01 Oct

অন্য ভূমিকায়

লিখেছেন:অনিলেশ গোস্বামী


‌ ( এক )

—  কীসব আবোলতাবোল কথা বলছিস  পাগলের মতো।এ হয়না,কখনও হতে পারেনা।

নিজের চিৎকারে নিজেই চমকে উঠলো দীপক। স্বাতী পাশেই দাঁড়িয়ে। দীপক আর স্বাতীর হাত দুটো বরুণ তখনও তার দু’হাতের তালুর মধ্যে বজ্রমুষ্টিতে ধরে আছে। হাসপাতালের কেবিনে সেই মূহূর্তে ওরা তিনজন। একটু পরে হাসপাতালের লোকেরা ট্রলি নিয়ে আসবে । বরুণকে নিয়ে যাবে আইসিসিইউতে। ফাঁকা কেবিনে বরুণ ওদের দুজনকেই কাছে আসতে ইশারা করলো। দুজনের হাত নিজের মুঠোয় শক্ত করে ধরে জানালো তার করুন মিনতি ,

—  দেখ ,এখন আমাকে লুকোবার কিছুই নেই। আমি সব জানি, সব বুঝি।গত কয়েকদিন  আমি অনেক ভেবে মন স্থির করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোরা জানিস আর আমিও বুঝতে পারছি যে   আমার জীবন ফুরিয়ে আসছে।একটু পরে  ওরা এসে যাবার আগে আমার শেষ ইচ্ছেটা তোদের দুজনকেই জানিয়ে রাখবো।

সেই স্কুল জীবনে থেকে আমাদের তিনজনকে কখনো আলাদা ভাবা যেতোনা।আমাদের অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা আজও  অটুট।

এই পর্যন্ত বলে বরুণ হাঁফিয়ে উঠলো। একটু দম নিয়ে শুরু করলো,

—  আমার আর কয়েকটা ঘন্টা, বড়োজোর  দু-একটি দিন।  আমাকে হারিয়ে স্বাতীর   জীবনটা হাহাকারে ভরে মরুভূমির মতো

হয়ে যাক আমি চাইনা। এখনও ওর গোটা   জীবনটা পড়ে আছে, এর মধ্যেই জীবনের   সব শখআহ্লাদ শেষ করে ও সন্ন্যাসিনীর মতো    জীবন কাটাবে এটা হতে পারেনা। এই বয়সে  স্বাতীর একাকী জীবনের লক্ষ্যহীন নিঃসঙ্গতা  ওর বাকি জীবনটা কুরে কুরে খাবে।

বরুণ আবার ক্লান্ত হয়ে হাঁফাতে লাগলো। গত পরশু থেকেই ওর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।দীপক একটু বেশি জোর দিয়ে বললো, কেন তুই এসব ভাবছিস ? তুই কিছুদিনের    মধ্যে সম্পূর্ণ সেরে উঠবি , ডাক্তারের সঙ্গে    আমার আর স্বাতীর কথা হয়েছে। প্রয়োজন    হলে “বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ” করার ভাবনাও    আছে।

বরুণ কোনো উত্তর দিলোনা। শুধু তার ঠোঁটের কোনে এক রহস্যময় হাসি দেখা গেলো। সে হাসি বড়োই করুন। দেখলেই বুকে মোচড় দেয়। বরুণ সবকথাই জানে, ডাক্তার কী আলোচনা করেছে সেসব কিছুই তার অজানা নয়।

এই অবস্থায় বরুণ দুজনের হাত ধরে আছে যাদের একজন তার একদা বান্ধবী ও প্রেমিকা এবং বর্তমানে তার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী আর অন্যজন তাদের দুজনেরই সবচাইতে কাছের প্রিয় বন্ধু দীপক। ওরা কেউই বুঝতে পারছেনা

ও ঠিক কী বলবে ।

এবারে বরুণ বললো,-  দীপু, আমরা তিনজনে ছোটবেলা থেকেই প্রাণের বন্ধু। আমরা পরস্পরকে যেরকম বুঝি, ভালোবাসি সেটা শুধু আমরাই জানি।

দীপক আর স্বাতী ভাবছিলো এগুলো নতুন কোনো কথা নয়।

—  দেখ, আমি আর বাঁচবোনা । আমি জানি আর তোরাও জানিস। আমার অবর্তমানে স্বাতী বড়ো একা হয়ে যাবে । আমাকে হারানোর

কষ্ট সম্বল করে বাকি জীবনটা স্বাতী একা থাকুক আমি চাইনা। এর থেকে বেরিয়ে আসার একটাই পথ খোলা আছে।

দীপক আর স্বাতীর চোখে জিজ্ঞাসা। এরপর বরুণ যেটা বললো সেটা দুজনের কেউই কল্পনাতেও আনতে পারেনি। ওদের চোখের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী বরুণ হঠাৎ বলে উঠলো,

