14 Apr

রবীন্দ্রগানের পরম্পরায়

লিখেছেন:প্রতিভা দাস


[রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে সুপরিচিত নাম সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের গানের গভীরে ডুবে থাকা মানুষটি এই সঙ্গীতের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন জীবনের পথ চলার আনন্দ।রবীন্দ্রগানের আলোকমাখা পথ ধরে হাঁটতে গিয়ে তিনি  কিংবদন্তি শিল্পী সুবিনয় রায়কে  শিক্ষক  হিসাবে অনেক কাছ থেকে পেয়েছেন। সান্নিধ্যে এসেছেন রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকার শৈলজারঞ্জন মজুমদারের। আর এই ২০২১-এ সুবিনয় রায়ের জন্মশতবার্ষিকীতে আমরা ঋদ্ধ হয়েছি তাঁর সেই সংগীতময় আলোকযাত্রার সঙ্গী হয়ে।শিল্পী সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ের কখনও হাতে লেখা,কখনও বা মুখে বলা এই সঙ্গীতযাত্রার সাক্ষী থাকলেন নৃত্যশিল্পী প্রতিভা দাস।]  

প্রতিভা দাসঃ একদিকে শৈলজারঞ্জন মজুমদার আর অন্যদিকে সুবিনয় রায় – এই দুই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর সাহচর্যে আপনি ঋদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানকে জীবনসঙ্গী করে নেওয়ার কথা ভাবলেন কীভাবে?

সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ হ্যাঁ, আমি বলে থাকি – আমার গুরুভাগ্য  ঈর্ষনীয়।একজন  অন্যতম শ্রেষ্ঠ  গায়ক, অন্যজন  রবীন্দ্রনাথের শিক্ষণ পদ্ধতিকে  মান্য করে  আদর্শ  শিক্ষক।এঁদের সান্নিধ্য লাভ করেছি দীর্ঘদিন। গভীর থেকে আরও গভীরে  আরও বৈচিত্রে অবগাহন করার সৌভাগ্য লাভ  করেছি এনাদের সাহায্যে। গানের মধ্যে দিয়ে  কবির মনের কথা বুঝতে চেষ্টা  করেছি । পূজা  প্রেম  প্রকৃতি সম্পর্কে  আমার মনোভাব  রবীন্দ্র প্রভাবিত। তাই রবিঠাকুরের গান আমার জীবনসঙ্গী  হয়ে উঠবে  এটা স্বাভাবিকই ছিল।

প্রতিভা দাসঃ সুবিনয় রায়ের কাছে গান শিখবেন এটা কিভাবে ঠিক করলেন?

সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ জীবনের প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতটি  শিখেছি সুবিনয় রায়ের কাছে – এই ঘটনা আমার কাছে এখনও  স্বপ্ন মনে হয়। অনেকের মতো তখন রেডিওই ছিল  আমারও গান শোনার মূল  মাধ্যম, উচ্চাঙ্গ  আর রবীন্দ্রসঙ্গীত, দুইই। আমি প্রথমে  উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত  অভ্যাস করি  স্কুলের গণ্ডী পেরোনোর পর। রে ডিওতে এই সঙ্গীতের  মুগ্ধ শ্রোতা  ছিলুম আমি। পাশাপাশি  রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথায় মুগ্ধ হতে শুরু করেছি, তবে সুরের বৈশিষ্ট্য  লক্ষ করিনি  প্রথমদিকে। তারপর হঠাৎই  একবার  বহুরূপীর  কয়েকটি নাটক  দেখে ফেলার সৌভাগ্য হল, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের নাটক অবশ্যই ছিল;  চার অধ্যায় ( নাট্যরূপ  শম্ভু মিত্র )  আর অবশ্যই রক্তকরবী। রক্তকরবী দেখে মনে হল এটি একটি তিলোত্তমা শিল্প, অথচ এমন প্রতিবাদের নাটক  আর দেখিনি,পড়িনি । অভিভূত হয়েছিলুম। রবীন্দ্রনাথ নাটকটি  দশবার নতুন করে লিখেছিলেন।শম্ভু মিত্রই আমাকে রবীন্দ্রনাথের  কাছে নিয়ে গেলেন বলা যায়। কারণ  তখনই মনে হয়েছিল, এমন নাটক যিনি লিখতে পারেন  সেই তিনি  যখন গান লিখবেন  সে গান  নিশ্চয়ই সাধারণ  গান হবে না, এই গান  অবশ্যই গভীর ভাবে  অনুশীলন  যোগ্য৷ অনুশীলনের জন্যে শিক্ষা দরকার।শুরু হল  গুরু নির্বাচনের সন্ধান।  অনেকের গান শুনি  কিন্তু তেমন  দাগ কাটে না।একদিন কলেজ থেকে ফিরছি, পাড়ার  মুখের কাছে  কোনও  এক বাড়ি থেকে একটি গান ভেসে আসছে –  হৃদয়নন্দন বনে।

