ভারতবর্ষের নানা ভাষার আধুনিক সাহিত্য গড়ে উঠেছে বিদেশী ও বিভাষী ইংরেজের রাজত্বকালে। সে রাজত্বের দু-দশ বছর ভারতবর্ষের ইতিহাসে অতি আধুনিক কাল। কিন্তু এই কালসাম্যই সে সাহিত্য ও রাজত্বের একমাত্র যোগ নয়। ইংরেজ রাজত্বের আনুষঙ্গিক রাজভাষা ইংরেজির প্রচারেতার মাধ্যমে ভারতবাসীর পরিচয় হল আধুনিক ইউরোপের জ্ঞান ও চিন্তা, সাহিত্য ও ভাবের সঙ্গে। এ আধুনিক ইউরোপকে ইউরোপীয়ের বলে আপ্তবাক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নির্বিচার বিশ্বাসের মধ্যযুগের অবসানে অবাধ বিচার ও সৃষ্টির পথে ইউরোপের মুক্তমনের জয়যাত্রা। এই মুক্তমনের গতির বেগ ও ফলের বৈচিত্র্য ভারতবর্ষের মনকে প্রবল নাড়া দিয়ে আকর্ষণ করেছিল। অর্থহীন আচার ও সংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ অনেকের মনে হয়েছিল আধুনিক ইউরোপের পথ সভ্যতার একমাত্র পথ। আচারে ব্যবহারে মনে আধুনিক ইউরোপীয়ের মত হওয়াই সভ্য হওয়া। ভারতবর্ষের জাতিগুলির মধ্যে এই হঠাৎ পাওয়া নূতনের মত্ততা বাঙ্গালীকেই সব চেয়ে আবিষ্ট করেছিল। কিন্তু নেশা কাটতে খুব বেশিদিন লাগেনি। বাঙ্গালী চিন্তানায়কদের মনীষা অল্পদিনেই বাঙ্গালীকে বুঝিয়েছিল যে সব বড় সভ্যতার মতোই এই বিদেশাগত সভ্যতার দুটো দিক আছে। এর মধ্যে এমন উপাদান ও মনোভঙ্গী আছে যা জন্মস্থান নিরপেক্ষ সকল মানুষের সাধারণ সম্পদ। এদের গ্রহণ করে সকল সভ্যতাই পুষ্ট হয়, কোনও সভ্যতা স্বধর্মচ্যুত হয় না। গঙ্গোত্রী থেকে প্রবাহিত ভাগীরথীর ধারার মতো যেখানে যায় সে মাটিকেই উর্বরা করে। এর মধ্যে আবার এমন অংশ আছে যা বিশেষ মানুষগোষ্ঠীর ভূগোল ও ইতিহাসের ফল। বিশেষ মাটির মহীরুহের ফুল পাতা। তার ডাল কেটে আনলে ফুল পাতা দুদিনেই শুকিয়ে যায়। তাকে গ্রহণ করে নিজস্ব করা যায় না, নকল করা যায় কাগজের ফুলপাতা বানিয়ে। এ নকলের কাজ বাঙ্গালী কিছুদিন করেছিল, অনেক হাস্যরসের উপাদান যুগিয়ে। মোহ যখন ভাঙ্গল তখন ইউরোপীয় সভ্যতায় যেটা সর্বমানবীয় অংশ সেটা বাঙ্গালী মনের নিজস্ব হয়েছে। যেটা মাত্র ইউরোপীয় অংশ তার নকল সাজ মোটের উপর খসে পড়েছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভিত্তিতে রয়েছে এই গ্রহণ ও বর্জন। বাঙ্গালীর আধুনিক সভ্যতার আদিপুরুষ রাজা রামমোহন রায় কল্পনা করেছিলেন ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতায় যা মহার্ঘ আর ইউরোপীয় সভ্যতায় যা নূতন ও মূল্যবান এদের সমন্বয়ে বাংলাদেশে ও ভারতবর্ষের সভ্যতায় এক নূতন যুগের আরম্ভ হবে। তারপর আমাদের বিক্ষিপ্ত মন নানা পথে ঘুরলেও শেষ পর্যন্ত বাঙালীর আধুনিক সভ্যতা ও সাহিত্যের গতি এই সমন্বয়ের পথে। ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে রামমোহনের যে নিবিড় পরিচয় ছিল, পরবর্তী-যুগের শিক্ষিত বাঙালীর সে পরিচয় নেই। ফলে সভ্যতায় ও সাহিত্যে যে সমন্বয় আমরা গড়ে তুলেছি তাতে ইউরোপ বেশি, ভারতবর্ষ কম। সন্দেহ হয় এর ফলে আমাদের মন যথেষ্ট সচল নয়, আমাদের সৃষ্টির উৎসাহ ও শক্তি দ্বিধাগ্রস্ত। ইউরোপের জ্ঞান বিজ্ঞান সাহিত্যকে আমরা আপনার করেছি, কিন্তু এর মধ্যে যেন একটু আপ্তবাক্যের আমেজ আছে। ওগুলি যে আমাদের মতো মানুষেরই সৃষ্টি; সুতরাং পরীক্ষা করেই গ্রহণ করতে হবে তাতে আমরা সব সময় সজাগ নই। আমাদের দেশের অনতিপ্রাচীন পণ্ডিতদের অনেকে প্রাচীন ভারতের সব কথাকেই ভাবতেন ঋষিবাক্য অর্থাৎ অভ্রান্ত। ইউরোপীয় ভাষার পুঁথিতে যা লেখা হয় তার উপর আমাদের অনেকের ভক্তি অতটা না হোক, অনেকটাই সেই ধরনের। ইংরেজ গিয়েছে। রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা আমাদের মনের গহনে ক্রিয়া করে ইউরোপের জ্ঞান বিজ্ঞান সাহিত্যের উপর কেবল্মাত্র ইউরোপীয় বলে আমাদের যে অহৈতুকী ভক্তি জন্মায় তাকে মনের উপর তলায় এনে পরীক্ষা ও বিদায় দেবার সময় হয়েছে। প্রাচীন ভারতবর্ষের মন যখন সজীব ছিল তার ভাব ও সাহিত্যের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয় এ কাজে আমাদের বড় সহায়। তাতে আমাদের দৃষ্টির প্রসার ও প্রখরতা বাড়বে। সভ্যতায় ও সাহিত্যে আমরা যে সমন্বয়ের পথে চলেছি তার উপাদান থেকে অসমঞ্জস অবান্তর দূর হয়ে শক্তিগর্ভ নূতন যৌগিক দেখা দেবে।
// ২ //
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এই ইতিহাস অল্পবিস্তর সমস্ত ভারতীয় ভাষার আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাস। এ সব সাহিত্যের আধুনিক রূপ ইউরোপীয় সাহিত্যের আদর্শ থেকে নেওয়া। এ সব সাহিত্যেই নিজস্ব ভারতীয় মন ও ভাবের সঙ্গে বিদেশী ইউরোপীয় মন ও ভাবের সমন্বয়ের চেষ্টা চলছে। অর্থাৎ ভারতবর্ষের নানা ভাষার আধুনিক সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গী ও গড়নভঙ্গী মোটামুটি একরকমের। রাষ্ট্রীয় পরাধীনতার যে প্রতিক্রিয়া সকল সাহিত্যেই তা প্রকাশ হয়েছে, মর্মান্তিক বেদনা কী দেশভক্তির ভাববিলাসের রূপ নিয়ে। এই সকল সমধর্মী সাহিত্যের পরস্পরের সঙ্গে নিকট পরিচয়, ও ভাব ও রচনাশৈলীর আদান-প্রদান অতি স্বাভাবিক। কিন্তু ইংরেজের রাজত্বকালে এ স্বাভাবিক ঘটনা ঘটে নাই, যদিও