বাঃ, পুকুরের জলটা তো তেমনিই টলটলে আছে! ঠিক যেন আয়না। টিফিনে ঐ জলে আমরা মুখ দেখে চুল ঠিক করে নিতাম। ওপাড়ের তালসারিতে কত বাবুই পাখির বাসা ছিল। যাঃ, বাবুইগুলো কোথায় গেল, তালসারিটা তো একইরকম আছে। ও পাশের ঐ রাধাচূড়া গাছটাও তেমনিই ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। হলুদ ফুলে ছেয়ে থাকত গাছটা। ঝরা ফুলে পুকুরের জলটাও হলুদ হয়ে থাকত। আরে! ঐ তো সেই পঞ্চমুখী জবা গাছটা। ঐ জবাতলায় দাঁড়িয়েই ক্লাস টেনের সৈকত মনিকার থুতনি ধরে একটু সন্টুমন্টু করেছিল। বাপরে! সে নিয়ে কি হুজ্জুতি। গার্জেনকল পর্যন্ত গড়িয়েছিল।বাঁধানো ঘাটটাও একই আছে তবে এখানে ওখানে ছালচামড়া উঠে ঘেয়ো কুকুরের পিঠের মত দেখাচ্ছে। একবার বাহাদুরি দেখিয়ে নামতে গিয়ে পিছলে জলে পড়ে গিয়েছিলাম। সবার সামনে দেবাস্যারের কাছে চারটে গাঁট্টা খেয়েছিলাম। খুব মানে লেগেছিল। তখন তো পাঁচিল ছিল না। তাই পুকুরটাকে মামুদপুর শিক্ষানিকেতনের একটা অংশ বলেই মনে হত। সুব্রতস্যার তো যখন তখন যাকে তাকে দোতলা থেকে সটান ঐ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দিতেন। মোটা গোঁফ। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। অসম্ভব মারকুটে। একটু এদিক ওদিক হলেই সপাসপ ছড়িপেটা।সেদিন পলাশ কি ঠ্যাঙানিই না খেয়েছিল! ফণীবাবুর ক্লাস। উনি তখনও ক্লাসে আসেননি। দারুণ হট্টগোল হচ্ছে। পাশের ক্লাস থেকে রেবাদি বেরিয়ে এলেন। রেবাদি নিরীহ মানুষ। কেউ তেমন তোয়াক্কা করে না। মিনমিনে গলায় বললেন, “এত চেঁচামেচি কিসের? তোমাদের এখন কার ক্লাস?” কেউ কিছু বলার আগেই পলাশ হাতটা উঁচিয়ে সাপের ফণার মত করে ছোবল মারার ভঙ্গিমায় হাতটা দোলাতে লাগল। সেই মুহূর্তে রেবাদির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন সুব্রতস্যার। আমরা কেউ খেয়াল করি নি। পলাশ হাত দুলিয়েই যাচ্ছে। আমরাও সবাই হি হি করছি। হঠাৎ বাঘের গর্জন। ‘চো ও ও ও প!’ দরজার দিকে তাকাতেই একজোড়া আগুন চোখ। হাঁটু কাঁপতে শুরু করল। প্রাণপন চেষ্টাতেও হাঁটুর ঠকঠকানি কিছুতেই থামাতে পারছি না। আর কোন কথা নয়। সটান এসে শুরু করলেন এলোপাথাড়ি মার। পলাশের মুখ থেকে শুধু উঃ! আঃ! আর্তনাদ। পলাশের পর তপন, বাপি, পিনু এরাও বেশ ঘা’কতক করে খেল। তবে কো-এড স্কুলের একটা সুবিধে। ছেলেরাই মারটারগুলো বেশি খায়।
তবে সেবার সুতপাও বেশ গোটাকতক গাঁট্টা খেয়েছিল দেবা স্যারের কাছে। দেবা স্যারের গাঁট্টা বিখ্যাত। মাথায় একেবারে আলু গজিয়ে ছেড়ে দেবে। স্যার বোর্ডে বায়ুপ্রবাহের গতিপ্রকৃতি বোঝাচ্ছেন। সুতপা একটা কাগজ ডেলা পাকিয়ে সেকেন্ড বেঞ্চের সুমিতের পিঠে ছুঁড়ে মারে। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ঠিক সেই সময়ই মুখ ঘোরায় দেবা স্যার। বাপিকে কাগজটা কুড়িয়ে আনতে বলে। কাগজ হাতে নিয়ে স্যার টেনে টেনে পড়তে শুরু করেন, আমিইইই তোমাকে এ এ এ ভে এ লে এ বাসি ইই। তারপরই দারুণ এক হুংকার, সুতপা! বেরিয়ে আয়! সুতপার চোখমুখে তখন আর একটুও রক্ত নেই। স্যারের দাবড়ানিতে আমরাও বুকে হাতুড়ি পেটার স্পষ্ট শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
— এটা কি লিখেছিস?