শিল্পী সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়

এই গান অন্যদের কণ্ঠে শুনেছি, কিন্তু সেদিনের সেই গাওয়া গান কানের মধ্যে দিয়ে  বুকে এসে লাগল যেন।পুরুষ কণ্ঠ, খুব ভারী গলা নয়, কিন্তু  সেই কন্ঠই  ভাসিয়ে নিয়ে গেল, বুঝলুম  এনার স্বরস্থান আর গানের ওপর এনার  দখল অসাধারণ। মনে মনে গুরুপদে এনাকে বসালাম,কিন্তু কে গাইছেন কী তাঁর নাম  কিছুই তখনও জানি না।

আমাদের পাড়ার এক সঙ্গীতজ্ঞ দাদা, বিষ্টুভাই বলতাম,বাঁশি বাজাতেন,উদয়শংকরের দলে ছিলেন, আমায় ভালোবাসতেন,গান শেখা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আগেই কথা  হয়েছিল; তাঁকে জানালুম-গুরু পেয়েছি  কিন্তু নাম বলতে পারব  না। উনি বললেন,তা কী ভাবে গুরু ঠিক হল? বললাম যে তাঁর গলায় এই গানটি শুনে আমি মুগ্ধ। বললেন,ঠিক আছে, নির্বাচন ভালোই হয়েছে, এনার নাম  সুবিনয় রায়।কিন্তু কোথায় শেখান তা বলতে পারবো না,তবে  এটুকু শুনেছি- উনি  খুব  রাগী আর খুঁতখুঁতে মানুষ,সবাইকে গান শেখান না।

তারপর বেশ কিছুদিন পরে জানলাম – ইনি গান শেখান সুরধুনী নামের এক স্কুলে,বরানগরের কাছে। এক বন্ধুকে নিয়ে হাজির হলাম। দেখলুম নিচের ঘরে অনেক বয়স্ক লোক, মনে হয় সংস্থার কর্মকর্তা, আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে  তাকালেন – বললাম – এখানে কি সুবিনয় রায় গান শেখান ?  একজন বললেন হ্যাঁ, কিন্তু তোমার কী দরকার? বল্লুম – ওনার কাছে গান শিখতে চাই।বয়েস কম আমার তাই একটু বিস্মিত হলেন যেন। আচ্ছা বোসো,উনি ওপরে ক্লাস নিচ্ছেন,নামবেন চা খাবেন।কিছুক্ষণ পর ভেতরের দরজা দিয়ে ঢুকলেন একজন সৌম্যদর্শন,ধুতি  সাদা পাঞ্জাবি,কণ্ঠের সঙ্গে মানানসই চেহারা৷ বুঝতে বিন্দুমাত্র দেরি হল না, এনার কাছেই এসেছি।একবার তাকালেন,আমি এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলুম; বললেন- কী ব্যাপার! বল্লুম- আপনার কাছে গান শিখবো।সন্তুষ্ট হলেন না মনে হল। কে পাঠিয়েছে ?

বল্লুম-কেউ পাঠায় নি, রেডিওতে আপনার গান শুনে এসেছি। অ, তা কার কাছে শিখেছ আগে ?   ডিপ্লোমা করেছ ? জানালুম – কারুর কাছে শিখিনি,ডিপ্লোমাও না৷  সেকি !  আমার কাছে যারা গান শেখে  তারা পাঁচ বছরের  ডিপ্লোমা  পরীক্ষায় পাশ করে তবে আসে৷  মনে মনে ভাবছি- তাহলে বোধহয় এনার কাছে শেখা হল না আর ।  ওই বয়সে ওনার গানে মুগ্ধ হয়েছি  হয়তো সেই  সন্তুষ্টি  থেকেই বল্লেন – এখানে ডিপ্লোমার ক্লাস হয়, তুমি কি একটা গান করতে পারবে !  তাহলে  ইয়ারটা  ঠিক করে দেবো, সবসময়  ফার্স্ট  ইয়ার থেকেই যে শিখতে হয় এমন নয় ৷  ততক্ষনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি – ডিপ্লোমার জন্যে  ভর্তি  হব না।  তবে বাড়িতে সারাক্ষণই গান গাইতাম,  না বুঝেই। তাই বললাম –  গাইব । বললেন – ওপরে দোতলায় চলে যাও, ঘরে বোসো,আমি আসছি একটু  পরে।

