24 Jan

পান্থজনের সখা

লিখেছেন:প্রবুদ্ধ বাগচী


গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে যখন হঠাৎ করেই জীবনবীমা নিগমে একটা চাকরি পেয়ে গিয়েছিলাম তখন তার নিরাপত্তা ও নানারকম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চেনামহলে একটা ধন্য ধন্য রব উঠেছিল। কিন্তু সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে একটা সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাজে মন বসানো বড় কঠিন। ইচ্ছের বিরুদ্ধে সেই মরুভূমিতে পথ হাঁটার সংকটকালে মরুদ্যান বলতে ছিল জীবনবীমা নিগমের পূর্বাঞ্চলীয় দফতরের একটি অত্যাশ্চর্য লাইব্রেরি। বহুখ্যাত হিন্দুস্থান বিল্ডিং, যেখানে একসময় দেবব্রত বিশ্বাস কাজ করতেন, তার উত্তর-পশ্চিম কোণের প্রায় একটা গোটা তলা জুড়ে এই লাইব্রেরি। একচেটিয়া ব্যবসার সুবাদে জীবনবীমা নিগম বরাবরই টাকার পাহাড়ে বসে থাকে, তারই একটা অনুমোদিত অংশ তারা এই লাইব্রেরিকে দিত বইপত্র-পত্রিকা কেনার জন্য। বাংলা-ইংরিজি এবং কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ার সুবাদে হিন্দি সবরকমের বইই এখানে মিলত। জীবনবীমার কর্মীদের জন্য এই পরিষেবা সম্পূর্ণ ফ্রি, যদিও সিংহভাগ কর্মীই এসবের ধার ধারতেন না, টিফিন টাইমের অবসরে তারা কুঁদ হয়ে থাকতেন তাস বা ক্যারাম পেটানোয়।

কিন্তু শ্রীসুধীর চক্রবর্তীর বিষয়ে লিখতে গিয়ে হঠাৎ এই লাইব্রেরির কথা উঠল কেন? কারণ, আমার এই যাবৎ চলে আসা জীবনে আমি অনেকগুলো লাইব্রেরির সদস্য হলেও মাত্র একবারই আমার হেফাজত থেকে লাইব্রেরির বই খোয়া যায়। সেই বইটি ছিল এই জীবনবীমা নিগমের লাইব্রেরির। বইটি খোয়া যাওয়ার বৃত্তান্ত অতীব রহস্যজনক। সে কথা বিস্তারিত বলে কাজ নেই। কিন্তু সেই হারানো বইটির নাম; সদর-মফস্বল, যার লেখক সুধীর চক্রবর্তী। বিশেষ কোনও বই পড়ে ফেলার পর তার ভালোলাগা তো থাকেই, যা পাঠকের অনুভূতিকে তীব্রভাবে জড়িয়ে রাখে। কিন্তু তার সঙ্গে যদি জুড়ে যায় সংশয় আর দুশ্চিন্তা তাহলে সেটা অন্যরকম একটা বিষয়। মনে আছে, কাঁচুমাচু মুখে যখন গ্রন্থাগারিককে এই দুঃসংবাদটা দিলাম, তিনি বললেন, আপনাকে সাতদিন সময় দিচ্ছি, আপনি বইটার একটা নতুন কপি কিনে এনে আমায় জমা করে দেবেন। একটা বাঁচার রাস্তা আছে তা হলে? এই প্রবোধবাক্যে নিজেকে যখন আশ্বস্ত করছি তখন সমান্তরাল আরেক সংশয় আমার ভেতরে। বইটা যদি ছাপা না থাকে? যদি কলেজ স্ট্রীটে না পাই? ততক্ষণে আরও একটা কাণ্ড আমার চোখে পড়ে গেছে।

অফিসে আমার পাশের সহকর্মীটি নতুন চাকরির পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা হিসাবে লাইব্রেরির কার্ডটি মুফতে করিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়া আর যাই হোক ‘নট হিজ কাপ অফ টি’। ফলে পড়ে থাকা অব্যবহৃত কার্ডটা আমি চেয়ে নিয়েছিলাম, যাতে দুটো কার্ডে আমি দুটো বই নিতে পারি। কিন্তু হবি তো হ, সেই সহকর্মীর কার্ডটিতেই ইস্যু হয়েছিল খোয়া-যাওয়া বইটি, ফলে সেটা একটা বাড়তি বেইজ্জতির চোরা আশঙ্কা। এরকম বিপন্ন মুহূর্তেই মানুষ বিধাতার শরণাপন্ন হয়, কালীঘাটে জোড়াপাঠা মানত করে বা শনির থানে গিয়ে মাথা কোটে। এর কোনওটাতেই যেহেতু আমার আস্থা নেই ফলে আমি ছুটলাম সরাসরি কলেজ স্ট্রিট। এবং কী আশ্চর্য, খুব সহজেই পেয়ে গেলাম বইটা। বই হাতে করে ফেরা নয়, যেন বিশ্বজয় করে ফেরা! অন্য কারোর কাছে এই ঘটনার কোনও মূল্য নেই। কিন্তু আমার কাছে ‘সদর-মফস্বল’ মানে এই আদ্যোপান্ত সবটাই।

যদিও সুধীর চক্রবর্তী নামের এই আশ্চর্য মানুষটির লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল এই ঘটনা (বা দুর্ঘটনা)-র অন্তত সাত-আট বছর আগে। স্কুলের বেড়া ডিঙিয়ে সদ্য তখন স্নাতকস্তরে ভর্তি হয়েছি। একটু একটু করে চোখ ফুটছে। পরিচিত এক সিনিয়র দাদা আমায় দুটো বই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পড়ে নিতে পরামর্শ দেন – একটি হল শ্রী অশোক মিত্রের ‘কবিতা থেকে মিছিলে’ অন্যটি শ্রীসুধীর চক্রবর্তীর ‘গভীর নির্জন পথে’। দুটো দু-ধরনের লেখা। কিন্তু বিষয় ও রচনাসৌকর্যে ‘গভীর নির্জন পথে’ আমায় তীব্রভাবে আকৃষ্ট করে এর লেখক সম্বন্ধে। সেই আকর্ষণে একের পর এক খুঁজতে থাকি তার লেখা। পেয়েও যাই। গান আর গ্রাম যাঁর প্রিয় বিষয় বলে জানতে পারি, সেই গান আর গ্রামের অন্য এক চিত্র ক্রমশ ধরা দিতে থাকে তাঁর লেখায়। আমার মতো অল্পবয়সী তরুণের কাছে সে এক অপার বিস্ময়ের জগৎ।

