(১)
আজ তিরিশে। তিরিশে জানুয়ারি।আসছে মাসের চোদ্দই ভ্যালেন্টাইন ডে। সেই সুবাদেই সাত তারিখের মধ্যে একটা প্রেমের গল্প জমা দিতে হবে। আজই চোখে পড়ল বিজ্ঞপ্তি।
এর মধ্যে তিন তারিখ আমাকে দেখতে আসবে। সেটা অবশ্য নতুন কথা নয়। রবিবারের কাগজ দেখে মা পাত্রী চাই এর ছোট বিজ্ঞাপনগুলো দাগিয়ে রাখে প্রথমে। তারপর মোটা আট নম্বর খাতায় ফোন নম্বরগুলো টুকে রাখে। এক একটা নম্বর লিখে মাঝে খানিকটা করে জায়গা ছেড়ে রাখে। শেষে একটার পর একটা নম্বরে ফোন। মা’র উৎসাহে একটু কি ঘাটতি পড়ছে সম্প্রতি? দুটো ফোন নম্বরের মধ্যে রাখা জায়গা কমছে। আগে ছিল একটা পুরোন ডায়রি, এল. আই . সি.’র। শেষ হতে চার নম্বর রুলটানা খাতা। এখন আট নম্বর সাদা খাতা। সাদা পাতায় লেখা অভ্যেস নেই তেমন মা’র। লাইন বেঁকে যায়। পাতার শেষ দিকে পৌঁছে নম্বরের সঙ্গে লেখার মিল থাকেনা। ফোন করে বেইজ্জতিও হয়ে যায়। তার আগে শুক্রবার থেকে তাগাদা মেরে দাদাকে দিয়ে ফোনে পয়সা ভরায়।
মা স্নানে যায় যখন, মঝেমাঝে আমি ছেলেদের ছবিগুলো লুকিয়ে দেখি। এসব লুকোচুরির দরকার ছিলনা আগে। আমি, দাদা, মা সকলে মিলে হুমড়ি খেয়ে ছবি দেখতাম। হাসাহাসি। কেউ টেকো তো কেউ মোটু। বুড়োটে বা অসভ্য টাইপ। এখন আর কাউকেই বাতিল করা হয়না। আর মা ছবি লুকিয়ে রাখে। প্রথমেই সাত পাঁচ ভেবে নিয়ে পরে কান্নাকাটি, মন খারাপ। – আগে কথাবার্তা এগোক খানিক, তারপর ছবি টবি। চুপচাপ মেনে নিই। আর সুযোগমতো টুক করে দেখে নিই। তবে কোন তাবনাকে ঘেঁষতে দিই না মনের চৌহদ্দিতে।
এবার বেশ অনেকদিন পর দেখতে আসা অব্দি এগোল। করোনা, ভাদ্র মাস হ্যানাত্যানা। তবে এসব ভাবের ঘরে চুরি। বয়স বাড়ছে, মুখে তার ছাপ পড়ছে। যতই কায়দা করে ছবি তুলে দিক দাদা পাত্রপক্ষ ভোলেনা। বলেই দেয় মুখের ওপর, আরএকটু স্পষ্ট ছবি পাঠান, অথবা কেউ বলে আরও দুচারটে ছবি, ঘরের বাইরে, ন্যাচারাল ছবি নেই? ছবি পছন্দ হল যদি তখন স্কুল, কলেজ, অনার্স না পাস কোর্স, মাস্টার্স করেনি ? গান জানা টানা, সেলাইফোঁড়াই,হাতের কাজ, যেমন মা বলে তখনকার সময়ে ছিল, এখন আর তা নিয়ে অত কেউ মাথা ঘামায় না। এর পর চাকরি। চাকরি শুধু করলে হবেনা, যখন খুশি ছাড়ব কিনা। এটাতে মাস্টার স্ট্রোক হাঁকাতে পারে মা। – ওর চাকরি নিয়ে কোন প্রবলেম হবেনা দিদি। ইচ্ছে হলে ঘরে বসেও…..। এই করোনার সময়ে তো পুরো ঘরে কম্পিউটারেই কাজ করে যাচ্ছে। কোন অফিস? – প্রাইভেট কোম্পানি। এর পর প্রসঙ্গান্তরে যাবার জন্যে মা সামান্য তাড়াহুড়োয়। সোজা একটা উপায় শিখিয়ে দিয়েছি আমিই। – পরীক্ষা টরীক্ষা তো দিচ্ছে। বেটার পেলেই …
আজকাল আর বুক ধুকপুকটুকুও করেনা। মা আর দাদাটার জন্যেই কষ্ট হয়। জানি মুখে যাই বলুক, প্রত্যেকবার একটা আশায় কেমন অধীর হয়ে থাকে।শুধু ওদের কথা ভেবেই আপ্রাণ চেষ্টা করি একটা পণ্যের মতো সত্যি মিথ্যে মেশান বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতার মন জিতে নিতে। দাদা বরাবর কুল থাকে। এবারই দেখছি বড্ড ছটফট করছে।
(২)
