যারা বই পড়তে ভালোবাসে, বইয়ের অনেক চরিত্রই তাদের কাছে রক্তমাংসের মানুষ হয়ে ওঠে। রাস্তায় চলার পথে অনেককে দেখলেই মনে হয় – ” দ্যাখ, একদম অমুক চরিত্রের মত ” ; কিংবা কাউকে উপহাস করে আমরা বলি – ” এই হাঁদা শোন ” বা ” হাঁদা নাকি! মাথায় গোবর পোরা আছে? ” আবার কেউ মোটা হলেই পাড়ায় তার নাম হয়ে যায় ‘ভোঁদা’। এইসব অভিজ্ঞতাই মানুষের মনে চিরনবীন কমিকস চরিত্রদের অমলিন করে রেখেছে।
হাঁদা – ভোঁদা/ একটি মিষ্টি গল্প
দুটো ছেলের দস্যিপনায় পিসেমশাইয়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কে যে তাদের বাবা, কে মা, ‘ কোথায় বাড়ি কেউ জানে না কোন সড়কের মোড়ে। ‘ তবে এইটুকু জানা যায় হাঁদার পুরো নাম হাঁদারাম গড়গড়ি আর ভোঁদার পুরো নাম ভোঁদা পাকরাশী আর তাদের পিসেমশাইয়ের নাম বেচারাম বকশি। ১৯৬২ সালে নারায়ণ দেবনাথের হাত ধরে দেব সাহিত্য কুটীর থেকে প্রকাশিত ‘শুকতারা’ পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ ঘটার পর থেকেই আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের মন জয় করে নিয়েছে। প্রথম দিকে অবশ্য নারায়ণ দেবনাথ হাঁদা – ভোঁদার ইলাস্ট্রেশন একটু অন্য রকম করেছিলেন। তবে ধীরে ধীরে সামনে আসে আমাদের অতি পরিচিত ‘খোলতাই’ মুখের হাঁদা & ভোঁদা।
হাঁদা – ভোঁদাকে সৃষ্টি করার কথা স্রষ্টার মাথায় কিভাবে আসে তা নিয়ে একটি মিষ্টি গল্প আছে। হাওড়ার শিবপুরে নারায়ণ দেবনাথ যে বাড়িতে থাকেন তার কাছেই তাঁর পৈতৃক গয়নার দোকান ছিল। সেখানে তিনি মাঝেমধ্যে বসতেন। সামনের রাস্তায় কয়েকজন ছেলের দুষ্টুমি দেখে খুব মজা পেতেন। তা দেখেই হাঁদা – ভোঁদাকে সৃষ্টি করার কথা ভাবেন নারায়ণ দেবনাথ। প্রথম প্রথম শুধু পেনসিলে আঁকলেও পরে রং-তুলি ব্যবহার করেন স্রষ্টা। এখন অবশ্য রঙিন আকারেও প্রকাশিত হয় হাঁদা – ভোঁদা। হাঁদা – ভোঁদাকে নিয়ে অ্যানিমেশন সিরিজও তৈরী হয়েছে।
হাঁদা বলতেই চোখে ভেসে ওঠে রোগা চেহারার সবজান্তা গোছের ছেলে, আর ভোঁদা মানেই স্থুল, গোবেচারা স্বভাবের ছেলে। কিন্তু হাঁদা যে সত্যি হাঁদা, তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতিটি গল্পের শেষে। অন্যদিকে ভোঁদা চেহারার দিক থেকে একটু বোকাসোকা হলেও আসলে কিন্তু তা নয়। সে তার বুদ্ধি দিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে পরাস্ত করে হাঁদাকে।
হাঁদা – ভোঁদা/ একটু অন্য রকম
