অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই একটি ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়, যাকে কোনও নীতিশাস্ত্রীয় বাক্যের দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এই আগ্রহ যতক্ষণ না পরিতৃপ্ত হচ্ছে ততক্ষণ এই জাতীয় মানুষের শরীর মনকে উদ্দীপ্ত, উত্তেজিত, চনমনে করে রাখে। এই অতি আগ্রহের নাম দেওয়া যেতে পারে — অমরত্বের বাসনা। অমরত্বের বাসনা কিন্তু সাধারণ মানুষদের মধ্যে কম। কিন্তু যাঁদের মধ্যে এই বাসনা রয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে দেখা যায় দিনরাত্তির সর্বক্ষণ তাঁরা এই চিন্তায় মশগুল। এঁরা যেন ওই বিশেষ বাসনা চরিতার্থ করার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত। এই বাসনা চরিতার্থতায় যে পরিতৃপ্তি আসবে তার চিন্তাতেই তাঁরা সর্বক্ষণ বিভোর। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে একে এক ধরনের রোগও বলা যায়, যা মানুষকে ভিতর থেকে ক্ষয় করে দেয়। তবু বাহ্যত তার মধ্যে অফুরান এক প্রাণশক্তির পরিচয় মেলে।
এই জাতের একজন বিশিষ্ট মানুষকে জানার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ভদ্রলোকের নাম স্যার চমনলাল। একসময় ব্যারিস্টার ছিলেন। পরে অযোধ্যা হাইকোর্টের প্রধান বিচারক, আইন সভার কাউন্সিলর এবং ভারত সরকারের আইন সংক্রান্ত উপদেষ্টাও হয়েছিলেন।
তিনি এখনও বেঁচে আছেন, যদিও ওই সব দায়িত্বশীল পদে আসীন থাকার দরুন আগের সেই ঔজ্জ্বল্য আর তাঁর নেই। তবে চওড়া গোঁফ, ভিক্টোরীয় যুগের বনেদি চালচলন, সব মিলিয়ে তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্ব এখনও অটুট। তাঁর পরিমার্জিত আচরণবিধি এখনও তাঁকে বিশিষ্ট করে রেখেছে। তিনি প্রায়ই অতিথি আপ্যায়ন করেন কিন্তু রাত সাড়ে নটার আগেই তিনি তাদের বিদায় জানান। অতিথিরা চলে গেলেই তিনি শুতে যান। লখনৌ-এর হজরতগঞ্জে তাঁর বিশাল বাড়ি। বিকেলের দিকে বাগানে বসে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করেন। কিন্তু কখনওই হালকা ধরনের কথা তিনি পছন্দ করেন না। তিনি মনে করেন জিভের উপর একটা শাসন থাকা দরকার। গান্ধীজীর কোমরে একটি রুপোর ঘড়ি সবসময়ই ঝুলত এবং তিনি সময়ের কাজ সময়েই করতেন। স্যার চমনলালের জীবনযাত্রার প্রণালীও ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে বাঁধা।
আমার কিন্তু ধারণা বর্তমান যুগের কাছে তিনি ফসিল হলেও এখনও যে দোর্দণ্ড প্রতাপে টিকে আছেন তার পিছনে রয়েছে মনের গহীনে এক সুপ্ত বাসনা যার আর এক নাম অমরত্বের বাসনা।
বাবার কাছে শুনেছি এই ভদ্রলোক নিজের হাতে গড়া মানুষ। কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নানা বিপর্যয় রোধ করে শেষ পর্যন্ত ভাগ্যের আশীর্বাদ লাভ করেছেন।