যা বলছিলাম, তিরিশ থেকে সাত। এই সাতটা দিন, না আট দিন। জানুয়ারিতে একতিরিশ দিন বলে বাড়তি আরেকটা দিন। ম্যাডাম বলে দিয়েছেন, এই এক সপ্তাহ তোমাকে সময় দিলাম তনু। স্যার বলছিলেন এক তারিখেই তোমার হাতে চিঠি ধরাতে। আমি বলে কয়ে সাতটা দিন চেয়ে নিয়েছি। বরাবরই আমি ম্যাডামের এই বাড়তি স্নেহটুকু বুঝতে পারি। তনুশ্রী থেকে কদিনের মধ্যেই তনু হয়ে গেছি বলে শুধু নয়। গম্ভীর হয়ে থাকলে তুমি , নাহলে তুই হয়ে গেছি সেই কবেই। টি. এ. বিল টিল… ঝামেলা হয়নি কখনই, যেমন রাকেশ কি বাণীদিদের ।
– ভীড় বাসে টাসে উঠতে যেওনা। টোটো কি অটো করে নিও। আমি থ্রু করিয়ে দেব। তবে আমি বাড়তি সুযোগ নিই নি কখনও এর চেয়ে বেশি। সেরকম হলে তো অ্যাপ ক্যাবের ভাড়াও চেয়ে বসতাম। কিন্তু পরিস্থিতি এখন ঘোরালো হয়ে উঠছে। কোভিডের জন্যে বাজার ডাউন। অনেককেই বসিয়ে দিয়েছে। – একটা কিছু করে দেখা এবার তনু। প্রীতি, মিলনী স্যারের কাছে এসে তোর কথা তুলে ঝামেলা করে গেছে। একটা ক্লায়েন্টও দিতে পারিসনি ….. ছ`মাসের জায়গায় সাড়ে ন`মাস গড়িয়ে গেল। শুধু আমার কথায় তোকে কাগজ ধরায়নি।
– বিয়ে হয়ে বাচ্চা ভি পয়দা হবার টাইম পার হয়ে গেল, তনুশ্রী তো এনগেজমেন্ট তকই পৌঁছল না। ঢপ মেরে যাচ্ছি তোর হয়ে এটা ওটা। ওরই লাকটা খারাপ প্রদীপদা। একটা তো প্রায় ফাইনাল হয়ে গেল তখন ছেলের জেঠু করোনায় গেল। তোর ঐ ফরেনের কেসটার কথা জিগ্যেস করছিল। বলে দিলাম ফ্লাইট চালু হলেই ওটা ধরে নেবে তনু। প্রায় ফাইনাল।
চোদ্দই ভ্যালেন্টাইন। সাত তারিখের মধ্যে ফাইনাল করতে হবে। একটা একটা করে দিন চলে যাচ্ছে । প্রেসার বাড়ছে,ঘাড়ের কাছে কন্টিনিউয়াস দপদপানি, ঘুম হচ্ছেনা, অম্বল, মাথাভার…
(৩)
বিয়ে, চাকরি আর গল্প বিনুনির তিন গুছি চুলের মতো জড়াজড়ি করে আছে। এক গতিতে এগোতে হবে তিনজনকেই তবেই একটা সম্পূর্নতায় পৌঁছবে। খেলা বললে খেলা, জীবন বললে তাই।
ঘাড় গুঁজে সকাল থেকে কম্পিউটারে। চারপাশে ছড়ানো কাগজ, চিরকুট, ডায়রি।রান্নাঘরে মা ধাঁই ধাঁই করে বাসন কোসনের শব্দ করে রাগ দেখাচ্ছে।গলাও চড়ছে। আমি উঠে সপাটে দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছি।দাদা চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে এসে দরজাটা আটকে দাঁড়াল। – চা নিয়ে আসছি দাঁড়া। কথা আছে। দুকাপ চা আর মুড়ি এনে বসল।
– রাগ দেখাচ্ছিস কাকে? মার কথাটাও ভাব একবার।
– আর আমার কথা? সেটা কে ভাববে?
– নিজের কি অবস্থা করেছিস দেখেছিস? আর্শিটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখে কি সকলের চোখ বন্ধ করতে পারবি?
– সাত তারিখের পর চাকরিটা যাচ্ছে। তিন তিনটে সুপার প্রোফাইল এক সঙ্গে ল্যাণ্ড করেছে অথচ একটা সিঙ্গল ম্যাচ পাচ্ছিনা।একটা, জাস্ট একটা যদি ম্যাচিওর করে তাহলেই … । লাকটাই খারাপ ।
একই সঙ্গে আমার আর দাদার চোখ চলে গেল ফ্রেমে বাঁধানো বাবার ছবিটার দিকে।
– তনু, তুই সেদিন বারো, আমি বাইশ। খারাপ কপালের দোহাই দিয়ে বসে থাকলে এই তেরোটা বছর কাটতোনা। ছবির ভদ্রলোক তোকে কি বলত ভুলে গেলি ?
