‘খবর্দার! তুমি ওদিকে যাবে না। এই না বলছি তো না। যাবে না, যাবে না, যাবে না।’ – শ্যামলী চোখ পাকিয়ে আমাকে বলল। বউয়ের বারণ। আমি পাজামার ওপর বিনা গেঞ্জিতে হাফ পাঞ্জাবি গলিয়ে সবে দরজা খুলে বেরিয়েছি, জানালা দিয়ে ওই বাঘিনীর গর্জন। আমি উজিতপুরের মাঠের দিকের রাস্তা না ধরে রেল স্টেশনের গ্যাঞ্জামের দিকের সড়কটি ধরলাম। পাখি দেখা আজ আর হলো না আমার।
রোজই আমার রুটিন ছিল সাতসকালে বেরিয়ে উজিতপুরের মাঠ পেরিয়ে সিংহবাড়ির ধ্বংসাবশেষের ওপর গজিয়ে ওঠা ঝোপজঙ্গলে প্রজাপতি দেখা। আর বিকেল-বিকেল বেরিয়ে সিংহবাড়ির ওই ঢিবির ওপর উঠে চারপাশের গাছপালায় মহা মহা বৃক্ষে কুলায় ফেরা পাখিদের পর্যবেক্ষণ। দূরবিন আছে আমার। কলেজে জুলজি পড়িয়েছি তো। যখন পড়াতাম ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এসেছি কয়েকবার। অবসর নেওয়ার পর রোজই আসতাম, রুটিন হয়ে গিয়েছিল।
আমার এই রুটিন তছনছ হয়ে গিয়েছে, এই সেদিন, যখনও বর্ষা শেষ হয়ে যায়নি। উজিতপুরের মাঠের ওই প্রান্তে প্রায় ঝোপঝাড়ের কাছাকাছি সেদিন ভোরে একটি মৃতদেহ পাওয়া যায়। আমার চেয়েও বয়সে বড়ো এক বৃদ্ধ ব্যক্তির। চোখ দুটি ড্যাব ড্যাব করে খোলা, ভয়ার্ত মুখের মানুষটিকে ঘিরে আশপাশের লোকজন মাঝেরপাড়ার হারাধন মণ্ডল বলে শনাক্ত করে ফেলেছিল। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। পুলিস এসে মাঠের কাদায় তার পায়ের চিহ্ন দেখে বলেছিল, ভয়ে ছুটতে ছুটতে এসে এখানে পড়ে মরেছে। পরদিন ময়নাতদন্তের রিপোর্টের কথাও শহরে ছড়াল : হার্টফেল।
ঠিক ৫ দিনের মাথায় ভর দুপুরে আরেক কাণ্ড। টংয়ের হাটের ফুলমণি সারেনকে ওই মাঠের প্রান্তে চিৎকার করে ছোটাছুটি করতে দেখা গেল। হলটা কী? – মাঝিপাড়ার বউঝিরা এপ্রান্ত থেকে মাঠের ওপ্রান্তে ফুলমণির কাছে পৌছানোর অর্ধেক পথ যায়নি, এম্নিসময় ফুলমণিও ধপ করে পড়ে গেল। ছুটে যেতে যেতেই বউঝিরা ওই ভরদুকুরে দেখল, দু একবার হাত পা ছুড়ে শুয়ে পড়ল ফুলমণি। থানার ওসি এসে হাতখানি ধরে বললেন, মরে গেছে। হাসপাতালে পাঠানো হলে ডাক্তারও বললেন, হার্টফেল। ও, হ্যা ফুলমণিরও দু-চোখ ছিল খোলা ড্যাবড্যাবে, মুখটি ছিল ভয়ে আঁতকে ওঠা। এসব কথা আমি ওই রেলস্টেশনের গ্যাঞ্জামে গিয়ে শুনেছি।
১০ দিনের মাথায় সন্ধের পর মৃতদেহ পাওয়া গেল এক রাখালের। তার গরুরা সন্ধে নামতে ফিরে এলেও, ঘন্টাখানেক সে না ফেরায় মুন্সিবাটির লোকজন খুঁজতে গিয়ে ওই উজিতপুরের মাঠের ঝোপের ভেতর পেল ভয়ে ফ্যকাসে মুখের কিশোরটিকে, মৃত অবস্থায়।
