গনেশ চ্যাটার্জির মেয়ে বোধহয় এবার হেরেই যাচ্ছে।
ছমাস ধরে।
রোজ একটু করে। আরেকটু করে।
মা এখন হাঁটতে গেলে পড়ে যায়।
দোতলার বারান্দার জানালা দিয়ে রামুকে আর বকেনা – বাগানের কাজে ফাঁকি দিলেও।
কল্পনাকে ব্যাগের থেকে টাকা বের করে বাজার করতে দেয়না আর।
সে ব্যাগটাই হারিয়ে গেছে কবে।
চেনা মুখগুলো হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতি থেকে।
সুখ দুঃখের কত স্মৃতির অনুক্রম বদলে যাচ্ছে।
প্রতিদিন।
মাকে আজকাল বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়নি কতদিন ।
আমার ভাইপো সমীর ডাক্তার ছিলো। অনেক ভালো ভালো ডাক্তার বন্ধুও ছিলো তার ।
ও থাকলে ঠিক কাউকে নিয়ে আসত বাড়িতে। দিদাকে দেখাতে।
নিজেই যে অসময়ে চলে গেলো ও।
মায়ের খাতাতে হেরে যাওয়া ছিলো না কিন্তু কোনো দিনই।
যখনই দেয়ালটা পিঠের কাছে এসে যেত, মা নিজেকে মনে করিয়ে দিতো
– আমি গনেশ চাটুজ্জের মেয়ে।
সেই মহামন্ত্রের সামনে সব বিপদকেই থমকে যেতে দেখেছি।
#
অন্ততঃ ষাট বছর না পিছিয়ে গেলে এ গল্পটাকে শুরু করাই মুশকিল।
তখনও চীনের যুদ্ধ হয়নি, গ্যাগারিন মহাকাশে পৌঁছয়নি, আমার রামকৃষ্ণ আশ্রম স্কুলের জীবন শুরু হতে আরও কিছুটা সময় বাকি । সেই সময়টাতে একটা ছবির মতো ছেলেবেলা ফেলে এসেছি আমি।
ভগবানের আঁকা ল্যান্ডস্কেপ।
ছোট্ট একটি বাড়ি। তখনো মাটির। সামনে সেই মাপেরই খেলার মাঠ। সারা বছরই সবুজ।
ও পাশে ঘন বাঁশবন। একটু হাওয়াতেই গাছেদের ফিসফিসানি।
গরমে, বর্ষায় শীতে আলাদা আলাদা সুরে। অনেক গল্প জানতো ওরা।
আর এপাশটায় ছিল গাড়ি চলার রাস্তা।
তার ওপারে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত।
বিকেলের আকাশটা যখন লাল থেকে ধূসরে পাল্টাচ্ছে, নারকেল গাছের মাথায় উনুনের সাদা ধোঁয়া জমছে, বাঁশবাগানের শেয়ালগুলো তখন রাস্তা পেরিয়ে ধানক্ষেতের দিকে ছুটে যেত। ডাকতে ডাকতে।
ঝুপ করে সন্ধে পড়ে যেত তখনই।
দূরের তালগাছগুলো যারা সারাদিন হাসিমুখ দেখিয়েছে, সন্ধ্যের পরে যেন হাসিটা পালটে ফেলতো।
অন্য রকম। ভয়ের ভয়ের।
ধান ক্ষেতটাকে আমরা মাঠ বলতাম।
তার একেক ঋতুতে একেক রূপ।
প্রথম বর্ষায় খুব ভারী বৃষ্টিতে সমুদ্র হয়ে যেত সে। আশেপাশের পুকুরগুলো ভরে গেলেতো কথাই নেই।
মনে আছে একদিন এমন জল থৈ থৈ বৃষ্টিতে যখন মা আক্ষেপ করছে ঘরে মাছ নেই বলে, দুটো কই মাছ পুকুর, মাঠ, রাস্তা পেরিয়ে বাড়িতে এসে হাজির।
মাঝ বর্ষায় সেই দূরের তালগাছগুলো পেরিয়ে কালো কালো মেঘ ভয় দেখাতে আসতো আর হালকা সবুজ নবীন ধানের চারাগুলো কিছু না বুঝে আনন্দে নেচে উঠতো।
লক্ষী পুজোর আগেই ধানের শীষ এসে যেত। আর কোজাগরীর রাতে জ্যোৎস্না, হালকা কুয়াশা, মাঠ ভরা ধান – এরা সবাই মিলে এক বিশাল কবিতার খাতা খুলে বসতো ।
জীবনানন্দ তো আরও কত পরে পড়েছি।
ওই মাঠ পেরিয়েই শীতের উত্তরে হাওয়া আসত। পৌষ সংক্রান্তির ঘুড়ি খেলার প্রাঙ্গন তৈরী হতো ওখানেই।
#
জটিরামদা নামের এক মানুষ আমাদের বাড়িটা বানিয়ে দিয়েছিল।
বাবা মা দিদি দাদারা আগে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতো।
মা-র সেটা পছন্দ হবে কেন!
জটিরামদা সেটা জানতো, বুঝতে পারতো।
একদিন বাবাকে বললো – মাস্টারমশাই, জমি আছে যখন সমস্যা কি ?
