অন্ধকার আকাশটা আজ ভালো দেখা যাচ্ছে না। কিছু তারা আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটা ধোঁয়ার মত অস্পষ্টতা জাল বিছিয়ে রেখেছে। উঁচু ঢিবিটার উপর শুয়ে আছি আকাশের দিকে তাকিয়ে। মাঝেমাঝেই এখানে আসি। বিশেষকরে মনের ওপর কোনো পাথর চেপে বসলে এই আকাশ আমার ব্যর্থতাকে অনেকটা ভাগ করে নেয়। জামা প্যান্টের পেছনটা ভিজে গেছে, ঘাসের উপরের জল এখনো শুকোয়নি। বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি রামধনু ডেকে এনেছিল। তবে গরম একটুও কমে নি। ধুলোরাস্তা আর বৃষ্টির ফোঁটায় বেশ একটা চেক ডিজাইন তৈরি হয়েছিল। অন্ধকার বাড়ার সাথে সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকও বেড়ে চলল, সঙ্গে মশার উপদ্রপ। কিন্তু এই উচু ঢিবিটার সাথে আমার সখ্যতা এসব তোয়াক্কাই করে না। মাথার নিচে হাত রেখে ক্লান্ত শরীরে ভাবছিলাম ছোটবেলায় ঠাকুমার মুখে শোনা গল্প, তারপর রাজপুত্র ও তার বউ সুখে শান্তিতে দিন যাপন করলো।
কলে কোনো কাজ নেই গত এক মাস। মালিক কয়েকজনকে যেতে বলেছিল, তাই কাজের আশায় গেছিলাম। কোনো কাজ দিলো না ঠিকাদার। পুরোনো কয়েকটা লরির মাল খালাস করে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ছেড়ে দিল। স্টোর থেকে বেরিয়ে দেখি একটা কুকুর আমার চপ্পল চিবোচ্ছে। খুব রাগ হল। কিন্তু ওর পেটের জ্বালা বুঝতে পারলাম। খালি পায়ে ঘরে এলাম। ডালায় একটাও সবজি নেই, চাল দুই মুঠো বাকি। মুড়ির ডিবে ফাঁকা। একটু জল খেয়ে পুকুরঘাটে বসে থাকলাম। জানিনা কলে চাকরিটা আর আছে কিনা। গত মাসের মাইনে পেলাম না। একার পেট হয়ত চলে যাবে কোনরকমে। কিন্তু ভুলু আর তার তিনটে বাচ্চাকে কি খেতে দি ! পায়ের কাছে বসে আছে চারটে প্রাণ। আমার পেটেও যে কিছু নেই তা বোধ হয় ওরা জানে না।
বিকেলে আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। বাসস্ট্যান্ডে অনেক্ষন ঘোরাঘুরি করলাম যদি কোনো কাজ জোটে। স্ট্যান্ড ফাঁকা। বাস চললে তো কাজ জুটবে। দেখা হল গুপের সাথে। গুপে বিশালক্ষী গ্যারাজের ঠিকা লেবার। গ্যারাজ বন্ধ এক মাস হলো। তাই গুপেরও পকেট-পেট ফাঁকা। আমার মত ফটকা কপালের লোক যে আরো কত আছে তার হিসাব নেই। গুপের বউ বাচ্চা কি খাচ্ছে কে জানে। ওকে কুড়ি টাকা দেবার ক্ষমতাও আমার নেই। হাসি পেল আমার মত মানুষদের বেঁচে থাকার তাগিদ দেখে। ছোট বৃষ্টি শুরু হল। থেকে থেকেই মানুষ নিরাশ্রয় হয়। ভেজা ছাড়া আর পথ থাকে না।
