মঞ্জু অনেকক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে। ভোর থেকে বিছানা ছেড়ে ঘরের কাজকর্ম কোনমতে কিছুটা শেষ করে এসে দাঁড়িয়েছে লাইনে। তার সামনে অনেকে লাইনে দাঁড়িয়েছে। কলকাতা থেকে নামকরা ডাক্তারবাবুরা আসবেন তাদের গাঁয়ের স্বাস্হ্য শিবিরে। গাঁ বলতে ছিটমহল। চলমেঘা। বাংলাদেশের গা ঘেঁসা বর্ডারে। জমিদারি দখলটা বাংলাদেশের। তবে ভারতীয় আইনযুক্ত সুযোগ-সুবিধেগুলো পায় তাদের গাঁয়ের লোকেরা। লোকজন বলতে মেরেকেটে দুশোর কাছাকাছি। ঘর বলতে খড়ের কিংবা টিনের ছাউনি আর মাটির দেওয়াল। কোনভাবে মাথা গৌঁজার ঠাই করে নিতে পেরেছে। বর্ষাকালে জলে টইটুম্বুর আর ঝড়ো হাওয়ায় ঘর শুদ্ধ উড়ে যাওয়ার আশংকায় ঈষ্টনাম জপাই ভরষা। বেশিরভাগ লোকের রোজকারের উৎস হল জন মজুরী। ছেলেমেয়েরা পাশের এক অবৈতনিক স্কুলে লেখাপড়া শেখে। সেখানে মিডডে মিলের মাধ্যমে দুপুরের আহারটা জুটিয়ে নেয়। পাঁচ কিলোমিটার দূরের গাঁয়ে উচ্চবিদ্যালয় আছে। সেখান থেকে মঞ্জু কলা বিভাগ নিয়ে দ্বাদশ শ্রেণী থেকে উত্তীর্ণ হয়েছে। কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সেই করিমপুরে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার সামর্থ তাদের ছিল না। সেকারণে লেখাপড়ার ইতি হয়ে গেছে তার। ওদের গাঁয়ের পাশে আর একটা ছিটমহল আছে। নাম জামালপুর। দখলদারি বাংলাদেশের। আইনগত সুযোগ-সুবিধে পায় বাংলাদেশের।ওখান থেকেও অনেকে চলে এসেছে ডাক্তার দেখানোর জন্যে।
বেশ কিছুদিন হল ওদের হাতে-পায়ে, গায়ে দেখা দিয়েছে সাদা-কালো ছিটছিটে দাগ।হাতের তেলো বা পায়ের তেলোয় শক্ত খরখরে ভাব।সংসারের দৈনন্দিন কাজে কিংবা হেঁটে চলতে-ফিরতে বেশ ব্যথা লাগে। খাবার হজম হয় না। গ্যাস-অম্বলে জেরবার। সর্বক্ষণ ক্লান্তি ভাব। চলতে-ফিরতে হাঁপ লাগে। বাচ্চাগুলো ও বয়স্কদের সর্দ্দি-কাশি সারতেই চায় না। কারো কারো আবার পায়ে ঘা, সারতেই চায় না।
সমস্যা হল হাতে-পায়ে, গায়ে সাদা-কালো ছিটছিটে দাগের জন্যে মঞ্জুর দু-তিনবার বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙ্গে গেছে। মেয়ে দেখতে এসে পাত্রপক্ষ ঐ দাগগুলোকে ভাল মনে নিতে পারেন নি। কেউ কেউ এমনও মন্তব্য করে গেছেন যে ঐ দাগগুলো একধরণের সাদা-কুষ্ঠ। তাই মঞ্জুকে দাগী আসামী করে চলে গেছেন। শুধু মঞ্জু নয়, ওদের গাঁয়ের বেশ কয়েকজন বিবাহযোগ্যা মেয়েদের ক্ষেত্রে একই অপবাদ জুটেছে।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মঞ্জুর পা দুটো বেশ টনটন করে উঠছে। এখন বাজে বেলা বারোটা। সকাল দশটা থেকে এসে লাইন দিয়েছে। শিবিরের আয়োজককারীরা একবার এসে জানিয়ে গেলেন ডাক্তারবাবুরা সবাই আসছেন। পথের জ্যামে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। সেজন্যে দেরি হচ্ছে।