চমৎকার বাড়ি, বেশ বড়ো চারকোনা  উঠোন ঘিরে  বাড়ি, যাকে চকমিলানো বাড়ি বলা হয়, এসব বাড়ি আর তৈরি  হয়না, রুচিও নেই, কারিগরও আর পাওয়া যায় না।বারান্দা ঘিরে চারপাশে ঘর।  পরে জেনেছিলুম এটি প্রশান্ত মহলানবিশের বাড়ি।দোতলার একটা ঘর থেকে গানের আওয়াজ আসছিল, গেলাম।ঘরে অনেক মেয়ে,সবাই আমার চেয়ে বড়ো – আমি আলগোছে  এককোণে  বসলাম, ওদের জিজ্ঞাসু চোখ, বললাম- উনি আমায় এখানে অপেক্ষা করতে বলেছেন।

তারপর উনি এলেন ওপরে, হাতে সিগারেট,বারান্দার রেলিংঙে পেছনে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে  বললেন – গাও ।

একটি মেয়ে হারমোনিয়াম  ধরল, আমার স্কেল জানতে চাইল।যাই হোক, চোখ বুজে  গান করলাম। কী সুর বাজে আমার প্রাণে আমিই জানি  মনই জানে- রেডিও থেকেই শেখা। গান শেষে চোখ খুলে দেখি  – উনি ঘরে এসে বসেছেন, নিজের জায়গায়।বললেন- তুমি  এখানে  সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি হয়ে যাও,ডিপ্লোমায়,তারপর একটু থেমে- আর আমার কাছেও এসো,আমি শেখাবো।

শিল্পী সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়

হাতে চাঁদ পাওয়া কাকে বলে,সেদিন জেনেছিলুম ।

সেই শুরু।তারপর দীর্ঘ  বারো বছর …

প্রতিভা দাসঃএই বছরটা সুবিনয় রায়ের জন্মশতবর্ষ। রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবেই একসময় পরিচিতি ছিল সুবিনয় রায়ের। পরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়ক হিসেবে মানুষ তাঁকে চেনে।এই দুই সুবিনয় রায়কে আপনি কেমনভাবে পেয়েছেন?

সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ  সুবিনয় রায়ের  ক্লাসে আমার শেখা প্রথম গানটি- শ্রান্ত কেন ওহে পান্থ,পথপ্রান্তে বসে এ কী খেলা। তিন তালের গান, পূরবীতে আছে মনে হল, প্রথম স্বর শুদ্ধ নি।পরেরদিন গান ধরবেন,প্রত্যেককে একা একা। অন্তরা একমাত্রা ছাড় দিয়ে  ধরতে হবে,মেয়েরা ভুল করছিল।এবার আমার পালা।স্কেল পাল্টালেন, দুটো তানপুরা ছিল,তবলাও (বাজাতেন  বাবলুদা)।সবাই প্রস্তুত।গান ধরবো।সুবিনয়দা হারমোনিয়ামে  মৃদু স্বরে সা আর পা ধরে রেখেছেন,গানটা ধরিয়ে দিচ্ছেন না৷ কী বিপদ! ভয়ে চোখ বুঁজলাম,তারপর যা হয় হবে বলে ধরলাম গান।পথ প্রান্তে বসে এ কী খেলা  গেয়ে যখন সা  এ এলাম, সুবিনয়দা বললেন- বাঃ।প্রথম দিনেই পরম প্রাপ্তি৷ ক্লাসের পরে মেয়েরা ঘিরে ধরল – গান শেখোনি এটা মিথ্যে কথা। শিখিনি বলিনি তো! রবীন্দ্রসঙ্গীত  শিখিনি, বিশ্বাস করো,সত্যিই।