–  আমার মৃত্যুর পর একা থাকলে শোকে দূঃখে    স্বাতী পাগল হয়ে যাবে। শোন কে বা কারা কী ভাববে এসবে মাথা না ঘামিয়ে খুববেশি

দেরি না  করে দীপু তুই স্বাতীকে বিয়ে করবি। স্বাতীকে যে তুইও ভালোবাসিস  অস্বীকার করতে পারবিনা।

হঠাৎ যেন একটা বিস্ফোরণ । দীপক আর স্বাতীর মনের মধ্যে তোলপাড়। কেবিনের ভেতরে পিন পড়ার আওয়াজ হলেও শোনা যাবে। এই মূহুর্তে নৈঃশব্দ যেন কথা বলছে। হাসপাতালের বাতাসে ওষুধ, ডেটলগন্ধ ও মানুষের আসাযাওয়ার চাপা শব্দ ছাপিয়ে ওদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সময়ের গন্ধ, জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রিয়তম বন্ধুর করুণ মিনতি। আসন্ন মৃত্যুর অন্ধকার টানেলের শেষে একটি মেয়ের কাছে কেউ পৌঁছে দিচ্ছে নতুন আরেকটি জীবনের হাতছানি।

স্বাতী বাকরুদ্ধ। দীপক অস্ফুটে বললো, –  এ কখনো হয়না, হতে পারে না। এসব কথা উচ্চারণ করবিনা। হাসপাতালের লোকেরা ট্রলি নিয়ে এসেছে। আমরা বাইরে থাকছি।মনের জোর হারাবিনা । সব ঠিক হয়ে যাবে।

দীপক বুঝতে পারছে এই সান্তনার কথাগুলো ফাঁকা আওয়াজ।

বরুণ একদিন সুদর্শন, তরতাজা ভীষন প্রাণবন্ত এক মানুষ ছিলো। স্বাতীও সুন্দরী , স্মার্ট কিন্তু তুলনায় বরুণের কাছে খুব চোখে পড়ার মতো নয়। দুজনের মধ্যে কলেজ জীবন থেকেই ভীষন ভালোবাসা এখবর সবাই জানতো। স্বাতীকে দীপকের খুব ভালো লাগতো। মনের প্রাণের সব কথা ওরা তিন বন্ধু ভাগ করে নিতো।

লেখাপড়ায় তুখড় বরুণ ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি পেলো ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট অর্থাৎ ডিসিএলে। দীপক নিজেও একই বছরে পাশ করে দূর্গাপুর এভিবিতে জুনিয়র ইন্জিনিয়ার । ওর বাবা-মা কলকাতার বাড়িতে আর দীপক তাদের একমাত্র সন্তান থাকে দূর্গাপুরে এভিবি কলোনিতে । কোয়ার্টার খুব চমৎকার। স্বাতী বাংলায় এমএ করে এখন এমফিল করছে। ডিসিএলের ডিজাইন সেকসনে চাকরি কনফার্ম হবার সঙ্গে সঙ্গেই বরুণ স্বাতীকে বিয়ে করলো । এবিয়ের প্রধান উদ্যোক্তা বলা বাহুল্য তাদের বন্ধু দীপক।

 

( দুই )

 

বরুণ আর স্বাতীর বিয়ের একমাসের মাথায় বজ্রপাত। আকস্মিক একটা সাংঘাতিক খবরে ওদের সুখী জীবনে নেমে এলো বিপর্যয়।

কিছুদিন আগে থেকেই বরুণের মাঝেমাঝে খুব ক্লান্তি, জ্বর , শরীরের ওজন ক্রমশ কমে যাওয়া এমন সব সমস্যা দেখা দিয়েছিলো । ও খুব একটা পাত্তা দিতোনা। কিন্তু বিয়ের পর যখন হানিমুনে যাবার প্ল্যান করছিলো তখন একদিন তীব্র শ্বাসকষ্ট হতে অফিসের ডাক্তারকে দেখালো। উনি জিজ্ঞেস করলেন যে কতদিন ধরে এই সমস্যা চলছে । তারপর সব উপসর্গ শুনে ও ভালো করে দেখে সঙ্গে সঙ্গে রাজারহাটে  টাটা হসপিটালে ওনার জানাশোনা এক বিখ্যাত অঙ্কলজিস্টের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে অনেকরকম পরীক্ষার পর জানা গেলো বরুণের অসুখ – ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকোমিয়া, স্টেজ ফোর । লাইফ এক্সপেক্টেনসি তিন থেকে চার মাস ।