কেন বিস্ময়? কারণ, মূলত মফস্বলকে ঘিরেই আমার বড় হয়ে ওঠা হলেও গ্রাম বিষয়ে আমার ধারণা ছিল একমাত্রিক। অর্থাৎ, গ্রাম মানে হয় কৃষক-জোতদার-জমিদারের ভূমিকেন্দ্রিক সংঘর্ষ-সংঘাত নতুবা ছায়াশীতল একটা মাখো মাখো ধারণা যেখানে খাটি দুধ, নির্ভেজাল খাদ্যশস্য বা সবজি, নদীর ধারে গরু-চরানো উদাস রাখাল, সাবেকী চণ্ডীমন্ডপ বা একচালা দুর্গাপ্রতিমা। আরেকটু পরের দিকে জানা গেল গ্রাম মানে বিকেন্দ্রীকৃত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, দরিদ্র কৃষকের জন্য হাজারো সরকারি প্রকল্প, ভূমি সংস্কার, কৃষিঋণ ইত্যাদি ইত্যাদি বহুবিধ উপচার। কিন্তু এর মধ্যে কোথায় সেই মানুষগুলির কথা যারা গ্রামসমাজকে একটা স্বতন্ত্র আদল দিয়ে ধরে রেখেছেন? যাদের চেতনায় নানা গৌণধর্মের আচমন, অন্তরালবর্তী সেই সাব-অল্টার্নরা নির্মাণ করে রেখেছেন তাদের বাঁচবার একটা ধরন। এই জীবন আমাদের শিক্ষিত উচ্চশ্রেণির চেনা জীবন নয়, ভিন্নরকম একটা জীবন। সেই জীবনের দিকেই তো আমাদের দৃষ্টি ফেরালেন সুধীর চক্রবর্তী।

শ্রেণিগত অবস্থান থেকে এই আড়ালে থাকা জীবনের সঙ্গে যে তার পূর্ব-পরিচয় ছিল এমন কোনও তথ্য আমার জানা নেই। গ্রাম দেখবেন বলেই পথে বেরিয়েছিলেন তিনি। এই দেখার সূত্রেই তার সামনে উন্মোচিত হচ্ছিল গ্রাম-সমাজ আর গ্রামীণ-সংস্কৃতির একেকরকম চিত্র। এক স্তর থেকে অন্যস্তরে সরে যাচ্ছিল তার অন্বেষণের অভিমুখ। আর, এভাবেই তিনি পেয়ে গেলেন সেই অন্য ভুবনের মানচিত্র। বাউল-ফকির-কর্তা ভজা সাহেব ধনী ইত্যাদি নানা গৌণধর্ম নিয়ে তার লেখাগুলি যখন অত্যন্ত আকর্ষণ নিয়ে পড়তে বসেছি, খেয়াল করেছি বাংলার চেনা গ্রাম-সমাজের অন্দরমহলে কী বিচিত্র সব চিন্তাভাবনা-দর্শনের বুনন উজ্জ্বল হয়ে আছে। সেগুলোকে তথাকথিত মেনস্ট্রীম সমাজের সামনে তুলে আনা, সাগর ছেঁচে মুক্তো তুলে আনার মতোই দক্ষ ডুবুরির কাজ। সুধীর চক্রবর্তী শুধু সেই ডুবুরির কাজটিই করেননি, সংগৃহীত মণিমুক্তোগুলোকে বর্ণময়ভাবে গ্রন্থিত করে সাজিয়ে দিয়েছে দুই মলাটের ভিতর। নতুবা আমরা তার খোঁজ পেতাম কোথায়?

আরও বলার মতো কথা এটাও যে, যদি বিদ্যাচর্চার তত্ত্ব কাঠামোর দিক দিয়ে ভাবা যায় তাহলে গ্রামকে কেন্দ্র করে বিকশিত এইসব নানান গৌণধর্ম ও তাদের অন্তর্নিহিত দর্শনের চর্চাকে কোনও একটা শিরোনামের ব্র্যাকেটে বেঁধে ফেলা যায়। তার নাম লোকধর্মচর্চা বা ফোকলোর এই ধরনের কিছু একটা হতে পারে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরমহলে এসব নিয়ে চর্চা আগেও অল্পবিস্তর হত, সুধীরবাবুর লেখালিখির পথ বেয়ে এখন তার অন্বেষণ সম্ভবত বিস্তৃততর হয়েছে। কিন্তু এইসব বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রাচীরের বাইরের ফুটপাথে আমার মতন যারা দাঁড়িয়ে আছেন, তাদের কখনও মনে হয়নি যে লেখালিখিগুলো আমাদের মতন পাঠকদের জন্য নয়। তত্বগতভাবে এসব বিষয়ের সহজপাঠ না জেনেও অনায়াসে আস্বাদন করা যায় এইসব অনবদ্য লেখাগুলির। প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে কোনও বিষয়কে চিহ্নিত করলে তাকে আমরা ‘ডিসিপ্লিন’ বলি, কিন্তু সুধীর চক্রবর্তীর লেখাগুলিতে যে এই ‘ডিসিপ্লিন’ নামক শব্দবন্ধের মধ্যে আটকে থাকার আলসেমি নেই। তাতে আমাদের মতো বিশৃঙ্খল পাঠকরা বেঁচে গেলাম বই কী!

একই কথা বলা যাবে তার গান বিষয়ক লেখালিখিকে সামনে রেখে। অতি শৈশবে বাবার গলায় ভালো গান শুনে ভোরের বিছানা ছাড়ার কথা লিখেছেন তিনি। মায়ের গান গাওয়ার স্মৃতিরও কিছু টুকরো ছড়িয়ে আছে তার লেখায়। এরপর আসবে কৈশোরের স্মৃতিতে তার রেডিও থেকে শুনে শুনে গান শিখে নেওয়া, রেকর্ডের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে গান তোলা, নতুন মুক্তি পাওয়া সিনেমার গান তুলে বন্ধুদের মাত করে দেওয়ার সব চমৎকৃত প্রসঙ্গগুলি। কিন্তু পারিবারিকভাবে অল্পবিস্তর গানের চর্চা, আকাশবাণী কলকাতার সুবাদে নানান গান শোনার সুযোগ, এগুলো আজ থেকে যাট-সত্তর বছর আগের গড়পরতা বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে খুব একটা বিরল দৃষ্টান্ত, একথা বলা চলে না। তুলনায় সম্পন্নতর পরিবারে গান শোনার গ্রামাফোন যন্ত্রের উপস্থিতিও সেই সময়ের পারিবারিক-সামাজিক কৌলীন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ছিল। কিন্তু গানের এই আবহাওয়া থেকে বড় জোর তিনি একজন সুশিক্ষিত কণ্ঠশিল্পী হয়ে উঠতে পারতেন। সেই রকমের দৃষ্টান্ত যে নেই, এমন কথা বলতে পারি না।

কিন্তু তার নিজের কথায় ‘স্বশিক্ষিত’ গাইয়ে হয়ে উঠলেও এই হয়ে ওঠার মধ্যেও তো থেকে গেল একটা অন্বেষণের গোপন পথরেখা। যে পথকে ক্রমশ আমরা প্রকাশ্য হতে দেখব নানান লেখার মধ্যবর্তিতায়। যদিও পরিণততর পর্বে একদিকে যেমন অমিয়নাথ সান্যালের মতো সংগীত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার নিবিড় সখ্য গড়ে উঠবে, সাহচর্য মিলবে গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বের, অন্যদিকে ছোটখাটো ঘরোয়া আসরে গান গেয়ে কিছু পরিচিতিও ঘটবে তার। কিন্তু তিনি কি গায়ক হয়ে উঠতে চেয়েছেন কখনও?