যতদূর জানা যায়, স্যার চমনলালের বাবা ছিলেন অমৃতসরের এক শিখ পরিবারের পাচক ঠাকুর। চমনলাল চার্চ মিশন হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছেন। মিশনারিরা মাসিক সাহায্য করতেন। বেত খেয়ে তিনি নিয়মানুবর্তিতা এবং কাজ করার অভ্যাস আয়ত্ত করেছিলেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। ফলে বিলেতে গিয়ে পড়াশোনা করার জন্য স্টেট থেকে স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। খ্রিস্টান মাস্টারমশাইদের কাছ থেকে জুতোর বাড়ি খাওয়ার অপমান তিনি ভুলতে পারেননি, তাই যখনই ধর্মনিরপেক্ষ স্কলারশিপ পেলেন সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলেন। তাঁর শরীরে ছিল ব্রাহ্মনের রক্ত। সব জ্ঞানের গোড়ার কথা তিনি জেনে নিয়েছিলেন। যুক্তিতর্কেও অগাধ আধিপত্য অর্জন করেছিলেন।
কেম্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মরাল সায়েন্সে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর তিনি ‘ইনার টেম্পল বার’-এ যোগ দেবার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন।
জ্ঞানের যে প্রজ্জ্বলিত শিখা তাঁর মধ্যে ছিল সেই আলোয় জীবনে যেমন তাঁর সাফল্য এসেছে, তেমনি সেই আলোয় তাঁর অন্তরের কিছু অজ্ঞাত প্রদেশও আলোকিত হয়েছে। যেমন, পাশ্চাত্য দর্শন পড়াশোনা করে স্বদেশীয় বেদান্ত দর্শন সম্পর্কে তিনি বিরূপ ছিলেন। তাঁর পার্থিব চেতনা, বাস্তব জগৎ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়িয়েছিল। বেদান্তের শিক্ষা ‘ঈশ্বরই মোক্ষে’র পরিবর্তে তাঁর মনোভাব ছিল ‘শরীরই মোক্ষ’। ফলে ধীরে ধীরে তাঁর শরীরে মেদের স্ফীতি, উদরের স্ফীতি ও আনুষঙ্গিক সব দিকেই তাঁর স্ফীতি ঘটেছিল। পরে যাঁরা বিলেতে গিয়েছেন তাঁরা চমনলাল সম্পর্কে কিছু কিছু প্রবাদ শুনে এসেছেন। যেমন, তিনি জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রে গ্ল্যাডস্টোনের মূর্তির সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতেন। কোনও পুলিশ এসে এভাবে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি নাকি উত্তর দিতেন, ‘তারা দেখছি।’ পুলিশরা পাগল মনে করে তাঁকে আর ঘাঁটাত না।
পোশাকের প্রতি তাঁর আকর্ষণের সঙ্গে উপরোক্ত কিছু ঘটনার যোগাযোগ থাকতে পারে। গোড়ার দিকে পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি তাঁর কোনও নজরই ছিল না। অতি সাধারণ পোশাক পরতেন।
এমনও গুজব শোনা যায় যে লন্ডনে থাকাকালীন তিনি বড় বড় ফটোগ্রাফারদের চিঠি লিখতেন তাঁর ফটো তোলার জন্যে এবং তাঁদের কাছে যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ছবি আছে তাঁদের সঙ্গে তাঁর ছবিটি যুক্ত করে দিতে। আইন পরীক্ষায় প্রথম হবার পর অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি নাকি তাঁকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন এবং একসঙ্গে ফটো তুলেছিলেন। গুজব যাই হোক, অমরত্বের বাসনা যে তাঁর অনেকদিনের তার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে তাঁর বাড়িতেই। বিশাল বাড়ির ঘরে ঘরে তাঁর অসংখ্য ফটো টাঙ্গানো রয়েছে।
