“খাঁটি ও নির্ভেজাল ভূতের দেখা পেতে হলে আপনাকে ওয়েস্ট এন্ড পার্ক আসতেই হবে…” সোহা আলি খান অথবা মুরাকামি কে একথা বলেছিলেন, ঠিক খেয়াল নেই কিন্তু কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। আমাদের মাদারপাড়ায় যদি আপনি আসেন ঘুরতে ফিরতে আপনার ভূতের সাথে ঠোক্কর লাগবে। যাকে বলে ভূতে ভূতে ধুল পরিমাণ। রাত্রি নামলেই আমাদের পাঁচিলে সাদা থান পরা এক মহিলা এসে বসতেন। ভয়ে ওদিকে চাইতে পারতাম না। রাতে জল খেতাম না, পাছে ঘুম থেকে উঠে ওই বিভীষিকাময় পাঁচিলের পাশ দিয়ে বাথরুম যেতে হয়। এছাড়া ছিল ঠ্যাকেশ্বরী ও বউ-পাগলী। মায়ের কথা মত, ঠ্যাকেশ্বরীর বাগানে ও বিছানার ঠিক নীচে বউ-পাগলীর অবাধ বিচরণ। পিতামাতার অবাধ্য কত সন্তানের ঠ্যাং ধরে বউ-পাগলী নিজের বাড়ি নিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। রাত্রি নামলেই মা এদের কার্যকলাপ সুর করে বলে যেতেন। সকালের আলো ফোটার পর খুব সন্তর্পনে বিছানার নীচটা দেখে তবেই আমি আর দিদি পা ফেলতাম। কখনো এদের সামনে পড়েছি তো সে রাতে ভয়ঙ্কর জ্বর আসত। মা তখন নিজেই ভয় পেয়ে কী একটা মন্ত্র পড়তেন। তারপর তিনবার হাততালি। মা বলতেন কুসসি। পরে জেনেছি ওটা আয়াতুল কুর্সি। পড়ার পর তিনবার হাততালি দিলে তার আওয়াজ যতদূর যায়, ভূত প্রেত থাকেনা। সম্ভবত ভূত প্রেতের ধর্ম থাকেনা। আয়াতুল কুর্সি রাজশাহীর বিশায় মায়ের স্কুলের বন্ধু নূরির থেকে শেখা। মা ৮১ সালে এদেশে চলে আসেন। আজকাল “কেন ওদেশ ছেড়ে চলে আসতে হল?” এইসব প্রশ্নের মুখোমুখি সারাক্ষণ আপনাকে হতে হবে। উত্তর দেবার প্রয়োজন দেখিনা। উত্তর প্রশ্নকর্তারা বুঝবেনও না।
সৌরভই আমায় প্রথম বোঝায় ভূত মানেই ভয়ঙ্কর নয়। একটা বই দিয়েছিল “ভালো ভূত” অরূপ দাশগুপ্তের। তার সাথে গৌরী ধর্মপালের “চোদ্দ পিদিম”। সৌরভরা আমাদের ঠিক দুটো বাড়ি পরে সোনালী জেঠিমাদের বাড়ি ভাড়া থাকত। ও বাবা সৈয়দ নইমুদ্দিন আর মা রীতা দাম দুজনেই ওয়ালশ হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন। সরকারি চাকুরে হওয়ায় ওদের বাড়িতে আনন্দমেলা আসত। সেই লোভেই সৌরভ আমার খুব কাছের বন্ধু। আমি কোনদিন ওদের বাড়ি ঈদ পালিত হতে দেখিনি। বরং দুর্গাপূজায় জামা হতেই দেখেছি। ৯২ সালের পর বহুদিন ওদের ‘স্বাভাবিক’ জীবনে কী ঘটেছিল বোঝার বয়েস হয়নি। আমরা সকলেই বাড়ি থেকে শিখছিলাম মুসলমানরাই এদেশের সবচেয়ে বড় শত্রু। সামনাসামনি না বললেও সৌরভের সাথে আচরণে স্পষ্ট এগুলো বুঝিয়ে দেওয়া হত। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল আমার খুব কাছের বন্ধু যশ, ডা. অমৃত বিশ্বাস আর ওর দাদা। ওদের পরিবার শ্রীরামপুরের নামী শিক্ষিত পরিবার, বামপন্থী। এসব ওরা কখনো বলত না।
এর পরে পরেই আমার সাথে আমাদের বাড়িতে দীর্ঘকাল বসবাস করা উপকারী ও দুঃখী ভূত জেমস বন্ডের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বাঙালী ভূতের নাম জেমস বন্ড কেন জিজ্ঞাসা করায় উত্তর পেয়েছিলাম ভূতের নাম পিন্টু পাল হলে কি আর আমি পাত্তা দিতাম। অকাট্য যুক্তি। জেমস বন্ড গত তিনমাস একেবারেই আমার সাথে কথা বলেনি। হয়ত অভিমানে… আমাদের বাড়িটা প্রমোটার ধুলোয় মিশিয়ে দিলেও আমগাছটা এখনো কাটেনি। এখনো বন্ড ওখানেই আছে।