এই তিনজনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় নানারকম গুজব। ছড়িয়ে পড়ল আমাদের চন্দ্রপুর শহরে। গুজব জোরদার হয়ে উঠল। চন্দ্রপুর বিজয় সিংহ স্মৃতিবিদ্যালয়ের শিক্ষক বিষ্ণুবাবুকে যেদিন ওই উজিতপুর মাঠে পাওয়া গেল রাত ৮টা নাগাদ। না, মারা যাননি তিনি। উদভ্রান্তের মতো চিৎকার করতে করতে মাঠ পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে শহরে ঢোকার স্টেশন রোডে তাকে লোকজন দেখতে পেয়ে ঘিরে ধরে। দু-চোখ বিস্ফারিত, ভয়ে আর্তনাদ করতে করতে আসছিলেন তিনি। আবোল তাবোল চিৎকার। চিৎকার তবে গোঙানির মতো আওয়াজ। সে আওয়াজে শুধু বোঝা যাচ্ছিল। কয়েকটা শব্দ – ‘উড়ন্ত মানুষ। উ-উ-উ-ড়-ন্ত মানুষ। একটা দোতলা বাড়ির দিকে আঙুল তুলে অঙ্কের মাস্টার বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস বলেছিলেন, ‘ও-ই অ-ত-তোটা উঁচু – বিরাট। লোকজন তাকে ডা. বসাকের চেম্বারে নিয়ে যায়। দিনদুয়েক পর সবটা শুনে আমিও তাকে শ্রীরামপুরে নিয়ে যাই মনোবিদ মোহিত রণদীপের কাছে। ওষুধপত্রে কিছুটা ভালোও হন তিনি। এরপর একদিন শুনি, স্কুলে ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক কষাতে কষাতে তিনি উজিতপুর মাঠের সিংহবাড়ির ঢিবির ছবি এঁকে যাচ্ছেন রোজই। ঢিবি, ঝোপঝাড়, তার ওপরে এঁকে যাচ্ছেন উড়ন্ত এক মানুষ।
এই গুজব ছড়িয়ে পড়ল সারা চন্দ্রপুর শহরে। ভর সন্ধেবেলা। গনগনে দুপুরে, কাকডাকা ভোরে নাকি ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে ওই লোকটা অট্টহাসি হাসে। তারপর বিরাট হতে থাকে, লাফ দিয়ে ওঠে এবং উড়তে থাকে। যারা তাকে দেখেছে ভয়ে আঁতকে উঠে মরে গেছে। ওই হারাধন মণ্ডল, ফুলমণি সোরেন, রাখাল ছেলেটি, কেউ তারা ওই উড়ন্ত মানুষকে দেখেছে? – জানার উপায় নেই। হারাধন, ফুলমণি, রাখাল বালকটি মারা গেছে। একমাত্র জীবিত বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস তিনি ওষুধপত্রে গুম মেরে আছেন। এসব প্রশ্নের জবাব তিনি দিচ্ছেন না, তিনি কেবল স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে লসাগু গসাগু করানোর ফাঁকে ফাঁকে এঁকে ফেলছেন ঝোপজঙ্গলে ঘেরা ঢিবির ওপর এক উড়ন্ত মানুষ। গুজবে মশমশ করতে লাগল আমাদের চন্দ্রপুর শহরটি।