দূর্গাপুর থেকে টানা একমাসের ছুটি নিয়ে দীপক কলকাতার বাড়িতে চলে এসেছে । প্রতিদিন নিয়ম করে ও আর স্বাতী রাজারহাটে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে যায়। বরুণের মা নেই, বাবা নিজেই অসুস্থ তাই দীপক চলে আসতে খুব নিশ্চিন্ত বোধ করেন। স্বাতীও এই বিপদে দীপক কাছে থাকার জন্য মনের জোর পায়। বরুণের সহকর্মীরা সবাই প্রাণপাত করছে। সব ব্যবস্থাই তারা করে যাচ্ছে।

দীপক আর স্বাতী রোজ অনেক সময় ধরে বরুণের কেবিনে থাকে যদিও ইদানিং বেডে শোয়া অবস্থায় বরুণ মাঝেমাঝেই মুখে নেবুলাইজার নিয়ে থাকে । যখন সেসব থাকেনা তখন তিনি বন্ধু মিলে অনেক গল্প করে। ছেলেবেলার মজার মজার খুঁটিনাটি, কলেজের দিনগুলি এসব নিয়ে মনের আগল খুলে দেয়।

তিনবন্ধুর মিলিত হাসিঠাট্টায় ঘরের বাতাস হালকা হয়ে যায় এবং বরুণের রোগমুক্ত জীবনের স্বপ্ন দেখার শুরু হয়। মন খুশি থাকলে ফেরার পথে কখনো কখনো দীপক বলে,-  চল স্বাতী , তোর তো ফেরার তাড়া নেই।কোথাও বসে একটু কফি খাওয়া যাক ।

এভাবেই চলছিলো কিছুদিন । একমাসের ছুটি ফুরিয়ে যেতে দীপক দূর্গাপুরে ফিরে গিয়ে অনেক চেষ্টা করে ওদের কলকাতা অফিসে একটা এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে তিনমাসের জন্যে ফিরে এসেছে। দীপকের এই ব্যবস্থা স্বাতীর খুব পছন্দ হলো। সে অনেকটা ভরসা পেলো ।

বরুণের অসুখের ব্যাপারে দীপক সবই জানে যদিও স্বাতীকে সবকিছু বলেনা। এর কারণ ওর এক ডাক্তার বন্ধু ঐ হাসপাতালেই কাজ করে। সে গতকাল সন্ধ্যায় ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলো। বলে দিয়েছে মানসিক প্রস্তুতি যেন থাকে কারণ বরুণ এখন ভেন্টিলেশনে । রক্তের পিএইচ অনেকটা নীচে, একটু একটু করে অর্গান ফেলিয়োর শুরু হয়েছে।

আজ সকালে বরুণের প্রস্তাব শোনার পর থেকেই দীপকের মনটা ভীষন অস্থির অস্থির লাগছে। এতোদিনের বন্ধু স্বাতীর মুখের দিকে ভালো করে তাকাতে পারছেনা। স্বাতী নির্বিকার।প্রয়োজনের বেশি দীপকের সঙ্গে কোনো কথা বলছেনা। তার চোখের ভাষা কেউ পড়তে পারবেনা।

পরদিন হাসপাতাল থেকে বরুণকে বার করে আনতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলো । যাবতীয় নিয়মকানুন, ঝক্কিঝামেলা সামলে দিলো বরুণের অফিস কলিগরা। কাঁচে ঢাকা গাড়িটা ফুলে ফুলে সাজিয়ে যখন রওনা হলো , টাটকা রজনীগন্ধার গন্ধে তখন বাতাস ভরে গেছে। সেদিন দীপক ইচ্ছে করেই স্বাতীকে নিয়ে যায়নি। সে গড়িয়ায় বরুণদের বাড়িতেই ছিলো।

কাঁচের গাড়িটা যখন সেখানে পৌছোলো তখন একটু রাত হয়ে গেছে। দীপক একবার স্বাতীর দিকে তাকালো। মনে হলো তার মুখটা ভরে আছে জ্যোৎস্নামাখা অশ্রুতে। কিছুটা দূরে ওদের সাবেক বাড়ির পেছনের ঝোপে ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে অবিরাম। সমস্ত চেতনাজুড়ে এক নিদারুণ ব্যথায় বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে পাথরপ্রতীমার মতো গাড়ীটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে স্বাতী। পূর্ণীমা আকাশের গোল চাঁদ আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে শহরের যান্ত্রিক শরীরে।

দীপক এগিয়ে গিয়ে ওর হাতটা আলতো করে স্বাতীর কাঁধে রাখলো ।

 

( তিন )

 