আবু সঈদ আইয়ুবের বাড়িতে বসে আইয়ুব দম্পতিকে গান শোনাবার পর আবু সঈদ তাকে বলেছিলেন “মনে হচ্ছে, আপনি ঠিক গায়ক নন, সন্ধানী।” এই অভিধাকে তিনি স্বীকার করে নেন অন্য এক লেখায়। বলেন, ‘লোকে আমাকে একটা ভারি তকমা দিয়েছে, আমি নাকি গানের উৎসাহী গবেষক। ওসব গবেষক টবেষক আমি নই। আমি হলাম বাংলা গানের একনিষ্ঠ সন্ধানী। একদম ঠিক। গানের নানান ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও বাংলা গানের সুনির্দিষ্ট একটা ইতিহাসের আদল তৈরি করার কাজটা বড় সহজ নয়। তার একটা বড় কারণ নদীমাতৃক গ্রামকেন্দ্রিক বাংলার সমাজে-সংস্কৃতিতে গান একটা স্বাভাবিক সৃজন হিসেবে মান্য হয়ে এলেও গান যে শুধু শোনার জিনিষ নয়, ভাবারও, এই বোধটা বহুকাল পর্যন্ত চাপা পড়ে ছিল। আর ভাবানোর কাজটাকে পুষ্টি দিতে গেলে তার সামনে সংগীতচর্চার একরকম লিখিত মাধ্যম থাকা দরকার হয়।

রবীন্দ্রনাথের আগে পর্যন্ত এই প্রকাশ নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর বলেই আমাদের ধারণা। রবীন্দ্রনাথ নিজের গানকে কেন্দ্র করে সংগীতবিষয়ক লেখালিখির একটা বড় প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন। সেটা খানিকটা তাকে করতে হয়েছিল নিজের গানের স্বাতন্ত্র্যকে আলাদা করে প্রতিষ্ঠা করার একটা পরোক্ষ ভাবনা থেকে। কিন্তু বাংলা গানকে আরও বড় প্রেক্ষিতে মেলে ধরলে তার যে বৃহত্তর একটা মানচিত্রে সেটাকে প্রকাশ করা বেশ দুরূহ কাজ। সন্ধানী মন নিয়ে পথ হেঁটেছেন বলেই সুধীর চক্রবর্তীর চোখে এই পূর্বাপর চালচিত্র আড়াল হয়ে থাকেনি। বাংলার কীর্তন থেকে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-অতুলপ্রসাদ-দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত হয়ে দিলীপকুমার, পরের পর্বের হিমাংশু দত্ত – সলিল চৌধুরী হয়ে একেবারে গত শতকের শেষ দশকের সুমন-নচিকেতা পর্যন্ত তিনি তার সন্ধানের পরিসীমাকে বিস্তৃততর করেছেন। ঠিক কোনও ইতিহাস রচনার দায় তার ছিল এমন নয় কিন্তু গান-বিষয়ক লেখালিখিটাকে একটা ধারাবাহিকতার পথে টেনে নিয়ে গেছেন তিনি। শুধু চেনা মহলের রবীন্দ্র-নজরুল নয় তিনিই পেরেছেন অচেনামহলের লালন কিংবা ফিকিরচাঁদ, দরবেশী অথবা সাহেবধনী সম্প্রদায়ের মতো গৌণ ধর্মাবলম্বীদের গানকেও এই বৃত্তে তুলে আনতে। বাংলা গানের সনাতনী রাজদরবারে আমরা তো এদের ব্রাত্য করেই রেখেছিলাম।

সুধীর চক্রবর্তীর সংগীত-সন্ধান থেকে যেসব লেখালিখির সুত্রপাত ও বিস্তার তার দিকে নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে আরও দুটো কথা বলে ফেলা দরকার। প্রথম কথা হল, স্বভাবজ রবীন্দ্র-সৃষ্ট বাঙালি মধ্যবিত্তের চেনা আদল ছেড়ে বেরিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের সমকালীন অতুলপ্রসাদ-দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত এবং দিলীপকুমার রায়ের সাংগীতিক প্রতিভা বিষয়ে তার নিবিড় অভিনিবেশগুলি বাঙালি পাঠকের জন্য সাজিয়ে দিয়েছেন। এঁদের গান বিষয়ে স্বভাব-উন্নাসিক গড়পরতা বাঙালির পক্ষে সেটা একটা বড় পাওনা বলেই আমার মনে হয়েছে। বিশেষ করে, অধুনা-বিস্মৃত দিলীপকুমার রায়ের গান যে বাংলা গানের ধারায় একটা অনন্য সংযোজন এই চাপাপড়া সত্যটাকে তিনি বারবার উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। সন্ধানী চোখের প্রসারিত দৃষ্টি না থাকলে এই ধরনের অবস্থান নেওয়া কঠিন।

অন্যদিকে, বৃহত্তর দৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিত বজায় রেখেও বাংলা গানের পরম্পরায় রবীন্দ্রনাথের মহীরুহসম অবস্থানকেও তিনি যোগ্যভাবে সম্মানিত করেন তার রচনায়। বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে লেখালিখির চর্চা অবশ্য আরম্ভ হয়েছে বেশ খানিকটা আগেই। কিন্তু সেইসব লেখালিখির একটা সীমাবদ্ধতা এই যে সেখানে মূলত বাণী বা কথার দিক থেকে বিষয়টাকে দেখার চেষ্টা হয়। এইসব লেখালিখিতে যাঁরা বিশিষ্ট, ঘটনাচক্রে তারা কেউই সংগীতে প্রশিক্ষিত নন। কিন্তু সুধীর চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে বিষয়টা অবশ্যই অন্যরকম কারণ সুরের বিষয়টা তার অজানা নয়। এই অবস্থান থেকে তার দেখার চোখ কোথাও কোথাও আমাদের ভিন্নরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে। কিন্তু এ কথাও তো ঠিক সাদা কাগজের ওপর কলম চালিয়ে তাতে সুরসংযোগ করা যায় না, তাই শেষ পর্যন্ত সেগুলো শব্দেরই প্রতিবেদন। এটা নিশ্চয়ই সীমাবদ্ধতা। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিতে যদি অন্যরকমের প্রতিসরণ থাকে রচনার শরীরে তা কিছুটা ছায়া ফেলবেই। তার লেখায় এই ছায়া আমাদের স্নিগ্ধ করে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে মনে পড়ে যায়, বছর দুয়েক আগে তাঁর বাড়িতে নেওয়া একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি গায়ন সহযোগে দেখিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানে সুরের আশ্রয় কীভাবে তুলনায় সরল কথাকেও বৃহত্তর ব্যঞ্জনার দিকে নিয়ে যায়। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি তুলে এনেছিলেন ‘আলোর অমল কমলখানি’ গানটিকে। পাশাপাশি ভাষাগতভাবে যথেষ্ট দুরূহ শব্দপ্রয়োগ সুরের সারথ্যে কেমন সহনীয় হয়ে কানে বেজে ওঠে তারও একরকম উদাহরণ হিসেবে টেনে এনেছিলেন ‘বিশ্ব বীণা রবে’ গানকে। এইভাবেও যে রবীন্দ্রনাথের গানের বিচার চলে, তিনি না দেখালে আমরা কার কাছে দেখতে পেতাম?