মঞ্জু লাইনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল গাঁয়ের মা-মাসিরা খোসমেজাজে সংসারের গল্প জুড়ে দিয়েছে। পুরুষ মানুষেরা উসখুশ করছেন। কেউ কেউ বিড়ি ধরে সুখটান দিচ্ছেন। বিড়িতে টান দিতে দিতে কেশে নুইয়ে পড়ছেন তবুও বিড়িটা হাত থেকে ফেলছেন না। কথার ফাঁকে ফাঁকে মঞ্জু জানতে পারলো হাজার রকম সমস্যা নিয়ে লোকজন হাজির হয়েছেন স্বাস্হ্য পরীক্ষা শিবিরে। এরই মধ্যে লক্ষ্য করলো ওদের গ্রাম ও পাশের গ্রাম থেকে ওর মতো একই সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে।
মঞ্জুর গায়ের রঙ ফর্সা। মুখশ্রী ও দেহের গড়ন বেশ ভালোই। নাকটা টিকালো ও মুখটা পানপাতার মতন। পাত্রপক্ষের তো পছন্দই হয়ে গিয়েছিল তাকে কিন্তু বাদ সাধলো ওই সাদা-কালো দাগগুলো।ওর গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা বলে দাগগুলো চোখে পড়েছে সকলের। পাত্রপক্ষের ওইধরণের আচলণ তাকে ব্যথিত করেছিল। নারীত্বের এতবড় অপমান সে হজম করবে কিভাবে?
ডাক্তারবাবুরা এলেন পৌনে একটায়। লাইনে দাঁড়িয়ে প্রায় শ দুয়েক লোক। তিন-চারজন ডাক্তারবাবু এসেছেন। একজন মহিলা ডাক্তারও আছেন। অল্প বয়েসী। সম্ভবত সহকারী চিকিৎসক। সিনিয়র ডাক্তারটি বেশ সুপুরুষ। সুঠাম চেহারা। ফর্সা গায়ের রঙ। কাঁচাপাকা চুল মাথায়। রাশভারি বলে মনে হল মঞ্জুর।
অল্পক্ষণের মধ্যে নাম ডাকা শুরু হল। একে একে যাচ্ছেন। সমস্যার কথা বলছেন। ডাক্তারবাবুরা তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রেসক্রিপশান লিখে দিচ্ছেন। সঙ্গে আনানো ওষুধ-পত্রও দিয়ে দিচ্ছেন কোন টাকা-কড়ি না নিয়ে। এছাড়া ওষুধ কিভাবে খেতে হবে, কবার খেতে হবে, কখন খেতে হবে ঐ সমস্ত বুঝিয়ে বলে দিচ্ছেন। লোকেরা বেশ খুসিমনে বাড়ি ফিরছে। লাইন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে।
মঞ্জু একটা জিনিস লক্ষ্য করলো দূরে দাঁড়িয়ে, সিনিয়র ডাক্তারবাবু যাকে প্রথমটায় রাশভারি গম্ভীর প্রকৃতির বলে মনে হচ্ছিল, তাঁর কাছে যারা যাচ্ছেন পরীক্ষার জন্যে তিনি কিন্তু বেশ খোলামনে প্রাণজল ভাষায় তাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন রোগের গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে। জনে জনে যেন নতুন সূর্য্যের আলো এনে দিচ্ছেন। কবেই বা সে গাঁয়ের লোকেদের এত খুশি ভাব দেখেছে মনে করতে পারছে না। মনে হচ্ছে স্বাস্হ্য শিবির যেন আনন্দ-উৎসব শিবিরে পরিণত হয়েছে।