ডালপালাও ছড়াল এসব গুজবের। উঠে এল পুরনো কথাও। নানা কথা। উজিতপুরের মাঠের ওই শেষপ্রান্ত, সিংহবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, জঙ্গলে ঘেরা ঢিবি, তার পিছনে বলহাটি স্টেশনে যাওয়ার রেললাইনের বাঁক – এসব অঞ্চল পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল বহু আগেই! পরিত্যক্ত হওয়ার কারণও ছিল। এমনিতেই আমাদের এই চন্দ্রপুর শহর, কলকাতার হাতায় হলেও কেমন যেন ময়লা মতো। মানে, এর আকাশ-বাতাস ছাই ছাই রঙে ভরা। এক একটা শহর থাকে না, যে সব শহরের ওপর দুধের সরের মতো একটা আস্তরণ থাকে, আমাদের চন্দ্রপুরের ওপর ওইরকম একটা আস্তরণ আছে। তবে সাদা বা অফ হোয়াইট নয়, ধোঁয়াটে আস্তরণ। সন্ধের দিকে দেখা যায় উজিতপুরের মাঠের ওপর দিয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া ওই আস্তরণের টুকরোগুলো ভেসে যাচ্ছে টিবি, বনজদলের ওপর দিয়ে, সিংহবাড়ির ওই ধ্বংসস্তুপের ইটের পাঁজা পেরিয়ে। কেবল বৃষ্টি হয় যেদিন যেদিন, তারপর যে সূর্য ওঠে, তাতে গাছপালা বিশেষত কলাগাছ, কলাবতী ফুলের ঝোপ, তখন অতিরিক্ত সবুজ দেখায়। সেদিন, সেই দিনগুলিতে নানারকম পাখি দেখা যায়, বিচিত্র সব প্রজাপতির ঝাঁক ওড়ে। আমি সেসব দিনে অবশ্য অবশ্যই ওই উজিতপুরের মাঠ পেরিয়ে সিংহবাড়ির ধ্বংসস্তুপ পিছনে ফেলে ঢিবির ওপর ঝোপঝাড়ের ভিতরে যাই। দূরবিন চোখে লাগিয়ে পাখি খুঁজি, লাল ড্রাগন ফ্লাই ফড়িংয়ের ভেতর হঠাৎ দু-তিনটি নীল রঙা প্রজাপতি দেখে উত্তেজিত হই, উল্লসিত বোধ করি, এই নীল রঙা প্রজাপতি, ব্লু এঞ্জেল আমাদের দক্ষিণবাংলায় দুর্লভ, মোবাইলে তুলেও নিই ছবি।
কেন এই উজিতপুরের মাঠের শেষপ্রান্ত, সিংহবাড়ির ধ্বংসাবশেষের শেষে জঙ্গলে ঘেরা এই ঢিবি, মনোরম বনরাজির এই তল্লাট বহুকাল আগে থেকে ক্রমে ক্রমে পরিত্যক্ত হয়ে গেল, এবার সেই আসল কথাটিতে আসি।
আমার বাল্যকালে এই সিংহবাড়ি, তখনই ভাঙাচোরা অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল আড়াইশো-তিনশো বছরের জমিদার বাড়িটি।আমি তার ওয়ারিশদের দেখেছি। বুড়ো বুড়ো সিংহ ও তাদের বুড়িবুড়ি বউদের সঙ্গে খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো মিলিয়ে পাঁচ ভাইকে দেখেছি। আমি যখন স্কুলে পড়ি, তখন ওই পাঁচ ভাই পড়তে যেত কলকাতায় কলেজে। দেখতে দেখতে কী দিনকাল এসে পড়ল। চতুর্দিকে বেধে গেল খুনোখুনি। ধরপাকড়। ওই পাঁচ ভাই আর তাদের কলকাতা থেকে আসা বন্ধুরা আমাদের চন্দ্রপুরেও দেওয়ালে দেওয়ালে লিখে দিল – চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। সিংহবাড়ির অগুণতি ভাঙাচোরা ঘরের কোণের ঘরগুলিতে বসে নাকি বোমা বাঁধত ওই পাঁচভাই আর তাদের বন্ধুবান্ধবরা। রাত গভীরে মাঝে মাঝে গুম গুম শব্দও শুনতাম বালক আমি। সে সময় লোকজন তো সিংহবাড়িটিকেই বলত – নকশালবাড়ি। বলহাটির কংগ্রেস নেতা রামজীবন বন্দোপাধ্যায় খুন হয়ে গেলেন একদিন, দিনের বেলায়, বাজারে। উজিতপুরের মাঠের, আরেকপ্রান্তে ছিল পুলিসের আউটপোস্ট, সেই ফাড়ি বিস্ফোরণে উড়ে গেল। বালক আমি, সঙ্গে আরও কয়েকজন সহপাঠীবন্ধু সবিস্ময়ে, সভয়ে উজিতপুরের মাঠের ধারে ভীত কিন্তু কৌতুহলী জনতার ভিড়ের ফাক দিয়ে মৃত দুই ছিন্নভিন্ন কনস্টেবলকে দেখেছি।