সন্ধানী মনের কথা বারবার এসে পড়ছে বলেই তার আত্মকথনের একটা খণ্ডিত স্মৃতি এখানে বলে রাখতে চাই। গান আর গ্রামের দুই অঙ্গাঙ্গী সত্তাকে নিয়ে যিনি এতকাল ঘর করছেন, তার কথায়, গ্রামে গ্রামে ঘোরার একটা পর্যায়ে বিচিত্র ধরনের গানের মুখোমুখি যখন হতে হচ্ছে, তখনই তার অনুসন্ধানের অভিমুখ ঘুরে যায় গানের তত্ত্ব খুঁজে ফেরার দিকে। এই তত্ত্বানুসন্ধানের ভিতর দিয়েই তিনি এসে দাঁড়ান গৌণধর্ম বা লোকায়তের প্রান্তরে। আবার এই বৃত্ত সম্পূর্ণ করে যখন তিনি এক নতুন দিগন্তের মুখোমুখি দাঁড়ান তখন রবীন্দ্রগানের অন্য এক ব্যঞ্জনা তাঁর সামনে খুলে যায়। তিনি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন, “ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ গানে যখন আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘ভুল’ খুঁজতে যাই তখন খেয়াল করি না বাউল-দর্শনে ‘চাবি’ শব্দের অন্য এক ব্যঞ্জনা আছে। রবীন্দ্রনাথ সেইদিকেই যে ইঙ্গিত করেননি কে বলতে পারে? এ এক আশ্চর্য পারাপারের গল্প।

কিন্তু গান আর গ্রামকে ভালবাসার আচমন থেকে যেসব লেখালিখি সুধীর চক্রবর্তীকে বিশিষ্ট করেছে তার রয়েছে একটা নির্দিষ্ট সীমানা। সেই সীমানার কথা নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। গৌণধর্মগুলি নিয়ে নিবিড় অনুশীলন ও চর্চা করার পর তার এটা মনে হয়েছে যে এইসব ধর্মের সঙ্গে যে ধরনের দর্শন জড়িয়ে থাকে তার খুব কিনারায় পৌঁছে গেলেও সম্পূর্ণত সেগুলোকে আত্মস্থ করতে গেলে যে দেহগত অভ্যাসের প্রয়োজন হয়। তা সামগ্রিকভাবে তার পক্ষে গ্রহণীয় নয়। যে সাক্ষাৎকারটির কথা খানিক আগেই উল্লেখ করেছি সেখানে তিনি খুব সরাসরিই বলেছেন, যতদূর পর্যন্ত তিনি যেতে পেরেছেন তার সম্পূর্ণ ধারাভাষ্য তিনি গ্রন্থিত করেছেন তার লেখালিখির মধ্যবর্তিতায়। গানের নানান ধারা ও ধরন নিয়ে তার পরিব্যাপ্ত কাজকর্ম ও আলোচনা অনেকাংশেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু তার মানে কি এই যে লেখক হিসেবে সুধীর চক্রবর্তীর প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব এখানেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকল?

আমায় এই প্রশ্নটা করলে আমি খুব সোচ্চারেই বলব – না। কেন? কারণ গান ও গ্রাম নিয়ে নানা চরিত্রের লেখালিখিতে নিজেকে চিহ্নিত করার অবসরে অন্য আরেক ধরনের রচনায় তিনি আস্তে আস্তে খুঁজে নিতে পারছিলেন নিজেকে। যে ধরনের রচনা বাংলার গদ্য সাহিত্যে, আমার বিচারে, আনকোরা ও সতেজ। আজকের সময়কালে দাঁড়িয়ে যদি কেউ তার সার্বিক লেখালিখির বিচার করতে বসেন তাহলে গান আর গ্রামের বন্ধনীচিহ্নের বাইরে গিয়ে খুঁজে নিতে হবে তার সেইসব বাঁধনমুক্ত লেখাগুলিকেও। গান আর গ্রাম বিষয় হিসেবে যদি দুটি প্রান্ত হয়, তবে সেই প্রান্ত থেকে উড়াল পেয়ে যায় এক অনিবার প্রান্তর – যার মধ্যে খুঁজে পাব এই নতুন ঘরানার লেখাগুলিকে।

‘সদর-মফস্বল’ নিয়ে মুগ্ধতার কাহিনি দিয়েই এই লেখার সূত্রপাত। তারই ধারাবাহিকতায় পড়ি ‘মাটি পৃথিবীর টানে’। অনেক পরে হাতে আসে ‘নির্বাস’, তার আগে হঠাৎ করেই এক লাইব্রেরিতে পেয়ে যাই ‘পঞ্চগ্রামের কড়চা’। তারপর গত ক’বছরে ‘ঘরানা-বাহিরানা’ হয়ে খুব হালের ‘শামুক-ঝিনুক’ বা সংকলন ‘আখ্যানের খোঁজে’। খুব নির্দিষ্টভাবে বললে এই ধরনের লেখাগুলির সেই অর্থে কোনও বিষয় নেই। এক ধরনের আখ্যান অথচ কথাসাহিত্য বা কাহিনির জমাটবাধা ফ্রেমে এদের বাঁধা যায় না। আর এই লেখাগুলোর জোর সেখানেই। লেখাগুলোকে নিয়ে বলার কথা বা ভাবার কথাও তাই অনেকখানি।

খুব নির্দিষ্টভাবে দেখলে এই পর্যায়ের লেখাগুলিকে দুটো উপপর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। একরকম হল তার সমাজৰীক্ষণের ফসল অন্যটা তার সুদীর্ঘ পর্যটনের পরিণত শস্য, যদিও দুয়ের মধ্যে যোগাযোগ যে একেবারেই নেই সেকথা বলা যাবে না। কিন্তু এত অনুপুঙ্খ বাছবিচারে না গিয়েও নিছক পাঠকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে এইসব লেখাকে সরাসরি বিচার করা যায়। সেই বিচার একেবারেই সাধারণ পাঠকের বিচার।