ক্লাসে আমার একটু দর বাড়ল। প্রতিটি গান শেখাবার পরে প্রত্যেককে গান ধরতেন।তাতে আমাদের সকলেরই উপকার হত।নির্দিষ্ট সময়ে আসতেন প্রতিদিন। কিন্তু বছর খানেক পরে  কী যে হল,পরপর দুদিন এলেন না। অফিস থেকেও কিছু জানতে পারলুম না। তৃতীয় দিন এলেন,  আগের গান কাউকে কাউকে  ধরলেন একটু করে।শেষে বললেন- শোনো,আমি আর ক্লাস নেবো না তোমাদের,আজই শেষ। অন্য কেউ তোমাদের ক্লাস নেবেন।

মাথায় বাজ পড়ল। কেউ কিছু বলছে না। আমি বলে ফেললাম- আমার কী হবে সুবিনয়দা!   আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন-তোমার কী হবে  তা আমি কী জানি। আরও কিছু বলতে চাইলুম কিন্তু মেয়েরা  পেছন থেকে জামা ধরে টানল – কোনো কথা বলবে না। কিন্তু কেন বলব না !!  ঠিক আছে, এখানে নয়, আমি মনে মনে  প্ল্যান করে নিলুম।যেখানে গাড়িতে উঠবেন,সেখানে দাঁড়িয়ে  রইলুম।

উনি গাড়িতে উঠবেন,আমি বল্লুম- সুবিনয়দা,আমি তো  সুরধুনিতে শিখতে আসি নি, আপনার কাছে শিখতে এসেছি।আমার কি তাহলে গান শেখা হবে না?

এবার একটু শান্ত স্বরে বললেন- আমার কাছেই শিখতে হবে? বল্লুম – হ্যাঁ  আপনার কাছেই।

তখন বললেন- আমার ফোন নম্বরটা লিখে নাও,রবিবার সকালে ফোন কোরো।

ফোন করলাম- উনি বাড়িতে আসতে বললেন,বালিগঞ্জ প্লেস,ওখানেই ক্লাস হবে।

পরে বুঝেছিলুম- এই সংস্থাগুলো  আসলে গানের ইস্কুল,শিক্ষক হিসেবে এরাই কাউকে নিয়োগ করেন,হয়তো নির্দিষ্ট কিছুদিনের জন্যে,অথবা শর্তে না পোষালে,পরে অন্য শিক্ষক নিযুক্ত হন।অন্য ছাত্রছাত্রীরা  এটা জানতো,তাই  তারা ওখানেই রয়ে গেল।

বালিগঞ্জ প্লেসে ওনার বাড়িতে ক্লাস  শুরু হল।তবে এক জায়গায় বেশিদিন শেখাতেন না।গড়িয়াহাটে কোনো ছাত্রীর বাড়িতে কিছুদিন,তারপর বেকবাগানের তিভোলি কোর্টে  একটি অভিজাত  বাড়ি,প্রায় ছ সাত ফুট চওড়া কাঠের সিঁড়ি  দিয়ে উঠে,সম্ভবত তিনতলার একটি ঘর,  লাগোয়া প্রশস্ত একটি বিশাল ব্যালকনি, দক্ষিন দিকে। একবার পূর্ণিমার সময়  ব্যালকনি ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়, মনে আছে উনি শিখিয়েছিলেন- আজি সাঁঝের যমুনায় গো,তরুন চাঁদের কিরণ তরী কোথা ভেসে যায় গো।এমন গাইছিলেন  মনে হচ্ছিল  জ্যোৎস্নাও অস্থির,যেন ঘরের ভেতরে ঢুকতে চাইছে।ভোলা যাবে না সে বাড়ির কথা।তবে সে বাড়ি আর নেই,ওখানে এখন কংক্রিটের জঙ্গল।

তিভোলি কোর্টের পর  স্বরগম,তারপর গান্ধর্বী,রজনী সেন রোড,তারপর উত্তর কোলকাতার গান্ধর্বী,  ঠনঠনে কালিবাড়ির কাছে।যেখানে নিয়ে গেছেন যাযাবরের মতো  সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছি।

