31 Mar

স্রোতের উল্টো দিকে হাঁটতেন তিনি

লিখেছেন:কিন্নর রায়


[অমিয়ভূষণ মজুমদার যত বড়মাপের কথাশিল্পী,ঠিক ততখানিই অবহেলিত বলে অভিযোগ।অমিয়ভূষণ মজুমদার ছিলেন আদ্যপ্রান্ত উত্তরবঙ্গের মানুষ।সারাজীবন লিটল ম্যাগাজিনে লিখে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের এই রত্ন সাহিত্যের টানে কখনও স্বভূমিচ্যুত হননি।ধারাবাহিক অবহেলার শিকার এই সাহিত্যিককে নিয়েই লিখেছেন আর এক সাহিত্যিক কিন্নর রায়।পূর্ব প্রকাশিত এই লেখাটি সংগ্রহ করে ফের প্রকাশ করল ‘গল্পের সময়’]  

নিজের গদ্যভঙ্গি, শব্দচয়ন, বিষয় নির্বাচনে অমিয়ভূষণ মজুমদার ছিলেন সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক স্রোতের উল্টোদিকে। সারাজীবন তিনি এই গড্ডালিকার বিপরীতে সাঁতার দিয়েছেন। কলকাতাকেন্দ্রিক, বিগ হাউসের সার্টিফিকেট পাওয়া পণ্যসাহিত্যের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আজীবন অবিচল। লেখা, জীবনচর্চা, ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা সমেত নিজস্ব আধুনিকতা, সবার ওপর সমস্ত সময়কে নস্যাৎ ক্করা তীব্র অহংকার  — সব মিলিয়ে তিনি একজন ‘মিথ’-এর মানুষ। নিজস্ব প্রত্যাখানের ভাষায় তিনি এই সম্মান অর্জন করেছিলেন।

মনে পড়ছে ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে (সম্ভবত ২১ নভেম্বর, মঙ্গলবার, আমার দিনলিপি তেমনই বলছে) অমিয়বাবু দীর্ঘক্ষণ তাঁর কথা সাজিয়েছিলেন, জীবনতারা ভবনে, সাহিত্য আকাদেমির অডিটোরিয়ামে। নিজের স্মৃতি, সত্তা, লেখালেখি নিয়ে বলতে বলতে তিনি বার বার ফিরে গেছেন জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর ট্রমা প্রসঙ্গে।

 

সেখানে প্রায় শুরুতেই তিনি বলেছিলেন —

১। ঘুম না এলে বিষবড়ি খাই।

২। ফ্রয়েডের স্বপ্ন তত্ত্ব কাজ করে মাথার ভেতর।

৩। ঘুমের মধ্যে পলায়ন যেন মাতৃগর্ভে ফিরে যাওয়া।

৪। সংস্কৃতে স্বপ্নকে কী ঘুম বলা হয়?

৫। ট্রমা। ট্রমা।

তাঁর সেই দীর্ঘ কথন থেকে জানতে পারি নিজের কন্যার মৃত্যুর সময়, নিকট আত্মীয়ার মৃত্যুর সময় তাঁর বিছানার পাশে থাকার অভিজ্ঞতা। নিজের মায়ের সঙ্গে লাভ হেট সম্পর্ক। আর ট্রমা ও ফ্রাস্টেশনের পাশাপাশি চলার ছবি।

তাঁর নায়িকারা অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী। আর সেদিন তাঁর কথা থেকে উঠে আসে, তাঁর মা দিদিমা স্ত্রীর গলায় আমেরিকান ডায়মন্ড নয়, ছিল পোখরাজের মালা। মা ভাই বোনেদের ছেড়ে ‘ট্রপিক্যাল স্কুল অফ মেডিসিন’-এ তিন দিন থাকার স্মৃতি। ডাক্তার কর্নেল নেপিয়ার তাঁকে অসম্ভব ভালবাসতেন।

পাকসিতে তাঁর স্কুল ছিল। মা বলতেন, সাহিত্য না পড়লে লেখাপড়া হয় না। বাবা কাছারি ঘরে বসতেন। কমবয়সী অমিয়ভূষণ ভাবেন তাঁকে কে বেশি ভালবাসেন? দিদিমা, না মা? বাবা নাকি মামা? এসব নিয়েও ট্রমা। এরকম নানা কথা।

সেই ট্রমার দীর্ঘ ছায়া কী তাঁর গল্প উপন্যাসকে প্রভাবিত করেছিল? গদ্য রীতি, বাক্য গঠনে তিনি খানিকটা বঙ্কিম অনুসারী। কোথাও কমলকুমারও হয়তো তাঁকে প্রভাবিত করেছেন। অন্তত ফ্রাইডে আইল্যান্ড পর্বে। কেউ কেউ বলেন, তাঁর গদ্যে চসারের প্রভাব। তবু তিনি অনন্য।