এ সকল সাহিত্যই ইংরেজ রাজত্বের আনুষঙ্গিক ফল। ভাষায় নানাত্ব এর প্রধান কারণ নয়। ইউরোপের নানা ভাষার সাহিত্যের প্রধান সৃষ্টিগুলির সঙ্গে ইউরোপের প্রত্যেক দেশের শিক্ষিত সমাজের পরিচয় হয়। কারণ এ সমাজের একটা বড় অংশ নিজের মাতৃভাষা ছাড়া অন্য দেশের দু’একটি ভাষায় কৃতবিদ্য, এবং অনুবাদের মাধ্যমে এ দেশের সাহিত্য অন্য দেশের শিক্ষিত সাধারণের মধ্যে প্রচার হয়। এই রকম ইংরেজী অনুবাদেই ভারতবর্ষের শিক্ষিত সমাজ ইউরোপের অন্য ভাষার সাহিত্যের কিছু পরিচয় পায়। ইংরেজী ভিন্ন ইউরোপের অন্য কোনও ভাষায় সাহিত্য পড়ার মত কৃতবিদ্যের সংখ্যা আমাদের মধ্যে যৎসামান্য। ভারতবর্ষের এক ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে অন্য ভাষাভাষীদের অপরিচয়ে অবশ্য প্রমাণ হয় যে ইংরেজের রাষ্ট্রশাসন ভারতবর্ষকে এক করেছিল, ভারতবাসীদের এক করে নাই। কিন্তু এ অপরিচয়ের মূল কারণ ভারতীয় আধুনিক সাহিত্যগুলির শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদার অভাব। যে শ্রেষ্ঠত্বের আকর্ষণে ভিন্ন ভাষার সাহিত্য পড়তে সাহিত্যরসিক পাঠকের মন উন্মুখ হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম যুগ থেকে রবীন্দ্রনাথের শেষ যুগ পর্যন্ত প্রায় এক-শ বছর বাংলা সাহিত্য প্রতিভাবান কবি ও সাহিত্যিকদের দানে পুষ্ট হয়ে আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যগুলির মধ্যে কিছু মর্যাদা পেয়েছে। তার ফলে এ সাহিত্যের প্রভাব ভারতীয় অন্যান্য ভাষার আধুনিক সাহিত্যের উপর কিছু পড়েছে। এ সব ভাষার লেখকদের উপর বাঙালী কবি ও সাহিত্যিকদের ভাব ও প্রকাশভঙ্গীর কিছু প্রভাব এসেছে। কিন্তু সে প্রভাব মোটের উপর লেখকদের মধ্যেই আবদ্ধ। অন্য ভাষাভাষী শিক্ষিত সমাজের একটা ছোট অংশেরও বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় আছে এ কথা বলা চলে না। বাংলা সাহিত্যে যে প্রতিষ্ঠা এখনও পায় নাই যাতে ইংরেজ আমলে সেটা সম্ভব হত। এ কথা কল্পনা করা যায় না যে কেবলমাত্র ভিন্ন ভাষার সাহিত্য পড়ার ঔৎসুক্যে মারাঠি কি তামিল সাহিত্যরসিক ফরাসী কি জার্মান না শিখে বাংলা ভাষা শিখতে উৎসুক হবে।