আগেই বলা হয়েছে, প্রথমদিকে হাঁদা – ভোঁদার ইলাস্ট্রেশন একটু অন্য রকম ছিল। আমরা হাঁদার চুলের যে স্টাইলের সঙ্গে পরিচিত, তার নাম ‘অ্যালবোট’। তবে প্রথম থেকেই কিন্তু ‘অ্যালবোট’ স্টাইল ছিল না। প্রথম গল্পে (১৩৬৯ শ্রাবণ, ১৯৬২) হাঁদা ছিল আরও রোগা আর চুল ছিল সামনের দিকে পাতা। অন্যদিকে, সাধারণত দেখা যায় ভোঁদার ক্ষেত্রে চুলটা বাঁদিকে একটু স্পাইক করা। প্রথম গল্পে ওটা ছিল ডান দিকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হাঁদা-ভোঁদাকে নিয়ে লেখা প্রথম গল্পের নাম ‘হাঁদা-ভোঁদার জয়’। মোহনবাগান – ইস্টবেঙ্গল ম্যাচকে কেন্দ্র করে এই গল্প। গল্পটি ছিল তিন পাতার। তবে পরবর্তীকালে হাঁদা-ভোঁদাকে নিয়ে লেখা প্রত্যেকটা গল্পের পাতার সংখ্যাই জোড় সংখ্যা।
এর পরের গল্প, ‘হাঁদা-ভোঁদার কালীপূজা’ (১৩৬৯ কার্তিক)। গল্প দুর্লভ এক পাতার। এখানে অবশ্য ভোঁদার চুলের স্টাইল আগের গল্পের মতই। তবে হাঁদার চুল অল্প অল্প ‘অ্যালবোট’ স্টাইল পেতে শুরু করেছে।
তৃতীয় গল্পের নাম ‘হাঁদা-ভোঁদার বারোয়ারী’ (১৩৬৯ আশ্বিন)। এটাও দুর্লভ এক পাতার গল্প। জ্যান্ত দুর্গাকে মূর্তি ভেবে পুজো করাকে কেন্দ্র করেই এই গল্প।
চতুর্থ গল্প ‘হাঁদা-ভোঁদার লেখাপড়া'(১৩৬৯ অগ্রহায়ণ)। এই গল্পেই জানা যায় হাঁদা-ভোঁদার পুরো নাম। হাঁদার পুরো নাম ‘হাঁদারাম গড়গড়ি’ আর ভোঁদার ‘ভোঁদা পাকরাশী’। বেতার মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে কীভাবে ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া যায় তা নিয়েই এই গল্প লিখেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ।
এখানে অবশ্য একটা ব্যাপার আছে। হাঁদা-ভোঁদা যে জন্য বহুল প্রচলিত, সেই খুনসুটি এখানে সম্পূর্ণ অমিল। কোনো গল্পেই হাঁদা-ভোঁদার মধ্যে রেষারেষি নেই।
তাহলে হাঁদা-ভোঁদার মধ্যে রেষারেষি শুরু হল কবে থেকে? সে উত্তরও আছে। একবার ভোঁদা মূল ক্রিকেট দলে চান্স পায় আর হাঁদার জায়গা হয় রিজার্ভ দলে। ১৯৬৩ সাল, পৌষ ১৩৬৯ সংখ্যা। ব্যস, এই প্রথম হাঁদা ভাবতে শুরু করে ভোঁদাকে কীভাবে দল থেকে কায়দা করে সরানো যায়। তবে শেষে অবশ্য হয় উল্টো। নিজের কর্মফলের জন্য দল থেকে বাদ পড়ে হাঁদা। সেই থেকেই দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্বের শুরু।
এর মধ্যে আস্তে আস্তে দুজনের চেহারাও পাল্টাতে শুরু করেছে। হাঁদা ‘অ্যালবোট’ হেয়ার স্টাইল পেয়েছে। তবে ভোঁদার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ১৯৬৪ সালের চৈত্র ১৩৭০ সংখ্যা থেকেই পরিচিত ভোঁদার আবির্ভাব। আর ভোঁদার স্পাইক করা অংশ ডানদিক থেকে বাঁদিকে চলে গেছে।
আরও কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। প্রথম দিকে হাঁদা-ভোঁদা জামা গুঁজে পড়ত না। এই গল্প থেকেই (হাঁদা-ভোঁদার পদযাত্রা, চৈত্র ১৩৭০) হাঁদা-ভোঁদা জামাকাপড় গুঁজে পড়তে শুরু করে। আর একটা বিষয় উল্লেখ্য। এই গল্প থেকেই ভোঁদাকে জামার বদলে গেঞ্জি পড়তে দেখা যায়।
এভাবেই ধীরে ধীরে আমাদের সামনে এল অতি পরিচিত ঝকঝকে চেহারার হাঁদা-ভোঁদা।