এই গান্ধর্বীরই  একটি ঘটনার কথা মনে  আছে, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।সালটা উনিশশো আশি, মঙ্গলবার,তারিখটা মনে নেই। ক্লাসে আসতে দেরি করছেন,তবে অফিস ঘরে ফোন করে জানিয়েছেন – একটু দেরি হবে। আমরা আলোচনা করছি,দেবব্রত বিশ্বাস মারা গেছেন,তাই কি দেরি।আমিই বোধহয় বলেছিলুম -ওখানে উনি যাবেন না। তারপর এলেন,বসলেন, তারপর বললেন- তোমরা বোধহয় জানো, ওই জর্জ বিশ্বাস যাকে বলা হয়,দেবব্রত বিশ্বাস,তিনি আজ মারা গেছেন।বুদ্ধদেব ( ভট্টাচার্য,তখন তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী) আমাকে দু তিনবার ফোন করে  রবীন্দ্রসদনে আসতে অনুরোধ করল, তা গেলাম,প্রথম মালাটা আমিই দিলাম,যদিও উনি আমার প্রিয় শিল্পী  নন।

সুবিনয় রায়ের মতো বিশিষ্ট বিশুদ্ধ শিল্পী  বলছেন- দেবব্রত বিশ্বাস তাঁর প্রিয় শিল্পী  নন, ব্যাপারটা ভেবে দেখার মতো  অবশ্যই।

সাধারণত  অন্য গায়ক গায়িকা প্রসঙ্গে কিছু বলতেন না। একবার শুনলুম, একটি ব্যাংকের অনুষ্ঠানে উনি গাইবেন।সেই তিভোলি কোর্টের ব্যালকনিতে, সেদিন ওনার মেজাজটা বেশ  ভালো ছিল। বললাম- সুবিনয়দা,দুপুরের ওই অনুষ্ঠানে যাবো কিন্তু।একজন গায়িকা( লঘু সঙ্গীতের ঢঙে গান করতেন) তার নাম  করে বললেন- ওখানে  গিয়ে কী করবে,উনি গাইবেন।ও গান শুনতে হবে না।সেদিন সাহস করে জানতে চেয়েছিলুম,সুবিনয়দা,আপনার গান তো শুনি,আর কার কার  শুনবো?

বলেছিলেন- ‘বাচ্চুর গান শুনবে’।

বাচ্চু  অর্থাৎ  নীলিমা সেন।

আসলে গায়ক আর শিক্ষক  দু ভাবেই তাঁকে জেনেছি। সুর,তাল গানের   সঠিক লয়, সঠিক উচ্চারণের  ওপর জোর দিতেন।মুগ্ধ হয়ে গান শুনতাম পায়ের কাছে বসে।শুধু ধ্রুপদ ধামার নয়,  কীর্তন ভঙ্গীম গান,ঋতু পর্যায়ের গান, বিশেষ করে বসন্ত আর বর্ষা পর্যায়ের  গানে  ওনার জুড়ি ছিল  না।ওনার সম্বন্ধে প্রচারে শুধু ধ্রুপদ ভঙ্গীম গানের কথাই  বার বার উঠে এসেছে,কিন্তু  সে প্রচার  অবশ্যই অর্ধসত্য ।

খুব পরিচিত গান ওনার কণ্ঠে  অন্যরকমের সৌন্দর্যে  ফুটে উঠত। ক্লাসে এসে একদিন বললেন  – আজ এই গানটি শেখাবো,অবশ্য পরিচিত গান- দিবস রজনী।একটি ছেলে হঠাৎ বলে উঠল-  গানটা  জানি  সুবিনয়দা।সুবিনয়দার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।স্থির দৃষ্টিতে এক মুহুর্ত ওর দিকে তাকিয়ে বললেন- তুমি গানটি শুনেছ,কিন্তু তুমি গানটি জানোনা,শিখে নাও।এ কথা বলেই  আমার হাত থেকে  তানপুরাটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে একটা কি দুটো মোচড় দিলেন,সুরে ভরে গেল ঘর।  এতো দ্রুত তানপুরা বাঁধতে  আর কাউকে দেখিনি।তারপর হারমোনিয়ামে হাত রাখলেন,খুব মৃদু  সুরে বাজছে।একেবারে শুদ্ধ রে থেকে গান ধরলেন,অন্য কোনোও স্বরের ছোঁয়া নেই,যাকে বলে বিশুদ্ধ রেখাব।গানটি প্রথম লাইন দুবার গাইতে হয়,দ্বিতীয়বারের আমি যেন কার, এখানে কার শব্দটিতে কিছুটা তালের বাইরে গিয়ে,আবার ঠিক জায়গায় তালে ফিরে এসে,এমন একটা হাহাকার তুললেন- অভাবনীয়।যেমন স্বরের ওপর দক্ষতা  তেমন ভাব।কথায় একটু বেশিই ইংরিজি ব্যবহার করতেন।বলেছিলেন- নট অনলি নোটেশনালি,ইউ হ্যাভ  টু বি কারেক্ট  ইমোশনালি  অলসো৷