আমাদের বাঙালীদের ভারতবর্ষের অন্য ভাষার আধুনিক সাহিত্যের যে অজ্ঞতা, কোনও সন্দেহ নেই যে ভারতবর্ষময় এ ভাষাগোষ্ঠীর শিক্ষিত সমাজ অন্য সব ভাষার সাহিত্য সম্বন্ধে সমান অজ্ঞ। ভারতবর্ষের প্রত্যেক ভাষাভাষী জনসংখ্যার অতি সামান্য অংশ শিক্ষিত এবং তার মধ্যে যারা সাহিত্য পড়ে আনন্দ পায়, ও সাহিত্য পড়ে তাদের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও এ অজ্ঞতার বড় কারণ এসব আধুনিক সাহিত্যের মূল বোধের অভাব। এই জ্ঞান যে ওদের মধ্যে এমন কিছু নেই যার সাহিত্যিক শ্রেষ্ঠত্ব ভিন্ন ভাষা শিক্ষার পরিশ্রমকে সফল করবে। অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের বাহক ভারতীয় কোনও ভাষা শিখলে পরিশ্রম অনেক বেশী সার্থক হবে। বিশুদ্ধ সাহিত্যিক বিচারে এ মনোভাবের দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু আজকের ভারতবর্ষে কেবলমাত্র সাহিত্যিক মাপকাঠিতে এ অজ্ঞতার ভালমন্দের পরিমাণ সম্ভব নয়।
// ৩ //
ইংরেজের শাসনে ভারতবর্ষের ঐক্য বাইরের চাপে ঐক্য। এক শাসনযন্ত্রে শাসিত জনগণের বাহ্যিক ঐক্য। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশের লোকদের অন্তরের ঐক্য নয়। বিদেশির অধীনতা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও কর্মোদ্যম ভারতবাসীর মনে রাষ্ট্রচেতনার ঐক্য এনেছিল। কিন্তু সে ঐক্যের চেতনা মনের অল্প অংশব্যাপী; বিশেষ প্রয়োজনের তাগিদে তার আবির্ভাব। সে প্রয়োজন আজ দূর হয়েছে। পূর্বে পশ্চিমে খণ্ডাংশ ছিন্ন হলেও মহাদেশের মত প্রকাণ্ড দেশে আমরা এক মহারাষ্ট্র গড়ে তুলেছি। বাইরের চাপে নয়, নিজেদের প্রয়োজনে ও ইচ্ছায়। এ মহাদেশের ঐক্য কী কেবল হবে রাষ্ট্রীয় ঐক্য, শাসন সৌকর্যের ঐক্য — যা ইংরেজের আমলে ছিল। প্রভেদ কি কেবল এইমাত্র হবে যে তখন শাসনযন্ত্রটা ছিল বিদেশীর হাতে, এখন থাকবে স্বদেশীর হাতে? যদি তাই ঘটে তবে ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটা প্রকাণ্ড সম্ভাবনাকে আমরা ব্যর্থ করব। সে সম্ভাবনা হচ্ছে বহুজাতির মিলনক্ষেত্র এই মহাদেশে জাতিতে জাতিতে যে মিল তা রাষ্ট্রীয় ও সাংসারিক প্রয়োজনের গণ্ডী ছাপিয়ে অন্তরের ঐক্যে পরিণত হবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ স্থাপন হবে, এক রাষ্ট্রের নাগরিক বলে কেবল নাগরিক মৈত্রী নয়।
এ সম্ভাবনা সিদ্ধির প্রথম প্রয়োজন অন্য জাতির লোকের মনকে জানা। তার আচার ব্যবহার কাজকর্মের বাহ্যিক রূপটি মাত্র নয়, এই রূপের মধ্যে তার যে মন রয়েছে সেই মনকে জানা। বহু বিচিত্রের মধ্যে মানুষের একই মনের খেলা। নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে মানুষ যখন অন্য মনের পরিচয় পায় তখন তার গভীর আনন্দ অপরিচয়ের পরিবেশে চিরপরিচিত মনকে আবিষ্কারের বিস্ময়ের আনন্দ। মানুষের মনের সঙ্গে এই পরিচয়ই মানুষের সঙ্গে নিবিড় পরিচয়। স্বীকার করতে হবে এ অর্থে বাঙালীর সঙ্গে ইংরেজের