ভারতে ফীরে আসার পর আদালতে তিনি তাঁর পেশার মানুষদের একরকম ভাসিয়েই দিয়েছিলেন বলা যায়। তখনকার দিনে আইনজীবীদের যে গুণটি ছিল অর্থাৎ আচার-আচরণে মার্জিত রুচির পরিচয় দেওয়া — তা তাঁর ছিল। কিন্তু একদিকদিয়ে তাঁর মধ্যে মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। জনতার সামনে যখন বক্তৃতা দিতেন তখন কখনও তাঁকে অবিকল নেপোলিয়নের প্রতিকৃতি মনে হত। সেই বাঁ হাতটি বুকপকেটের নিচে রাখা; কখনও বা আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো মেরুদণ্ড টানটান করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ভঙ্গি।
এই সব যৌগিক আসন কিংবা অঙ্গভঙ্গি তিনি অনেক সাধনায় আয়ত্ত করেছিলেন। বিশিষ্ট একটি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা করতে পারতেন। শোনা যায় একবার তিনি নাকি মাঝপথে বক্তৃতা বন্ধ করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ আর বক্তৃতা দেব না, আমি খেই হারিয়ে ফেলেছি।’ সেদিন শ্রোতাদের ঢিলের আঘাতে তিনি গুরুতর রূপে আহত হয়েছিলেন।
এই ঘটনার পরেও মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে তিনি প্রস্তাব পাস করাতে পেরেছিলেন যে, শহরে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপিত হবে। তিনি ছিলেন মিউনিসিপ্যাল কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। শোনা যায় তিনি নাকি কমিটির অন্যান্য সদস্যদের ঘুষ দিয়েছিলেন। লখনৌ ডেপুটি কমিশনারকে উনি নাকি এক ঝুড়ি ফল ভেট পাথিয়েছিলেন। তবে তিনি প্রথম মহাজুদ্ধের সময়ে যুদ্ধ তহবিলে এক লক্ষ টাকা দান করেছিলেন — এই তথ্যটি কিন্তু গুজব নয়। এই মহান কাজের জন্য ‘নাইট’ উপাধি পাবার যে আশা করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য কিন্তু সফল হয়নি। যুদ্ধের কারণে তাঁর অবদানের পুরস্কার স্বরূপ ‘রায়বাহাদুর’ খেতাবটি অবশ্য পেয়েছিলেন।
যাই হোক, তিনি কাজের কাজটি হাসিল করতে পেরেছিলেন। লন্ডনের রাস্তায় গ্ল্যাডস্টোনের মূর্তির সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা দণ্ডায়মান যোগীর মতো বক্তৃতা দেওয়া, এ-সবের পিছনে সুদীর্ঘকাল তিনি যে আকাঙ্ক্ষাটিকে লালনপালন করে আসছিলেন সেটি ভূমিষ্ঠ হতে চলেছে।
আমার তো মনে হয় নিজের মূর্তির প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাস করানোর ব্যাপারে তিনি অনেক রকম চাল চেলেছিলেন। মহৎ কারণেই যে তিনি দারপরিগ্রহ করেননি এমন চালও হয়তো চেলেছিলেন। তবে তিনি যে বুদ্ধিমান ব্যক্তি এবং ভারিক্কী হলেও তাঁর আকৃতি যে সমীহ আদায় করতে পারে এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত্থাকার কথা নয়। পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির লম্বা। যদিও নেপোলিয়নের মতো সুঠাম গড়ন কিংবা গ্ল্যাডস্টোন অথবা লিঙ্কনের মতো দীর্ঘকায় তিনি নন।