১৯৭৪ থেকে ৮৬ সাল অব্দি ওনার কাছে শিখেছি। শেষদিকে সবাই বুঝলুম এ গান আগে শিখিনি,এ গান যে উনি শেখাবেন তাও ভাবিনি।আবার ধ্রুপদাঙ্গ গানের বেলায়- আগের মতোই।

পরিচিত  গান ওনার কণ্ঠে এমন চেহারা নিতো, শেখানো শেষ করে যখন চলে যেতেন,  আমরা স্তব্ধ বিস্ময়ে  অভিভূত হয়ে বসে থাকতাম।বিশেষ করে মনে আছে – দিবস রজনী  আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি।এই গান তিনি যে  শেখাবেন, ভাবতে পারিনি।কিন্তু বোঝা গেল  এই গান আগে শিখিনি।রবীন্দ্র গানের একটা সস্তার বাজার আছে,সেটাই জনপ্রিয় খুব।

আবার জহুরি চেনেন খাঁটি জিনিস কাকে বলে, কিন্তু তাদের সংখ্যা বেশি নয়।গানের আভিজাত্য  কথাটা সেইদিনই মনে এসেছিল।আবার ধ্রুপদাঙ্গ গানের বেলায়, এমন অবলীলায় তাল ছন্দ বজায় রেখে গাইতেন,ভাবতাম কোনওদিন কি গাইতে পারবো এমন করে ! গান সাধারণত উনি নিজেই ঠিক করতেন,শেষের দিকে আমাদের অনুরোধও রাখতেন ।

আর একটা কথা বলা খুব জরুরি।রবীন্দ্রনাথের গান  আর ব্রাহ্মসমাজের গান ছাড়া অন্য কোনও গান তিনি কখনও করেন নি,তাঁর  রুচি-পছন্দের সঙ্গে মেলেনি বলেই; যদিও  তাঁর সতীর্থেরা করেছিলেন ।

ব্রাহ্মসমাজের গানের সূত্রে  বিশেষ করে  দ্বিজেন্দ্রনাথ আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের  দুটি গান  শিখেছি,যা ভুলবো না কোনদিন ।জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গান,সুরফাঁক তালে, আদি নাথ প্রণবরূপ  সম্পূর্ণ- শেখাবার পর সুবিনয়দা বলেছিলেন – ‘সঙ্গীত-প্রতিভায়  ঠাকুর বাড়ির কেউই  কম যেতেন না, কিন্তু  প্রাচুর্যে  আর সৌন্দর্যে  রবীন্দ্রনাথ  সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন’।

তবে শিক্ষক হিসেবে ওনার ধৈর্যের একটু অভাব ছিল।একবার বা দুবারের বেশি  বুঝতে চাইলে  বা তারপরেও কেউ না ধরতে পারলে  সরাসরি বলে দিতেন- কী দরকার ক্লাসে আসার!তোমারও  সময় নষ্ট,আমারও।

ওনার লেখা বই- রবীন্দ্র সঙ্গীত  সাধনা। অবশ্য পাঠ্য।তাত্ত্বিক  আলোচনা বেশি নেই, কিন্তু কেমন  করে গাইতে হবে তাঁর গান,তার জন্য  কী কী জানা অবশ্য প্রয়োজন,সেগুলো কী ভাবে অনুশীলন করা দরকার,যাকে বলে প্র‍্যাকটিকাল  ক্লাসের জন্যে বই,এমন বই আর  দুটি নেই।পড়তে পড়তে মনে হয়  ওনার ক্লাসে বসে আছি।বইয়ের নামকরণ থেকেই বোঝা যাচ্ছে,শুধু উচ্চাঙ্গসঙ্গীতই নয়,  রবীন্দ্রসঙ্গীতও সাধনার বিষয় বলেই উনি মনে করতেন।অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি  ঠিকই মনে করতেন উনি।সঙ্গীতভবনের ছাত্রছাত্রীদেরও উচ্চাঙ্গসঙ্গীত অল্পবিস্তর শিখতে হত।