কলকাতা অফিসে তিনমাসের এ্যাসাইনমেন্ট শেষ হয়ে গেলো। দীপক ফিরে গেলো দূর্গাপুর। বরুণ চলে যাওয়ার পর এপর্যন্ত সে যতোদিন  কলকাতায় ছিলো তখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় চলে যেতো স্বাতীর কাছে। ওদের গল্পের বেশিরভাগ সময় বরুণের কথা হতো । দীপক মাঝেমাঝে অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে গল্প শুরু করতো ইচ্ছে করেই । একটা করুন হতাশ মানসিকতার দম বন্ধ করা প্রায় পঙ্গু অবস্থা থেকে স্বাতীকে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে যেতো। শোক যতই আকস্মিক ও তীব্র হোক সব মানুষকেই একটা সময় তার থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে নাহলে জীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। দীপক জানে ওকে আরো একটু সময় দিতে হবে। সময়ের নিরাময় শক্তি অপরিসীম।

দূর্গাপুরে ফিরে যাবার সময় দীপক একটু হালকা মনে রওনা হতে পারলো কারণ সে লক্ষ্য করেছে যে স্বাতী পরিস্থিতির চাপ সামান্য হলেও কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যাবার আগের দিন দীপককে জড়িয়ে ধরে বললো,  দীপু, তুইতো দূর্গাপুরের তোর কোয়ার্টারে আপাতত একদম একাই থাকবি, আমায় কথা দিয়ে যা প্রত্যেক উইক-এন্ডে আসবি ।মাসীমা আর মেসোমশাইও সেটা নিশ্চয়ই আশা করবেন।

দীপক স্বাতীর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে রইলো। বললো,  এটা আবার তোকে বলতে হবে ? আমিই কি পারবো বেশিদিন তোকে ছেড়ে থাকতে। আমি প্রতি শনিবার বাড়ি আসবো, ফিরবো সোমবার ভোরের ট্রেনে। এই দুটো দিন তুই  সন্ধেবেলাটা রাখবি আমার অর্থাৎ আমাদের জন্যে। তোকেও কিন্তু এবার পড়াশুনা শুরু করতে হবে।

এমনি করেই দিন কাটতে লাগলো। দেখতে দেখতে আরও কয়েকটা মাস চলে গেলো । সপ্তাহশেষে নিয়ম করে দীপক এসে যায়, মোবাইলে কথাবার্তাতো লেগে থাকে হামেশাই। বরুণের বাড়িতে স্বাতী মাঝেমাঝে গিয়ে ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে কিন্তু বেশিরভাগ সময় মায়ের কাছে থাকে । থমকে যাওয়া লেখাপড়ার জগতে মানিয়ে নিয়েছে।

দীপক সেখানেই আসে। স্বাতীর মা ওদের তিনজনের সম্পর্কে সব খবরই জানতেন প্রথম থেকেই। মা মেয়ে খুব বন্ধু , সবকিছু আলোচনা হয় খোলামেলা। মেয়ের বিবাহিত জীবনের শুরুতেই যে বিপর্যয় সেটা ওনাকেও কম আঘাত দেয়নি বলা বাহুল্য।

দীপককে উনি বরাবর ভীষন পছন্দ করেন। উনি লক্ষ্য করেছেন বরুণ চলে যাওয়ার পর দীপকের নিয়মিত সাহচর্য এই ছ’সাত মাসে স্বাতীকে তার জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। উনি লক্ষ্য করেছেন প্রতি সপ্তাহে দীপকের জন্যে স্বাতী কী ভীষন কাতর অপেক্ষায় থাকে। হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে বরুণের কাছে দেওয়া ওদের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে কিছু না জানলেও মা হিসেবে দীপকের সঙ্গে স্বাতীর বিয়ের সম্ভাবনা অন্তরের গোপনে লালন করতে শুরু করেছেন, স্বপ্ন দেখছেন।

ওরা কখনো কখনো চলে যায় আউট্রাম ঘাট। নদী দিয়ে একটার পর একটা নৌকার যাওয়া আসা দেখে। কখনো যায় ভিক্টোরিয়া বা লেকে অথবা অন্য কোনো ফাঁকা জায়গায়।

সেইরকমই একদিন গেছে বিবেকানন্দ পার্ক, সবমাত্র সন্ধ্যা নেমেছে । আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা, শুধু ওরা দুজন। স্বাতী সেদিন একটা নীল শাড়ি পরেছিলো, কপালে সুন্দর করে একটা একই রঙের টিপ , চমৎকার কোনো পারফিউমের গন্ধ দীপকের নাকে আসছিলো। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও অফুরন্ত গল্প চলছিলো । বেশ কিছুক্ষণ পরে দীপক ওঠবার উপক্রম করতে হঠাৎ স্বাতী বললো, তোর কি খুব ফেরার তাড়া আছে ?