সেই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমার ধারণা সুধীর চক্রবর্তীর এই পর্বের লেখাগুলির একটা অংশ সহজ আখ্যান কিংবা ব্যক্তি অভিজ্ঞতার নির্যাসের ভিতর দিয়ে এক গভীর সমাজভাষ্য নির্মাণ করে দেয়। মনে পড়ছে, তার ‘বিজ্ঞান প্রযুক্তি উন্নয়ন’ শিরোনামের লেখাটি। বিষয় হিসেবে এমন একটা বিষয়কে তিনি যখন বেছে নেন তখন আমাদের একটা অন্যরকম প্রত্যাশা তৈরি হয়। সেই প্রত্যাশা তিনি মিটিয়ে দেন যখন দেখি মূলত ব্যক্তি অভিজ্ঞতার টুকরো টুকরো চিত্রে তিনি চিনিয়ে দেন পরিবর্তন হয়ে যাওয়া এক সমাজের ছবি। লেখাটি আরম্ভ হয় হাতঘড়ির প্রসঙ্গ দিয়ে। লেখকের চাকরিজীবনের প্রথম মাসের বেতন পাওয়ার পর নিজের জন্য একটা হাতঘড়ি কিনবার সুযোগ হয়। আর, পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখেন প্রত্যেকের হাতেই হাতঘড়ি প্রায় তাদের পোশাকপরিচ্ছদের মতোই অচ্ছেদ্য হয়ে আছে। এই অভিজ্ঞতা আরও একটু ছড়িয়ে যায় যখন তিনি দেখেন পাড়ার ঘড়ির দোকান হয়ে উঠেছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘড়ির শোরুম আর সেখানকার সুবেশী তরুণী কর্মীর কাছে তিনি জানতে পারেন দশহাজার-বিশহাজার দামের বহুমূল্য ঘড়িও রয়েছে তাদের সংগ্রহে। কারণ, এরকম ঘড়িরও তো কাস্টমার আছে। এসব অভিজ্ঞতার আলোয় তো বিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রযুক্তি উন্নয়নের একটা বাস্তববোধ্য স্তর আমাদের সামনে খুলে যায়। ওই রচনারই পরের অংশে যখন লোকাল ট্রেনের কামরার এক সরস আলাপচারিতা তিনি তুলে আনবেন তার উদ্দিষ্ট বিষয়ের সমর্থনে তখন পাঠকের মনে শুধু পুলক সঞ্চারই হবে না, ভাবনার দেহপটে কোথাও একটা তরঙ্গও উঠবে। কারণ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আর উন্নয়নের সাত-পাঁচ কাহিনি থেকে তিনি চলে যাবেন পূর্ব উত্তর প্রদেশের মুপাহার গোষ্ঠির ইদুর খেয়ে বেঁচে থাকার সংবাদ বিচিত্রায়। সমাজ আর উন্নয়নের এই স্ববিরোধী গিরিখাদ আমরা চিনি না এমন নয় কিন্তু নিজস্ব এক স্টাইলের পথ বেয়ে এসে তিনি পাঠককে কোথাও একটা আত্মধিক্কারেরও মুখোমুখি করে দেন।

অন্য এক রচনায় দেখি, তিনি এক তরুণীর কাছে তার নাম আর সেল ফোনের নম্বর চাইছেন। মেয়েটি তাকে লিখে দেয় নিজের নাম আর দুটো ফোন নম্বর। দুটো কেন? এই প্রশ্নের জবাবে সে জানায়, একটা রাত নটার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন তাকে পেতে গেলে ফোন করতে হবে অন্য নম্বরটায়। ঘটনা হিসেবে খুবই তুচ্ছ, কিন্তু অন্যদিকে এরই মধ্যে রয়েছে নবীন প্রজন্মের জীবনযাপনের একটা ইশারা, যার অন্তর্গত হয়ে আছে একদিকে প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, অন্যপ্রান্তে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির আর্থিক সচ্ছলতার স্থিতি ও বিস্তার। মনে পড়বে, আমরা যারা চল্লিশ পেরিয়ে পঞ্চাশের দিকে হাঁটা লাগিয়েছি তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যেও ফোন বিপ্লবের স্মৃতি খুব প্রত্যক্ষ। একসময় আমরা জানতাম বা দেখতাম টেলিফোন হল একেবারেই উঁচু সমাজের আভিজাত্য-স্মারক। আরেকটু পরে যখন নিজেদের বাড়িতে ফোনের অবস্থান, তখনও তার নানান ঝামেলা কম পোহাতে হয়নি। নিত্যদিন তার খারাপ হওয়া, রং নাম্বারের বা ক্রশ কানেকশনের বিভ্রাট। টেলিফোনের ক্রশ কানেকশন নিয়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তো পুজোয় এক রেকর্ড বার করে ফেলেছিলেন আমাদের ছেলেবেলায়। আর, এখন মোবাইলের সংক্রমণে বহু পরিবারেই সাবেকী ল্যান্ড ফোন নিছকই শো-পিস, এমনকী আমরা অনেকেই দু-তিনটে মোবাইল পুষবার দিব্যি ক্ষমতা অর্জন করেছি। কিন্তু পরিবর্তনের এই আদলটা ছুঁতে গেলে এমন কিছু আপাত-তাৎপর্যহীন ব্যক্তি অভিজ্ঞতাও যে অমোঘ হয়ে ওঠে, সুধীর চক্রবর্তী সম্ভবত সেই স্পর্শের পথটা আমাদের সামনে খুলে দেন।

এটা আসলে নিবিড় পর্যবেক্ষণের একটা অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত। একজন চিত্রকর যেমন ক্যানভাসের একটা তুলির আঁচড়ে অনেক বৃহত্তর ব্যঞ্জনায় আমাদের মুক্ত করে দেন, সুধীর চক্রবর্তীর তাঁর লেখাতেও পেয়ে যাই এমন সব অনবদ্য ব্যঞ্জনাময় ইশারা। মনে পড়ে গেল, জনপদ বৃত্তান্ত বিষয়ক লেখাগুলিতে তিনি যখন নিজের সাবেক বাস্তুগ্রাম দিগনগর নিয়ে লিখছেন তার মধ্যে ছিল বদলে যাওয়া এক জনপদের নিবিড় আখ্যান। বিদ্যুৎহীন, শেয়াল ডাকা, ম্যালেরিয়া পীড়িত সেই ধ্বস্ত জনপদ যখন অন্য এক সময়পর্বে নতুনভাবে জেগে উঠছে, সেখানে পৌঁছে তিনি কেবলই দেখছেন জায়মান এক বদলের ছবি। কিন্তু সে কি শুধুই এক পুরনো জনপদের ভেঙে গড়া? না তারও মধ্যে আছে সামগ্রিক সামাজিক পরিবর্তনেরও এক খণ্ডচিত্র? তিনি জানাচ্ছেন। বাবা যা দেখে গেলেন না তা হল ছেলেদের আর মেয়েদের হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুল, ভিডিও হল, পেট্রোল পাম্প, ধাবা আর টেলিফোন বুথ। … দিগনগরে হল সরকারি বাসের স্টপেজ। খাবারের দোকানে ঢুকল ফ্রিজে ঠান্ডা দই। সবাইকে সচকিত করে বাসরাস্তার বটগাছে বিজ্ঞাপন পড়ল । হাঁটাপথে ২ মিনিট দক্ষিণে এম. টি. পি. সেন্টার। বিনা অস্ত্রে মাসিক নিয়মিত করা হয়। অভিজ্ঞ ডাক্তার। নির্ভরযোগ্য পরিষেবা গ্যারান্টি।