তার মনের গ্লানি যেন অনেকটা কমে গেল। কিছু লোক তার নারীত্বের অপমান করেছিল গায়ের চামড়ায় সাদা-কালো দাগ দেখে, আর এই যে ডাক্তারবাবুরা এসেছেন কত দূর থেকে, এরাও তো মানুষ।ইনাদের আচরণে মমত্ব, ভালবাসা, সহমর্মীতা, শ্রদ্ধা সবই ঝরে পড়ছে মেঘভাঙা অঝোরধারা বারিষের মতো। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিল স্বামী বিবেকানন্দের একটা বাণী এই প্রসঙ্গে মঞ্জুর মনে পড়ে গেল: “ওঠো, জাগো, থেমে থেকো না যতক্ষণ না তুমি তোমার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছো”। কলকাতার ডাক্তারবাবুরা যেন স্বামীজীর ব্রতকে মনেপ্রাণে গেঁথে নিয়ে তাঁদের অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
তাদের গাঁয়ে ত পাশকরা ডাক্তার কেউ নেই। রোগ হলে হাতুড়ে ডাক্তারই ভরষা। বাড়াবাড়ি হলে করিমপুর ব্লকে নয়তো তেহট্ট মহকুমা হাসপাতালে ছুটতে হয় গাঁটের টাকা-কড়ি খরচ করে। এই ডাক্তারবাবুদের কি দায় পড়েছিল এরকম প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে গাঁয়ের লোকেদের সেবা করার?
এখনো মনুষ্যত্ব বেঁচে রয়েছে। নতুন সূর্য্যের আলো দেখানোর মত লোকজন এখনো রয়েছে। ভাবতে ভাবতে ডাক এল মঞ্জুর। জুনিয়র ডাক্তারেরা তাকে দেখে সিনিয়রের কাছে পাঠালেন। খুব কাছ থেকে সিনিয়র ডাক্তারবাবুকে দেখার সুযোগ পেল মঞ্জু। সারা মুখ জুড়ে কি প্রশান্তির ভাব! কোন দুঃখ-কষ্ট যেন তাঁকে স্পর্শ করে না। কোন কিছুতেই বিচলিত হন না। চোখ দুটো কেমন মায়াময় আর তার উজ্জ্বল দ্যুতির ছটা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। যে কেউ তাঁর চোখের দিকে তাকালে আবিষ্ট হয়ে পড়বেন। এরকম চোখ তো মঞ্জু ঠাকুর-দেবতা কিংবা মনীষীদের ছবিতে দেখেছে।
শান্ত স্বরে এক এক করে প্রশ্ন করলেন ডাক্তারবাবু। মঞ্জু উত্তর দিল যতটা সে জানে। পরীক্ষার পরে জানালেন রোগটা মোটেই সাদা কুষ্ঠ নয়। এর নাম আর্সেনিকোসিস। দীর্ঘদিন ধরে আর্সেনিকযুক্ত জল খেলে এ রোগ দেখা দেয়। বুঝিয়ে বললেন আর্সেনিক একটা বিষ। গ্রাম বাংলায় একে স্যেকো বিষ বলা হতো। এই বিষ মাটির ভেতরকার জলাধারে কোনভাবে মিশে গেলে সেই আর্সেনিক মিশ্রিত জল নলকূপের মাধ্যমে বহুদিন ধরে পান করলে আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
তোমার যে যে লক্ষণগুলো দেখা গেছে সেগুলোর কারণ হল দীর্ঘদিন ধরে আর্সেনিকযুক্ত জল খাওয়ার জন্যে। তবে চিন্তা করো না, প্রাথমিক স্টেজে রয়েছে। এখন তো আর্সেনিক মুক্ত জল খাচ্ছো। এর সঙ্গে খাবারে শাক-সবজি, ফল, দুধ ডাল বেশি করে খেলে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাবে আর দাগগুলোর জন্যে কিছু মলম ও ওষুধ খেলে সব দাগ মিলিয়ে যাবে। খুব খারাপ লাগছে শুনে, শুধুমাত্র দাগগুলোর জন্যে তোমার বা গাঁয়ের অন্যান্য মেয়েদের বিয়ে ভেঙে গেছে। এগুলো