আমার বন্ধুদের ধারণা যেহেতু আমার বাবা ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তাই এই ভদ্রলোক সম্পর্কে আমার অহেতুক সহানুভূতি রয়েছে। লখনৌ পোস্টফিস সংলগ্ন ছোট্ট বাগানে রায়বাহাদুর বরতমানে রায়বাহাদুর স্যার চমনলালের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে অত্যন্ত বিরক্তিকর পরিস্টহিতির উদ্ভব হয়েছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করায় লোকে তাঁকে ক্ষমা করতে পারেনি। আমার মনে হয় বড় মাপের লোকেরা বিশেষ করে যাঁরা আবার নিজেদের মূর্তি নিজেরাই প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরা কখনওই অমর্যাদাকর কোনও কাজ করতে পারে না, সম্ভবত এরকম একটা ধারণা থেকেই সাধারণ মানুষেরা তাঁর সম্পর্কে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে থাকে।
রায়বাহাদুর তাঁর মূর্তি গড়ার জন্যে ইউরোপ থেকে ভাস্কর আনতে চেয়েছেন এতে লোকে তাঁর রুচির প্রশংসা করলেও যখন গেল তাঁরই নির্দেশে রয়েল আকাদেমির অজ্ঞাতপরিচয় এক শিল্পীকে এই কাজের ভার দেওয়া হয়েছে তখন কিছু সমালোচনাও হল।
এর পর জানা গেল রায়বাহাদুরকে নাকি রোজই দেখা যায় তাঁর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। তিনি মূর্তির সঙ্গে কথা বলেন, হাসেন। কাজটি সত্যিই উপহাসাস্পদ। ফলে খর জিভের কটূক্তি তাঁর প্রতি প্রচুর পরিমাণে নিক্ষিপ্ত হল।
এরপর কয়েক বছরের জন্য রায়বাহাদুরকে লখনৌ ছাড়তে হয়েছিল। ভাইসরয় কাউন্সিলের ল-মেম্বার হিসেবে সিমলাতে গিয়েছিলেন। এই সময়ে কিছুদিনের জন্য তিনি আলোচনার বাইরে ছিলেন। কিন্তু লর্ড চিফ জাস্টিস হয়ে লখনৌ ফিরে আসার পর আবার সেই গুঞ্জনের পুনরাবৃত্তি।
স্যার চমনলাল তাঁর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, হাসেন, কথা বলেন — এসব সত্যি না ঈর্ষাপরায়ণ কিছু লোকের অপপ্রচার তা পরখ করতে কিছু সত্যসন্ধানী শৌখিন গোয়েন্দা কাজে লেগে গেলেন। দুর্ভাগ্যবশত যা রটেছিল তা সবই প্রমাণিত হল। শুধু তাই নয়, সাম্নের একটি পাম্প থেকে বালতি করে জল এনে নিজের মূর্তি সাফাই করতেও তাঁকে দেখা গেছে। কিছু বিবেকবান নাগরিক রায়বাহাদুরের এই অমর্যাদাকর কাজের সমালোচনা করে মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। আয়েসি কাউন্সিলাররা এই রিপোর্টের ভিত্তিতে কিছু করণীয় আছে বলে মনে করলেন না। রায়বাহাদুর স্যার চমনলাল তাঁদের পূর্বতন সহযোগী এবং একজন প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট। সুতরাং তাঁরা এই সব রিপোর্ট অগ্রাহ্য করলেন। নিজেদের মধ্যে তাঁরা বলাবলি করলেন শহরে ঝাড়ুদার ধর্মঘট চলছে, অনেককে তাঁরা বরখাস্তও করেছেন, এই পরিপ্রেক্ষিতে মূর্তি ঝাড়পোঁছ করার মতো লোক পাওয়া যাবে না। সুতরাং স্যার চমনলাল যদি নিজে কিংবা চাকর-বাকর দিয়ে মূর্তি ধোয়া-মোছা করেন তাতে ক্ষতিটা কোথায়?