ফ্রিজের ঠান্ডা দই-এর পাশে এম.টি.পি সেন্টারের এই আশ্চর্য উল্লেখ আসলে খুলে দেয় সামাজিক পরিবর্তনের ভিন্ন এক অলিন্দ। সরকারি নীতির হাত ধরে এই দেশে যখন গর্ভপাত অনুমোদনের আইন পাশ হয়, সামাজিক পরিসরে তার যে একটা অন্যরকম প্রতিক্রিয়া সমাজের অন্য পটবদলের সঙ্গে একাকার হয়ে যাবে তার একটা প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত ওই বটগাছের গায়ে সাঁটানো বিজ্ঞাপন। আসলে তো কথাটা ভুল নয়, পরিবর্তমান গ্রাম মফস্বলে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সুত্রপাত ও ক্রমশ তার ছড়িয়ে পড়া এখনও সমানভাবে সত্যি। আরও সত্যি এই যে জনপদের সমাজের সঙ্গে এই এম.টি.পি. প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা গোপন যোগ থেকে যায়। তার মধ্যে ব্যভিচারের কলঙ্ক যেমন থাকে, কোথাও থাকে ট্রাজেডির বিস্তার। কিন্তু এইসব প্রকাশ্য অথচ গোপন প্রতিষ্ঠানগুলির সমাজের সঙ্গে সংযুক্তির যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল একদিন সুধীরবাবুর সন্ধিৎসু বীক্ষণে তা অধরা থাকেনি, এইটেই বলবার কথা। মনে পড়বে কি, এমনই এক মফস্বল জনপদের এইরকম একটা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে স্বপ্নময় চক্রবর্তী লিখে ফেলেছিলেন একটা আস্ত উপন্যাস?

আসলে সুধীর চক্রবর্তীর দেখার ধরনটাই এমন। পরিবর্তনের চেহারাটাকে তত্ত্বের মোড়কে না দেখে তিনি সবসময়েই নিজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বুঝে নিতে চান। পারিবারিক আবহেও যখন তিনি দেখেন তার ভাইপো জন্মদিনের উপহার হিসেবে চেয়ে নেয় পেন ড্রাইভ অথবা অন্য একজন তার উপনয়নের উপহার হিসেবে চেয়ে বসে মাধ্যমিকের লাস্ট মিনিট সাজেশন তখন তিনি নিঃসংকোচেই জানিয়ে দেন এসবই পাল্টে যাওয়া একটা পৃথিবীর কথা বলে। এই পরিবর্তন তিনি দেখেন তারই একদা-ছাত্রের গৃহ-শিক্ষক হয়ে ওঠায়, দেখেন স্কুল কলেজের স্টাফরুমের ক্লাবঘর বা আড্ডাখানায় রূপান্তরিত হওয়ায়, শুনতে পান স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষার্থী তার মোবাইল নম্বর দিয়ে লিখে দিয়েছে পাশ করিয়ে দিলে এক লক্ষ টাকা দেব, ভেবে দেখুন। তিনি এইসব কিছুই ভাষ্যকার। কিন্তু এর পাশাপাশিই তো তিনি দেখতে পান বাস্তুগ্রাম দিগনগরের তথাকথিত গয়লা-পরিবারের মেয়ে চলে এসেছে তার অনার্সের ক্লাসে, খুব গর্বভরেই তিনি শোনান প্রাক্তন ছাত্র মোশারফ হোসেনের কন্যা ফরিদার কথা যে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরিজি অনার্স পড়ায় দৃঢ়কল্প, চারজন হিন্দু মেয়ের সঙ্গে সে একসঙ্গে মেসে থেকে চালিয়ে যেতে চায় তার শিক্ষা।

প্রজন্মান্তরের এই পরিবর্তন-ভাষ্য নির্মাণে সবথেকে বড় অর্জন তার সজীব মন আর মনন। নতুবা সত্তর-পঁচাত্তরের জীবন পেরোনো যাদের আমরা নিয়ত দেখি উত্তরপ্রজন্মের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাতে তিনি সেই দলে কোনওদিনই নাম লেখাননি। ওইসব ভ্রু কুঞ্চনপন্থীদের একমাত্রিক চোখে তাদের কালের সবকিছুই মোহময় আর নির্ভেজাল তা সে দাদখানি চালই হোক বা লালমুখো সাহেব অথবা পণ্ডিতমশায়ের বেত্রাঘাত কিংবা কানন দেবীর বায়োস্কোপ। আর, বিপরীতে, পরের প্রজন্মের সবটাই শুধু ভেজাল অথবা আদিখ্যেতা বা গোল্লায় যাওয়ার ব্যাপার-স্যাপার। সুমনের গানে ছিল বয়স হওয়ার মানেই বোধহয় স্বচ্ছতাকে বিদায় দেওয়া – ভরসার কথা, সুধীর চক্রবর্তীর চিরসবুজ মননে এই স্বচ্ছতার বিসর্জন-চিহ্ন কোথাও খুঁজে পাই না। পরিবর্তে এক অমল আক্ষেপ শুনি তার লেখনীতেঃ  “…ভারী লোভ হয় এখনকার শিক্ষাধারার বিষয়গত বৈচিত্র্য আর ব্যাপ্তি দেখে। …. জ্ঞানবিদ্যার চর্চা আজ এত বিস্তারে তার ডানা মেলেছে এবং যোগ্যদের জন্য খুলে যাচ্ছে দেশবিদেশের জীবিকার এত দরজা – তা দেখলে মনে হয়, আহা যদি এখনকার কালের পাঠার্থী হতে পেতাম!’ নিজের প্রজন্ম থেকে এভাবেই নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি, নির্মাণ করেন এক গ্রহণযোগ্য দুরত্ব।

কিন্তু সুধীর চক্রবর্তীর লেখালিখি বিষয়ক এই অক্ষম আলোচনা খঞ্জ হয়ে থাকবে যদি না তাঁর অন্যধরনের লেখাগুলির দিকে আমরা চোখ না রাখি। ‘সদর-মফস্বল’ বইটি থেকে সুত্রপাত হয়ে যার প্রান্ত এসে পড়েছে একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে। আগেই বলার চেষ্টা করেছি, এইসব লেখায় তিনি কোনও গ্রাম-সন্ধানী গবেষকও নন, নন কোনও গান-খুঁজে ফেরা সন্ধানী। এখানে তার দেখাটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। কেমন সে দেখা ?