ব্রেভ গার্ল। সো …
– আজ এক তারিখ। পরশু ওরা আসছে। তারপর আরও তিন চার দিন তোর হাতে থাকছে কিন্তু।
– দাদাভাইরে…… আর … আর … ছবির ভদ্রলোক তোকে কি বলত?
– মুস্কিল আসান। মা কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে আমরা কেউ খেয়াল করিনি।
দাদা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে আয়নার ঢাকাটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল নিজের দিকে একটু তাকা এবার। কালো কাপড় দিয়ে কি আড়াল করছিস? অন্ধ সেজে বসে আছিস….
(৪)
– উইশ মী লাক। ঘুটি প্রায় হোম এ পৌঁছতে চলেছে – ম্যাডামকে মেসেজটা করে দিতেই দিনটা পুরো আমার হয়ে গেল। পার্লারে যাবার ইচ্ছেটা আপাতত এই করোনার বাজারে প্রশ্রয় দেওয়া গেলনা।সমস্ত সকাল ধরে নিজেই ঘষা মাজা, মাজা ঘষা।বরাবর দেখেছি যাহোক কিছু নিয়ে একবার ব্যস্ত হয়ে যেতে পারলেই মনটা চনমনে ।কেন করছি, কিসের জন্যে ফালতু ভাবনাগুলো আর জ্বালাতন করেনা।
স্নান টান সেরে আয়নায় নিজেকে দেখে কেমন একটা খটকা মতো। দাদার কথাগুলো… লাফ দিয়ে কম্পিউটারটা খুলে প্রোফাইলগুলোয় চোখ বোলাচ্ছি।আহ, এই তো… ফোটোটায় চোখটা আটকে যাচ্ছে… চোখ দুটোয় আরও একটু হাসি যোগ হয়েছে… গল্পটায় কিন্তু প্রেমের এলিমেন্ট ঢোকাতে হবে।
– আজ তোমার স্পেশাল চাউমিনটা বানাও তো মা। দাদা বললো, রাতে সিক্স বি পি থেকে বাসন্তী পোলাও আর মাটন কষা।
গল্পটা মেঘলা, গুমোট মতো হয়ে যাচ্ছিল।এতক্ষণে এক ফালি রোদ ঢুকছে। হাল্কা খুশির ভাব। রাতে ফের যখন কম্পিউটারে খুলে বসেছি, দাদাভাই বলল, কালকের দিনটা অব্দি ই আমি একটু হ্যান্ড হোল্ডিং করছি। তারপর সাত তারিখের মধ্যে গল্প শেষ করা কিন্তু পুরোপুরি তোর দায়িত্ব।
রহস্য গল্পটাকে প্রেমের গল্পে কনভার্ট করা খুব একটা শক্ত নাকিরে দাদা?
(৫)
প্রথম মেসেজটা ম্যাডামের কাছ থেকেই ।একটা ফুলের তোড়ার ছবি।দাদা হাসছিল, মা হাসছিল। আমি হাসছিলাম কিন্তু চোখে জলও আসছিল। এই সব চার তারিখ সকালের কথা। অভিষেকের মা ফোন করার পরের কথা। তার আগে দাদাকে ফোন করেছিল অভিষেক। তিন তারিখ রাতে আমার ফোনের মেসেজটার কথা আমি বলিনি কাউকে।
অগ্নিসাক্ষী ডট কম, মানে আমার প্রাইভেট কোম্পানির স্যারের সঙ্গে এই চুক্তিটা যেমন দাদা বলেনি, আমিও সেরকম আমার খেলাটা বলিনি।অভিষেক বলেছিল তোর চাকরিটা যাচ্ছে ধরেই নিতে পারিস। দু দুটো কেস হাতছাড়া করার ব্যবস্থা তো প্রায় পাকা করেই ফেলেছিলি। সেই কলেজবেলার চেহারাটা ভেবে ভেবে অগ্নিসাক্ষীর দিদিমণিকে নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে গেলাম – পাঁচ দুই, একটু শ্যমলা মতো। সাজগোজ বেশি না হয় যেন…. লাস্ট মোমেন্টে তরুময়দাকে ধরলাম…
প্রদীপ স্যার আর ম্যাডাম এসেছিল বিকেলে। কনফার্মেশনের চিঠিটা তার আগেই মেলে। – ডাবল ইনক্রিমেন্ট তো দিতেই হবে, এক সঙ্গে এক জোড়া প্রোফাইল ম্যাচিং। ম্যাডামকে লজ্জা পেলে এত বিউটিফুল লাগে জানতেই পারিনি। ঢিপ করে মাকে প্রণাম করে উঠতেই আমি বৌদি বলে জড়িয়ে ধরেছি। দাদাটা যে কোথায় পালালো !
গল্পের শেষটা তেমন স্মার্ট হলনা বোধহয়। রহস্য গল্প থেকে প্রেমের গল্প বানাতে গেলে যা হয় আর কি ….
Tags: মাঘ ফাগুনের গল্প, শ্রেয়া ঘোষ
email:galpersamay@gmail.com
রুচিরা on March 5, 2021
খুব ভালো লাগলো।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।