মোড়ের নকুলদার দোকান থেকে বাকিতে একটা চা আর টোস্ট বিস্কুট খেয়ে ঢিবিটায় এলাম। গত পনেরো বছর এই ঢিবিটা আমার অনেক হাসি কান্নার সঙ্গী। এমনিতে আমার জীবনে ঘটনা বা দুর্ঘটনা, আনন্দ বা দুঃখ কোনোটাই বেশিদিন টেকে না। তবে কলে কাজ করতে এসে এতবড় ঢিবিটা দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। মাঠের মাথায় এত উঁচু ঢিবি এলো কোথা থেকে ? আবার দেবদারু চারিদিকে ঘিরে রেখেছে গাছ-প্রাচীর দিয়ে। লোকে বলে কেউ কেউ কোদাল নিয়ে ঢিবি খুঁড়ে দেখতে গেছিল ভেতর কি আছে। কিন্তু তারা কেউ খুব বেশিদিন বাঁচেনি। ঢিবির একপাশে চৈত্র সংক্রান্তিতে শিবঠাকুরের পুজো হয়, মেলা বসে। তখন লোকজনের ভিড়ে ঢিবি আর আমায় চিনতে পারে না। কয়েকদিন পাল্টে যায় আমার রংচটা জীবনটা। হাতে টাকা থাকলে ঘুগনি, চাউমিন, জিলিপি, কুলফি খাই। বন্দুক ফাটাই, নাগরদোলায় উঠি। বেশ আলো ঝলমল করে অন্ধকার ঢিপি।
করোনা নামে কি এক ভাইরাস এসেছে দেশে, যার জন্য সারা দেশ বন্ধ। গাড়ি ঘোড়া বাজার হাট ব্যবসা স্কুল কলেজ চাকরি সব বন্ধ। লোকজন বাড়িতে থাকলে এই রোগে মরবে না। এর কোনো চিকিৎসা নেই। কি অবাক কান্ড ! আমার মত কত লেবারের চাকরি নেই, হয়তো বাবুদেরও থাকবে না। পথে কত লোক ভ্যান নিয়ে সবজি, ফল, মাছ বিক্রী করছে। বাঁচতে গেলে তো খেতে হবে। যত টুকু আয় হয়, তাই দিয়ে বাঁচার লড়াই করে যাচ্ছে মানুষ। আমার না আছে ভ্যান, না আছে হাট থেকে পাইকারি দামে সবজি কিনে আনার টাকা। কোথাও কাজ নেই। দু মুঠো চাল দিয়ে আজ রাত আর কাল দুপুরের পেট মিটবে। তারপর কি খাবো ?
আকাশে তারা কিছুটা বেড়েছে। ঢিবিতে শুয়ে গোনার চেষ্টা করলাম। হাতে রাখা সংখ্যাগুলো আর মনে থাকে না। তাই কিছুক্ষন পর চোখ বুজে ভাবছিলাম এখানে প্রথম দিন কাজ করতে আসার ঘটনা। কলকাতার বিভিন্ন কারখানা খুঁজেও একটা চাকরি জোটেনি ছয় মাস। লোকাল ট্রেনে সেই দুর্ভাগ্যের কথা বলছিলাম পাশের যাত্রীকে। উল্টোদিকে গুপে বসেছিল। আগ বাড়িয়ে আমায় জিজ্ঞাসা করলো আমি পাট কলে কাজ করতে পারবো কিনা। সেদিন গুপেই আমাকে কলের ঠিকাদারের কাছে পৌঁছে দেয়। এত বিরাট কারখানা দেখে শুরুতে ভয় পেয়েছিলাম। টিনের চালাঘর থেকে রোজ ডিউটি করছি সকাল থেকে সন্ধ্যা। কাজের কোনো উন্নতি হয়নি। কিন্তু চালের অবনতি হয়েছে অনেকবার।
চোখটা ধরে গেছিল। অনেকগুলো জোনাকি আমার শরীরের ওপর খেলা করতে থাকে। পাশেই নিচে একটা বড় প্যান্ডেল করে লোকজন খাওয়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে। দুপাশে দুটো বিরাট ছবি টাঙানো। একটি ছবিতে সুন্দর বাচ্চা বিছানায় শুয়ে হাসছে, আর একটিতে দুটি পুরুষ নারী মালা বদল করছে। কয়েকটা ঝাউগাছ আর ফোয়ারা পেরিয়ে এগোতেই দুজন ধুতি পাঞ্জাবি পড়া বাবুলোক আমার হাত ধরে ভেতরে বসালেন। একটি