বলেই খটাশ করে জোরালো এক গাঁট্টা।
— স্যার, বানানটা ভুল হয়ে গেছে। ওটা ‘ভালোবাসি’ হবে।
সুতপা তখন দিশেহারা। এতোল বেতোল বলে ফেলছে।
— ভালোবাসি হবে? হওয়াচ্ছি ভালোবাসা।
ঠকাঠক ঠকাঠক শব্দে সুতপার মাথায় দেবা স্যারের ভালোবাসা-বর্ষণ শুরু হয়।
তারপর সুতপা রাগে ছড়া বানিয়েছিল, টরেটক্কা টরেটক্কা/ দেবা স্যারের ঝাল গাঁট্টা / কিনলে টাকায় একটা। কেন কে জানে, দেবাস্যারের উপর আমারও খুব রাগ ছিল।মনে মনে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু মুখে বলেছিলাম, “ ধ্যাৎ, স্যারেদের নামে ওরকম বলতে নেই।“
ক্লাস নাইনে একটা নতুন ছেলে এসে আমাদের মামুদপুর শিক্ষানিকেতনে ভর্তি হল। যদিও ছেলেটা নাইনে পড়ার বয়েস কবেই পেরিয়ে গেছে। ছেলেটার নাম …. ছেলেটার নাম …. মনে হয় কুশল, ঠিক মনে পড়ছে না। শুধু মনে আছে হিপি চুল। কায়দা দিয়ে আঁচড়ানো। গলায় চেন। চেনে ঝুলছে চকচকে ব্লেড লকেট। হাতে বালা। মস্তান মস্তান সাজগোজ। কিন্তু চেহারাটা খ্যাঙরা কাঠির মত । দাঁতগুলো কালো কালো, ছ্যাতলা পড়া। বিড়ি খৈনি এসব খায় মনে হয়। চোখেমুখে একটা স্পষ্ট রাফনেস। মুখে সবসময় একটা বোকা বোকা হাসি যেটা দেখলেই হাড়পিত্তি জ্বলে যেত। ছেলেটা পুনে না কোথায় যেন পালিয়েছিল। মামারা অনেক খোঁজখবর করে ধরে এনে জোরজবস্তি ইস্কুলে ভর্তি করে দিয়ে গেছে।
ভর্তি করলেই কি আর লেখাপড়া হয়! মামারা তো জানে না, পুনে গিয়ে ভাগ্নেকে ঘুনে ধরেছে। জানলা দিয়ে পুকুরের হাঁস গুনে গুনে আর হাই তুলে তুলে ক্লাস কাবার করে দেয়। লাস্ট বেঞ্চে উদাসীন হয়ে বসে থাকে। কিছু শোনেও না, কিছু বোঝেও না। ওকে দেখে মনে হত জলের মাছকে কেউ ডাঙায় তুলে এনে ফেলেছে। সেদিন বেলাদির অঙ্ক ক্লাস। বোর্ডে সম্পাদ্য আঁকছেন। হঠাৎ কি মনে হল, পিছন ফিরে তাকালাম। আশ্চর্য, ছেলেটা ক্যাবলার মত আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ বিরক্তি লাগল। আচ্ছা বাজে ছেলে তো! তখন নাইনে উঠে গেছি। বালিকা বালিকা মুখ,মহিলা মহিলা ভাব। শাড়ি পরে ইস্কুল যাই। এসব চাউনির মানে বেশ বুঝতে পারি। কিছুক্ষণ পর মনে হল, কি জানি, ছেলেটা কি এখনও তাকিয়ে আছে? আবার মুখ ঘোরালাম। হ্যাঁ, একইরকম, ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে। আজকেই প্রথম? না কি ও রোজই আমাকে এভাবে দেখে? খেয়াল করি নি তো।আমি আর সেদিন বেলাদির ক্লাসটা ভাল করে মন দিতে পারলাম না। রাগ হচ্ছিল খুব কিন্তু বারবার পিছনে তাকিয়েও ফেলছিলাম।