বাবা জানতেন জটিরাম সাথে থাকলে সমস্যা সত্যিই নেই। বাঁশ সস্তা। মাটিতো কিনতেই হবেনা।
টালিটা কেবল আনতে হবে শ্রীরামপুরের শহর থেকে।
ব্যাস আমাদের নিজেদের বাড়ি তৈরী হয়ে গেলো।
আর একদিন সেখানেই আমি আমার প্রথম পৃথিবীটাকে পেলাম।
আমাদের শোওয়ার খাটগুলোও মনে হয় জটিরামদারই তৈরী ছিল – বাঁশ দিয়ে।
সেগুলো একটু উঁচু ছিল। সকালে ঘুম ভাঙলে লাফ দিয়ে নামতাম– মনে আছে।
সেই মাটির বাড়িতে একদিন সকালে আমরা অনেক দুঃখের মধ্যেও প্রাণ খুলে হেসেছিলাম।
সে এক ভীতু চোর অনেক যত্ন করে কত সময় নিয়ে সিঁদ কেটেছিল।
সেই সময়েই হয়তো বাড়ির কেউ টয়লেটের জন্য বাইরে বেরিয়েছে। চোর পগার পার। ফিরেও আসেনি।
সকালে আমরা দেখি খাটের তলায় সকালের অনেক আলো ।
আর তার পেছনে মাটির দেয়ালে সিঁদ কাটার অপূর্ব শিল্পকাজ ।
বেচারা।
সেই ঘটনার পরে গণেশ চ্যাটার্জির মেয়ের দেওয়ালটা মাটির থাকেনি অবশ্য আর বেশিদিন।
মাটির মেঝে আর টালির চাল পাল্টায় আরও কিছু পরে।
#
আমরা গরিব ছিলাম না।
পুজোয় নতুন জামা হতো, লক্ষীপুজোয় ইলিশ ভোগ।
শীতে ধুনুরি এসে লেপগুলোকে নতুন করে দিতো।
বছরে একবার রংওয়ালা এসে ট্রাংক দুটোকে রং করতো ।
আর আমাকে খুশি করতে ডালাটায় একটা বড় করে ফুল এঁকে দিতো ।
মাঝে মধ্যেই মাংস হতো। আর সুতো দিয়ে কাটা আধখানা ডিম তখন তো সবাই-ই খেতো।
কখনো সামনের মাটির উঠোন লেপে সত্যনারায়ানের পুজো করতাম আমরা।
সেই দিন মা খুব সুন্দর ক্ষীরের নাড়ু বানাতো।
বুঝতেই পারতো না যে তার ছোট ছেলে ভগবানের খাওয়ার অপেক্ষায় না থেকে কিছু নাড়ু আগেই শেষ করে দিয়েছে।
আমরা গরিব ছিলাম না।
আশেপাশে সবাই এই রকমই তো ছিল।
ওপার বাংলা থেকে আসা অনেকেই দেশভাগের কোপে তখন কম বেশি আহত।
এখন মাঝে মাঝে মনে হয় স্বাধীনতার জন্য যারা সব ছেড়েছিলো, তাদের কেউ মুক্তিযোদ্ধা কেন বলেনি ?
ছ দশক আগের সেই গ্রামটি তার ঘন বাঁশবন, উর্বর ধানক্ষেত, শরতের শিউলি, শীতের খেজুর রস আর গরমের তালশাঁস নিয়ে আমার বড় প্রিয় শান্তির নীড় ছিল।
অনেক ভোরে সংকীর্তনের সুরে ঘুম ভেঙেছে।
হরির লুঠের বাতাসা নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছি বন্ধুদের সাথে।
মাঠের প্রান্তে উঁচু ঢিবিতে চড়ে অভিযানের আস্বাদ নিয়েছি কতবার।
আমরা গরিব ছিলাম না।
তবু দক্ষিণের বারান্দায় সন্ধেবেলায় মাদুর পেতে যখন পড়তে বসতাম, মুদির খাতা নিয়ে বাবা মায়ের গোপন মিটিং এর ফিসফিস কানে এসেছে এক দুবার।
সেইসব মিটিংয়ের পরে তাঁদের পান–জর্দার ওপরে স্বেচ্ছা নিষেধাজ্ঞা পড়তো।
তবে সে অন্ধকার কাটিয়ে মোটামুটি দশ দিনের মধ্যে পান জর্দা ফিরে আসতো যে যার নিজের জায়গায়। বংশীদাও টাকা শোধের জন্য কোনো দিনই চাপ দেয় নি।
যেদিন ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস থাকতো, আমরা রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে তৈরী থাকতাম।
কিসের জন্য তৈরী থাকতাম বুঝিনি সেই বয়সে।
ঝড়েরাও সব কিছু বুঝে ঠিকঠাক দিক পাল্টে অন্য কোন দিকে চলে যেত।
সকালেই আবার ঝকঝকে রোদ্দুর।
গ্রামে গরিব লোকও ছিল।
লক্ষীপূজোর রাতে দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি প্রসাদ খেতে বেরিয়েছি আমরা ।
নারায়ণদের বাড়িতে দেখি দরজা ভেজানো – ভেতরে অন্ধকার।
বৌদি বললো এবার পুজো হয়নি। সকালে মাকে বললাম সেই কাহিনী।
– ওরা যে খুব গরিব রে । লক্ষ্মীপুজো করে কি করে বল?
