেই চিঠি পেলাম আমাকে মণিপুরে গোবিন্দজী নর্তনালয়ে নাচ শেখাতে হবে। ওখানকার মিলবি শাস্ত্রী এবং আইবা সুছন শর্মা আমাকে জানালেন তোমরা সব ওখানে (বম্বে) চলে গেছ – তাহলে এখানে (মণিপুরে) কে নাচ শেখাবে? তো এইরকম কথাবার্তা যখন চলছে তখন গুরু বিপিন সিং কলকাতায়। তাঁর সঙ্গে আরও অনেকেই ছিলেন। তিনি আমায় কলকাতায় ডেকে পাঠালেন। এরকম একটা কানাঘুষো চলছিল যে কলাবতী দেবী গুরু বিপিন সিংয়ের সঙ্গেই থাকবে। এর কারণ আমি বিপিন সিংয়ের সঙ্গে অনেক অনুষ্ঠান করেছি, বই সংকলিত করেছি (তথ্য সংকলন করেছি)। তারপর আমি কলকাতয় চলে এলাম। গুরু বিপিন সিংয়ের সঙ্গেই থাকতে লাগলাম।
প্রতিভা দাস – আপনি নিজে মণিপুরি নৃত্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রনৃত্যের ভক্ত। শান্তি বসুর চিত্রাঙ্গদা দেখে আপনি মুগ্ধ হন, সিদ্ধান্ত নেন যে মণিপুরি নৃত্যশৈলীর মাধ্যমে চিত্রাঙ্গদা করবেন। ভাবনাটা ঠিক কীরকম ছিল?
কলাবতী দেবী – শান্তি বসুর চিত্রাঙ্গদা প্রযোজনা দেখে আমি এমন অভিভূত হয়ে পড়লাম যে ভাবলাম এমন উপস্থাপনা আমাকে করতেই হবে। সবার সঙ্গে আলোচনা শুরু করলাম। চিত্রাঙ্গদা কিনে পড়তে শুরু করলাম। যদিও আমি বংলা ভাল পড়তে পারি না। গানগুলোও জানি না। তারপর শান্তিদাকে বাড়িতে ডেকে পরামর্শ করলাম। গান নিয়ে আমায় অনেক সাহায্য করেছেন শিল্পী প্রমিতা মল্লিক। তাঁর মেয়ে আমার কাছে নাচ শেখে। অবশেষে রবীন্দ্র সদনে একটা সফল প্রযোজনা করেছিলাম। অনেকেই প্রশংসা করেছেন। অনেক কাগজেও প্রশংসা বেরোলো। পরে অবশ্য দূরদর্শনেও এই প্রযোজনা করেছি। তবে রবীন্দ্রসদনে এই প্রযোজনাটা আমার খুবই মনোমত হয়েছিল।
প্রতিভা দাস – ‘গল্পের সময়’ ই- ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে এতটা সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কলাবতী দেবী – তোমাদেরও অনেক ধন্যবাদ।
কৃতজ্ঞতা – এই সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় উপস্থিত ছিলেন নৃত্যশিল্পী সুমিতা ব্যানার্জি। তাঁর মূল্যবান উপস্থিতির জন্য ধন্যবাদ
বিশেষ কৃতজ্ঞতা – শ্রী শান্তি বসু
Tags: কলাবতী দেবী, গুরু বিপিন সিং, প্রতিভা দাস, মণিপুরি নৃত্য, সাক্ষাৎকার
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।