যে পরিচয়, পাঞ্জাবী কি রাজস্থানী কি বিহারীর সঙ্গে তার সে পরিচয় নেই। কারণ ইংরেজের মনকে আমরা জেনেছি তার সাহিত্যের মধ্যে। পাঞ্জাবী কি রাজস্থানী, কি বিহারীর মনকে তাদের সাহিত্যের মধ্যে দেখতে চেষ্টা করিনি। অন্য জাতির মনের এ পরিচয় , তাদের মধ্যে বসবাস না করলে, তাদের সাহিত্য ছাড়া আর কিছুতে পাওয়া যায় না। জাতির সাহিত্য জাতির মনের দর্পণ।
অসাহিত্যিক প্রয়োজনে ভাষা ও সাহিত্যের চর্চার আহ্বান কিছুটা অদ্ভুত। কিন্তু ভারতবর্ষের প্রত্যেক ভাষাগোষ্ঠীর শিক্ষিত সমাজ এ আহ্বানে সাড়া না দিলে ভারতবর্ষ থাকবে এক রাষ্ট্রের কাঠামে বাঁধা মহারাষ্ট্র মাত্র; সে কাঠামোর মধ্যে পরিপূর্ণ জীবনের প্রতিমা প্রতিষ্ঠা হবে না। যে আবাহন মন্ত্রে এ প্রতিমার প্রাণপ্রতিষ্ঠা সম্ভব সে হচ্ছে ভারতবর্ষের জাতিগুলির পরস্পরকে যথার্থ করে জানার আহ্বান। পরস্পরের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় এ জানার একমাত্র উপায়, অন্য সহজ ও সরল পথ নেই। সেই কারণে ভারতীয় অন্য ভাষার সাহিত্য এমন সাহিত্যিক শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে কিনা যাতে তার সঙ্গে পরিচয়ের পরিশ্রম সহ্য করা যায়, এ বিচার বুদ্ধিকে সরিয়ে রাখতে হবে। মাতৃভাষার সাহিত্যে অনেক অন্য ভাষার সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব না থাকলেও আমাদের যেমন মমত্ববোধ, সেই মমত্ববোধের কিছুটা আনতে হবে ভারতীয় অন্য ভাষার সাহিত্যের উপর। এ কাজ খুব সহজ নয়। কিন্তু ভারতবর্ষ ও ভারতবাসীকে যদি নিজের মনে করার সাধনা করি, তবে এ কাজ খুব কঠিনও নয়। প্রতি ভাষাগোষ্ঠীর শিক্ষিত সমাজের কিছু লোক নিজের রুচি অনুসারে অন্য ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা আয়ত্ব করে তার সাহিত্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়ে পরিচিত হবে। প্রতি ভাষার যা শ্রেষ্ঠ সাহিত্য, প্রাচীন ও আধুনিক, অনুবাদের মাধ্যমে অন্য ভাষাভাষী তার সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ দিতে হবে। এই আদান-প্রদান সাহিত্যের দিক থেকেও কখনও সম্পূর্ণ নিস্ফল হবে না। এতে প্রত্যেক সাহিত্যের সাহিত্যিকদের দৃষ্টির প্রসার বাড়াবে। ভারতবর্ষের বহু জনসংঘের বৈচিত্র্য প্রত্যেক সাহিত্যে প্রতিফলিত হবে।
// ৪ //