বাচ্চা মেয়ে ছোট্ট একটা টবে চারাগাছ দিয়ে গেল, তাতে কয়েকটা ফুল ধরে আছে। আমার টেবিলে অনেক খাবার রাখা। আমি খেতে শুরু করলাম। কোণে একজন চোখ বুজে বেহালা বাজাচ্ছে। দুটো জোনাকি আমার মাথার পাশ দিয়ে ঘুরতে থাকলো। পায়ের পাশে ভুলু তিনটে বাচ্চা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মাছের মাথাটাতে যেই কামড় দেব, মাছের চোখটা আমার দিকে রাগ চোখে তাকালো। দরজায় শোরগোল হতেই তাকিয়ে দেখি ধুতি পাঞ্জাবি পড়া ভদ্রলোকদুটি গুপেকে ঢুকতে দিচ্ছে না। ক্র্যাচ হাতে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে পান্ডেচাচা ডাকছে – ‘এদিকে আয়, আর বসে থাকিস না।’ হটাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঘামে জামাটা পুরো ভিজে গেছে। চারিদিক ঘন অন্ধকার। এখন কত রাত কে জানে ? কয়েকটা জোনাকি খালি পায়ের উপর বসছে আর উঠছে। খুব খিদে পেয়েছে। ঢিবি থেকে নেমে হাঁটা দিলাম ঘরের দিকে। খালি পায়ে হাঁটতে বেশ গর্ব হচ্ছিল।
বাল্বের ম্লান আলো মেঝেতে পড়েছে। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। চারিদিক নিস্তব্ধ। মাঝেমাঝে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পাচ্ছি। দরজা খোলা রাখতে ভয় হয়, আজকাল সাপ দেখা যায় উঠোনে। পেছন বাড়ির জবার বাচ্চাটা কেঁদে উঠলো, হয়ত দুধ খাবে। হাড়িতে একমুঠো চাল দিয়ে ভাত চাপাতে গেলাম। কিন্তু কেরোসিন স্টোভ জ্বললো না। মনে পড়লো কাল তেলের ডিবে ফাঁকা হয়ে গেছে। সারাদিনে এককাপ চা আর বিস্কুট ছাড়া পেটে কিছু পড়েনি। শরীর আর চলছে না। চৌকিতে বসে ভাবছিলাম একটু খাবার পাই কোথায়। অনেক অভাবেও কারোর কাছে কোনোদিন হাত পাতিনি। কিন্তু আজ না খেলে পেট শুকিয়ে মরতে হবে। মনে পড়ছে বিয়েতে দাদা সকাল থেকে না খেয়ে ছিল। দাদা খায়নি বলে আমিও উপোস দিলাম সারাদিন। সন্ধ্যায় কাকিরা ঠেস দিয়ে বললে, বিয়ে কার রে গজা ? সেই সন্ধ্যায় কি পেট ব্যথা আমার। বরযাত্রী গিয়েও কিছু খেতে পারলাম না, উল্টে কুটুম বাড়িতে বাথরুম খুঁজতে হলো। ভালোই কাটছিল বাড়িতে দিনগুলো। কিন্তু বছর না ঘুরতেই বৌদি খাবার দেওয়া বন্ধ করলো, দাদা বললো নিজে রান্না করে নিতে। কম মাইনে হলেই কি টানতে হবে সারাবছর ? দাদা এক চড় কষিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে বললো। পরের দিন একটা ব্যাগে কয়েকটা জামা প্যান্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কোলকাতায় কাজ পাওয়া নাকি জলভাত। অনেক খুঁজে একটা গাড়ি ধোয়ার কাজও পেলাম না । শেষমেষ গুপে আমার মাস মাইনের ব্যবস্থা করে দেয়।