—  না, তা নেই ।

স্বাতী ওর হাতটা ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো।

—  তাহলে আরও একটু থাক দীপু । আজ তোকে আটকে রাখবো আরো কিছুক্ষণ । তাড়াহুড়ো করবিনা।

স্বাতীর এই পরিবর্তন দীপকের খুব ভালো লাগছিলো। ও বোঝে শোক আঁকড়ে ধরে মানুষ বেশিদিন থাকতে পারে না। জীবনের রাজপথে তাকে ফিরতেই হয় । এটাই জীবনের ধর্ম।

স্বাতী যথেষ্ট সুন্দরী, তবু তাকে এই মুহূর্তে দীপকের একটু বেশি সুন্দরী আর আকর্ষণীয় লাগছিলো।

এই অবস্থায় স্বাতী আচমকা দীপককে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো । তারপর ওর কোনো প্রস্তুতির অপেক্ষা না করেই দীপকের গালে, গলায় ও শেষপর্যন্ত ঠোঁটের ওপর একটার পর একটা চুম্বন , পাগলের মতো। সাতাশ বছরের যুবক দীপকের রক্তে আগুন লাগলো, তারুণ্য উদ্বেল। স্বাতীর পরনের শাড়িটা বিস্রস্ত, সেদিকে খেয়াল করার অবস্থায় নেই,  আঁচল সরে গিয়ে স্তনযুগল উন্মুক্ত । কাছাকাছি কেউ নেই দেখে দীপক তার দুহাতে স্বাতীকে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে উন্মত্তের মতো আদরে আদরে মাতিয়ে তুললো।

মূহুর্তের জন্যে মনে হলো বরুণের ছায়া কি ওদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ? কিন্তু তখন আর ঐসব চিন্তাকে প্রশ্রয় দিলোনা। মনে মনে উচ্চারণ করলো এই মূহুর্তে শুধুমাত্র ওরা দুজন ছাড়া বিশ্বসংসারে কেউ নেই। আছে শুধু বাঁধনছাড়া যৌবনের পাগলামি , মাথার ওপর খোলা আকাশ আর সামনে সবুজের বিস্তার। ওকে জড়িয়ে ধরেই স্বাতী বললো,  বরুণ বড়ো নিষ্ঠুরের মতো আমাকে একলা ফেলে চলে গেলোরে । দীপু , এখন তোকে ধরে আমি বাঁচতে চাই , তুই আমাকে বল্ ফেরাবিনা ।

একটা আবেশে আচ্ছন্ন ছিলো দীপক । সে জবাব দিলো,  আমি নিজেও সেটাই চাই স্বাতী । আমিও তো তোকে ভালোবাসতাম কিন্তু জানতে দিইনি কোনোদিন। আমরা ঘর বাঁধবো , আমাদের নিজস্ব একটা সংসার হবে এটা আমিওতো চাই । অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের কথার মধ্যে , জীবনযাপনের মধ্যে বরুণ এসে যাবেই। কিন্তু তোর মনে তার অতীত উপস্থিতি কোনো…

স্বাতী ধমক দিলো – না, আমার বিবেক পরিস্কার । বরুণের কাছে আমাদের প্রতিশ্রুতি পালনের সময় হয়েছে। দেখতে দেখতে প্রায় দুটো বছর পেরিয়ে গেলো দীপু । তোর আপত্তি নেই তো ?

দীপক কোনো কথা বললোনা । শুধু স্বাতীকে আরো একটু জোরে জড়িয়ে ধরলো ।

 

( ৪ )

 

স্বাতীর মায়ের খুশি আর ধরেনা । বরুণের হঠাৎ চলে যাওয়া ওনার মনটাকেও যে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এই বয়সেই মেয়ের জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে এই চিন্তা তাঁকেও কুরে কুরে খাচ্ছে। যে ফুল ফুটে ওঠার আগেই ঝরে গেলো তার রেখে যাওয়া গভীর শূন্যতা আর অবসাদ একটু একটু করে গ্রাস করছে মেয়ের সমগ্র অস্তিত্ব।

বরুণের চলে যাওয়ার পর দুবছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। উনি লক্ষ্য করেছেন যে দীপকের সান্নিধ্য স্বাতীকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করছে। কিছুটা পড়াশুনা , বিশেষ করে তার হারিয়ে যাওয়া হাসি আবার ফিরে এসেছে। দীপককে উনি নিজেও খুব পছন্দ করেন। ভাবেন , আহা ওরা দুজন মেলামেশা করুক , জীবনের হারিয়ে যাওয়া সবকিছু নতুন করে ফিরে পাক ।

ঠিক এমন সময় স্বাতী জানালো সে আর দীপক বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে । মায়ের সাথে তার সম্পর্ক বন্ধুর মতো তাই হাসপাতালে বরুণের শেষ ইচ্ছা আর ওদের দুজনের কাছ থেকেই প্রতিশ্রুতি আদায় করা – সবকথা মাকে সবিস্তারে জানালো । সব শুনে মায়ের আনন্দ আর ধরে না এবং একথাও বললেন যে মনে মনে তিনি নিজেও ঠিক এটাই চাইছিলেন।