তারপর তো ভোট হল। সে ভোটেও সিংহবাড়ির ছেলেরা বা তাদের বন্ধুরা ইতিউতি দেওয়ালে দেওয়ালে লিখেছিল – ভোট বয়কট করুন। ওই ভোটের কয়েকদিন আগে রাস্তায় রাস্তায় খুব শোরগোল হচ্ছিল। কেন জানি না আমাদের হেডমাস্টার সেদিন। টিফিনেই স্কুল ছুটি দিয়ে দিলেন। আমরা ছেলের দল রাস্তায় এসে দেখলাম ভোটপন্থী সব দলেরই লোকজন, সঙ্গে পুলিসও মোটামোটা বুরুশ দিয়ে ভোট বয়কটের দেওয়াল লিখন চুনকাম করে মুছে দিচ্ছে। জনতার অনেকেরই হাতে লাঠিসোটা, দা, বল্লম, শাবল। ঢেউয়ের মতো ওই জনতা, পুলিস পিছনে নিয়ে উজিতপুরের মাঠ পেরিয়ে গেল। সদ্ধে নাগাদ দাউ দাউ জ্বলে উঠল সিংহবাড়ি। ভোটপন্থীদের মহাজোট পুড়িয়ে দিল ভোট বয়কটের ডাক দেওয়া দলটির স্থানীয় সদর – ওই সিংহবাড়ি।
এরপর মাসখানেকের মধ্যেই ওই সিংহবাড়ির কড়িবরগা দরজা জানালা সব লুটপাট হয়ে গেল, পরের বর্ষাতেই ইটের পাঁজা গুলির ওপর জঙ্গল হয়ে গেল। সিংহবাড়ির বুড়োবুড়িরা কোথায় গেলেন কে জানে। পাঁচ ভাইও উধাও হল। কেউ কেউ তখন বলাবলি করত, সব কটাই জেলে আছে। কেউ কেউ বলত ভাইদের দুজন আমেরিকা চলে গেছে, তিনজন আলিপুর জেলে গুলি খেয়ে মরেছে। হবেও বা। তবে তাদের এক বন্ধু পন্টু সেনকে আমি পরে হিন্দমোটরে শ্রমিক সংগঠনের নেতা হিসেবে দেখেছি। অন্ধ্রের ওয়ারেঙ্গল জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে এসেছিলেন ওই পন্টু সেন।
সিংহবাড়ির ওই ঘটনার পর থেকেই অলক্ষুণে অঞ্চল হিসেবে ওই তল্লাট পরিত্যক্ত হতে থাকে। ওই এলাকা জন-বিবর্জিত হয়ে যায় আরেক মর্মান্তিক ঘটনায়। সেটা বিগত ৮০-র দশকের ঘটনা। ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলেন ১৯৮৪ -তে, সেইবার। সেবার শীতে উজিতপুরের মাঠের ধারে পিকনিক করতে এল একদল ছেলেমেয়ে। চাপাইতলার নবজীবন সঙ্ঘের ব্যানার লাগিয়ে বাসে। পিকনিক থেকে ফেরার পথে ওই সিংহবাড়ির পিছনের বলুহাটির রেললাইনের ক্রশিংয়ে ওই বাসের সঙ্গে জগদলপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের লাগল ধাক্কা! বহু লোক হতাহত হল সেবার। এরপর থেকে কথা রটে গেল, জায়গাটা অতি অলক্ষুণে। ওই রেলক্রশিংয়ে নাকি মাঝেমাঝেই লোক কাটা পড়ে। এই এলাকা নির্জন হয়ে পড়ল আরও।