কদমতলার সানে পা ছড়িয়ে বসলাম। পাশে দীনু গলা অব্দি মাল খেয়ে উল্টে পড়ে আছে। ভালোই আছে হয়তো। ভাত জলের টান বুঝতেই পারে না। ভুলুও কোথা থেকে এসে লেজ নাড়তে থাকলো। জলের ছোঁয়ায় কদম ফুলগুলো ভারী হয়ে খসে পড়ছে । একটা উগ্র গন্ধ বাতাসে মেখে আছে। খুঁটির সাথে টুডুর রিকশাটা চেন দিয়ে বাঁধা অনেকদিন ধরে। দিন আর রাতের কোনো ফারাক নেই, সব সময় প্রাণহীন রাস্তা। প্যাসেঞ্জার নেই, ক্রেতা নেই, বিক্রেতা নেই। আছে কেবল পুলিশের গাড়ি আর লাঠি হাতে সিভিকের দল। ওদের সবার চাকরি আছে, মাইনে আছে। আমার কিচ্ছু নেই, কেবল খিদে আছে। সব বন্ধ করে, বাড়িতে বসে যে কিভাবে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করা যায়, তা মাথায় ঢুকে না। এভাবে না খেয়ে কি বেঁচে থাকা যায় ? সরকার নাকি ঘোষণা করেছে, কারোর চাকরী যাবে না। ঠিকাদারের কানে কি সেই কথা ঢোকে ? আমাদের আনলোড ইউনিটে বিশ জন কাজ করে। কারোর চাকরি আর আছে বলে তো শুনিনি। তবু তাদের এক ফালি জমি আছে, চাষ করতে পারবে। আমার তো বারান্দাও নেই।
মাঝরাতে চৌকিতে শুয়ে ছাদের টিনে ঢেউ দেখতে থাকি। কখনো উঠছে, কখনো নামছে। জীবনের ওঠা পড়া এক নিয়মে চলে না। কারোর বোর্ডে শুধুই সাপ, কারোর কেবল সিঁড়ি। ছোটবেলায় মা বাবাকে হারানোর পর ভালোবাসার গন্ধটাও উবে যায়। পেট ভরলে পশুর চাহিদা মেটে, মানুষের মন তো হাহাকার করে। দাদা ভাত দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল শরীরটাকে। মনের দুর্ভিক্ষে জল নেই। কত জায়গায় ছুটলাম। মনে কাউকে ধরলো না। যার হাতের ছোঁয়ায়, শরীরের গন্ধে, শাঁখা-পলার শব্দে, ভেজা চুলের জলে খরা কাটে। এতবছর পর আর একা লাগে না। বরং উঁচু ঢিবি আছে, ভুলুর বাচ্চারা আছে, পুকুর ঘাট, কদমতলা, পিচ রাস্তা, টিনের চাল আছে, যাদের আপনজন মনে হয়।
সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন আটটা বাজে। বাল্বের আলোটা এখনো জ্বলছে। দরজার পাল্লা খোলা। কাল রাতে খিল দিতে ভুলে গেছি। টাইম কলে খাবার জল ভরে, পুকুরে ডুব দিয়ে এলাম। হঠাৎ মনে পড়লো কাল থেকে খাওয়া জোটেনি। কিন্তু শরীর খুব দুর্বল লাগছে না। কষ্ট পেতে পেতে যেমন গা সওয়া হয়ে যায়, তেমনি খিদে আর নতুন করে কষ্ট দিচ্ছে না। দরজার চৌকাঠে বসে ভাবলাম কিছুক্ষন, কি করা যায় ! কাজ নেই, খাবার নেই, খিদে নেই, শুধু একটু মাথা ব্যথা আছে। নকুলদার দোকানে গিয়ে কিছু খাই, কিন্তু কদিন আর বাকিতে চলবে। দোকানের বাইরে বেঞ্চে শিব জেঠা, মতি, মাস্টারবাবু আর দুলাল বসে চা খাচ্ছে। পাশে তিন চার জন কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে মহামারী সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করছে। এত জনের সামনে বাকিতে চা বিস্কুট চাইতে খুব লজ্জা করলো। নকুলদাই জিজ্ঞাসা করলো, ‘কিরে, চোখ লাল কেন ? ঘুমোসনি রাতে ? কিছু খেয়েছিস ?’ আমি উত্তর দিলাম না। চায়ের কাপ আর দুটো টোস্ট বিস্কুট এগিয়ে দিল। খেয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। মাথা ব্যথাটা বাড়ছে। আবার বাস স্ট্যান্ডের দিকে গেলাম, যদি কোনো কাজ জোটে। দু-তিন ঘন্টা স্ট্যান্ড চত্বর এদিক ওদিক ঘুরেও কপাল খুললো না। দুজন পুলিশ এসে ধরলো, ‘কিরে, এখানে কি করিস ? অনেক্ষন থেকে দেখছি, এখন লক ডাউন চলছে, আর তুই বাস স্ট্যান্ডময় ঘুড়ির মত উড়ে বেড়াচ্ছিস ? দেবো ঘুড়ির সুতো কেটে ?’ কাতর সরে বললাম, ‘আমার কাজ নেই, পকেট ফাঁকা, তাই একটু কাজ খুঁজতে বেরিয়েছিলাম, যদি কিছু জোটে তবে দুপুরে একটু খেতে পাবো। কাল থেকে কিছু খাইনি।’ পুলিশটি চিৎকার করে উঠলো, ‘এত খাই খাই করিস কেন রে ? খেতে খেতেই জাতটা শেষ হয়ে যাবে। ভাইরাস আসছে। এক্ষুনি বাড়ি পালিয়ে যা। যা বলছি।’ লাঠি তুলে খেদাতে এলো। কোনরকমে সরে পড়লাম।
একবার তিন ক্লাসে পড়তে, আমরা চার বন্ধু স্কুলের প্রাচীর টপকে রাস্তার ওপারে ঊষা ফার্মের বাগানে ঢুকেছিলাম। চুরি করা যে অন্যায় তা তখন বুঝিনি। চারজন চারটে আমগাছে উঠে পাকা আম পেরে নীচে ঘাসের জমিতে ফেলছিলাম। কিভাবে যেন দারোয়ান বুঝতে পারলো। ধরা পড়ে গেলাম। একটা আমও খেতে পেলাম না। কিন্তু গার্ডের ঘরে আমাদের চারজনকে অনেক মারা হল। তারপর আমাদের হেড স্যারের ঘরে দিয়ে এলো। সেখানেও দুজন স্যার আমাদের ছড়ি দিয়ে পা থেকে মাথা অব্দি মারলেন। সবার বাড়িতে খবর পাঠানো হল। সন্ধ্যায় দাদা মেরে আধমরা করে দিল। কেউ বাঁচাতে এলো না। সারা শরীর আমার ফুলে গেল। ব্যথায় হাঁটতে পারছিলাম না, বসতেও না। পা, পিঠ কেটে গেছে অনেক জায়গায়। পরদিন স্কুলে গেলাম পা খুঁড়িয়ে হেঁটে। সব বন্ধুরা, স্যারেরা সারাদিন চোর বলে ডাকতে থাকলো। ছুটির সময় কলপাড়ে গিয়ে অনেক কেঁদেছিলাম। শরীরের ব্যথায় নয়, সারাদিনের অপমানে। কত বছর আম খাই নি, তাই পাড়তে গেছিলাম, দাদাকেও দেব ভেবেছিলাম। সেদিন কেউ আসেনি মাথায় হাত রাখতে। চোখের জল মোছাতে।