সময়ের দেওয়ালে গেঁথে গেলো সেই শব্দগুচ্ছ।
নারায়ণের বাবার নামটি কিন্তু এই পরিস্থিতির সাথে ভারী বেমানান ছিল – গান্ধী বাবু।
এখনো চোখে ভাসে ছ ফুটের রোগা মানুষটি ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলেছেন জীবিকার সন্ধানে।
#
বাবা ছিলেন সেই গ্রামের মাস্টারমশাই।
কর্মযোগী ঋষি পুরুষ।
লক্ষী ঠাকরুনকে ঠিকঠাক নিয়ে আসতে পারেননি পূর্ব বাংলা থেকে।
কিন্তু শিব ঠাকুর, মা সরস্বতী, বিশ্বকর্মা আর ধন্নন্তরীর সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল।
সে আরেক গল্প। অনেক বড়। অন্যদিন হবে।
যে মানুষটি একদিন অনেককে আশ্রয় দিতে পারতেন, তিনি অক্লেশে শরণার্থী শিবিরে দিন কাটিয়েছেন।
কোনো আক্ষেপ শোনেনি কেউ কোনোদিন। বিদ্বেষও ছিলোনা কোথাও।
পূর্ব জীবনের দিনগুলো তাঁর কাছে শুধু সুখের স্মৃতি ছিল।
আর বর্তমানের বাস্তবতা – সে তো পথের সাথী।
সহজ দৈনিকতার মানসিকতা নিয়ে সেটিকে গ্রহণ করার সরল দর্শন ছিল তাঁর।
আর ছিল বুক ভরা সাহস।
সেই সব দিনে শীতের রাতে গ্রামে ডাকাত পড়তো।
এমন দুটি রাতে তাঁকে দেখেছি লাঠি হাতে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে।
বাবার জিনের এই দু তিনটে টুকরো আমি পাইনি। বা সুপ্তই থেকে গেলো হয়ত।
বাস্তুচ্যুত হওয়ার ব্যাপারে মা অবশ্য বাবাকে এক গোলে হারিয়ে দিয়েছে। বাবা একবার তো মা দু দু বার। মা যখন এইটুকু ছোট, আমার দাদু ভূমিকম্পের পর বিহারের মুজাফ্ফরপুর ছেড়ে সপরিবারে এ বাংলায় চলে এসেছিলেন।
বাবা যদি মাস্টারমশাই ছিলেন তো মা ছিল গ্রামের দিদিমনি বা দিদু। আরবয়সীদের কাকিমা।
অনেক বাড়িতে মেয়ে দেখা থেকে বিয়ে পর্যন্ত মায়ের উপস্থিতি ছাড়া কেউ ভাবতে পারতো না।
আমাদের সেই ছোট জগৎ থেকে হাসপাতাল তখন অনেক দূরে।
অনেক শিশুরই ধাত্রী মা ছিল গণেশ চাটুজ্যের মেয়ে।
আর মার দেওয়া অদ্ভুত সব নাম নিয়ে তারা তাদের ছেলেবেলা কাটিয়েছে।
আদর দিয়ে মোড়া থাকলে নামের মানে কে আর খোঁজে!
অনেক মেয়েলি সমস্যার সমাধান কাকিমার পরামর্শেই সহজ হতো।
বাবা আর মা মিলে আমাদের বাড়ির দেওয়ালগুলোকে যেন গ্রামের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছিল।
আমি তখন ষাটের দশকের হাত ধরে বড় হচ্ছি।
সেই বয়সটা।
যখন স্কুলও ভালো লাগে, আর স্কুলের ছুটিও।
যখন একই সাথে আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ আর সত্যজিৎ হওয়ার স্বপ্ন অবাস্তব লাগে না।
#
সেই বয়সটায় আমার এক বড় গর্বের নাম ছিল শ্রী অনিল কুমার চট্যোপাধ্যায় – আমার সেজোমামা ।
সেজোমামা সাহিত্যিক ছিল।
পরিপাটি মানুষটি একটু গম্ভীরের দিকেই।
বাবার সাথে কিন্তু তার কথা যেন শেষ হতো না।
হৃদযন্ত্রে কোথাও একটু খুঁত ছিল, হয়তো সেই কারণেই মামা অকৃতদার থেকে যায়।
সাহিত্যিক হিসেবে মামা তখনও উদীয়মান। শারদীয়া সংখ্যায় গল্প ছাপা হতো।
তবে নাট্যকার হিসেবে তখনই বেশ ভালো নাম ।
তারাশঙ্কর, শৈলজানন্দের মতো সাহিত্যিকদের স্নেহধন্য ছিল মামা। তাঁদের লেখা চিঠি পড়েছি আমি।
রঘু ডাকাত নিয়ে মামার লেখা নাটক কলকাতার এক নামি থিয়েটারে অনেকদিন চলেছিল।
আমাদের বাড়িতে সেই নাটকের বইটা ছিল। অনেকবার পড়েছি।
একদিন পাড়ার লাইব্রেরিতেও দেখি বইটাকে।ব্যাস বইটা ইস্যু করতেই হলো ।
আর লাইব্রেরিয়ানকে গর্ব করে জানাতেই হলো সে বইয়ের লেখকের সঙ্গে আমার পরিচয়।
সে ভদ্রলোক চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে ভালো করে দেখলেন পাঁচ সেকেন্ড আর একটা তিন সেকেন্ডের মৃদু হাসির পরে অন্য কাজে মন দিলেন।
হু!
গ্রামের রোগ পটকা একটা বাচ্চা ছেলে। তার মামা নাটক লেখে।
সে নাটক ছাপা হয়, আর লাইব্রেরিতেও জায়গা পায়।
এতোগুলো অসম্ভবতা তিন সেকেন্ডের হাসিতে প্রকাশ করা খুব সহজ ব্যাপার নয়।
তাও তো তাঁকে রেডিওর কথাটা বলার সুযোগই পাইনি।
আমার স্কুলের বন্ধুরা আর প্রতিবেশীরা সন্দেহ করেনি কিন্তু।
তখন বেতার নাটক খুব জনপ্রিয় ছিল। ভালো ভালো মঞ্চের শিল্পীরা রেডিওয় অভিনয় করতেন।
শুক্রবার রাত আটটার জন্য সবাই অপেক্ষা করতো।
সেজ মামার লেখা নাটক প্রায়ই প্রচারিত হতো ওখানে।বেতার জগতে মামার ছবিও এসেছে একাধিকবার।
দুরকম নাটক ছিল। কিছু নাটক মৌলিক – পুরোপুরি মামার লেখা।
আবার কিছু নাটকের গল্প কোনো বিখ্যাত লেখকের আর নাট্যরূপ মামার – যেমন তারাশঙ্করের রসকলি। .