এই সাহিত্যিক আদান প্রদানের প্রয়োজনের একটা দিক আছে, যার কথা বলতে সংকোচ বোধ করছি। কিন্তু না বললে সত্যও গোপন হয়, বক্তব্যও অসম্পূর্ণ থাকে। ভারতবর্ষ যখন দীর্ঘদিনের বিদেশী শাসনমুক্ত হল তখন এ আশা স্বাভাবিক যে এ মহাদেশের বিভিন্ন অংশগুলি, যার পূর্ব নাম ছিল প্রদেশ এখন হয়েছে রাষ্ট্র আগের চেয়ে পরস্পরের নিকটে এসে নবীন ভারতরাষ্ট্রকে সংহতি দেবে। কিন্তু অনেক স্বাভাবিক ঘটনা ঘটে না। যে সব কারণ থেকে স্বাভাবিক পরিণতির অনুমান করা যায় না, ঘটনা যখন ঘটে তখন দেখা যায় এমন সব কারণ যাদের নগণ্য মনে করে হিসাবে ধরা হয়নি। তারাই প্রবল হয়ে কল্পিত স্বাভাবিক ঘটতে দেয় না। অচিন্তিত আর কিছুকে ঘটায়। দেখা যাচ্ছে স্বাধীন ভারতের আদিপর্বে রাজ্যগুলি পরস্পরের কাছে না এসে দূরে সরছে। তারা নিজের অস্তিত্বে এমন মশগুল যে, যে মহীরূহের তারা বড় ছোট শাখা, যা থেকে রস না আসলে তারা শুকিয়ে কাঠ হবে, তার সত্তা ও সজীবতার কথা মনে ঝাপসা হয়ে এসেছে। আপাত প্রেয়ের ‘মাইওপিক’ দৃষ্টি চরম শ্রেয়ের বৃহৎ পর্যন্ত প্রসারিত হচ্ছে না। রাজ্যগুলির রাজশক্তি যে সব পলিটিশ্যানদের হাতে এসে পড়েছে তাদের অনেকের মনের গতি এই সংকীর্ণ পথ ধরে চলেছে। নিজের রাজ্যের নাগরিকদের সুখ সাচ্ছন্দ্যের ছবি কিছু দেখাতে পারলেই তাদের রাষ্ট্রনীতি সার্থক হল। সে নীতির ফল অন্য রাষ্ট্রের লোকের সুখদুঃখের উপর কেমন হবে সে চিন্তার প্রয়োজন নেই। ভারতরাষ্ট্রের কামধেনুর দুধ যতটা সম্ভব নিজের রাজ্যে টানা রাষ্ট্রবুদ্ধির লক্ষণ। সে দুধের জোগানি কিসে বাড়বে সে চিন্তা রাজ্যের রাষ্ট্রনায়কের প্র্যাক্টিকাল পলিটিক্স নয়।
এমন অবস্টহার উদ্ভবের মূল খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। রাজনীতিকদের চাই রাষ্ট্রক্ষমতা আয়ত্তে রাখা। গণতন্ত্রের যুগে সে ক্ষমতার উৎস জনগণের অনুমোদন। এ অনুমোদন পেতে জনগণের মনকে আকর্ষণ করতে হয়। আকর্ষণ নীচে থেকে করা যায়, উপর থেকেও যায়। প্রথমটি সহজ, দ্বিতীয়টি কঠিন। ঘরোয়া স্বার্থের প্রলোভনে মানুশকে নীচে টেনে নামিয়ে জনতার জনহিতৈষী নেতা হওয়া কঠিন নয়। সে প্রলোভনের সঙ্গে যদি প্রতিবেশীর উপর ঈর্ষা ও বিদ্বেষ কিছু মেশানো যায় তবে আকর্ষণ বারে দশগুণ। কারণ মানুষের মনের আদিম পশুটি তাতে জেগে ওঠে। যে কৌশলী পলিটিশ্যান সাফল্যের সঙ্গে এ কাজ পারেন তিনি কাজের লোক, বস্তুতান্ত্রিক নেতা। তাঁর হাতে রাজ্যের জনগণের স্বার্থ নির্ভয়। মানুষকে সংকীর্ণ স্বার্থের গর্ত থেকে উপরে টেনে টোলাই কঠিন। কারণ বস্তুর মতো মানুষের মনের সহজ গতিও নীচের দিকে। মানুষকে উপরে তুলে তাদের শুভবুদ্ধি জাগাতে পারেন এ রকম রাষ্ট্রনেতা সব সময় দুর্লভ। অপরিস্ফূট রাষ্ট্রচৈতন্য আমাদের নিরক্ষর গণতন্ত্রে সে নেতৃত্বের স্থায়ী সাফল্যেও সন্দেহ আছে। সুতরাং