কয়েকদিন পর থেকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিলেন তিনি। কোনোরকম বাড়াবাড়ি হবেনা এই শর্তে উনি নিমরাজি হয়েছেন বটে তবু সবকিছু পুরোপুরি মানলেন না। স্বাতীকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমেই একটা নতুন বেনারসি কিনে ফেললেন। প্রয়োজনীয় কিছু কিছু কেনাকাটা জোর করে করতে শুরু করে দিলেন। প্রথমে আপত্তি করলেও পরে স্বাতীর নিজেরও ভালোই লাগছিলো। প্রথম বিয়ের স্মৃতি একটু হলেও ফিকে হতে শুরু করেছে। দীপকের হাত ধরে সে একটা নতুন জীবনে প্রবেশ করতে চলেছে। বেশ উত্তেজিত লাগছে।

দীপকের কলকাতার বাড়িতে থাকেন শুধু তার বাবা আর মা , দীপক তাদের একমাত্র সন্তান। ওর বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসার ছিলেন, অবসর নিয়েছেন। বর্তমানে পেনশনভোগী। বাবা-মা দু’জনেই উদার প্রগতিশীল মনের মানুষ।তাঁরা ওদের তিন বন্ধুর সম্পর্কে সব কথা জানেন। তাই দীপক যখন স্বাতীকে বিয়ে করার কথা জানালো ওনারা দুজনেই খুব খুশি হলেন।

দীপক আর স্বাতী দুজনেই স্বাতীর মাকে বলেছিলো যে কোনো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান যেন না হয়। সবটাই সাদামাটা, নিয়মমাফিক হবে। শুধুমাত্র রেজিষ্ট্রি করে মালাবদল । তারপর কোনো একটা রবিবার দুবাড়ির ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব সমেত ছোট্ট করে একটা রিসেপশন । দীপকের বাবা-মা রাজি হলেও স্বাতীর মা এইরকম মামুলি অনুষ্ঠানে আপত্তি তুললেন । তাই শেষপর্যন্ত একটা মধ্যপন্থা ঠিক হয়েছে। ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়মকানুন সবটা না মানলেও অন্তত কিছুটা মেনে নিতে হবে। সেইমতন নতুন বেনারসি থেকে শুরু করে বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ড , বরের ধুতি-পাঞ্জাবি ইত্যাদি মা আর মেয়েতে মিলে প্রবল উৎসাহে ঘুরে ঘুরে কিনতে লাগলো। অনেকদিন পর স্বাতীর এতো খুশি আর আনন্দ দেখে তার মায়ের বুকের ওপর থেকে একটা পাথর নেমে গেলো।

বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। একমাস পরেই , গোধূলি লগ্নে। দীপক বর্তমানে ওদের কলকাতা অফিসে আছে। এর মধ্যে দু-এক দিন অন্তর ওদের দেখা হয়েছে। ওর দূর্গাপুর এভিবি কলোনির সুন্দর কোয়ার্টারের ছবি দেখে স্বাতী ঠিক করে ফেলেছে ওটার সামনে যেটুকু ফাঁকা জমি আছে সেখানে ফুলের বাগান করবে ফুলের বাগান ওর ভীষণই ভালো লাগে।

বিয়ের এখন বাকি আছে পনেরো দিন। ওরা ঠিক করেছে বিয়ের পর দীপক পনেরো দিনের ছুটি নেবে হানিমুনের জন্য। কোথায় যাবে বিয়ের দিন চারেক আগে দুজনে বসে প্ল্যান করবে কারণ যাওয়ার টিকিট, হোটেল বুকিং ইত্যাদি সবকিছু আগে থেকে ঠিক করতেই হবে।

ঠিক করেছে বিয়ের পর কিছুদিন স্বাতী দূর্গাপুরে থাকবে। তারপর ফিরে এসে আগে এমফিল কমপ্লিট করবে। এইসময়টা ওরা দুজন নিজেদের ছুটিছাঁটায় কলকাতা দূর্গাপুর যাওয়া আসা করবে।

বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছেন স্বাতীর মা। স্বাতীর আপত্তি না শুনে বিয়ে উপলক্ষে দূরের কয়েকজন আত্মীয়কে আমন্ত্রণ করে বাড়িতে ডেকে এনেছেন যাতে বিয়েবাড়ি একটু গমগম করে। যতই হোক স্বাতী তাঁর একমাত্র মেয়ে । প্রথম বিয়ের দূঃখ ভোলার জন্যে এই বিয়েটা ভালো করে হোক এটাই ইচ্ছে।

তাই জলপাইগুড়ি থেকে স্বাতীর রেণুপিসি আর সদাহাস্যময় বাড়ি মাতিয়ে রাখা পিসেমশাই, বাঁকুড়া থেকে জাড়তুতো দাদা বৌদি, আর স্বাতীর খুব ভালো বন্ধু প্রায় সমবয়সী ধানবাদের ইরা মাসি আর তার মা । সবার উপস্থিতি আর কোলাহলের জন্যে বাড়িটা উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে।