কিন্তু এইভাবে বিক্ষোভ ধামাচাপা দেওয়া গেল না। ট্যাক্সিওয়ালা , টাঙ্গাওয়ালা এবং বিশিষ্ট অনেক নাগরিক নির্দিষ্ট অভিযোগ আনলেন যে স্যার চমনলাল রোজ সকালে নিদেনপক্ষে এক ঘণ্টা যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেন। তিনি রাস্তার ওপারে পাম্পের সঙ্গে হোসপাইপ লাগিয়েছেন মূর্তি পরিষ্কার করার জন্য। রাস্তার ওপর দিয়ে এই হোসপাইপে জল আনা হয়। চতুর্দিকে জমে থাকা জলে মশা জন্ম নিচ্ছে। এই নিয়ে খবরের কাগজে চিঠি ছাপা হতে লাগল।
মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান চৌধুরী শিউশরণ কয়েকজন কাউন্সিলরকে নিয়ে সরজমিনে একদিনে তদারক করতে গেলেন এবং যথারীতি স্যার চমনলালকে দেখলেন। নিজেও ছিটগ্রস্ত এই মানুষটি দেখলেন স্যার চমনলাল হোসপাইপ দিয়ে নিজের মূর্তি পরিষ্কার করে চলেছেন।
কাছে গিয়ে মিষ্টি হেসে চৌধুরী শিউশরণ বললেন, ‘মূর্তিটা এত সুন্দর হয়েছে, আমি হলে তো এমনিই একে রেখে দিতাম, যদি নেহাতই ধোয়া মোছার দরকার হয় তো আপনার মূর্তির জন্যে আমরা একজন সুইপার কিংবা মালী নিয়োগ করতে পারি।’
স্যার চমনলাল নিজের কাজ করতে করতেই বললেন, ‘কাকেরা আমার মাথার উপর, কপালে বিষ্ঠা ত্যাগ করবে আর মাকে তা সহ্য করতে হবে!’
চৌধুরী শিউশরণ তাঁর বন্ধুর সহজ-সরল বক্তব্য শুনে কৌতুক অনুভব করলেন কিন্তু তাঁর যুক্তিকে একেবারে অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। ঠিকই তো, মূর্তিটি যদি তাঁর নিজের হত, তাহলে তিনি নিজেই কী সহ্য করতে পারতেন এই দৃশ্য! অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তিনি উত্তর পেলেন — ‘না।’ সুতরাং জজ সাহেবের সঙ্গে দু’চারটি মামুলি কথা বলে সঙ্গীদের নিয়ে তিনি চলে এলেন।
স্যার চমনলালের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া গেল না। এদিকে সমালোচনার ঝড় বয়েই চলেছে। লর্ড মেয়রের বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠল। পরিস্থিতি এমনই ঘোরাল হয়ে উঠল যে উত্তরপ্রদেশের গভর্নরও বিচলিত বোধ করলেন। অনেক সংবাদই তাঁর গোচরে এসেছিল এবং তার সত্যতা যাচাই করলেন। গভর্নর বাধ্য হলেন স্যার চমনলালকে চিঠি লিখতে। তিনি অবশ্য তাঁকে চায়ের আসরে নেমন্তন্ন করলেন। চা-টা খাওয়ার ফাঁকে তিনি হাল্কাভাবে প্রসঙ্গটা উত্থাপন করলেন। ‘মালি আর মেথরেরা নাকি ধর্মঘটের হুমকি দিয়েছে’? স্যার চমনকে সম্বোধন করে গভর্নর বললেন, ‘পৌর প্রতিষ্ঠান বেশ মুশকিলেই পড়ে গেছে…মানে বলছিলাম কি…আমার কাঠখোট্টা কথায় কিছু মনে করবেন না…কমোড সাফ হচ্ছে না, শুকনো পাতা জমে ডাঁই হচ্ছে…।’
স্যার চমন বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, ‘আমি তো আপনার কথার মানে ঠিক বুঝতে পারছি না!’
গভর্নর হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘এই কারণেই নাকি আপনার মূর্তিটা পরিচ্ছন্ন রাখা নিয়ে অসুবিধায় পড়েছেন?’
‘না না, আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।’ স্যার চমন বললেন।
গভর্নর বললেন, ‘আচ্ছা, আপনার জন্য তা আমরা একজন মালি নিয়োগ করতে পারি।’
স্যার চমন বললেন, ‘সারা দুনিয়ায় এমন কোনও মালি পাওয়া যাবে কি যে চব্বিশ ঘণ্টা আমার মূর্তির কাছে দাঁড়িয়ে থেকে কাক তাড়িয়ে বেড়াবে?’