মাথা ব্যথার সঙ্গে জুটেছে কোমর, পায়ের ব্যথা । দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদেই গেলাম ঢিবিতে। শুয়ে পড়লাম একটা দেবদারু গাছের ছায়ায়। একটুও গরম লাগছে না। দুটো কাঠবেড়ালি লাফাতে লাফাতে উঠে এসে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি এদের চিনি। আগে এদের জন্যে বাদাম ভাজা নিয়ে আসতাম। আজ কিচ্ছু নেই। তবু এরা থেকে গেল। ওদের দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেলাম একসময়। একটা বিরাট কাশবনের মধ্যে দিতে হাঁটছিলাম। চারিদিকে ঘাসের উপর পাকা আম পরে আছে। দাদার ডাক শুনতে পেলাম, ‘ভাই, একটা আম দিবি খেতে ? ভাই…।’ কোথাও দাদাকে খুঁজে পেলাম না কাশবনে। রাস্তার ওপর হেডস্যার ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে । আমি উল্টোদিকে দৌড়াতে থাকলাম। একটা বিরাট নাগরদোলা ঘুরছে। আশেপাশে অনেক খাবারের দোকান। লম্বা চুলের শাড়ি পরা একটি মেয়ে আমায় টিকিট হাতে দিয়ে বললো, ‘চলো নাগরদোলায় উঠি, তারপর বাদাম ভাজা খাবো।’ একটা বেহালার সুর কানে আসতে থাকলো। দারোয়ান দুটো দেবদারু গাছের মাথায় উঠে কি যেন ফল পাড়ছে। বিরাট গাছটা হঠাৎ দু-টুকরো হয়ে আমার গায়ে এসে পড়লো। ঘুম ভেঙে যেতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কাঠবিড়ালি দুটো আর নেই। আমার বেশ ঠান্ডা লাগছে। মাথাটা ভীষণ ভার। ঢিবি থেকে নামতে পারছি না।
নকুলদার দোকানের পাশ দিয়েই ঘরে ফিরতে হয়। চলে যাচ্ছিলাম দাদাকে এড়িয়ে। কিন্তু নকুলদা হাঁক দিল, ‘এদিকে আয়। আমি জানি তোর কাজ নেই, টাকাও নেই। একটা চা খা, আর দুটো কেক নিয়ে যা। কাজ পেলে সব টাকা মিটিয়ে দিস।’ চা খেতে খেতে ভাবছিলাম, বোর্ডে শুধু সাপ নয়, এক আধটা মইও আছে। ধন্যবাদ জানালাম না । শুধু একবার তাকিয়ে হাসলাম। নকুলদা আবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘তোকে অন্যরকম লাগছে। চোখগুলো লাল। শরীর কি খুব খারাপ ? এদিকে আয়, দেখি জ্বর বাধিয়েছিস নাকি আবার !’ কপালে হাত দিয়ে বলে – ‘আরে তোর তো গা গরম, যা ঘরে গিয়ে শুয়ে পর, গায়ে চাপা দিবি গরম কিছু।’
মাথার কাছে জলের জগ আর কেক দুটো রেখে চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। চাদরের ফুটো দিয়ে বাল্বের আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। সারা শরীর ভীষণ যন্ত্রনা করছে। চোখ-নাক জ্বলে যাচ্ছে। মুখে থুতু আসছে বারবার, কিন্তু ঢোক গিলতে পারছি না। গলাতেও সুঁচ ফুটছে। খুব ঘুম পাচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে পারছি না আর। বেল ফুলগুলোর গন্ধ যেন পাচ্ছি। জগের জল একটু হাতে নিয়ে কপালে দিলাম। সারা শরীর কেঁপে উঠলো। কেকের প্যাকেটটা খুলে একটু মুখে দিলাম, কিন্তু গিলতে পারিনি। শরীরের আর কিছু দরকার নেই বোধ হয়। জবার বাচ্চাটি খুব জোরে কেদেঁ উঠলো। কাছের মানুষকে না দেখতে পাওয়ার অভিমান। ভুলুর কুই কুই ডাক আর দরজা আঁচড়ানোর শব্দ পাচ্ছি। চোখ জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। নাক দিয়েও জল গড়াচ্ছে। শরীরে জল ছাড়া তো আর কিছুই নাই। ঘুমে চোখ জুড়ে এলো।