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল একটা পুরনো স্মৃতি। অনেকদিন আগে (প্রায় পঁচিশ বছর হবে) শ্রীরামপুরে এক কবিসভায় কবিতা পড়তে এসেছিলেন কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত। কবিতা পড়ার পর শ্রোতাদের সঙ্গে মুখোমুখি প্রশ্ন উত্তরের ব্যবস্থা করেছিলেন আয়োজকরা। শ্রোতারা চিরকুটে প্রশ্ন লিখে পাঠাচ্ছিলেন কবির কাছে। বয়সোচিত নির্বুদ্ধিতায় আমি প্রশ্ন করে বসেছিলাম – আপনি পৃথিবীকে কোন চোখে দেখেন? উত্তর এসেছিল, কেন? দুই চোখে। দুই চোখে পৃথিবীটাকে দেখার মানে বুঝতে আমার অনেক সময় লেগে গেছে। কিন্তু সুধীর চক্রবর্তীর এই স্বাতন্ত্র-চিহ্নিত লেখাগুলি পড়ে নতুন করে চিনতে পেরেছি দুচোখে এই দুনিয়াটাকে দেখার আসল ব্যঞ্জনাটা কত গভীর আর অতলান্ত। এই দিদৃক্ষা একেবারেই তার নিজস্ব ঘরানার। এই ঘরানাটার দিকে যদি একটু খুঁটিয়ে নজর করা যায় দেখা যাবে এই পর্যায়ে সুধীর চক্রবর্তী যেন এক একলা পথের পথিক। আর, একলা বলেই অবশিষ্ট ভুবনের প্রতি তার এক তীব্র আশ্লেষ। ভুবন, না কি ছড়িয়ে থাকা এই বিরাট আর বিচিত্র জীবন? যে জীবন আমাদের চেনা প্রতিবেশের আড়ালে আড়ালে তার শিকড় ছড়িয়ে দেয়, যে জীবন আগলে রাখে এমন সব জীবনের স্পন্দন সচরাচর আমরা যার সাড়া পাই না। এই পরিব্যাপ্ত বিচিত্রগামী জীবনের খুব কাছে এসে দাঁড়াতে চান তিনি, ছুঁয়ে জেনে দেখতে চান তার অন্তরমহলকে, কখনও নিজের জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে দেন অন্য জীবনের সেই পা-তোলা পা-ফেলা।

এই পর্যন্ত লিখে ফেলে খুব ভয়ে ভয়েই বলি, এই জীবন অন্বেষণের ধরণ দেখে আমরা যেন সুধীর চক্রবর্তীকে আমাদের সাবেকী চশমার আড়াল থেকে সনাতনী বামমার্গীয় না ঠাউরে বসি। সে এক মস্ত বড় ভুল। তিনি কখনও অস্বীকার করেননি কৈশোর থেকে ছাত্রাবস্থার পরিণতি পর্যন্ত যে সময়কাল, সেখানে মার্কসবাদ বা সাবেক বামপন্থার ছোঁয়াচ তিনি এড়িয়ে চলেছেন। বিশেষত পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে অন্তত পরের কুড়ি বছরে পশ্চিমবঙ্গের সমাজে রাজনীতিতে-সংস্কৃতিতে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির কাছে বামপন্থার দর্শন আদরণীয় ও অনুসরণযোগ্য ছিল। কিন্তু তার জীবনবোধ ও চেতনায় মার্কসবাদী বীক্ষা ছায়া ফেলে গেলেও খুব প্রত্যক্ষভাবে তাকে আমরা মার্কসবাদের আরাধনায় দেখিনি। এমনটা ঘটলে, কী জানি, হয়তো তাকে আলাদা করে চিনতে পারতাম না!

ফলে সাবেকী কায়দায় কাঁধে ঝোলা নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েছেন পথে-প্রান্তরে আর সাধারণ নিপীড়িত মানুষের জীবনযন্ত্রণার শরিক হয়ে বুঝতে চাইছেন সমাজসত্যকে, এমন কোনও বিশ্বাস আদৌ আমার নেই। না থাকার কারণ তার লেখালিখির ভিতর দিয়ে যে অন্বেষণের আদল দেখতে পাই তা জীবনের চলার পথকে চিনতে চায় আরও বড় কোনও ক্যানভাসে যার মধ্যে কোনও বিশেষ তত্ত্বের পূর্বনির্ধারিত অভিমুখ নেই। কিন্তু তাই বলে জীবনের রণ-রক্ত-সফলতা-বন্ধন-ট্রাজেডির রং যে ফিকে হয়ে যায় এমন নয়। বরং, বিপরীতে এটাই যেন প্রতিষ্ঠা পায় তত্ত্বের যাদুকাঠির স্পর্শে জীবনের সবটুকু উন্মোচিত হয় না, হতে পারে না। তত্ত্বের চেয়ে জীবনের প্রান্তর আরও অনেক বড়, অনেক মহত্তর, পিট সিগারের বিখ্যাত গানের কথা ধার করলে তা রামধনু রঙে অলঙ্কৃত। এই জীবনকে খুঁজে বেড়ানোর যে সংক্রমণ তার জন্য প্রয়োজন হয় দুচোখের সহযোগ, সুধীর চক্রবর্তী যাকে কখনও অস্বীকার করেন না। করেন না বলেই হয়তো এই চলা আসলে ‘আলোর পানে প্রাণের চলা’ যা আসলে কাউকে সোচ্চারে বলার দরকার হয় না—জীবনের আনন্দ থেকেই তার আহরণ আর পুষ্টি, তাত্ত্বিক পরজীবিতা স্বভাবত এখানে অবান্তর।

খুব অকুণ্ঠেই সুধীর চক্রবর্তী তার এইসব ভাবনার অভিজ্ঞান ছড়িয়ে রাখেন এই সমস্ত  লেখাগুলির স্তরে স্তরে। ধরা যাক, ট্রেনের অন্ধ গায়িকা সরয়ুর আখ্যানটিকে। গায়িকা হিসেবে যার অবলম্বন কেবলই রবীন্দ্রনাথের গান। কী বিচিত্র এক জীবনকে সে বহন করে  তার যাপনে। তারই ঘরের দাওয়ায় বসে তার সেই জীবনের গল্প শুনে নেন সুধীর চক্রবর্তী অথচ সাংবাদিকের অভিনিবেশে তার নেওয়া সাক্ষাৎকার শুধু কিছু তথ্যের গোলাঘর ভরায় না, পর্দা সরিয়ে দেখায় জীবনের এক রসস্নিগ্ধ মানবিক ফসলের সবুজ প্রান্তর। নিত্যযাত্রী হিসেবে ট্রেনের হকারদের অজানা জীবনের নানা আখ্যান তিনি তুলে এনেছেন তার এমনই সব লেখায়। তার মধ্যে সুখ-দুঃখ-আনন্দ-ব্যর্থতা-অক্ষমতার সবরকম সুরই বেজে উঠতে দেখেছি আমরা, বলা ভালো, সপ্তসুরের এই সঞ্চার বেজে উঠেছে তার কলমে। আবার, লোকাল ট্রেনের কামরায় চাল বহনকারী মেয়েদের যখন তিনি দেখতে পান, সেখানেও এক জীবনযন্ত্রণার উপাখ্যান খুঁজে পেয়ে যান তিনি। শুধু কি তাই? এইসুত্রেই তার যোগাযোগ ঘটে যায় আপেল নাম্নী এক তরুণী বিধবার জীবনের উপাখ্যানের সঙ্গে, যাকে তিনি বাড়িতে বহাল করেন পরিচারিকা হিসেবে। এরপর আপেল থেকে মুক্তা হয়ে পাখির করুণ আখ্যান উন্মোচিত হয় ধারাবাহিকভাবে। অবদমিত যৌনতার ঘেরাটোপ থেকে বার বার ছিড়ে বেরোতে চাওয়া সেই যুবতীর জীবন কি অন্য অর্থে আমাদের গাইয়ে নিতে চায় : আকাশে তোর তেমনি আছে ছুটি? শুধু এই ক্ষেত্রেই নয়, যাপনের এক বাঁধন ছেড়া দায় থেকে বিবাহবহির্ভূত সংসার পালনের নানান চিত্র খুঁটে দেখান তিনি। তিনি এই অর্থে এক মুক্ত মতির পর্যটক।