হল চেতনার অভাব। আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি এই রোগ ছোঁয়াচে নয়। একে সাদা কুষ্ঠ রোগও বলে না। এই রোগ শুধুমাত্র আর্সেনিকযুক্ত জল খেলে হয়। আমি এটা অস্বীকার করছি না যে এই রোগে যত না শারিরীক বা মানসিক কষ্ট হয় তার থেকে বেশি সৃষ্টি করে সামাজিক সমস্যা। এই সামাজিক ব্যাধিকে চিরতরে নির্মুল করতে হবে সুস্হ চেতনার দ্বারা।
মঞ্জু আর নিজেকে সামলাতে পারলো না ডাক্তারবাবুর কথা শুনে। ধপ করে বসে পড়ে ডাক্তারবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অন্তরের সব ভক্তি উজাড় করে দিল।
ডাক্তারবাবু শশব্যস্ত হয়ে ওকে দুটো হাত ধরে তুলে সোজা দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি আমার মেয়ের বয়েসী। তোমার মনের ব্যথাটা আমি বুঝতে পারছি। এও জানি, তুমি লেখাপড়া জানা একজন সচেতন শক্ত মনের মেয়ে। আশা করবো তুমি অন্যান্যদের মতো ভেঙে পড়বে না। আজ থেকে তুমি হব এদের আলোক বর্তিকা। তোমার মধ্যে সেই আলোর শিখা আমি দেখতে পেয়েছি।
এই গাঁয়ের লোকজন খুব সহজ, সরল, সাধা-সিধে, অল্পেতে খুশি থাকে কিন্তু বড় অসহায়। তুমি পাশে থেকে এদের মনে সাহস যোগাবে, শক্তি যোগাবে, ভরষা দেবে। আর তোমার এই কাজে হাত লাগাবে উত্তম। তোমাদের পাশের গাঁয়েরই ছেলে। একই রোগে আক্রান্ত, বলে উত্তমকে ডেকে নিয়ে মঞ্জুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
তোমাদের কাজ হবে গাঁয়ের লোকেরা যাতে আর্সেনিকমুক্ত জল পায় সেটা দেখা, স্বাস্হ্য শিবিরেরসম আয়োজনা করা, ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ও সামাজিক কুসংস্কারগুলোকে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা। এই ব্যাপারে যা যা করনীয় আমাদের লোকেরা শিবির শেষে সব বুঝিয়ে দেবে তোমাকে।
উত্তম আর মঞ্জু দাঁড়িয়ে রয়েছে ডাক্তারবাবুর পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়। সব লোকেরা চলে গেছে তাদের নিজ নিজ ডেরায়। দুশোজনকে দেখেছেন এঁরা। হেলাফেলা করে নয়, ভাল করেই দেখেছেন, ওষুধ দিয়েছেন বিনা পয়সায়। সবাই খুশি মনে বাড়ি ফিরে গেছেন।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামতে চলেছে। উত্তম আর মঞ্জুকে ফিরতে হবে নিজ ডেরায়। কিন্তু আজ থেকে যে দুটো ডেরার ঠিকানা এক হয়ে গেল।দুটো অচিন বনের পাখী কোন এক অজানা ডেরায় বাঁধতে চলেছে তার হদিশ কি কেউ জানে? হয়তো বা কলকাতার দেবতুল্য ডাক্তারবাবু জানেন! দুজনে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল সেই অচিনপুরের অজানা ডেরার পথে।
Tags: আলোক শিখা, প্রদীপ কুমার দাস
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।