কানে ভেসে আসছে রবীন্দ্রসংগীত – আমার রাত পোহাল শারদ প্রাতে, বেল ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ছাদে, দূরে ক্লাবের মাঠে মেলা বসেছে, নাগরদোলার মাথা দেখতে পাচ্ছি, একটার পর একটা সমুদ্রের ঢেউ পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে, হাতের মুঠো খুলে দেখি তাতে ওঁ লকেট, আমি ভিজে যাচ্ছি জলকণায়, কবিতা পাঠ করছি দেবদারু গাছের পাশে ঢিবিটায় দাঁড়িয়ে, অনেক দর্শক হাততালি দিচ্ছে, বৌদি একটা প্রাইজ দিয়ে গেল হাতে, উঠোন ময় পাকা আম পরে আছে, দাদা একটা ছড়ি আমার হাতে তুলে দেয়, পাণ্ডে চাচাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে বেঁধে, আমি কাউকে আঁকড়ে ধরতে চাই, কাঠবিড়ালি দুটো একটু আদর করে চলে যায়। হঠাৎ শোরগোল উঠলো। সবাই মিলে দরজা ভেঙে ফেলে। আমার ঘুম ভেঙে যায়। সামনে তাকিয়ে দেখি নকুলদা, শিব জেঠা, দুলাল, জবা আরো অনেকে দাঁড়িয়ে। নকুলদা বলছে –‘কিরে, সারা দিন রাত তোর কোনো খবর নেই, দরজা বন্ধ, আমরা সবাই খুব ভয় পেয়ে তোর দরজা ভেঙে ঢুকলাম। এখনোও তোর গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সেন ডাক্তারকে খবর দিয়েছি, এক্ষুনি আসছে। চিন্তা করিস না। ভালো হয়ে যাবি।’
আমি দেখতে পাচ্ছি অনেক বাটি ভর্তি বেল ফুল চারিদিকে রাখা। ডাক্তার সেন চিৎকার করে বলছেন,-‘চোখ দেখি, এবার জিভ, বুক পিঠ দেখবো একটু।’ আমি সব যেন ঝাপসা দেখছি। খুব ঠান্ডা লাগছে। এতদিন খাইনি কিন্তু খিদে পাচ্ছে না। নকুলদা ডাক্তারবাবুকে বলছে –‘ চারদিন কিছুই খায়নি, বৃষ্টিতে ভিজেছে, কাজ নেই, টাকার অভাবে মনমরা হয়ে আছে।’ ডাক্তারবাবু নিজের মুখের কাপড় আর হাতমোজা ঠিক করে, সবাইকে দূরে সরে যেতে বললেন। নিজেও তফাতে গেলেন। ফোন করলেন কয়েক জায়গায়। এম্বুলেন্স আসছে, আলাদা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। হাসপাতাল আবার আলাদা কিভাবে হয় বুঝলাম না। শুধু আমায় বলে গেল – ‘চিন্তা করো না,সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি মনের জোর রেখো। শ্বাস নিতে অসুবিধা হলে সঙ্গেসঙ্গে বলবে, বুঝেছো !’ শুনলাম গাড়ি করে হাসপাতালে যেতে হবে। খুব ছোটবেলায় একবার বাবার সাথে কলকাতায় ট্যাক্সিতে উঠেছিলাম। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল খুব। ড্রাইভার বলছিল কাচ তুলে দিতে। কিন্তু বাবা ও আমি কেউ কাঁচ তুলতে পারলাম না। শেষে ড্রাইভার কি একটা খারাপ কথা বলে গাড়ি থামিয়ে কাঁচ তুলে দিল। কাঁচের বাইরে বৃষ্টির জল নদীর মত বইছিল। আমি আঙ্গুল দিয়ে কাঁচের ভেতরে একটা বড় পাহাড় এঁকেছিলাম।