অবশ্য এখানেই গল্পের শেষ নয়। যত দিন গেছে, তত বদলেছে হাঁদা-ভোঁদার গল্পের প্রেক্ষাপট। প্রথমদিকে হাঁদা-ভোঁদা ছিল লোকের ভিড়ে মিশে থাকা দুটো ছেলে। পাড়ার আর পাঁচটা ছেলের মতই। তবে গল্পের নায়ককে যে হাজারজনের ভিড়েও চিনে নিতে হবে। তবেই তো সে সবার থেকে আলাদা। মূলত এই ধারণাই পরবর্তীকালের হাঁদা-ভোঁদাকে জন্ম দিয়েছে।
প্রথম দিকেই গল্পগুলো পড়লেই বোঝা যাবে, প্রত্যেকটা গল্পেই হাঁদা-ভোঁদা যে বদমাইশি করেছে, তা নিছকই পাড়ার কয়েকটা চ্যাংড়া ছেলের সস্তা ফচকেমির নমুনা। তবে যত দিন গড়িয়েছে, এই ফচকেমি হয়ে উঠেছে আরও উদ্ভাবনীয়। নিত্যনতুন ফন্দি এসেছে হাঁদা-ভোঁদার মাথায়। নানারকম জিনিসও তৈরী করে ফেলেছে হাঁদা, কখনও ভোঁদাকে বিপদে ফেলার জন্য, তো কখনও পিসেমশাইকে চমকে দেওয়ার জন্য। এছাড়া তোলাবাজ, চোর, ডাকাত – এসব ধরে দেওয়া তো আছেই। এভাবেই সাধারণ মানের ফচকেমি ধীরে ধীরে অসাধারণত্ব লাভ করেছে। বদলেছে প্রেক্ষাপট, পাঠকদের আরও কাছে পৌঁছে গেছে আমাদের সকলের প্রিয় হাঁদা-ভোঁদা।
হাঁদা – ভোঁদা/বন্ধু ভূত
‘ রঘুপতি রাঘব রাজা রাম ‘ প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে যে হাঁদা – ভোঁদারা বহুবার ভূতের খপ্পরে পড়েছে। আর আশ্চর্য ব্যাপার এটাই ; বলা যায় এটা ‘ নারায়ণ দেবনাথের ‘ চোখে ভূত, ভূত মানেই হাত – পা সরু – সরু, গায়ের রঙ হয় কালো না হয় সাদা আর বড় বড় কান। ভূতের কাহিনিগুলোও ভূতের মতই অদ্ভুত। একবার হাঁদা – ভোঁদা একটা ভূতের বাচ্চাকে ওষুধ খাইয়ে বাঁচিয়েছিল। আর বাচ্চাভূতের বাবা খুশি হয়ে হাঁদা – ভোঁদাকে বলে যে সে সব ভূতেদের জানিয়ে দিচ্ছে যে এই দুটি ছেলেকে যেন কোনো ভূত কিছু না করে।
একদিন হাঁদা আর ভোঁদা আড্ডা দিচ্ছে, এমন সময়ে ভোঁদার চেলা বচা সেখানে এল। ভোঁদা তো অবাক – বচা তো এখন বেড়াতে গেছে। তাহলে? বচাও যেন আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। ম্যাজিক করে ইচ্ছামত রকমারি খাবার নিয়ে চলে আসছে। এক সপ্তাহ পর। বচা তো সব শুনে অবাক। তাহলে ও কে?
দুটো গল্পের নামই ‘বন্ধু ভূত’।
ভূঁতের কাঁন্ড আরও কান্ড
সব ভূতই কি হাঁদা-ভোঁদার বন্ধু নাকি? না, একেবারেই নয়। হাঁদা-ভোঁদা বহুবার বিপদেও পড়েছে। তবে শেষপর্যন্ত ‘ কানা ভূত- হাবা ভূত- বোবা ভূত- কিম্ভূত ‘ সবাইকে হারিয়ে ফিরতে পেরেছে। যেমন একবার হাঁদা-ভোঁদা ইলিশ মাছ কিনে ফিরছিল। পথ আটকায় মেছো ভূত আর ওদের জোড়া ইলিশ কেড়ে নিতে যায়। তবে ভোঁদাও কি কম যায় নাকি? ও মোবাইলে মেছো ভূতটার একটা ফটো তুলল আর সেই ফটোটাই ভূতটাকে দেখিয়ে বলল – ” এই দ্যাখো, তোমাকে খাবার জন্য জন্যে এটার ভেতরে আটকে রেখেছি। এবার কী করবে? আমরা তোমাকে খাবো না পালাবে?”