ক্লাস এইটে ম্যালেরিয়ার কষ্ট। ক্লাস টেনে ওঠার পর আবার জ্বর। তখন ইসমোফিল বড়ি খাওয়া, ডি গুপ্তর টনিক। ১৯৩৭-৩৮-এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। স্কুল শিক্ষকদের তখন বেতন ৪০-৪৫ টাকা। কলেজ ৪৫-৫০। প্রিন্সিপল পান ৬০ টাকা। প্রাইভেট স্কুলের মাস্টারমশাইরা পান ১৫ টাকা।

সেই কথাবার্তায় অমিয়ভূষণ বারবার বলেছিলেন, ‘মৃত্যু ছাড়া আমার আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।’

তাঁর উচ্চারণে ফুটে উঠেছিল পাইকপাড়া থেকে চটি ফটফটিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে আসার কথা। পরে কাকা নিয়ে এলেন মেসে। তাঁর সঙ্গে মেসে থাকেন ১৯/এ হ্যারিসন রোডে। তখন বাজারের রুই মাছ দু’আনা সের। ঘিয়ের সের বারো আনা। গ্লেজ কিডের গ্রিসিয়ান পরতেন পায়ে। একজোড়া সাড়ে তিন টাকা। একজন ছুতোর মিস্ত্রি দিনে দু’আনা মজুরি পান।

কলকাতায় থাকতে পুরনো বই কিনতেন। কাকা বললেন, ডাকঘর, রেলে চাকরির পরীক্ষা দাও। অমিয়বাবুর তৃতীয় ভাই অরুণ ততদিনে পাসকোর্সে ভর্তি হয়েছেন।

এই সমস্ত পর্বেই তাঁর ট্রমা। ট্রমা। ট্রমার ঘোর। আবার ট্রমাকে অতিক্রম করা।

এমনকি কোচবিহারের ডাক বিভাগের কেরানির চাকরি নিয়ে গিয়ে তার সৌন্দর্যের মধ্যেও ট্রমা। সেখানে সকালের জলখাবারে লুচি। বিকেলে রাজভোগ। মেসে আট টাকা দিতে হয়। মাসে চারটে ফিস্ট। তাঁর বিবাহ হয়েছিল ২১ বছর বয়সে। ষোড়শী স্ত্রী। বাবা-মা কর্মচারীদের ওপর দেশের বাড়ির ভার দিয়ে পাখাসিতে চলে এলেন। ঝোলা কাঁধে প্রবলভাবে ইউনিয়নের কাজ করেন অমিয়ভূষণ। সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে থাকেন বাংলা ভাষা কি তেজিয়ান টাটকা সতেজ হতে পারে না?

পাকসিতে ডাক কেরানির বাড়ি ভাড়া থাকেন। সেই ডাক-কেরানি আবার টি বি-তে মারা গেছেন।

অমিয়বাবুর কথায় পাকসি অনেকটা কোচবিহারের মতো। পাশের পাঁচিলের গায়ে শ্বেতকরবী গাছ। সেখানে ফুলের বাহার। ওঁর স্ত্রী পালকিতে আসছেন। পাশে বাবা হাঁটতে হাঁটতে। সঙ্গে চাকরের হাতে অন্য জিনিসপত্র। বয়ামে ঘানির তেল। একেবারে ‘রাজনগর’ গড়শ্রীখণ্ড’র পাতা থেকে উঠে আসা ছবি।

সরু সরু হাতে ওপেল বসানো আংটি। পায়রার ডিম রঙের ঢাকাই শাড়ি, পরিবারের এক নিকট আত্মীয়া বিয়ের পর এসেছেন। তাঁকে দেখে ট্রমা। অথচ ভাল গদ্য পড়লে সেই ট্রমা কেটে যায়। স্ত্রী রান্নাবান্না করেন। সেজোভাই অরুণ ‘পূর্বাশা’ আনে। অমিয়বাবু লেখেন আর ছেঁড়েন। দূরে ছুঁড়ে দেন খবরের কাগজ আর তার ভাষা। স্ত্রী বললেন, লেখ আর ছিঁড়ে ফেল কেন? কলকাতায় পাঠাও। তিনি অমিয়বাবুকে পড়তে বললেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ধূর্জটিপ্রসাদ।

লিখতে লিখতে ট্রমা আসে। আসে স্বপ্ন। আশ্বিনের শেষ দিকে গল্প বেরল ‘পূর্বাশা’য়। কাছেই ভাঙ্গা নীলকুঠি। আবার ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয়। ম্যালেরিয়ার ভয়ে খেতে হয় পোর্ট ব্র্যান্ডের ব্র্যান্ডি আর কুইনিন।