এর কয়েক বছর পর এক চৈত্র দুপুরে উজিতপুরের মাঠে দাউদাউ জ্বলতে দেখা গেল মসজিদতলার নাসরিনকে। মাঠেই মরে গেল সে। কেরোসিন ঢেলে তার স্বামীই নাকি জ্বালিয়ে দিয়েছে নাসরিনকে। ওই মজিদ মিঞাকে পুলিস আজও ধরে উঠতে পারেনি।
আমাদের চন্দ্রপুর শহরে চলতি সময়ের উড়ন্ত মানুষের গুজবের সঙ্গে সঙ্গে এসব পুরনো কথাও আলোচিত হচ্ছে। স্টেশন রোডে চলতে চলতে বয়স্ক মানুষজন অল্প বয়সিদের আঙুল তুলে উজিতপুরের মাঠের এদিক-ওদিক দেখিয়ে বলছেন, ওই ওখানে বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন দুই পুলিস কনস্টেবলের দেহ পড়ে ছিল। আর ওই মাঝখানটিতে জ্বলতে জ্বলতে ছুটছিল নাসরিন। আর ওই সিংহবাড়ির ইটের পাঁজায়, দেখেছিস তো পোড়া দাগ। ওই যে সিংহবাড়ির পিছনে জঙ্গলের ফাকে ওই রেললাইন, ওখানেই তো ধাক্কা লেগেছিল ট্রেনে-বাসে। – এইসব।
‘খবর্দার! তুমি ওখানে যাবে না।’ – চোখ পাকিয়ে আমাকে বলেছিল শ্যামলী। আমাদের মেয়ে গুনগুনের গতবছর বিয়ে হয়ে যাবার পর শ্যামলীর শাসন আরও বেড়ে গেছে। উড়ন্ত মানুষ দেখে বা না দেখে তিন-তিনটে মানুষের আঁতকে উঠে হার্টফেল করার ঘটনায়, স্কুল মাস্টার বিষ্ণুবাবুর মাথার স্ক্রু ঢিলে হয়ে যাওয়ায়, যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, তাতে শ্যামলীর উদ্বেগ স্বাভাবিক। সংবাদপত্রগুলিতে এসব গুজব, এই গণভীতি নিয়ে কিছু কিছু খবরও বেরিয়েছে – সে সব গিলেই শ্যামলীর ভয় বেড়েছে বুঝতে পেরেছি আমি।
বিজ্ঞানমনস্ক ছেলেমেয়েরাও দিনকয়েক ঘুরে ঘুরে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে শহরের মানুষজনকে বুঝিয়েছে এসব ভুয়ো। সে কথা আমিও বুঝিয়েছি শ্যামলীকে।
কিন্তু শ্যামলী বলেছে, ‘কী দরকার। ওদিকে একদম যাবে না তুমি।’
শীতের এই আসি আসি সময়টাতেই নানারকম পাখি আসে। নানাধরনের প্রজাপতিদেরও আনাগোনা শুরু হয়। বউয়ের নিষেধ অগ্রাহ্য করাই সঠিক স্বামীর কর্তব্য। তাতে মুক্তির আনন্দ। সেদিন যাইনি। পরদিনই বিকেলে, স্টেশন রোডের চায়ের দোকানে যাচ্ছি বলে, ঘুরপথে আমি উজিতপুরের মাঠে পৌঁছোলাম। পেরোলাম সিংহবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, উঠলাম ঢিবির ওপর। আমার সাইডব্যাগে সর্বদা দূরবিন, হাই পাওয়ারের জাপানি টর্চ থাকে। সূর্যাস্তের আলোয় আমি দেখলাম ওই তো প্রজাপতির ঝাক উড়ছে, হলুদ প্রজাপতি, খয়েরি ছোপ ছোপ প্রজাপতির ঝাঁকগুলির ভেতর উড়ছে তিন চারটি ব্লু এঞ্জেল, দূরবীনে দেখলাম জামরুল পাতার ফাঁকে এক জোড়া বসন্তবৌরী। নীচের ঝোপে কয়েকটা সিপাহি বুলবুল। এসব দেখতে দেখতেই ধীরে, অতিধীরে নেমে এল সন্ধ্যা, তারা ফুটতে লাগলে একটি-দুটি করে। এরপরই হঠাৎ মনে হল দুটি হাত লম্বা হয়ে আসছে