সেসময় লোকে মন দিয়ে ডিডি ওয়ানে খবর দেখত। এমনিতে আমাদের বাড়িতে সেই ৮২ সাল থেকে টিভি আছে। দাদু শৌখিন মানুষ ছিলেন, পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেননি। টিভিটা ওয়েস্টন কোম্পানীর শাটার দেওয়া সাদা-কালো টিভি। তাতে আবার একটা এক্সট্রা নীল কাঁচ। সেটা মাঝে মাঝে খুলে দিদি জল ভরে রাখত। তখন গোরাচাঁদ নামানো হত। গোরাচাঁদের কথায় পরে আসছি, কিন্তু আমি জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখেছি সে শাটার আর বন্ধ করা যায় না। শাটারের সানমাকাইকার পাতগুলো আমাকে বহুদিন তলোয়ার বানাতে সাহায্য করেছে।
কলকাতা দুরদর্শনের শ্বাস্বতী, মধুবন্তী-দের মত সংবাদ পাঠিকারা ছাড়াও দেবাশীষ বসু ও তরুণ চক্রবর্তী নামে দুজন পুরুষ পাঠকও খুব জনপ্রিয় ছিলেন। এদের মধ্যে তরুণ চক্রবর্তী আমার মায়ের পিসতুতো ভাই। ভদ্রলোক গলায় ভারিক্কি ভাব আনার জন্য ‘ন’-কে ‘দ’ ও ‘ট’-কে ‘ড’ উচ্চারণ করতেন। তার খবর পড়ার ভঙ্গিটা ছিল এরকম “দমস্কার, আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল, প্রধাদমন্ত্রী দরসিমা রাও একডি বেতার বার্তায় জাদিয়েছেদ…” কাল-অনৌচিত্ত দোষ ঘটবে জেনেও একটা কথা বলে রাখি। ৯৮ সালে এইটে পড়তে আমি একবার তরুণ মামার বাড়ি গেছিলাম। কলকাতায়। এমনিতে মা এদেশে আসার পরেই বড়মাসী সাবধান করে বলেছিলেন, দেখিস এখানে কিন্তু বাঙাল ভাষায় কথা বলে ফেলিস না, লোকে ঠাট্টা করে। মা প্রায় অশিক্ষিত মহিলা হয়েও খুব দ্রুত সে উপদেশের মর্মার্থ বুঝেছিলেন। একে অভিজ্ঞ বড়দির উপদেশ তারপর যৌথ পরিবারে সকলের মাঝে বর-কে ছাড়া বসবাস, আমি কখনো মাকে বাঙাল ভাষায় কথা বলতে দেখিনি। কিন্তু কিছু কিছু শব্দ থেকেই যায়। আমাদের মধ্যেও সেটা সঞ্চারিত হয়েছিল। তরুণ মামার বাড়িতে যাওয়া মাত্র দিদা জিজ্ঞাসা করলেন কীরে কুচু আসেনি। আমি বললাম না, ক্যাবল আমি এসেছি। খুব গম্ভীর মুখে লুঙ্গি পরিহিত তরুণ মামা জানালেন, উচ্চারণটা ‘ক্যাবল’ নয় ‘কেবল’। আমি চটপট উত্তর দিলাম কেবল তো টিভি হয়। সারাদিন তিনি মুখ হাঁড়ি করে বসে রইলেন। আমি ওসবে পাত্তা না দিয়ে ইলিশ, মিষ্টি সাঁটিয়ে পরেরদিন বাড়ি ফিরে এলাম। কেবল টিভির উত্থানের যুগে প্রসার ভারতীর একজনকে ওই কথা বলা আমার যে নিতান্ত অনুচিত হয়েছিল, তা এই বয়েসে বেশ বুঝি।
পরাণচন্দ্র বিদ্যালয়ে অবশ্য আমি গর্ব করে বলতাম, টিভিতে খবর পড়ে তরুণ চক্রবর্তী আমার মামা হয় জানিস। তাতে মোনালিসা বলে একটি মেয়ে একদিন জিজ্ঞাসা করে মিঠুন চক্রবর্তীও কি তোদের কেউ হয়? মোনালিসাকে কীকরে বোঝাই মিঠুন আমার কে হয়? মিঠুন ছাড়া আমাদের আর কেই বা ছিল? “বাঙালীর ছেলে মিঠুন চক্র বোম্বে করিল জয়…”। শ্যামবাজারে কে একটা গুরুর গলায় টাকার মালা পরিয়ে দিয়ে যায়। বর্তমানে বের হওয়া সে ছবি আমি ব্লেড দিয়ে কেটে কতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম।
মিঠুনের সিনেমা ডিডি ওয়ানে থাকলে, কেউ খেলতে আসত না। প্যায়ার ঝুকতা নেহি, ওয়ার্দাত, দিওয়ানা তেরে নাম-এর ডায়লগ আমি মুখস্থ বলতে পারতাম। যেদিন টিভিতে প্রথম ডিস্কো ড্যান্সার দেয়, আমাদের স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছিল। যাদের স্কুল খোলা ছিল তাদের এক ধারসে সকাল থেকে পেটখারাপ জ্বর ইত্যাদি হতে শুরু করে। প্যানডেমিক কী সেটা সেদিনই বোঝা গিয়েছিল। ডান দিকে হেলে গুরু যখন স্ক্রীনে উপস্থিত হতেন, একটা অপার্থিব আলোয় চারিদিক ভরে যেত।
এই সময়েই আমার পরিচয় হয়, ফিশেদার সাথে। ফিশে মুখার্জী। এশিয়াড সোনাজয়ী দলে শেষ মূহুর্তে বাদ পড়া গোলকিপার। নইম কাকুকে দেখাতে আসতেন। বুকুদের মাঠের পাশ থেকে হাতছানি দিয়ে একদিন আমায় ডাকলেন।
( এরপর ৩য় পর্ব)
Tags: অগ্নীশ্বর চক্রবর্তী, অংশহর, গল্পের সময় ব্লগ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।