এরকম অনেক কথা। টুকরো স্মৃতির ঝিলিক। সত্যিই তো তাঁর সেদিন মৃত্যু ছাড়া কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। তাই তো খুব সুন্দর করে সেদিন তিনি আবৃত্তি করতে পেরেছিলেন, ‘না মৃত্যু না শঙ্কা…’

এরপর অমিয়ভূষণকে আবার এক সন্ধ্যায় পাই কলেজ স্ট্রিটের এক গেস্ট হাউসে। ‘রক্তকরবী’ সম্পাদক প্রদীপ ভট্টাচার্য, কথাসাহিত্যিক ভগীরথ মিশ্র — সবাই মিলে জমিয়ে বসি। অমিয়বাবুর ছেলেও ছিলেন। একথা ওকথার পর ঐতিহাসিক উপন্যাস নিয়ে কথা বলতে বলতে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন অমিয়ভূষণ। খুব বিক্রি হওয়া ইতিহাসের মোড়কঅলা একটি প্রেমের কাহিনী বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, পড়েন কেন এইসব ছাইভস্ম লেখা! আরও নানা কথা ঘুরে ফিরে এসেছে। ওঁর সাহিত্য, লেখালেখি। আর অবশ্যই ট্রমার কথা।

পরে ১৯৯৮ সালের মালদা বইমেলায় গিয়ে এক বিকেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করি কথা সাহিত্যিক অভিজিৎ সেন আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন তিনিও ওখানে। ছিলেন কথা সাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায়ও। সে এক তুমুল আড্ডা। অমিয়ভূষণ তখন ওঁর মেয়ের বাড়ি। পা ভেঙেছে। কিন্তু মানসিক দৃঢ়তা, অহঙ্কারে তখনও তিনি চাঁদ বেনে বা মধু সাধুখাঁর উত্তরসূরী।

টুকটুকে ফর্সা রঙ। গালের হালকা হালকা পাকা দাড়িতে পোড়া তামাকের চিহ্ন খানিকটা দাগ ফেলেছে। মুখের রেখায় উচ্চারণে বরেন্দ্রভূমির আত্মবিশ্বাস, অহমিকা। শহরকেন্দ্রিক, বড় বাণিজ্যিক কাগজকে ঘিরে লতিয়ে ওঠা পেলব লেখালেখির বিরুদ্ধে স্থির উচ্চারণ। সেই সব কথা শুনে সাহস বাড়ে। বিশ্বাস জাগে। আর এই আত্মম্ভরিতাই হয়তো তাঁকে প্রত্যাখানের সাহস জুগিয়েছে।

দীর্ঘ সেই আড্ডায়, কথোপকথনে অভিজিৎ সেন, সাধন চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও ছিলেন ‘দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকার সম্পাদক আফিফক ফুয়াদ।, তরুণ কথাকার শরদিন্দু সাহা।

নিজের প্রতি তাঁর ছিল তীব্র আত্মবিশ্বাস। নিদারুণ অবজ্ঞা আর অহঙ্কারে কোনও কিছু তোয়াক্কা না করে তিনি ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারতেন হালকা, বিনোদনী লেখালেখিকে। কলকাতার নষ্ট মঞ্চ মায়া তাঁর সর্বনাশা লোভ দেখানো ডাকিনি মন্ত্রে তাঁকে একেবারেই সম্মোহিত করতে পারেনি। সব নস্যাৎ আর তুচ্ছ করে শুধু লিখনশৈলী, বিষয় ও শিল্পের সৌন্দর্যে আর তাঁর অহঙ্কারে তিনি ছিলেন প্রায় একক মহীরুহ। তাঁর চলে যাওয়া যারা স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতরাতে চায়, তাদের কাছে এক বড় আঘাত। কিন্তু জাগতিক নিয়মে এই গন্তব্য তো অবধারিত। তাই মেনে নিতে হয়। তারপর তাঁর জীবনযাপন, লেখালেখির শ্লাঘা, প্রত্যাখান, প্রত্যাখানের শিল্পভাষাকে সঙ্গী করেই ঝাঁপ দেয়া স্রোতের উল্টোদিকে। সাঁতরে চলা।

যাঁরা প্রতিকূল বাতাসে ‘বদর বদর’ বলে নৌকো ভাসান সময় তাঁদেরই শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখে, এ বিশ্বাস ফিরে আসে অমিয়ভূষণ মজুমদারের প্রত্যাখানে শিল্পভাষার সঙ্গী হলে।

 

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