দীপক দুদিনের জন্যে দূর্গাপুর গেছে। তিনদিন পরে শনিবার, সেদিন ফিরবে । সেদিনই সন্ধ্যায় স্বাতীর মা ওকে নিমন্ত্রণ করেছেন । ওর পাঞ্জাবী টা একসাথে পছন্দ করবে , তারপর ঠিক চারদিন পরে বিয়ে । হানিমুনের ডিটেল পরিকল্পনা দুজনে মিলে করে ফেলবে। সব মিলিয়ে অনেকটা সময় লাগবে। তাই একেবারে রাতের খাওয়া সেরে বাড়ি যাবে ।

তারপর সামনের চারদিন ওরা আর দেখাসাক্ষাৎ করবেনা যদিও করতে পারে অনায়াসেই, তবু স্বাতীর মায়ের অনুরোধে ওরা দুজনেই এই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে।সেই বহুকাঙ্খিত শনিবার এসে গেলো ।  সকাল থেকেই স্বাতী বেশ উত্তেজিত, অকারণ খুশি খুশি ভাব। ছেলেবেলার বন্ধু, বর্তমানে প্রেমিকই বলা যায় আর মাত্র কয়েকটা দিন পরে ওর বর। ‘স্বামী’ কথাটা কেমন যেন ভারি শোনায়, তার চেয়ে বেশি মিষ্টি লাগে শুধু ‘ বর’ । এখনও সেই শব্দটার গায়ে নতুনের গন্ধ লেগে আছে।

সন্ধ্যা নামার আগে স্বাতী খুব যত্ন করে সাজলো। ওর সেই ফেভারিট পিঙ্ক কালারের শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ। কপালে একই রঙের টিপ সামান্য বড়ো করে আর হালকা পারফিউম। যদিও অনেকদিনের পরিচয় তবু মন যেন বলছে ‘ তোমায় নতুন করে পাবো ‘বলে‌ এই অধীর অপেক্ষা। দুতিনবার ফোন করার চেষ্টা করলো ঠিক কখন আসছে জানার জন্যে কিন্তু প্রতিবারই বলছে সুইচড্ অফ্ । আরতো একটু পরেই দেখা হবে তবুও ছটফটানি কমছেনা। নিজের এই ছেলেমানুষীতে নিজেই হেসে ফেললো স্বাতী । বাড়ির সবাই গল্পগুজবে মশগুল, স্বাতী নিজেও মাঝেমাঝে তাদের সঙ্গে সানন্দে যোগ দিচ্ছে। চারদিন বাকি থাকলেও ইতিমধ্যেই উৎসবের কোলাহল শুরু হয়েছে।

হঠাৎ দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। স্বাতী মনে মনে স্বীকার করলো যে দীপকের সময়জ্ঞান প্রশংসা করতেই হবে। সে হাসতে হাসতে দৌড়ে গেলো। সামনে দীপককে দেখে কতটা উচ্ছাস দেখিয়ে ফেলবে ভাবতেই হাসি পেয়ে গেলো। কিন্তু দরজা খুলেই দেখলো একজন অপরিচিত ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাতীর পরিচয় জেনে ওর হাতে সিলকরা খামে একটা চিঠি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলো । একটাও কথা বললোনা।

চিঠিটা হাতে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এসে খুলে ফেললো।

 

( ৫ )

 

দীপক স্বাতীকে এই চিঠি লিখেছে । স্বাতী পড়তে শুরু করলো…

স্বাতী,

এই চিঠি যখন তোর হাতে পৌঁছবে আমি তখন অনেকদূরের পথে চলেছি। কোথায় যাচ্ছি এখন কিছুই জানাবো না কারণ এই মূহুর্তে তার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই । না, কোনো ভয় নেই, আমি বিবাগী হয়ে যেদিকে দুচোখ যায় তেমন করে বেরিয়ে যাচ্ছিনা।

এখন আমি কোনো একটি দূরপাল্লার ট্রেনের কামরায় জানলার ধারে সিটে বসে আছি। বাতাস কেটে কেটে আওয়াজ করতে করতে খুব দ্রুত পিছনে চলে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ অজানা প্রান্তর , গাছগাছালি , বনজঙ্গল, শস্যখেত । এই জানলার বাইরে ছুটে চলা দৃশ্যপটের মতোই অতীতে চলে যাচ্ছে আমার মন । তুই বিশ্বাস কর আমার প্রিয় কোনো একটি জনমানবহীন পাহাড়ের কোলে শান্ত আশ্রয়ে কয়েকটি দিনের জন্যে আমি চলেছি আমার নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে। সেটাই এখন আমার জীবনবোধের চারণভূমি ।