আপাততঃ কিছুদিন চলতে থাকবে আমাদের রাজ্যগুলিতে রাষ্ট্রনেতৃত্বের বিকট ব্যভিচার। পলিটিশ্যানরা প্রলোভনের ঢালু পথেই লোকের মন টেনে সহজে নিজেদের রাষ্ট্র ক্ষমতা বহাল রাখতে চাইবে। এই নিদারুণ রোগের কিছু প্রতিষেধক ভারতবর্ষের নানা ভাষার সাহিত্যগুলির সকল ভাষাভাষীর মধ্যে প্রচার। রাজনীতি যাদের দূরে ঠেলেছে, সাহিত্যের মানবতার আকর্ষণ তাদের কাছে টানবে। পলিটিশ্যানেরা স্থূল স্বার্থবুদ্ধির মোটা শিকলে জাতি থেকে জাতিকে দূরে টেনে রাখছে। সাহিত্যের সোনার সূতোয় তাদের এক্ত্র গাঁথতে হবে। সাহিত্যের এই শক্তি স্থূলদৃষ্টিতে দুর্বল। কিন্তু পরিণামে এর ফল স্থায়ী ও ব্যাপক। কারণ এর কাজ মানুষের মনের উপর যে মন সফল গতি ও সমস্ত কাজের মূলাধার। মানুষের মন টলাতে সাহিত্যের শক্তি পলিটিশ্যানদের অজ্ঞাত নয়। সেজন্য তাদের ‘মহতী বিনষ্টি’র অভিযানকে মঙ্গলের মূর্তিতে প্রকাশ করতে তারাও সাহিত্যের শরণ নেবেন। কোনও ভাসাতেই এ প্রচারের কলমধারীর অভাব হবে না। কিন্তু কোনও যথার্থ সাহিত্যিক পলিটিশ্যানদের এ ঢক্কা বহনে রাজী হবেন না মনে এ ভরসা রাখব।
// ৫ //
বলেছি আজ ভারতবর্ষের প্রয়োজন তার নানা ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে অপর ভাষাগোষ্ঠীর সাহিত্যরসিকদের পরিচয়। এ প্রস্তাব করতে এই জন্যই সাহসী হয়েছি যে এতে সাহিত্য প্রতিভা ও সাহিত্য সৃষ্টির দাবী নেই। ভারতবর্ষের শিক্ষিত সাধারণের মনে সমস্ত ভারতবাসীর উপর মমত্ববোধেই এই সাহিত্যিক আদান প্রদান সম্ভব হতে পারে। করতব্য বুদ্ধির একটু আমেজও এতে আছে। কিন্তু মমত্ববোধ ও কর্তব্যবুদ্ধির যোগে অপরের ভাষা শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার যে প্রয়াস তা কখনও স্থায়ী হতে পারে না, যদি সে ভাষার সাহিত্য সাহিত্যিক আনন্দ না জোগায়, কেবল কর্তব্য পালনের আনন্দ নয়। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত এ প্রস্তাবের চরম ফল ফলবে না, যদি ভারতীয় ভাষার আধুনিক সাহিত্যগুলিতে বড় সাহিত্যিক সৃষ্টির দেখা না পাওয়া যায়। শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের জন্ম বড় প্রতিভার মনে। প্রয়োজনের টানে প্রতিভার জন্ম হয় না, ফরমাশের খাতিরে সাহিত্যের সৃষ্টি হয় না। যা হয় তা ফরমায়েশী সাহিত্য, অর্থাৎ বিজ্ঞাপন। তেমনধারা সাহিত্য, ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট যেমন আর্ট।