তখন খুব কম বাড়িতেই রেডিও থাকতো।
বংশীবাবুর বাড়িতে ছিল।
ওঁদের জানালা থেকে আমাদের জানালা প্রায় পঁচিশ ফুট দূরে। মাঝখানে শুধু একটা বাঁশের বেড়া।
মামার নাটক হলেই ভ্রমর বা গৌরী ওদের জানালায় রেডিওটা কে ফিট করে আমাদের জানিয়ে দিতো।
এদিকের জানালায় আমরা ততক্ষনে তৈরী।
গ্রামেরা তখন গ্রামের মতোই ছিল – রাত আটটার আগেই শব্দ আর আলো বিশ্রাম নিয়ে নিতো।
আমাদের দুধের মধ্যে চোনা ছিল শুধু পাশের রাস্তাটি।
নাটকের নাটকীয়তম মুহূর্তেই হয়তো ছুটে এলো এক লোহা লক্কর ভরা লরি নিজেকে জাহির করতে করতে।
অথবা নিকুঞ্জদা বাঁশবাগানের নৈশ তাড়ির আখড়া থেকে বেরিয়ে তখনই রাস্তায় চলে এসেছে।
তাড়ির প্রভাবে মহাজাগতিক দার্শনিক নিকুঞ্জদা প্রথমে সবাইকে শিক্ষিত করবে আর শেষে জীবনের তুচ্ছতায় বিচলিত হয়ে কাঁদতে বসে যাবে। উঁচু স্বরে।
বলে রাখি নিকুঞ্জদা কিন্তু নিকুঞ্জদা নয়।
তাড়ির প্রভাব না থাকলে সে ভারী ভব্য বিনয়ী স্নেহশীল এক ভদ্রলোক।
তাড়ি তার চরিত্র বদল করে বলে আমি তার নামটা বদলে দিলাম।
এই গাড়ি আর তাড়ির উপদ্রবটা শুক্রবার রাতেই যেন বেশি কানে লাগতো।
ওপারে গৌরী আর ভ্রমরও রেডিওর শব্দ নিয়ন্ত্রণ করে করে ভারী ক্লান্ত।
আমার মামার বাড়ি ছিল গঙ্গা পেরিয়ে – সুখচরে।
পরে বেশ সুন্দর একটা বড়সড় বাড়ি হলেও প্রথমে যে একটা ছোট দু তলা ভাড়া বাড়ি ছিল সেটাকেই বেশি মনে পড়ে আমার ।
সিঁড়িটা একটু অন্ধকার ছিল কিন্তু বাকি বাড়িটা সবসময় হাসতো।
শৌখিন এবং সুপুরুষ শ্রী গণেশ চন্দ্র চট্যোপাধ্যায় ছড়ি হাতে প্রতিদিন যথাযথ ব্যক্তিত্ত্ব নিয়ে সান্ধ্য ভ্রমণে বেরোতেন। দোতলার বড়ো ঘরটি ছিল তাঁর।
সেখানে বড় বাটায় তাঁর জন্য পান সাজানো থাকতো আর কুলুঙ্গিতে লুকিয়ে থাকতো রাঙামামার
পানামা সিগারেটের প্যাকেট।
বাকি সব কুলুঙ্গিতে অনেক অনেক গল্প জমা ছিল। এখন হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের গর্তে ।
মামা মাসিদের মধ্যে যেন প্রতিভার অঘোষিত প্রতিযোগিতা ছিলো।
গান, নাচ, সাহিত্য, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন সব নিয়ে সুখচরের সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল আমার সেই মামাবাড়িটি।
অনেক লোক আসত।
নিজেদের নাটকের দল পর্যন্ত ছিল।
সেই সময় আর সেই মানুষগুলোকে নিয়ে মহাভারত লেখা যায়।
লিখবে হয়তো আমার কোনো ভাই বোন কোনোদিন।
অল্প দূরেই এক মাসির বাড়ি। মেসোমশাই ডাক্তার।
স্বল্পভাষী, অত্যন্ত বিনয়ী লোকটিকে দেখলে বোঝা যেতনা যে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজে নেতাজীর পাশে ছিলেন।
#
এক শনিবার সকালে মা আমায় ডেকে বললো
–কুঞ্জবনকে একটু বাড়িতে আসতে বলিস তো।
আমাদের পাড়াটা ছিলো একটা দ্বীপের মতো। বাঁশবন আর মাঠ দিয়ে তিন দিক ঘেরা।
আর পেছনে বেড়ার ওপারে সবজির ক্ষেত।
পুবে পাঁচ মিনিট হাঁটলে পূর্ব বাংলা আর পশ্চিমে অল্প দূরেই পশ্চিম বাংলা।
না না ভূগোলে নয়। কথা বলার ভাষায়।
সেই দ্বীপটি আমাদের পাড়া আর পরিবার দুইই ছিল।
দুপাশে দুই জেঠতুতো দাদার আর একটু কোনের দিকে এক পিসতুতো দিদির বাড়ি।
মাঝখানে এক দোতলা বাড়ি – তারা একটু দূরের।
বংশীদা ছাড়া সবাই মুখার্জী, তাই মুখার্জী পাড়া।
গঙ্গার এপারে আমাদের পাড়ার দোতলা বাড়ির লোকেরা একদিন শহরে চলে গেলো।
সেই বাড়িতে ভাড়া এলো তিন মালায়ালী যুবক – রবি, পুরুষোত্তম (পুরষু) আর কুঞ্জবন।
কাছেই কোনো অফিসে চাকরি করতো ওরা।
অসমবয়সী আর অন্যভাষীদের সাথে সহজেই বন্ধুত্ব হয়ে যেত আমার।
যেমন স্কুলের রাস্তায় এক পালোয়ান (নামেও, কাজেও) যে হাত মেশিনে মহা বিক্রমে খড় কাটতো।
বা রেললাইনের ওপারের পানের দোকানী, যেখানে আমি পয়সা জমিয়ে কোকা কোলা কিনতাম।
মিষ্টি সুপুরি ফ্রী।
ওরা ওদের বিহারের গ্রামের গল্প শোনাতো।
আমার শুনতে বেশ লাগতো। ওদের বলায় সুখ।
এক প্রৌঢ়প্রায় বিহারী ভদ্রলোকের সাথে ভারী মজার সম্পর্ক ছিল।
তাঁর নামটা আমরা ঠিক জানতাম না। দেখা হলেই রাগিয়ে দেওয়ার জন্য রাধেশ্যাম বলে ডাকতাম ।
তো উনি তাড়া করে আমাদের কাউকে ধরে ফেলতেন। তখন সীতারাম বললে তবেই ছাড়া পাওয়া যেত।
সে খেলাটা হয়তো তাঁরই ডিজাইন ছিল। আমাদের দিয়ে রাধেশ্যাম আর সীতারাম দুটোই বলিয়ে নেওয়ার ছল।
আরও একজন ছিল – বর্ধমান দাদা। সে ছিল আমার স্কুলের হিন্দি হোম টাস্ক যুদ্ধের গোপন অস্ত্র।
অন্যভাষী রবিদের সাথে বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি বেশি।
রবির একটা টাইপ রাইটার ছিল আর পুরষুর ছিল একটা সাইকেল।
আমার শেখার অসীম আগ্রহে সে দুটিকে মাঝে মধ্যেই সারাতে দিতে হতো ওদের।
রাগ হলেও বুঝতে দেয়নি কোনোদিন।
তখন কি জানতাম যে একদিন পৃথিবী জুড়ে বাচ্চা বুড়ো সারাদিন টাইপ করে দিন কাটাবে!