শিল্পী সুবিনয় রায়

সুবিনয়দার জন্মশতবর্ষ।  ২০২১ সালের জন্যে আমরা দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলুম। কিন্তু এ বছরের অস্বাভাবিক সময়ে  পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছে। তবে   আমাদের সঙ্গীত সংস্থা- কথা  ও  সুর – রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুশীলন/অনুসন্ধানের পক্ষ থেকে  একমাস ধরে  তাঁকে কথায় গানে স্মরণ  করেছি,এখন  যাকে বলে ভার্চুয়ালি, ফেসবুকে। কে মঙ্গলবার করেই ক্লাস হত গান্ধর্বীতে। মনে আছে  রবিবার বিকেলে সবার মন খারাপ করত,কাল আবার সোমবার,কাজ আর কাজ।  আমার কিন্তু মন ভালো হয়ে  উঠত; কারণ সোমবার পেরোলেই  মঙ্গলবার,সুবিনয়দার ক্লাস …

গায়ক সুবিনয় রায়ের আত্মপ্রকাশ  শান্তিনিকেতনেই ১৯৩৯ সালে।কেমিস্ট্রির ছাত্র ছিলেন,  কেমিস্ট্রি পড়াতে শৈলজারঞ্জন মজুমদার। সুবিনয় গান গাইতে পারে তা  শৈলজারঞ্জনই আবিষ্কার করেন।তখন  শান্তিনিকেতনে শেষ বর্ষামঙ্গলের রিহার্সাল চলছিল,কবির নতুন লেখা ১৬ টি অবিস্মরণীয় গানের সম্ভার নিয়ে।তখন সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ  শৈলজারঞ্জন।রিহার্সালের দলে নিলেন সুবিনয় রায়কে।

গানগুলি শৈলজারঞ্জনের আবদারেই রচিত হয়েছিল।গানের স্বরলিপি করেই উনি বাইরে এসে গাছতলায়  বসে  ছাত্রছাত্রীদের শেখাতে শুরু  করতেন।এ সম্বন্ধে একটি মজার গল্প সুবিনয়দার কাছে পরে শোনা।কলকাতার প্ল্যানেটোরিয়ামের ভেতরে একটি অডিটোরিয়াম আছে।সেখানে একটি গানের আসরে সুবিনয়দা ছিলেন সভাপতি।সেখানে শান্তিনিকেতনের স্মৃতি প্রসঙ্গে  সুবিনয়দা বললেন- আমাদের দু’জন শিক্ষক ছিলেন- শৈলজদা  আর শৈলেশদা।একজন কেমিস্ট্রি আর অন্যজন অঙ্ক পড়াতেন।শৈলজদা যখন গান শেখাতে  গাছতলায় বসতেন,শৈলেশদা  বলতেন- গানগুলো সদ্য জন্মেছে,এখনও গরম আছে,যাও টাটকা টাটকা শিখে নাও।

রবীন্দ্র-তিরোধানের পরের  সুবিনয় রায়ের খবর অনেকেরই অজানা।সে খবর সংগ্রহ করেছি  ইন্দিরা দেবীর ১৯৪৩ সালের ডায়রী থেকে।সেইসঙ্গে  শান্তিনিকেতনের তৎকালীন  সঙ্গীত পরিবেশের খবরও  জানা যাবে।

ইন্দিরা দেবীর স্মৃতি-সম্পুট  বইটিতে  ডায়রীর পাতায় ৩১.১০.৪৩  তারিখে সুবিনয়দার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়।সেবারে রাখীপূর্ণিমার  বর্ষামঙ্গলে  সুবিনয়দা গেয়েছিলেন-গহন রাতে শ্রাবণ ধারা পড়িছে ঝরে।

২৪.১১.৪৩ – রাসপূর্ণিমা উপলক্ষে  উত্তরায়নে  আগের অনুষ্ঠানের তিনটি গান বদল হল।”প্রফুল্ল গাইলে-কে রচে( আমার সঙ্গে),সুবিনয় একটা গাইলে,মালিনীর দুয়ার নাড়া দেবার বিষয়,মীরা জ্যোৎস্না রাতে আবৃত্তি করলে।”

“গর্মীর ছুটির আগে শান্তিদেব ঝগড়া করে চলে গেল।তারপর সমরেশও চলে গেল-স্পষ্ট কোনো কারণ না দেখিয়েই।তাতে অসুবিধাও হল,বিরক্তিও বোধ হল। অনুমানে বোঝা গেল,এখানে কাজ করার কতকগুলি অসুবিধাই তার মূল কারণ।যথা-মাইনে বাজার দরের অনুপাতে কম,চাকর পাওয়া শক্ত,ইত্যাদি।তারপর সুধীর করও বরখাস্ত হল- সে তবু ছোটদের শিক্ষার ভার অনেকটা লাঘব করত৷”