আরও একটা মেছো ভূতের গল্প বলি। এবার পিসেমশাই জোড়া ইলিশ কিনে এনেছেন। সবাই খুব খুশি। পিসিমা সেগুলো ভেজে একটা থালায় রাখছেন। একটা ভূত গন্ধ পেয়ে সেখানে আসে আর হাত লম্বা করে সেগুলো নিয়ে নেয়। পিসিমা তো অবাক। যদি বেড়ালে মাছ নিয়ে যেত তাহলে তো তিনি দেখতে পেতেন। ভোঁদার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। ও পিসিমাকে ফ্রিজে রাখা কিছু মাছ বলল আর নিজে তার ওপর লঙ্কা-গুঁড়ো ছড়িয়ে দিল। এবারও ভূতে মাছ নিয়ে গেল। কিন্তু সত্যিই যা হল! কান থেকে গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছিল ভূতটার। তারপর ঝড়ের আকার ধারণ আর অবশেষে ‘ চাচা আপন প্রাণ বাঁচা ‘।
এর পরের গল্পটা খুবই রোমহর্ষক। ভূতেরদহে পিসেমশাইয়ের বন্ধু বটুকেশ্বর ঢ্যাং খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই হাঁদা-ভোঁদার ভার পড়ল সেখানে গিয়ে তার খোঁজ নিয়ে আসার। প্রথমে ট্রেনে হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছল পোতরং। সেখান থেকে বাসে করে ভূতেরদহে পৌঁছনোর কথা। কিন্তু সেদিনই ধর্মঘট হল। ফলে হাঁদা-ভোঁদাকে হাঁটতে হল পাঁচ মাইল। সন্ধ্যা হয় হয়। হঠাৎ এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। তাঁকে বটুকেশ্বর ঢ্যাংয়ের বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে তিনি একটা বাড়ি দেখিয়ে বললেন – ” ঐ তো বটুক ঢ্যাংয়ের বাড়ি। শুনেছি উনি ঠ্যাং ভেঙে পড়ে আছেন। ”
ঘরে ঢুকল হাঁদা আর ভোঁদা। ভেতরটা অন্ধকার আর ওখানে কে যেন চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে। হাঁদা চাদরটা সরাতে যায়, কিন্তু, কিন্তু এ কে – এ তো ভূত। হাঁদা আর ভোঁদা দৌড়ে পালাতে শুরু করে। পিছন থেকে একটা হাত এগিয়ে আসে ওদের দিয়ে। ওরা শুনতে পায় – ” পাঁলাবি কোঁথায়? এঁখানে আঁরো অঁনেকে আঁছে। তোঁদের পিঁসেমশাই চিঁঠি পাঁওয়ার অাঁগেই আঁমি মঁরে ভূঁত হঁয়েছি। ”
একবার হাঁদা, ভোঁদা আর বচা গ্রামে ঘুরতে গেছে। গ্রামে গিয়ে দেখল যে সেখানে ক্ষেত থেকে পাখি তাড়াতে কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। হাঁদার তো সব সময়ে ফচকেমি। ও কাকতাড়ুয়া সেজে ভোঁদা আর বচাকে ভয় দেখাতে লাগল। তারপর ওদের অবস্থা দেখে মজা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর। কাকতাড়ুয়াটা আবার নড়ছে। হাঁদা একটুও ভয় পেল না। ভোঁদা বা বচা ওকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে হয়তো। কিন্তু পরক্ষণেই ওর শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল ঠাণ্ডা স্রোত। ভোঁদা আর বচা তো ওর পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে কি….