ঘরের বাইরে পাড়ার অনেক লোক দাঁড়িয়ে। নকুলদা ব্যস্ত হয়ে পায়চারি করছে। সবাই মুখ ঢেকে আছে। খুব বড় বিপদের কথা বলছে। সর্বনাশ নাকি ধেয়ে আসছে। ভুলু দরজার কাছে এসে করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে তিনটে বাচ্চাও। আমি কিছুই খাওয়াতে পারলাম না এদের। দীনু মাতাল দরজায় উকি দিতেই কেউ চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ওরে ঢুকিস না, মরবি রে, মরবি।’ গলা শুকিয়ে গেছে আমার, জল চাইলাম। কিন্তু কেউ ঘরে আসলো না। নকুলদা যেই ঘরে ঢুকতে এলো, সবাই তাকে হুমকি দিয়ে সরিয়ে দিল। কেন সবাই দূরে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারলাম না। আমি তো কারোর শত্রু নই। জ্বর হলে কি মানুষকে ছেড়ে চলে যেতে হয় ? অবশ্য মা বাবা তো কবেই ছেড়ে চলে গেছে বিনা কারনে। স্কুল থেকেও বের করে দিল। দাদা বৌদিও তাড়িয়ে দিল। কপালে যোগের থেকে বিয়োগ বেশি। অঙ্ক আর মিললো না। ভাগশেষ পরে রইলো চিরকাল একা।
বিরাট শব্দ করে এম্বুলেন্স এলো। আবার একটা হইচই উঠলো। ঘরের মধ্যে দাদা, হেড স্যার, বৌদি, গুপে, মা – সবাইকে আবছা দেখতে পেলাম। হাত তুলে আমাকে বিদায় জানাচ্ছে। দুজন মানুষ মাথা থেকে পা অব্দি প্লাস্টিক পোশাকে ঘরে এলো। আমাকেও প্লাস্টিকে মুড়ে এম্বুলেন্সে তুললো। আরো দুজন লম্বা পাইপ দিয়ে ঘরের ভেতরে ও বাইরে জলের মত কিছু ছড়াচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে থেকে নকুলদা বললো –‘ সুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি ফিরিস।’ আমি আসছি বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বেরোলো না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এখন। এম্বুলেন্স এগিয়ে চললো কঠিন শব্দ বাজিয়ে। আমার মুখে একটা পাইপ লাগানো ঢাকনা পরিয়ে দিল। এবার শ্বাস নিতে পারছি। জীবনে এই প্রথম এম্বুলেন্সে উঠলাম। কি সুন্দর শুয়ে শুয়ে যাওয়া যায়। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ঢিবিটাকে। কালো মেঘ যেন ঢিবিটাকে অন্ধকার ছায়ায় ঢেকে রেখেছে। দেবদারু গাছের তলায় বসে কুকুরটা একটা চপ্পল চিবোচ্ছে। কাঠবিড়ালি দুটো খেলা করে ঢিবির মাথায় উঠছে আর নামছে। বেল ফুলের গন্ধটা নাকে এলো। বেহালার করুন সুর কোথাও যেন বাজছে। শ্বাস নিতে আবার কষ্ট হচ্ছে। কাঁচের জানলার ওপর বৃষ্টি শুরু হল ।
Tags: অন্তমিল বাকি, অরিন্দম ঘোষ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।