খুব চটপট বাংলা শিখে নিয়েছিল রবিরা।
আমার মালয়ালি শেখার চেষ্টাটা খুব বেশি এগোয়নি যদিও।
নারকেল তেলে ভাজা ওদের টাপিওকা আর কাঁচকলা আমার খুব প্রিয় ছিল।
তবে আরও ভালো লাগতো বাড়িতে রোস্ট করা দানাতে তৈরী কফি।
ভাত খাওয়ার আমন্ত্রণও থাকতো কখনো।
কিন্তু করলা ভাজা আমার চিরকালেরই অপছন্দ আর টক দই খাওয়া শিখেছি তো আরও আঠেরো বছর পরে, আমেদাবাদের জীবনে।
কুঞ্জবনের মাথায় ছিল ঘন কোঁকড়ানো চুল। ও ছিল সবথেকে ছোট আর সবার থেকে লম্বা।
বাংলায় একটু কমজোরি ছিল। সে অভাবটা মিটিয়ে দিতো ওর মিষ্টি হাসি।
অবসর সময়ে কুঞ্জবনের কাজ ছিল রেডিও বানানো।
রোস্টেড কফি, নারকেল তেল আর ইলেকট্রনিক বোর্ডের রাং ঝালাই ওদের বাড়িটাকে এক অসাধারণ নতুন রকম গন্ধে ভরিয়ে রাখতো সারাদিন।
মা যে কুঞ্জবনকে বাড়িতে আসতে বলেছে তার গভীর তাৎপর্য বুঝতে পেরে আমি একটুও দেরি করিনি।
পরের দিন সকালেই টেনে এনেছিলাম।
আমাদের বাড়িতে শোয়ার ঘরে খাটের কিছুটা ওপরে আর টালির চালের ঠিক নীচে ছিল একটা ছোট মাচা। খাটে দাঁড়ালে হাত পাওয়া যেত। সেই মাচায় আর সব দরকারি, আধা দরকারি জিনিসের মধ্যে লুকিয়ে থাকতো আমার মার লকার – একটা খুব ছোট টিনের বাক্স।
যে গয়নাটা মার্ গায়ে নেই আর যে পয়সাটা মাসের শেষে বেঁচে গেলো তা মায়ের লকারে থাকত।
কুঞ্জবনের আসার দিন সকালে মা বাবার মিটিং হলো। মায়ের লকারে জমা টাকার হিসেবও হল।
মা ওকে কিছু অগ্রিম দিল। বাকি টাকাটা সে সামনের সপ্তাহে কখনো নিয়ে যাবে।
আর সামনের সপ্তাহের শনিবারে আমাদের ঘরে নতুন রেডিও আসবে!
পরের কয়েকটা দিন কুঞ্জবনদের বাড়িতে অন্তত একবার করে যাওয়া আমার রুটিনে এসে গেল।
দিনগুলোকে তখন অলস আর দীর্ঘতর লাগতো।
অনেক অনেক গড়িমসি করে একসময় পরের সপ্তাহটা এল। আর তো মাত্র ছ দিন।
সময়টা ফাল্গুন মাস ছিল।
আমার মতে ফাল্গুনই ঠিক ঠিক বসন্তকাল।
চৈত্রমাস কে আমার গ্রীষ্মের বিজ্ঞাপন মনে হয় – গায়ে ছাই মেখে রাগী সন্যাসী হয়ে বসে থাকে।
ফাল্গুনের সকাল সেজেগুজে আসে ।
উজ্জ্বল অথচ পেলব সূর্যালোকে।
তার শরীরে অনেক রকম সুগন্ধ।
আম বাগানে সে স্নিগ্ধ তো মহুয়ার বনে মাদক।
বেস্পতিবারও এসে গেল।
আর তো মাত্র দুদিন।
#
খাটে বসে পড়ছি – মা ঘরে এল। আজ বিকেলে বিশ্বাসদের বাড়িতে মেয়ে দেখতে আসবে।
মাকে থাকতে বলেছে ওরা। লকার থেকে গয়না বার করতে হবে।
টিনের বাক্স থেকে গয়না বার করার জন্য মা খাটে দাঁড়ালো। আমি তলায়।
একই সাথে দুজনেরই নজরে এল যে চালের একটা টালি সরানো। মাচায় সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছে।
মার সন্ত্রস্ত হাত তখন বাক্সের সন্ধানে। সেটা খুঁজে পেয়ে একটু আশ্বস্ত হয়ে মা ডালাটা খুললো।