এ জাতীয় যুক্তি শুনে চৌধুরী শিউশরণের মতো গভর্নরের মুখও বন্ধ হয়ে গেল। সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারবিভাগীয় প্রধানের কাজে হস্তক্ষেপ করা নীতিবিরুদ্ধ বটে। গভর্নর তাই এই ব্যাপারটির উপর ছেদ টেনে দিলেন।
এদিকে স্যার চমনলাল দুরন্ত আবেগতাড়িত হয়ে তাঁর মূর্তি পরিচ্ছন্ন করার কাজে লেগে গেলেন। কাকেরা তাঁর মূর্তি অপরিচ্ছন্ন করছে আর তিনি হোসপাইপের জলের তোড়ে সেই দাগ তুলছেন। ধোওয়ার সঙ্গে মোছাও চলছে। ঘর্মাক্ত কলেবরে শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে তিনি দিনের পর দিন এই কাজ করে চলেছেন। ধোওয়া-মোছার পর সূর্যের আলোয় পরিচ্ছন্ন প্রস্তরমূর্তির ঔজ্জ্বল্য দেখে তিনি যে তৃপ্তি পাচ্ছেন তাতে তাঁর শরীর ও মন তাজা হয়ে উথেছে। এতে একদিকে তাঁর শরীর ও মন তাজা হয়ে উঠছে। এতে একদিকে যেমন তাঁর নিজের এবং মূর্তির আয়ু বাড়ছে, অন্যদিকে তেমনি তাঁর মধ্যে সৌন্দর্য-চেতনাও জেগে উঠছে। মূর্তি ধোওয়ার ফলে সংলগ্ন ফুলের বাগানটিও প্রচুর জল পাচ্ছিল। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই তাজা ফুলের শোভায় মূর্তির চারপাশের পরিবেশও সুন্দর হয়ে উঠল। তাঁর মনের ছোটখাটো অসন্তোষ, বিক্ষিপ্ততা এভাবেই চাপা পড়ে গেল।
হাসিঠাট্টা, নিন্দা, বিদ্রূপ, প্রতিবাদ, ডেপুটেশন, সভাসমিতিতে বিক্ষোভ, কোনও কিছুই স্যার চমনলালকে অমরত্বের সাধনা থেকে টলাতে পারল না। ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, কটাক্ষ, খেউড় সব কিছুই যখন ঝিমিয়ে পড়লতখন সাধারণ মানুষেরা কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়ল, কিন্তু উপরতলার মানুষেরা ব্যাপারটিকে মনস্তাত্বিক বিচারের আলোকে ব্যাখ্যা করতে চাইলেন। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছিলেন। তারপর অনেক দুঃখ-কষ্ট অত্যাচার সইতে হয়েছিল তাঁকে। অসহায়ত্ব বোধ থেকেই রোগের সূত্রপাত — ইত্যাদি অনেক পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। সাধারণ অজ্ঞ মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু এইসব পণ্ডিতদের তুলনায় অনেক সুস্থ। এদের মধ্যে অনেকেই কিছু বুঝতে পারে না বলে ক্ষমাও করতে জানে। প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু উদ্ভট বাতিক থাকেই। এই কারণেই এরা স্যার চমনলালের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল। আর যাই হোক মানুষটি তো বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, খ্যাতি ও সম্মানের শীর্ষে উঠতে পেরেছেন।
একটা সময় এল যখন সব কিছুই গা-সওয়া হয়ে এল। এমনটাই হয়। গোড়ায় গোড়ায় সব ব্যাপারেই কিছু শোরগোল হয়। তারপর আবার সব শান্ত হয়ে যায়। নইলে বানিয়াদের ল্যাংমারা স্বভাব, রাস্তায় পাগলদের খ্যাপামি, ভিখিরিদের ঘ্যানঘ্যানানি, কালোবাজারিদের রমরমা, নিরীহ মানুশের উপর পুলিসের অত্যাচার– এসব দিনের পর দিন চলে কী করে?