বড় সাহিত্যের সৃষ্টি হয় প্রতিভাশালী সাহিত্যিকের সৃষ্টির আনন্দে। দাবির স্থান সেখানে নেই, কর্তব্যবুদ্ধি অবান্তর। তবে প্রতিভার পরিণতিতে সামাজিক পরিবেশ অনুকূল কি প্রতিকূল দুই-ই হতে পারে। জাতির মধ্যে প্রতিভার জন্ম বিধাতার শ্রেষ্ঠ দান। শ্রদ্ধার সঙ্গে সে দান গ্রহণ করতে হয়। যে জাতির মন সাহিত্যকে চরম মর্যাদা দেয় না বিধাতার এ দান কে সে প্রত্যাখান করে। সেখানে যদি ক্বচিৎ সাহিত্য প্রতিভার জন্ম হয় প্রতিকূল পরিবেশে সে প্রতিভা স্ফূর্তি পায় না। ভারতীয় ভাষার সাহিত্যগুলির শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্র তৈরী হবে এই মর্যাদাবোধে। প্রতিভার জন্মের জন্য অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু বড় প্রতিভার কখনও আবির্ভাব হয় না, তার জন্য যদি জাতির ঔৎসুক্য না থাকে, ক্ষেত্র যদি প্রস্তুত না থাকে। কারণ সেখানে প্রতিভার জন্ম হলেও বিকাশ হবে না, তার শক্তি অজ্ঞাত থেকে যাবে।
সাহিত্য সৃষ্টির মর্যাদা অত্যাধুনিক্কালে ভারতবর্ষের মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। যেমন পৃথিবীর অন্য সব দেশে তেমনি ভারতবর্ষে আজ আমরা কর্মব্যস্ত। অন্নবস্ত্রের কষ্টে ও চিন্তায় জাতি প্রপীড়িত। যেমন অন্যদেশে তেমনি ভারতবর্ষেও আমরা অনেকে বলেছি সুখের দিনের শেষে আমাদের দুঃখের দিন এসেছে। এ দুঃখের দিনের একটা প্রধান কারণ যাদের মুখে অন্ন কি পরনের কাপড় আছে কিনা সে খোঁজ নেওয়ার সুখী লোকের প্রয়োজন হত না, সেই অন্নবস্ত্রহীনের দল আজ আর কাকেও নিশ্চিন্তে থাকতে দিচ্ছে না। তাদের দাবী মেটাবার চেষ্টা না করে উপায় নেই। এই চেষ্টায় পূর্বতন সুখের পৃথিবীর সমাজ ও ধনতন্ত্র ভেঙ্গে পড়েছে। চারদিকে নূতন সৃষ্টির বেদনা। কিন্তু অন্নবস্ত্রের দাবীই কী এদের চরম দাবী? সে দাবী যখন মিটবে তাদের অন্তরাত্মা তখন জিজ্ঞাসা করবে না অতঃ কিম? যেমন আজকের সভ্যসজ্জনেরা শুধু শরীরের দাবী মেটানোকে পূর্ণ সুখের অবস্থা মনে করেন না, সভ্যতার যে সব অশরীরী সৃষ্টির আনন্দ না হলে তাদের জীবন উদ্দেশ্যহীন ও অপূর্ণ মনে হয়, তার দাবীও আজকের অন্নবস্ত্রের কাঙালেরা পরশু করবে। সভ্যতার যে সব সৃষ্টি সাংসারিক কাজে লাগে না, কিন্তু মানুষের যা অমূল্য সম্পদ, তার দাবী যদি তারা না করতে শেখে তবে এই চিরবঞ্চিতরা আবার বঞ্চিত হবে। ইতিমধ্যে তাদের অন্নবস্ত্র জোগাবার ব্যবস্থায় সভ্যতার অমৃতভাণ্ডগুলি যেন আমরা না ভাঙ্গি। মানুষের সাহিত্য সেই অমৃতভাণ্ডের একটি। কোনও কর্মব্যস্ততা একে উপেক্ষার হেতু নয়। এ উপেক্ষা তারাই করে শরীর ছাড়িয়ে মনের কোঠায় যারা কখনও পা দেয় নাই।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।