কানে এলো এক অস্ফুট আওয়াজ আর আমি তখন দেখতে পাচ্ছি যে মার সারা শরীরটা কাঁপছে।
দুর্বল পা দুটো হার মানল – খাটের ওপরে পড়ে গেলো মা।
হাতে বাক্সটি ধরা।
শব্দ শুনে বাবা দৌড়ে এলেন বাইরে থেকে।
খাটের ওপরে পাথরের মূর্তি হয়ে বসে আছে এক রিক্তা নারী।
আমার মা।
তার চোখে কোন ভাষা নেই।
হাতে বাক্সের ডালাটি ধরা। ডালাটির তলায় ঝুলছে সেই টিনের বাক্সটি – অনন্ত শূন্যতায় ভরা।
একটাও গয়না নেই, পয়সাও নেই কিছু। সব চুরি হয়ে গেছে।
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে আছি। মাযের চোখে চোখ রাখার মত মনের জোরই নেই।
বাইরের পৃথিবীতে ফাল্গুনের সেই সকাল সুসজ্জিতই ছিল।
ঘরের পেছনে বাগানের আম গাছে তখনও কোকিল ডাকছে।
সুনীল নির্মল আকাশ। বাতাসে মুকুলের সুবাস। ব্যস্ত মৌমাছি।
হালকা আলোয় স্নান করছে এক সুখী পৃথিবী।
ভেতরে দম বন্ধ করা ঘরটির মধ্যে আমাদের পথের পাঁচালীতে তখন শ্রাবন রাতের নিবিড় অন্ধকার।
গভীর, অনেক গভীর, তলহীন শূন্যতা।
ঘন। ছোঁয়া যায়।
চুরির খবর শুনে অনেকে এলো। সবারই মন খারাপ। তাদের মনে যে প্রশ্নটা বারবার ফিরে আসছে সেটা নিয়ে তার আগেই আমরা বাড়িতে আলোচনা করেছি।
এতো দক্ষতায়, ঠিক জায়গার টালিটা সরিয়ে চুরি করার একটাই মানে হয় – চোর আমাদের পরিচিত।
আমরা কি চিনতাম তাকে।
কিন্তু মা আগেই না বলে রেখেছে।
যদি সে না হয় ? কত অপমান, কত হেনস্থা হবে বেচারীর।
এক বৌদি মার কাছে গিয়ে নীচু স্বরে বললো – কাকিমা আজ আর নাহয় রান্না করলেন না। আমিই পাঠিয়ে দিই আজ ?
বৌদিকে জড়িয়ে আশীর্বাদ করে, গণেশ চাটুজ্যের মেয়ে নিজেই রান্না ঘরে চলে গেল।
ওই দুঃখটার মধ্যে থাকতে আর ভালো লাগছিলোনা আমাদের। আমি স্কুলে চলে গেলাম।
বিকেলে মা বিশ্বাসদের বাড়িতেও গেলো – মেয়ে দেখার অনুষ্ঠানে।
পরে – অনেক দিন পরে – বুঝেছিলাম যে বাবা মার জীবনের জমা খরচের খাতায় সেই গয়নার বাক্সটা খুবই ছোট ছিল। নগণ্য।
হিসেবরক্ষকরা যাকে রাউনডিঙ এরর বলে।
কুঞ্জবনের বাড়িতে আর গেলাম না – ও তো খবর পেয়েই যাবে।
শনিবার এলো।
রেডিওটা আসার কথা ছিল আজ।
সকালটায় একটু মন খারাপ হলো। স্কুল থেকে দেরি করে ফিরলাম বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলে।
ঘরে ঢুকতেই মা বললো – দেরি করলি যে? কুঞ্জবন রেডিও নিয়ে বসে আছে তোর জন্য। কি সুন্দর দেখতে হয়েছে রে। আওয়াজটাও বেশ ভালো ।
বছর দশেকের ছেলে যে প্রশ্ন করেনা সেটাই বেরিয়ে এলো মুখ্ ফসকে।
– মা – কিন্তু – টাকা?
মা হাসলো।
রেডিওর টাকাটা তোর বাবার হোমিওপ্যাথি বাক্সে রাখা ছিল কদিন ধরে।
কুঞ্জবন ঠিক কবে আসবে বলে যায়নি তো।
তারপর যে অন্য প্রশ্নটি করিনি তারও উত্তর দিয়ে দিলো ।
– গয়নার কথা ভাবছিস তো? বড় হয়ে বানিয়ে দিবি। দিবি না?