অথ পিসেমশাইয়ের কথা
হাঁদা – ভোঁদার পিসেমশাইয়ের একটা স্টেশনারি দোকান আছে। রকমারি জিনিস – সোফা থেকে শুরু করে ধূমপান করার পাইপ সব পাওয়া যায়। আর মাঝেমাঝে হাঁদা – ভোঁদাকে দোকানে বসিয়ে রেখে দেন। এখানেও মজার মজার ঘটনা ঘটেছে। আর সেটাই তো স্বাভাবিক।
একবার পিসেমশাই হাঁদা – ভোঁদাকে দোকানে বসিয়ে রেখে গেছেন। তখন দোকানে কোনো খদ্দের ছিল না। আর এই সুযোগে হাঁদা – ভোঁদা স্মোকিং পাইপ দিয়ে বাবল ওড়াতে শুরু করল। হঠাৎ অসাবধানে সাবান জল পড়ে গেল তামাকের শিশির ওপর। তখন হাঁদা তামাকের শিশি সরিয়ে দিয়ে শালপাতা গুঁড়ো করে শিশির মধ্যে রেখে দিল। ইতিমধ্যে হাঁদা – ভোঁদা কী করছে দেখার জন্য পিসেমশাই দোকানে এসেছেন বৃদ্ধের ছদ্মবেশে। তিনি হাঁদা – ভোঁদার কাছ থেকে পাইপ চাইলেন। কিন্তু পাইপে জলের ফেনা লেগে আছে। মানিকজোড়ের যুক্তি, তারা নাকি দোকানের সবকিছু পরিষ্কার করছিল। তো যাই হোক, পিসেমশাই পাইপটা মুছে নিলেন। হাঁদা – ভোঁদা শালপাতা গুঁড়ো করে রাখা শিশিটা এগিয়ে দিল। এবার আগুন ধরানোর পালা। কিন্তু আগুন জ্বালাতে গিয়েই সর্বনাশ। আগুন লেগে গেল নকল দাড়িতে। ব্যস, আর ছদ্মবেশে থাকা চলে না। পিসেমশাই এবার নিজেই পাইপে আগুন ধরিয়ে নিলেন। ততক্ষণে বেগতিক বুঝে হাঁদা – ভোঁদা সরে পড়েছে, কারণ ওরা ভালো করেই জানে যে পিসেমশাই নিজেও জানেন না যে তামাকের গন্ধ এরকম হতে পারে!
পিসেমশাই ও তাঁর দোকান নিয়ে আরও মজার মজার গল্প আছে। হাঁদা আর ভোঁদা একদিন দোকানে বসে আছে, এমন সময়ে সেখানে এলেন জিমন্যাস্ট শিক্ষক বোঁদাবাবু। তিনি একটা হুইসল চাইলেন। হাঁদা একটা হুইসল বের করে জোরে বাজিয়ে দেখাল। আর সেই আওয়াজ সহ্য করতে পারলেন না পিসেমশাই। বোঁদাবাবু হুইসল নিলেন না। তিনি অন্যের ব্যবহার করা জিনিস কেনেন না।
এরপরে দোকানে এলেন এক টাকমাথা লোক, ফলস চুলের জন্য। পিসেমশাইয়ের কানের অবস্থা তখন সঙ্গীণ। তিনি শুনলেন ‘ টুল ‘।
ভদ্রলোক রেগেমেগে বললেন, ” আমি চুল চাইছি চুল।একেবারে কালা! ”
” তালা? আগে বলবেন তো। এই যে নিন খুব মজবুত।”
ভদ্রলোক পিসেমশাইয়ের দিকে তালাটা ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। হাঁদা আর ভোঁদা দেখল এই সুযোগ। পিসেমশাই কানে কানে কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। এই সময়ে পেছনের ঘরে ঢুকে কিছু লেমোনেড সাবড়ে আসা যাবে। এই লেমোনেড শব্দটা পিসেমশাই শুনলেন ‘ হিয়ারিং এড ‘। তিনি কানে হিয়ারিং এড লাগিয়ে এলেন, তারপর হাঁদা আর ভোঁদাকে হাতেনাতে ধরে ফেললেন। তারপর দুজনকে বেধড়ক মার, তবে মারার আগে হিয়ারিং এড – টা খুলে রাখলেন পিসেমশাই, যাতে হাঁদা – ভোঁদার চিৎকার তাঁর কানে না আসে।