বরুণ আর তোর সম্পর্কের রসায়ন যখন বুঝতে পেরেছিলাম তখন থেকেই আমি নিজেকে একটু একটু করে গুটিয়ে নিতে শুরু করি । শুধুই তোর একজন বন্ধু এই সম্পর্ক সর্বদাই লালন করতাম। দূর থেকে তোদের লক্ষ্য করে মনকে বোঝাতাম এ-জগতে আমার প্রবেশাধিকার নেই।

কিন্তু বরুণের অকালমৃত্যু আর তারপর থেকেই তোর নিবিড় সান্নিধ্যে আমার সব অনুভূতির জগতটা ওলোটপালট হয়ে গেলো।

ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারছিলাম মানুষের জীবন অসংখ্য আকস্মিকতায় ভরা যার ফলাফল সবসময় তার ইচ্ছামতো ঘটেনা। তাই জীবনে কোনো একটা সময় জন্ম নেয় এমন কিছু অনুভূতি যা নিঃশব্দে ফুল ফোটার মতো যার গন্ধে ভরে ওঠে মন। সব মানসিক বাধা অতিক্রম করে অবুঝমন আবিষ্কার করে পাতার আড়ালে বসে থাকা কোনো রঙ্গিন পাখি, সময়ের শ্যাওলার নীচে ঘ্রাণ পায় জলজপ্রাণের।

হ্যাঁ , আজ সমস্ত অন্তর দিয়ে আমার স্বীকার করতে একটুও দ্বিধা নেই আমি তোকে ভালোবাসলাম।

কিন্তু মনে মনে যতই তোকে আপন করে কাছে টানি তখন হঠাৎ বরুণের ছায়া সামনে এসে যায়। আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পর থেকেই আমি বরুণের শূন্যস্থানের অস্তিত্ব বেশি করে অনুভব করতে শুরু করেছি। মনে হতে থাকে তার রেখে যাওয়া ঘর, ফেলে আসা শূন্য শয্যায় , তোর সাথে নিবিড় সম্পর্কের অসমাপ্ত অধ্যায়ের ভেতরে আমি কি একজন ট্রেসপাসার? ভূমিকা বদল করে আমি কি তার প্রেমিকাকে দখল করতে চলেছি – এইসব চিন্তা থেকে আমি এখনো মুক্ত হতে পারিনি।

তোকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করার আগে মনের সঙ্গে এই বোঝাপড়া আমার খুব দরকার। তাই কিছুদিনের জন্য আমার সেচ্ছানির্বাসন ।

স্বাতী , তুই আমাকে ভুল বুঝলে আমি কিন্তু খুব কষ্ট পাবো। তোকে কি আমি ঠিক বোঝাতে পারলাম ?

নির্জনতায় নিজেকে বুঝে নেবার জন্যে তুই আমাকে কয়েকটা দিন সময় দিস্ । আমি কতদিন এখানে থাকবো ঠিক নেই। আগে মনস্থির করি । তারপর… তোর মোবাইলের নম্বরটাতো আমার ফোনে রাখাই আছে। প্রয়োজনে আমার একটা আঙুলের স্পর্শের অপেক্ষা।

 

— দীপু

স্বাতীর মা অনেকক্ষণ ধরে মেয়েকে দেখতে না পেয়ে চিন্তা করছিলেন। দীপক কথা দিয়েও আসেনি। কিন্তু সে এইরকম করার ছেলে নয়। ভাবলেন হয়তো কোনো জরুরী কাজে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটু চিন্তা নিয়েই উনি স্বাতীকে কোথাও দেখতে না পেয়ে কৌতুহলের জন্যে ছাদে গেলেন। সেইখানে মেয়েকে দেখতে পেয়ে বেশ অবাক হয়ে গেলেন। একা দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই স্বাতী তার মাকে প্রাণপনে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। সে কান্না থামতেই চায়না। তার মা কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছেন এমন সময় স্বাতী বলে উঠলো,

—  মা, সবাইকে জানিয়ে দাও এই বিয়েটা হচ্ছেনা। দীপু চলে গেলো মা , আমার কাছ থেকে চলে গেছে। এর বেশি আমাকে কিছু বলতে বোলোনা, আমি পারবোনা।উনি বুঝলেন একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটে গেছে যেটার জন্যে ওরা তৈরি ছিলোনা। কিছু না জানলেও মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলেন। বাড়িভর্তি আত্মীয়-স্বজন, তাদের হাসিঠাট্টা, কোলাহলের শব্দে বিয়েবাড়ি জমে উঠেছে। কেউ জানতে পারলোনা নিশুতি ছাদের ওপর এক মেয়ে তার মাকে জড়িয়ে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে।

শহরের জীবন যেমন ছন্দে চলে তেমনি চলেছে। ছাদের ওপর সুনসান।নারকেল গাছের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে শুক্লপক্ষের চাঁদ।

[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]   

Tags: ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