সহজ পৃথিবী। আর তার সোজা অংক।
মাকে গয়না বানিয়ে দেওয়া হয়নি আমার। বড় হতে একটু দেরি করে ফেলেছিলাম। তত দিনে মার গয়না পড়ার ইচ্ছে ফুরিয়ে গেছিলো। আর তার আগে মার ছোট খাটো প্রয়োজন গুলো আমার দিদি দেখতো। দাদারা খেয়াল রাখতো।
আমার ছোট থেকে বড় হওয়ার রাস্তাটা তৈরি হয়েছিল ষাটের দশক চিরে।
এই সফরে যদি আমার অভিভাবক ছিল আমার স্কুল তবে সাথী ছিল সেই ছোট ট্রানজিস্টর সেটটি।
#
রামকৃষ্ণ আশ্রম স্কুল তখনও নবীন। আমাদের সাথেই বড় হয়েছিল সে।
ছোট শান্ত কালীমন্দির আর অনেক ফুলের বাগান নিয়ে সাজানো থাকতো আমার স্কুলটি।
ঝিলের পাশটায় ছিল তখন প্রার্থনার ঘর। প্রার্থনা সংগীতের পর কাউকে কোন বিষয়ে বক্তৃতা দিতে হতো।
দিন পনেরোর মধ্যেই কি করে যে হেড মাস্টারমশাই মিহির বাবুর চোখে পড়ে গেলাম জানিনা। রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর প্রস্তুতি চলছে তখন। তো কাল আমায় কবিগুরুকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে।
যত্ন করে স্ক্রিপ্ট লিখে, মুখস্ত করে স্কুলে গেলাম। জীবনের প্রথম বক্তৃতার জন্য তৈরী।
কি জানি কি কারণে দু তিন লাইন বলার পরেই দু চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এলো।
থামেনা একদম। অবাধ্য। নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
সেই সাংঘাতিক অপমানের মধ্যেও আমার মনে তখন ক্ষীণ আশা – এই শেষ – আর নিশ্চয়ই আমার ডাক পড়বেনা।
কিন্তু সে ছিল এক নাছোড়বান্দা স্কুল।
মোটামুটি মাস ছয়েকের মধ্যেই কেচে, ইস্তিরি করে আবার আমায় নতুন করে মাঠে নামিয়ে দিয়েছিল। আমাদের ছেলেরা বক্তৃতা, আবৃত্তি, বিতর্ক আর রচনা প্রতিযোগিতায় সব জায়গা থেকেই জিতে আসতো।
ক্লাস এইটে উঠলে মহারাজ কালীমন্দিরে নিয়ে গেলেন। পুজো শেখাতে না – মনের ব্যায়াম ক্লাসের জন্য। এখনো মন যখন বিক্ষিপ্ত হয়, মহারাজকে মনে পড়ে।
এখনো ধ্যান করি।
স্কুলের পরিপূরকের কাজ করে চলেছিল রেডিওটি।
মামার লেখা নাটক শোনানোর জন্য যে যন্ত্রটি ঘরে এসেছিলো সে সারা দুনিয়ার দরজা খুলে দিল।
শ্রীলংকা থেকে আমিন সায়ানি তো এলেনই। সাথে সাথে এলো ঢাকা রেডিও, বিবিসি আর ভয়েস অফ আমেরিকাও। মনে আছে, মধ্য ষাটে যখন কৃষ্ণান, জয়দীপ আর প্রেমজিৎ ভারতকে ডেভিস কাপের চ্যালেঞ্জ রাউন্ডে নিয়ে গেলো, অস্ট্রেলিয়া রেডিও ইংরাজী আর হিন্দির সাথে বাংলাতেও ধারাবিবরণীর ব্যবস্থা করেছিল। বেশ গর্ব হয়েছিল সেদিন ।
বিশ্ব রাজনীতিতে তখন আমেরিকা রাশিয়ার ঠান্ডা লড়াইয়ের দাপট।
কিউবার মিসাইল সংকট নিযে পৃথিবী ধ্বংসের মুখোমুখি। নিজের দেশে কেনেডি আর মার্টিন লুথার কিংকে যাঁরা বাঁচাতে পারলো না, সেই আমেরিকা তখন ভিয়েতনামে শান্তির নাটকে ব্যস্ত।
শুধু একটাই উজ্জ্বল ছবি সেই দশকটিকে প্রযুক্তি বিদ্যার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখবে।
দশকের শুরুতে গাগারিন মহাকাশ ছুঁয়ে এসেছিলেন আর দশকটি শেষ হওয়ার আগেই নীল আর্মস্ট্রং মানুষকে চাঁদ পর্যন্ত পৌছে দিলেন।
ষাটের দশকের আশেপাশে আকাশবাণী কলকাতা ছিল বাংলার সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, অন্য লঘু সংগীত, সাহিত্য, অভিনয়, বাচিক শিল্প সব কিছুতেই বাংলায় তখন এক স্বর্ণযুগ চলছে।
বড় মাপের অনেক উচ্চতার সব শিল্পী।
কলকাতা রেডিও তাঁদের সবাইকে সাদরে আমাদের ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে এসেছিলো।
আকাশ বাণীর নিজস্ব সঞ্চালক ও সংবাদ পাঠকরাও সেই সংস্কৃতির শরিক ছিলেন।
সময়ে অনেকেই বিখ্যাত হয়েছিলেন।
দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তো এমনকি পদ্মশ্রী ভূষিতও হয়ে ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের পর।
দেবদুলালের অসামান্য প্রতিভা বাংলা সংবাদকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল।
তাঁর বলার ভঙ্গিতে প্রতিটি সংবাদের টুকরোই নিজস্ব চরিত্র ও মেজাজ ফুটে উঠতো।
উজ্জীবিত কন্ঠস্বর সুসংবাদ নিয়ে আসত। আর কখনো যদি তাঁর কন্ঠস্বর খাদে নেমে গম্ভীর হয়ে যেত আমরা এক শোক সংবাদের জন্য প্রস্তুত থাকতাম।
সময়টিও অসামান্য ছিল।
ষাটের দশকের প্রথম দুটি বছর, রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী, আমাদের প্রজন্মের কাছে ঈশ্বরের এক বড় উপহার। প্রতিটি ইন্দ্রিয় দিয়ে তখন রবীন্দ্র সংস্কৃতি আত্মস্ত করার সুযোগ পেয়েছি।
তারপরে এল চীনের যুদ্ধ। বড়রা সারাদিন রেডিওর সামনে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে থাকতো তাজা খবরের জন্য। আমাদের মতো ছোটদের কাছে কিন্তু বাষট্টির সেই যুদ্ধও যেন এক উৎসব ছিল।
খবরে শুনতাম আমাদের সেনানী বীরের মতো যুদ্ধ করছেন।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মহিলারা দল বেঁধে তাঁদের স্বর্ণালংকার দান করছেন প্রতিরক্ষার জন্য।
আর সব থেকে ভালো লাগতো দেশাত্মবোধক গানগুলি।
বিশেষ করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে – মাগো ভাবনা কেন।
এই সুমধুর গানটি শুধু কালজয়ী নয় দেশের সীমানাও ছাড়িয়ে গেছিল।
সত্তরের দশকে এই গানে অনুপ্রেরিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীও।
বাষট্টির পরে পশ্চিমবাংলায় ভালো দেশপ্রেমের গান আর তৈরী হয়নি কেন কে জানে!