” নতুন ভর্তি হল  সুবিনয় রায়চৌধুরী- প্রভাতবাবুর শালীপুত্র।সে এখানকারই ছেলে।শৈলজাবাবু  দেখলুম তার ওপর  খুব জোর দেন- কারণ এখানকার আবহাওয়া ও আদর্শে একটু অভ্যস্ত  হওয়া দরকার, যেমন মেয়েদের সঙ্গে  সহজভাবে মেলামেশা ইত্যাদি।আর মোহর এখানকার পুরনো মেয়ে,সে সঙ্গীতভবনের শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছে,ও সব বিষয়ে উপযুক্ত।সে পুজোর পূর্ব পর্যন্ত ও এখন আবার  গর্মীর ছুটির আগে পর্যন্ত  শিক্ষয়িত্রী  নিযুক্ত হল।তাতে সুবিনয়ের ছোট শ্রেনীর  কিঞ্চিৎ ভার লাঘব হল৷ তা ছাড়া শৈলজাবাবু আছেন।যদিও তাঁর পক্ষে অধ্যক্ষের কাজ  ও অধ্যাপনার কাজের ওপর আবার ক্লাস শিক্ষার ভার  একটু গুরুতর হয়ে পড়ে।এদিকে শুনি কেমস্ট্রি শিক্ষকও সেরকম  স্থায়ী  আর মনোমত  পাওয়া যাচ্ছে না।তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল যে,রবিকার অভাবে,  বিশেষ করে শান্তিনিকতেনের অধ্যাপক পাওয়া একটু শক্ত হয়ে পড়েছে।কারণ,তাঁর  নাম-মাহাত্ম্যে  যে আকর্ষণ  ছিল,এখন অর্থ-মাহাত্ম্যে সেটা পূরণ না করলে লোকের আসবার আগ্রহ হবে না।”

২৬.৩.৪৪ তারিখের ডায়রির শিরোনাম- সুবিনয় বিদায় সম্মিলনী।

গত বুধবার (২২শে)  সুবিনয়ের কর্মত্যাগ উপলক্ষে সঙ্গীতভবনের ছাত্রছাত্রী  সন্ধ্যেবেলা  সাঁওতাল  পাড়ায়  একটা বিদায় সম্মিলনের আয়োজন করেছিল। আমি অতদূর নিমন্ত্রণ  রক্ষা করতে যেতে পারিনি।শুনলুম- বাদলা সত্ত্বেও  যথারীতি  খাওয়া  খেলা  ও গান প্রভৃতি   উৎসবের কোনও  অঙ্গহানি হয়নি।

সুবিনয় অল্পদিন বহাল হলেও বেশ ভালোমানুষ ও পরিশ্রমী  বলে পরিচয় দিয়েছে।সে চলে গেলে বাংলা গান শেখানো অসম্ভব হবে, যতদিন না  অন্য উপযুক্ত  লোক পাওয়া যায়। অন্তত নববর্ষ  পর্যন্ত  থেকে গেলেও সুবিধে হত- কিন্তু ভালো চাকরীর পথ তো আর বন্ধ করা যায় না। আর বেশি পেলে  কম মাহিনায় লোক থাকবেই বা কেন৷

রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক  বড়োই দুর্লভ  দেখছি… (এরপর দ্বিতীয় পর্ব)

[এখানে বাংলা গান,অর্থাৎ  রবীন্দ্রসঙ্গীত।শান্তিনিকেতনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে বলা হত হিন্দি গান।  লক্ষ্যনীয় যে  ৪৩ সালেও রবীন্দ্রসঙ্গীত কথাটি চালু হয়নি।]

এর পরের পর্ব – প্রসঙ্গ শৈলজারঞ্জন ও অনান্য…https://galpersamay.com/2021/05/09/%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a7%80%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a7%9f-2/

 

Tags: ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • » রবীন্দ্রগানের পরম্পরায় – ৩য় পর্ব on October 2, 2021

    […] পড়ুন এই সাক্ষাৎকারের  প্রথম পর্ব( ক্লিক করুন)   – https://galpersamay.com/2021/04/14/ […]

    মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