পিসেমশাই যাচ্ছেন পাখি শিকার করতে, আর সঙ্গে যাচ্ছে হাঁদা তার ছিপি – বন্দুক নিয়ে। এবার সঙ্গে হাঁদা থাকলে একটা না একটা গণ্ডগোল হবেই। সেদিন হাঁদার জন্য পিসেমশাই কোনো পাখিই শিকার করতে পারলেন না। তাই বাধ্য হয়ে তিনি হাঁদাকে শর্ত দিলেন যে বাড়ি ঢুকতে হলে তাকে পাখি শিকার করে আনতে হবে। হাঁদা চিন্তায় পড়ে গেল। তখন তার মাথায় এল – পিসেমশাইয়ের নিজেরই পোষা হাঁস রয়েছে। ও সেগুলোই শিকার করে নিয়ে এল। পিসেমশাইয়ের তা চিনতে ভুল হল না। এবার তাঁর ডায়লগ – ” হতচ্ছাড়া! আমার হাঁস দিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খাবার আগে এই কব্জির গোটাকতক রদ্দা তোর ঘাড়ে লাগাই। ”
পিসেমশাইয়ের গল্প শুরু করলে আর শেষ করা যায় না। হাঁদা বাড়িতে একটা টি-পার্টি দিতে চায়। তবে পিসেমশাইয়ের একটা শর্ত আছে। হাঁদা কোনো মস্তানকে নিমন্ত্রণ করতে পারবে না। পিসেমশাই কয়েকজন ভালো ছেলের নাম করে যেমন – নাড়ুগোপাল, গোলগোবিন্দ। কিন্তু হাঁদা ‘ আলুভাতে ‘ বা ‘ গোলআলু ‘ কাউকেই নিমন্ত্রণ করতে রাজি নয়। হাঁদার পছন্দের অতিথিরা হল পুবপাড়ার পাইপবাগান ক্লাবের গুলিরাম, দক্ষিণপল্লীর বোমারুসংঘের সেক্রেটারি পেটোচরণ আর গুপ্তি সংঘের পরিচালক ভোজালিকুমার। পিসেমশাইয়ের প্রথমে আপত্তি থাকলেও বললেন, ” ঠিক আছে, তাহলে সেই সঙ্গে আমিও কয়েকজন শক্তিশালী অতিথিকে তোর পার্টিতে আসতে বলছি। ”
পার্টির দিন বিকেলে অতিথিরা উপস্থিত। হাঁদার চক্ষু চড়কগাছ। একি! পুলিস! আইন রক্ষকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত। ভোঁদা বলল, ” হাঁদা, মনে হচ্ছে, এবার তোর অতিথিরাই উল্টে আর ভয়ে এদিকে ঘেঁষবে না।”
শুধুই নির্মল আনন্দ ?
হাঁদা – ভোঁদা কি শুধুই নির্মল আনন্দ দেয়? কোনো বার্তাই কি নেই এর মধ্যে? অবশ্যই আছে। গল্পগুলো পড়লেই বোঝা যাবে নারায়ণ দেবনাথ এর মধ্যে সমাজের Satire গুলো গুঁজে দিয়েছেন। একটা ছোট্ট গল্প বলি। হাঁদা – ভোঁদা বক্সিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। গতবার হাঁদা ভোঁদাকে হারিয়েছিল। এবার তাই ভোঁদা হাঁদাকে হারাতে বদ্ধপরিকর। এরই মধ্যে একদিন বক্সিং -এর কোচের কাছে একটা চিঠি এল। চিঠির বিষয়বস্তু এই যে বিজয়ী বক্সারের কোচকেও সংবর্ধনা দেওয়া হবে। তারপরেই কোচ হাঁদার প্র্যাকটিস আরও বাড়িয়ে দিল।
অন্য একটা গল্পে দেখা যায় পিসেমশাইয়ের অবস্থা একদম ভালো যাচ্ছে না। হাঁদা ওঁকে এক জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে নিয়ে গেল।
জ্যোতিষী কপাল দেখে বললেন, ” আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি যে আপনার কপালে শিগগির ঘোর বিপদ ঘনিয়ে আসছে।”
” তাহলে কী হবে জ্যোতিষ ঠাকুর? ”
” আপনার কোন চিন্তা নেই। আমি তো আছি। একটা সংকট মোচন যজ্ঞ করবো যে বিপদ আপনার ধারে কাছে ঘেঁষবে না। তবে যজ্ঞের জন্য হাজার পাঁচেক টাকা লাগবে।”