হঠাৎই শহরের শান্ত সরোবরে একদিন ঢিল পড়ল। স্যার চমনলালের সোনালি ফ্রেমের চশমা চুরি গেছে। তিনি ঘোষণা করেছেন চোর ধরে দিতে পারলে একশো টাকা পুরস্কার দেবেন।
বয়সের দরুন এবং কোর্টের কাজের চাপে স্যার চমনলালের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছিল। চশমা না হলে তাঁর চলে না। চোরও ধরা পড়ল না, চশমাও পাওয়া গেল না। তিনি আবার চশমা করালেন। হঠাৎই তাঁর একদিন মনে হল চশমা পরিহিত তাঁর চেহারার সঙ্গে পাথরের মূর্তির বিস্তর ফারাক। সুতরাং তিনি মূর্তির নাক ও চোখের মাপে চশমা করালেন এবং মূর্তিতে পরিয়ে দিলেন।
যে দেশে প্রায় সবাই অন্ধ হয়ে যাচ্ছে, জ্বালানি কাঠের ধোঁয়াতেই হোক আর রাজনীতির ধুলোয় আচ্ছন্ন হয়েই হোক, সেখানে চশমা তো একটি দুর্লভ বস্তু। সুতরাং মূর্তির চশমাটি যে অন্তর্হিত হবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
সুতরাং স্যার চমনলাল প্রচুর চশমা তৈরি করালেন তাঁর মূর্তিকে সাজাবার জন্যে। তিনি ভেবে দেখলেন, চোরের পিছনে ধাওয়া করার চাইতে রোজ একটি করে চশমা কেনা অনেক সুবিধের। ভেবে দেখুন সাধারণ আমেরিকান কাচের যা দাম বেড়েছে, রোজ একটি করে চশমা কিনতে কত খরচ পড়ে!
বলা-বাহুল্য জে-চোর প্রতিদিন চশমা চুরি করে সে ধরা পড়েনি। স্যার চমনলাল প্রতিদিনই তাঁর মূর্তিকে চশমা পরিয়ে সাজিয়ে আসেন। তিনি ভেবে দেখেছেন, তাঁকে কোনওমতেই বেহিসেবি বলা চলে না। আমদের দেশে প্রতিদিন কত মানুষ মন্দিরের দেবমূর্তিকে সোনাদানা, ফুল-ফল কিংবা ভোগ দিচ্ছেন। কেউ কি তাঁদের বেহিসেবি বলে? বলা বাহুল্য এবারেও কেউ স্যার চমনলালের যুক্তিকে খণ্ডন করতে পারল না। বলার কথা শুধু একটাই। যে মহত্তর আবেগ নিয়ে তিনি তাঁর অমরত্বের বাসনাকে লালনপালন করে আসছিলেন তা আনুপাতিক হারে তাঁর বোধশক্তিকে কমিয়ে এনেছে এবং তাঁর চরিত্রকে ক্ষুদ্রতার গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু সবাই জানে, পুরনো মদ নতুন পাত্রে ঢালাই তো মানুষের স্বভাব। অসুখী হবার সম্ভাবনাকে বিতাড়িত করে সুখী হবার প্রয়াসও মানুষের স্বভাবধর্ম। জীবনপাত্রের তলানি কিংবা বহমান জীবননদীর পলির মতো কেবলমাত্র অমরত্বের বাসনাই দীর্ঘকাল টিকে থাকে।
অনুবাদ – অমিয় রায়চৌধুরী
Tags: অনুবাদ গল্প, অমরত্ব, অমিয় রায়চৌধুরী, মুলক রাজ আনন্দ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।