আমার, পা দুটিও। আচমকাই ভাবলাম পা দুখানা ঢিবির ওপর নেই আর! শূন্যে ভাসছি যেন! এবার মনে হল, ধুস, মানুষ কি আর উড়তে পারে? পাখি ওড়ে, প্রজাপতি ওড়ে, মশা, মাছি, বহু কীট পতঙ্গ ওড়ে, পিপীলিকা পাখা মেলে মরিবার তরে, সরীসৃপের কেউ কেউ ওড়ে, উড়ন্ত গিরগিটি আছে, উড়ুক্কু মাছ আছে, স্তন্যপায়ীদের বাদুড় ওড়ে, উড়ন্ত কাঠবিড়ালীও হয়… মানুষ ওড়ে না। প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক ছিলাম, খ্যাক খ্যাক হাসি এল মুখে। ওমা, কিছুক্ষণের মধ্যে সেই হাসি হো হো হাঃ হাঃ হাসিতে পরিণত হল। অট্টহাসি হাসতে হাসতে মনে হল, উড়ছিই তো আমি! দূরে স্টেশন রোডটি দেখা যাচ্ছে আলোর সুতোর মতো। পিপড়ের মতো লোকজন সচল। ওই পিপীলিকার সারিটি হঠাৎ থমকে গেল। থমকে থাকা ওই সারির ভেতর থেকে অস্ফুট আবছা মতো হই হইও মৃদুভাবে কানে আসতে লাগল। দু চারটি নারীপুরুষ উজিতপুর মাঠের দিকে এদিপানে ছুটে আসছে, দেখতে পেলাম।
এরপর ঝপ করে পড়ে গেলাম আমি, ঝোপের ভেতর। লাগল একটু। তবে দুচোখের পাতা ঘুমঘোরে মুদে এল আমার।
ঘুম ভাঙতে দেখলাম ঢিবির ওপর ঝোপের ভেতর শুয়ে আছি আমি। সকাল হয়ে গেছে। শিশু সূর্য বালক হওয়ার দিকে ছুটছে। ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে ৬টা বেজে গেছে। ধড়ফড় করে উঠে ঢিবি থেকে নেমে উজিতপুরের মাঠ পার হয়ে বাড়ির দিকে ছুটলাম। শ্যামলী নিশ্চয়ই সারারাত ঘুমোয়নি। আমি কোথায় – ভেবে গেছে, ভয়ে আতঙ্কে।
বাড়ির সামনে গিয়ে দেখি ভিড়ে ভিড়। আমি পৌঁছোতেই হই হই পড়ে গেল। লোকজন সরে সরে আমাকে পথ করে দিল। বিছানায় শ্যামলী পড়ে আছে। ড্যাবড্যাব দুই চোখ, ভয়ার্ত মুখখানি। আমাকে খুঁজতে সে উজিতপুরের মাঠে গিয়েছিল গত সন্ধ্যাবেলা। বাড়িতে এখন আমাকে দেখেই শ্যামলী আঁতকে উঠল আরও, ভয়ার্ত চিৎকার শােনা গেল তার ‘উ-উ-উড়ন্ত মানুষ-ষ-ষ।’ উঠে বসতে চাইল সে। পাশের ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে আসা মিসেস মজুমদার সঙ্গে তার দুই কিশোরী মেয়ে জলি-মলিকে নিয়ে চেপে ধরে শ্যামলীকে ফের শুইয়ে দিলেন। জল ছেটালেন চোখে মুখে। চিৎকার করতে লাগল শ্যামলী “উ-উ-উ-উড়ন্ত মা-মা-মা-নুষ!’’ ফুল স্পিড ফ্যানে চুল উড়তে লাগল তার।
গল্পটি ইতিপুর্বে ‘নতুন গল্পপত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত
email:galpersamay@gmail.com
Sanat Kumar Das on July 15, 2021
যদিও আগে পড়েছি, তবু আবার চমৎকৃত হলাম ৷ সামাজিক আয়নায় এক অতি কল্পনার প্রতিবিম্ব ৷ দারুণ লাগল ৷
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।