এই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই একটা লোক হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল যে জ্যোতিষ ঠাকুরের বাড়ি নাকি দাউ দাউ করে জ্বলছে। দমকলে খবর দিতে যাওয়া হচ্ছে।
তখন পিসেমশাই বুঝতে পারলেন – ” দিব্য চোখে যে নিজের কপালে কী ঘটতে চলেছে দেখতে পায় না সে আবার অন্যের কপাল দেখছে। ”
হাঁদা – ভোঁদা/অন্যান্য কমিক্স সিরিজের থেকে আলাদা
হাঁদা-ভোঁদা কমিক্স সিরিজের মধ্যে এক অদ্ভুত স্বাতন্ত্র্য আছে যা তাকে অন্যান্য কমিক্স সিরিজের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রত্যেকটা গল্পই দু-চার পাতার। আগেই বলা হয়েছে, প্রথমদিকে এক বা তিন পাতার গল্প থাকলেও পরবর্তীকালে প্রতিটি গল্পের পৃষ্ঠা সংখ্যাই জোড় সংখ্যা। এই চরিত্রদের নিয়ে কখনও কোনো গ্রাফিক নভেল লেখেননি নারায়ণ দেবনাথ। তাঁর বক্তব্য, গ্রাফিক নভেল লিখলে তা ধারাবাহিক ভাবে ছাপানো হত পত্রিকায়। কিন্তু কোনো খুদে পাঠক যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো একটা সংখ্যা মিস করে ফেলে, তাহলে বাকি গল্পটা তার কাছে বোধগম্য হবে না। সবার কথা চিন্তা করেই নারায়ণ দেবনাথ গ্রাফিক নভেল লেখায় হাত দেননি।
এবার আসি চারিত্রিক স্বতন্ত্রতায়। এদের কেউই অবশ্য জটিল কোনো কেস সলভ করে না, টিনটিন-অ্যাসটেরিক্সের মত বার্গার বা বুনো শুয়োরের রোস্টও খায় না, কিন্তু পাঠককে দুর্বার গতিতে আকর্ষণ করে বইয়ের দিকে। টিনটিন-অ্যাসটেরিক্স-হ্যারি পটার – পাশ্চাত্যের প্রত্যেকটা কমিক্স চরিত্রই সাধারণের কাছে স্বপ্ন। তাদের জীবনযাত্রার মান, আদবকায়দা – প্রতিটি কাজকর্মই সাধারণের থেকে কয়েক ধাপ ওপরে। ফলে তাদের ছোঁয়া যায় না। এর পাঠকের মনে কল্পনার জাল বিস্তার করে।
অন্যদিকে, হাঁদা-ভোঁদা চরিত্রদুটি Down to earth। একেবারে পাশের বাড়ির ছেলের মত। মোটেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয়। ফলে পাঠক সহজেই পৌঁছে যেতে পারে তাদের কাছে। কাল্পনিক জাল বিস্তার করে সব গল্পই; তবে এ কল্পনা সে কল্পনা নয়। মোট কথা, কোনো জাদুশক্তি কাজ করে না এই চরিত্রগুলির মধ্যে। ফলে পাঠকের সাধারণ কোনো অপূরণীয় ইচ্ছা পূরণ হয় এদের মাধ্যমে। আর স্বভাবগত দিক খাঁটি বাঙালিয়ানা তো আছেই।
প্রসঙ্গগত উল্লেখ্য, শুধু কমিক্সের পাতাতেই নয়, ‘হাঁদা-ভোঁদাকে’ নিয়ে অ্যানিমেশন সিরিজও তৈরী হয়েছে; এবং তা সম্প্রচারিত হত ‘অ্যাঞ্জেল কিডস’-এর পর্দায়।
দেব সাহিত্য কুটীর থেকে প্রকাশিত ‘শুকতারা’ পত্রিকায় আজও নারায়ণ দেবনাথ হাঁদা – ভোঁদার নিত্যনতুন কাণ্ডকারখানার চাহিদা বিপুল । যে কাণ্ডকারখানা শুরু হয়েছিল ১৯৬২ সালে, তা আজও থামেনি। তাই হাঁদা – ভোঁদা আজও অম্লান।
Tags: ফন্টে/ফিরে দেখা, ভোঁদা ও নন্টে, হাঁদা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।