অথচ এরই পাশে যখন তিনি তুলে নিয়ে আসেন স্মৃতিধর সহপাঠীর সফল পেশার সঙ্গে স্মৃতিকোষের পাল্টে যাওয়া মর্মান্তিক ছবি তখন বোঝা যায় সত্যিই কোনও নির্দিষ্ট বৃত্তে তার আটকে থাকার অবকাশ নেই। ছড়ানো জীবনের পাশে বিচিত্রতর জীবিকার আলপনা তাঁকে আবারও সন্ধানী করে তুলবে। আমরা দেখব, জীবিকার ধরণ কীভাবে বদলে দেয় জীবনের আমূল ছাঁচ – তার অন্তর্গত হয়ে থাকে একেবারে সাধারণ মাপের চন্দননগরের ঘাটবাবু থেকে জেলা শহরের জজসাহেব।

পাশাপাশি আসে প্রথাগত ধর্মপালনের নানান দ্বন্দ্বময় চিত্রায়ন। অভাবরিক্ত দৈনন্দিন থেকে যেখানে ধর্মান্তরিত ক্যাথলিক গীর্জার পাদ্রীর দিকে তঞ্জনী তুলে বলতে পারে তার প্রয়োজনের জিনিষ না পেলে সে প্রোটেস্ট্যান্ট হয়ে যাবে! শহরের প্রান্তে থাকা মুসলমান রিকশওয়ালা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আবহে বাস্তুচ্যুত হয়ে মনে মনে ভাবে খৃষ্টান হয়ে যাওয়ার কথা, শুধু ভাবে না বলেও ফেলে! কৃতী মুসলমান অধ্যাপকের হিন্দু স্ত্রী মৃত্যুপথযাত্রী স্বামীর আরোগ্য কামনায় যখন নামাজে বসে তখন জীবন আর ধর্ম কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। অন্যরকমভাবে যার একটা সরল অথচ ব্যঞ্জনাময় ব্যাখ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ডিম-বিক্রেতা ইয়াকুব। বলে, ‘ভগমানের তৈরি জাত তো মেটি দুখানা – পুরুষ আর স্ত্রীলোক। সেটাই থাকবে। আর যা সব জাতাজাতি দেখছেন সব মানুষের তৈরি। কোনোটাই শেষ পর্যন্ত টিকবে না …’। গ্রামজীবনের এই অনাবিল অসাম্প্রদায়িকতার পাশে কি ম্লান হয়ে আসে না আমাদের বানিয়ে তোলা সম্প্রীতি আর ধর্মনিরপেক্ষতার ‘কনসেপ্ট’গুলো? এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি করে তোলাও সুধীর চক্রবর্তীর একরকম জয়।

তার এই পর্বের লেখাগুলো আস্বাদন করতে করতে একটা অন্য প্রশ্ন বারবারই আমার মনে উকি মারে। তার কারণ এইসব রচনার মধ্য দিয়ে বিচিত্র মানবচরিত্রের এক রামধনু মিছিল। তারা কেউ আমাদের ভীষণ চেনা কেউবা চেনা পরিধির বাইরের পথিক। সুধীর চক্রবর্তীর অভিজ্ঞতায় অবশ্য চেনা-অচেনার দূরত্ব সরে যায় অনায়াসেই, সবাইকেই তিনি ধরে রাখেন তার আখ্যানের পাতায়। কিন্তু গ্রাম-প্রেমিক ও গানের সন্ধানী এই মানুষটি যখন পাঁচ দশক আগে তার ভ্রামণিক জীবনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন সে কি শুধুই জনপদ আর তার সংস্কৃতির ভাড়ার খুঁজে দেখার অভিপ্রায়ে? না কি এর অন্তরালে ছিল ভিন্নতর এক উদ্দেশ্য – প্রসারিত জীবনের পরিসরে মানুষকে খুঁজে ফেরা? প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে যখন দেখতে পাই, গ্রাম ও গান বিষয়ক অজস্র লেখালিখি পেরিয়ে তিনি এবার আলাদা করে লিখতে চাইবেন বিচিত্র মানুষের জীবনকাহিনি। হয়তো এই আখ্যান লিখতে চাইলেন বলেই তাকে অতিক্রম করে আসতে হল ব্যাপ্ত পর্যটনের সেই সব উপলক্ষ, গান আর গ্রাম আসলে হয়ে উঠতে চাইল চিরকালীন মানুষের কাছে পৌঁছাবার একেকটা সেতু। এই ভাবনার সমর্থন পাই তার এক আত্মকথনে : “… এখনও পর্যন্ত আমার গবেষণা বা অনুসন্ধানের মূল বিষয় মানুষ—যে মানুষ দেশে-কালে-গ্রামে-শহরে-মফস্বলে ব্যাপ্ত। চন্দননগরে যাবার সময় লঞ্চে পেরোনোর সময় যে মানুষগুলোকে দেখতাম তাদের  মধ্যেও যেমন অত্যাশ্চর্য মানুষের সন্ধান পেয়েছি। তেমনই ট্রেনের হকারদের মধ্যেও খুঁজে পেয়েছি মানবিকতার ছবি। কাজেই মূলত আমি পর্যবেক্ষক ও অনুসন্ধানী ….।

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার এক কবিতায় লিখেছিলেন ‘কোথাও মানুষ ভাল রয়ে গেছে বলে / আজও তার নিঃশ্বাসের বাতাস নির্মল’। আমার ধারণা, ধ্বস্ত সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে সেই অমল মানবিকতার এরকম নির্মাণ ঘটেছে এইসব লেখায়। জন্মভূমির বর্ণপরিচয়কে নতুন পাঠে উদ্বোধিত করে আসলে তিনি বুনে চলেছেন মানবজমিনের সেই চিরায়ত আখ্যান। তার নিজের কথায় ‘… জীবনের অনেক অকথিত গল্পের মতনই অনেক অনিঃশেষ গল্প আছে—আমি সেই অনিঃশেষ গল্পের পেছনে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছি।’

এইখানে এসে আমার তাকে ভাবতে ভাল লাগে এক পান্থজন হিসেবে। পথ আর জীবনের আনাচ-কানাচ যেন মিশে যায় তাঁর নির্মিত আখ্যান-শরীরে। শুধু পান্থজনই বা কেন? তিনি পান্থজনের সখা, তাই তার এমন অনিঃশেষ পথ চলার আয়োজন আর বিস্তার।

এমন এক সন্ধানী পর্যবেক্ষকের যাত্রাপথে আনন্দগান আরও অনেকদিন আমাদের বেঁচে থাকাকে স্নিগ্ধ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।

[ লেখাটি ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে   “অক্ষরেখা” পত্রিকার সুধীর চক্রবর্তী বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