#
স্কুলের শেষ ক্লাসটিতে পৌঁছে গেলাম একদিন।
সে বছর গরমের ছুটিতে মামার বাড়ি গিয়েছিলাম। সেজোমামা একটা সুন্দর কলম উপহার দিল।
একটা চিঠি খোলা ছিল মামার টেবিলে। এক স্বনামধন্য মানুষের লেখা। লুকিয়ে পড়লাম।
মন খুশিতে ভরে গেল। কপট অভিযোগে অতি স্নেহের সুরে তিনি মামাকে লিখেছেন যে রেডিও স্টেশন তাঁকে আর ডাকে না। আর তার কারণ আমার মামা।
মামার অনেক নাটকই তখন বেশ জনপ্রিয়। শুক্রবার ছাড়াও তখন মাসের কোনো এক মঙ্গলবারে রাত দশটায় একটি নাটক সম্প্রচারিত হতো সর্ব ভারতীয় স্তরে। সেখানেও মামার লেখা এক মৌলিক নাটক এসে গেলো।
ষাটের দশকের সেই দ্বিতীয় অর্ধে রাজ্য রাজনীতি অত্যন্ত অস্থির। আমরা রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম না। কিন্তু আমাদের স্কুলের বিতর্ক সভায় অবাধে আলোচনার সুযোগ পেতাম। বিতর্কে আমাদের সাথে আমাদের শিক্ষকরাও যোগ দিতেন। আর একটি বৈশিষ্ট ছিল। বিষয়বস্তুর সপক্ষে বা বিপক্ষে কে অংশ গ্রহণ করবে সেটা মাস্টারমশাইরা ঠিক করতেন। আমাদের তাই প্রতিটি মুদ্রার দুটি দিকেই নজর রাখতে হত।
বড় হয়েছি সেটা প্রমাণ করার একটা তাগিদ থাকে সেই বয়সে।
তখন ছাত্র আন্দোলনে পশ্চিম বাংলায প্রায়ই ধর্মঘট হচ্ছে। এই রকম একদিন আমরা কয়েকজন ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলাম। ক্রমে দল ভারী হল। স্কুলের গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবো আন্দোলনে যোগ দিতে এমন ইচ্ছে।
গেট খোলাই ছিল। কিন্তু গেটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক হিমালয়।
হেমবাবু খুব শান্ত স্বরে তাঁর হালকা পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণে বললেন – ভিতরে যা, বাইরে বিপদ আছে।
দেবতূল্যু হেমবাবুকে হেড মাস্টারমশাইও শ্রদ্ধা করতেন।
তাঁর সামনে দিয়ে গেটের বাইরে চলে যাওয়ার মতো পায়ের জোর আমাদের ছিল না।
#
ক্রমেই বড় পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। পড়াশোনা শেষই হতে চায়না। আমার রেডিও শোনার সময় কমে এল।
সেদিন বোধহয় রবিবার ছিল।
পড়ার টেবিল ছেড়ে রেডিও শুনতে এলাম একটু। মা বাবা আর এক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেশী তখন স্থানীয় সংবাদ শুনছেন। বেশির ভাগ খবরই রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে।
আজ আবার খবরের শেষ দিকে সংবাদ পাঠকের কন্ঠস্বর খাদে নামলো এবং গম্ভীর হলো।
বুঝতে পারলাম বাংলার কোন কৃতী সন্তান অসীমে অন্তর্হিত হয়েছেন।
নিশ্চুপ ঘর। অপেক্ষায় আমরা।
রেডিও থেকে ভেসে এল সেজোমামার নাম।
নামটিকে যেন সুনিশ্চিত করতে আরও দুটি শব্দ কানে এল – নাট্যকার এবং সুখচর।
ঘরে বজ্রপাত হলো।
এমন একটি দুঃসংবাদ আমাদের সব চিন্তার বাইরে ছিল।
মামা তখনও প্রথম চল্লিশে। মধ্যদিনেই এলো তাঁর গোধূলি।
ছোট সেই খবরের টুকরোটি আমাদের টেনে নিয়ে এলো একেবারে অন্য এক পৃথিবীতে।
এখানে অন্য নাটক। অতি কঠিন নাট্যকার। কুশীলব আমরাই।
আর আমাদের সামনের রেডিওটি – মামার নাটক যাকে ঘরে নিয়ে এসেছিলো।
রেডিওটা বন্ধ করে দিলাম।
এক অনন্ত বিয়োগের মুখোমুখি আমরা।
শূন্য মন। বোধ নেই। সময় দাঁড়িয়ে আছে। স্থির।
বাইরের রাস্তাটিও নিস্তব্ধ। অচেতন। নির্জন। মৃত।
ঘরে স্তিমিত হারিকেনের আলো।
বাবা বসে আছেন। চোখ বন্ধ। ঋষি পুরুষ আশ্রয় নিয়েছেন তাঁর আত্মিক লোকে। সেখানে শোক নেই।
মার চোখ খোলা। দৃষ্টি অনেক দূরে। এখানে নেই। এই ক্ষণেও নয়।
স্মৃতিলোকে পৌঁছে গেছে বিহারের সেই ছোট শহরে।
অথবা ভবানীপুরের সেই ছোটবেলায়। তার কিশোর সেজদার কাছে।
দুঃসময়ের প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি – নৈশব্দ, অন্ধকার আর ঈশ্বরহীনতার ভগ্নস্তুপে।
সেই অনন্ত অসহনীয় অবসাদ থেকে উদ্ধার করলো আমার মায়ের কোমল ঋজু কন্ঠস্বর।
মাথায় স্নেহের হাতটি রেখে গণেশ চ্যাটার্জির মেয়ে বলল,
– শুয়ে পড বাবা। ঘুমিয়ে নে একটু। কাল ভোরে আমরা সুখচরে যাবো।
[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]
Tags: গল্পের সময় ব্লগ, দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়, মা, সেজোমামা আর আমাদের রেডিওটা
email:galpersamay@gmail.com
সুখপাঠ্য।।দারুন লাগলো।।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।