তারপর থেকেই যেখানে দেখা হত, বারান্দায়, ক্লাসে, মাঠে, পুকুরধারে দেখতাম ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়েই আছে। নিজের অজান্তেই আমারও যেন একটা নেশা হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুদের লুকিয়ে আমার ছোখদুটোও ছেলেটাকে খুঁজে বেড়াত। দেখি, আমাকে দেখছে কি না। আমি বরাবর ভাল রেজাল্ট করতাম। মনের মধ্যে একটা অহং বুরবুরি কাটল। একটা হাড়ডিগবিগে বখাটে ছেলে! লেখাপড়ায় অষ্টরম্ভা। আমার দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস কিভাবে পায়?নিজের মনেই দাঁত কড়মড় করে উঠি। তক্কে তক্কে থাকি কিক’রে ছেলেটাকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়া যায়।
আনুয়াল পরীক্ষা। আমার ঠিক সামনের বেঞ্চেই ছেলেটার সিট নম্বর। সেদিন ইতিহাস পরীক্ষা। সাদা খাতা নিয়ে ছেলেটা চুপ করে বসে আছে। উশখুশ করছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমি নিজের লেখায় মন দেবার চেষ্টা করি। একসময় দেখি ছেলেটা লিখছে। খাতার ভাঁজে ছোট টুকরো কাগজ। টুকে এনেছে! ব্যস, আমিও সুযোগ পেয়ে গেলাম।বাছাধন এবার বুঝবে ঠ্যালা। সোজা দাঁড়িয়ে বলে দিলাম, স্যার এই ছেলেটা টুকলি করছে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। আজকে আবার আমাদের রুমে সুব্রত স্যারের ডিউটি। সুব্রত স্যার মানেই মূর্তিমান আতঙ্ক। কিন্তু স্যার একটা কথাও বললেন না। শুধু ছেলেটার খাতাটা কেড়ে নিয়ে হিমশীতল কন্ঠে বললেন, ‘বিদেয় হও’। ছেলেটা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল তারপর ব্যাগ নিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল। রেজাল্ট বেরোল। ছেলেটা ফেল। আর আমিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক, একই ক্লাসে আর ওর সঙ্গে থাকতে হবে না। কিন্তু কেন জানি না, সেদিন একা একা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে পুকুরে অকারণ ঢিল ছুঁড়ছিলাম। মনিকা এসে বলল,”কি রে প্রীতি, এত ভাল রেজাল্ট করলি তাও মনটা খারাপ কেন?”
ইস্কুলের সরস্বতী পূজো মানেই এক দারুণ ব্যাপার। কাগজের শিকল তৈরী করা, আলপনা দেওয়া, ফুল তোলা, মালা গাঁথা,মাঠ থেকে জোড়া শীম, জোড়ামটরশুঁটি নিয়ে আসা, জোড়াকুল পেড়ে আনা, ঠাকুর আনা …… ঠাকুরকে বই দেওয়া …….সবাই মিলে হৈ হৈ করে দু তিনদিন ধরে এইসব জোগাড় করা। পূজোর দিন খুব সকালে হলুদ কাপড় পরে সেজেগুজে তৈরি হলাম। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ফল কাটা, নৈবেদ্য সাজানো ……… অনেক কাজ। বেরোবার সময় টুবলু বায়না ধরল যে, সে আমার সঙ্গে আমাদের ইস্কুলে ঠাকুর দেখতে যাবে।টুবলু আমার ছোট ভাই। ওয়ান -এ পড়ে। প্রথমে নিতে চাই নি কিন্তু মায়ের বকুনিতে নিতে বাধ্য হলাম। টুবলুকে একপাশে বসিয়ে রেখেছি। পলাশ, বাপি, সুমিত ওরা সিঁড়ির কাছে কলাগাছ, ঘট বসাচ্ছে। ওদের কাছে ফণীবাবু আছেন। আমরা মানে আমি, মনিকা, সুতপা, দীপা, কল্যানী সবাই গোল হয়ে বসে ফল কাটছি। আমাদের কাছে রয়েছেন বেলাদি আর লীনাদি। সবাই মিলে জোর গল্প হচ্ছে। পুরোহিত এসে পড়েছে। ধূপ ধুনো জ্বালানো হচ্ছে। এবার পূজো শুরু হবে। আরে! টুবলু কোথায়! এই তো এখানে ছিল! টুবলু উ উ উ উ টুবলু উ উ! সবাই মিলে ডাকাডাকি শুরু করলাম। বাইরে বেরিয়ে খুঁজতে লাগলাম। দোতলার ঘর, বারান্দা, ছাদ, মাঠ সব জায়গায় । কোত্থাও নেই। বেলাদি বললেন, “পুকুরের দিকে যায় নি তো?” তাই তো! খেয়ালই ছিল না। সামনে এত বড় পুকুর।বুকটা ধড়াস করে উঠল। দৌড়ে সবাই পুকুরধারে এলাম। টুবলু উ উ উ ……. টুবলু উ উ উ …… প্রাণপনে সবাই ডাকছে। ঐ তো! ঐ তো! পলাশ আঙুল দেখাল। ঘাট থেকে অনেকটা দূরে জলের মধ্যে টুবলুর ছোট্ট শরীরটা হাঁচোড় পাঁচোড় করছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, ঐ তো! ঐ তো! সবাই চিৎকার করছে। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীর অবশ হয়ে আসছে। হঠাৎ কোথা থেকে আচমকা সেই ছেলেটা দৌড়ে এল। হাতে একটা খাতা আর শরের কলম। ঠাকুরের কাছে জমা দেবে মনে হয়। সবাইকে ঠেলে একেবারে আমার কাছে চলে এল। খাতাটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে গায়ের জামাটা খুলে ফেলল। তারপর ডিগডিগে শরীরটাকে জোরসে ছুঁড়ে দিল পুকুরে। সাঁতরে চলে গেল পুকুরের মধ্যিখানে। টুবলুকে তুলে নিয়ে এল। টুবলু ততক্ষণে নেতিয়ে পড়েছে।
এখন টুবলু কানপুর আই আই টিতে। আমি এই মামুদপুর শিক্ষানিকেতনে মিউচুয়াল ট্রান্সফার নিয়ে এসেছি। আজ এই ইস্কুলে আমার প্রথম দিন। একে প্রথম দিন। তার উপর আবার নিজের ইস্কুল। তাই তাড়াতাড়িই চলে এসেছি। এখনও কেউ আসে নি। অনেক পরিবর্তন হয়েছে ইস্কুলের। তিনতলা হয়েছে। অনেক নতুন ঘর হয়েছে। নতুন রঙ হয়েছে আর হয়েছে বাউন্ডারি পাঁচিল। তাই পুকুরটা এখন ইস্কুলের বাইরে। আমি পাঁচিলের ধারের রাস্তা ধরে পুকুরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে জলের কাছে এলাম। মুখ দেখার জন্য মাথাটা ঝোঁকালাম। সেই আগের মত। আরে! এ কে! এ তো দু’বিনুনির শাড়ি পরা সেই ছোট্ট মেয়েটা। ক্লাস নাইনের প্রীতি। বালিকা বালিকা মুখ অথচ মহিলা মহিলা ভাব। অবাক কান্ড,জলে আমার মুখের আশেপাশে সারি সারি অনেকগুলো মুখের ছায়া। মনিকা, পলাশ, বাপি, সৈকত,পিনু, সুমিত ….. আমি ঐ ভিড়ের মধ্যে আর একটা মুখকে খুঁজছি। আকুল হয়ে খুঁজছি। কি যেন ছেলেটার নাম ছিল? আমার কাছে ছেলেটার খাতাটা যে এখনও রয়ে গেছে! ফাঁকা নতুন খাতা। নাম পর্যন্ত লেখা নেই।
Tags: পুকুর, পূর্বা কুমার
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।