আমরা বসেছি বলরাম মণ্ডলের দাওয়াতে। মণ্ডল মশাই বড় গৃহস্থ। সিলিং-সারপ্লাস জমি যাওয়ার পরেও হাতে যা আছে, তা চাষ করতে বেশ কিছু মুনিশ মাহিন্দার লাগে। মাথা ছাড়ানো চওড়া দেয়ালের একদিকে নিচু দরজা দিয়ে মাথা নামিয়ে ঢুকতে হয় তাঁর বাড়িতে। এক কোণে বেশ বড় গোয়াল। দুটো মরাই।
আমাকে যারা মণ্ডল মশাইয়ের খোঁজ দিয়েছেন, বাড়ি পর্যন্ত সঙ্গে এসেছেন তাঁরা সব বাম পার্টিকর্মী। স্থানীয় পঞ্চায়েতের ছোট-বড় সদস্য। ১৯৯৫ সাল। হেমন্তের মাঝামাঝি। অল্প ঠাণ্ডা। কেউ একজন হ্যাজাক জ্বালিয়ে এনেছে। মণ্ডল মশাই খাটিয়াতে। আমাদের জন্য তিনটে চেয়ার । আমার সঙ্গী দীপক হালদার। সমবায় পরিদর্শক। গ্রামে গ্রামে ঘোরার কাজ। আর আছেন লক্ষ্মীনারায়ণ শীল। ইউনাইটেড ব্যাংকের স্থানীয় ব্রাঞ্চের ম্যানেজার। তাঁর অনেক গ্রাহক এদিকের সব গ্রামে। মিশুকে মানুষ। ছুটির দিনে প্রায়ই বেরিয়ে পড়েন আমার সঙ্গে।
বেলাবেলি বেরিয়েছিলাম। পথে অনেক গ্রাম। সব গ্রামেরই নিজের নিজের গল্প আছে। দিনের আলো থাকতে সেইসব গ্রাম ছুঁয়ে তাদের গল্পগাছা শুনতে শুনতে সন্ধে নামার মুখে শ্রীনিধিপুরে বলরাম মণ্ডলের কাছে যাব। তাঁর মত প্রাচীন মানুষ এদিকে আর নেই। বছর কয়েক আগেই আশি পার করেছেন। গল্প বলেন নাকি কথকের মত। জোতদার। কিন্তু পঞ্চায়েত-চালানো-পার্টির লোকেরা একবাক্যে তাঁর কথাই বলেছেন। এদিকের পাড়াগাঁয়ের পুরনো কথা তাঁর মত আর কেউ জানে না।
পথে থেমেছিলাম সিউর গ্রামে। এককালে বীরভূমের গ্রামনাম নিয়ে চমৎকার একটি বই লিখেছিলেন বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির শিক্ষক সত্যনারায়ণ দাস। কোপাই এবং বক্রেশ্বর এই দুই নদীর মাঝবরাবর যে দীর্ঘ জনপদমালা, সিউর তার কেন্দ্রীয় গ্রামগুলির মধ্যে একটি। সত্যনারায়ণবাবুর ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় গ্রামনামটির উৎস দ্রাবিড়। অর্থ সূর্য বা অগ্নির গ্রাম (সি-অর )। গ্রামের ধর্মঠাকুরের নাম কটা রায়। তার প্রথম পুজো এবং প্রথম বলির অধিকার মাল জনজাতির একটি পরিবারের। মালেরা আদতে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মানুষ, যারা বাংলা দেশে আছে অস্ট্রিক ভাষাভাষী জনজাতির অনেক আগে থেকে। তাহলে এ গ্রামের ধর্মঠাকুর কটা রায় কি আদিতে কোন সূর্য দেবতা ছিলেন? আশুতোষ ভট্টাচার্য মশাই তো বলেছেন অনেক গ্রামের ধর্ম পূজাই সূর্য উপাসনার রূপভেদ।
তত্ত্বকথা সরিয়ে রেখে সিউরের গড়ে ঢুকি। এই গ্রাম নাকি সেন যুগে শিবাদিত্য সিংহ নামে এক স্থানীয় সামন্তরাজার রাজধানী ছিল। তারই অবশেষ এই সিউরের গড়। অর্ধচন্দ্রাকৃতি জলাশয় দিয়ে ঘেরা। দু’পারে ঘন নিচু বাঁশের ঝাড়। গড়ে ঢোকার মুখে কষ্টিপাথরের দ্বারবাসিনী। পুরনো বাড়ির কোনও চিহ্ন নেই তবুও মানুষ আজও তাকে গড় বলে। রাজার বাড়ির লোকেরা জমিজমার কাগজ বার করে দেখালেন, মৌজার নাম শিবপুর। এই নামই কি মুখে মুখে সিউর হয়েছে? নাকি পুরনো দ্রাবিড় গ্রামনাম শিবাদিত্য রাজার গল্পের সঙ্গে মিলে গেছে? গ্রাম নামের এমন সংস্কৃতায়ন তো কতই চোখে পড়ে।
শিবাদিত্যের পরিবারের দুর্গার নাম রামেশ্বর। একদিনের পুজো, দুর্গাপূজার নবমীর দিন। এই পুজোয় কুমড়ো বলি দেন ওই একই মাল পরিবারের কোন সদস্য। রাজপরিবারের আর এক দেবী শিবাক্ষ্যা। তাঁর মন্দির এই গ্রামে নয়, একটু দূরে গাংপুর গ্রামে শিবদহ নামে এক বড় দীঘির পারে। তার পাশের ডাঙার নাম রাজা পোড়া।
এখান থেকে সঙ্গী হলেন স্থানীয় উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক সুনীতি মুখোপাধ্যায়। তাঁর বাড়ি সিউর গ্রামের নিচু ঢালে খাঁয়ের পাড়ায়। বললেন, খাঁয়েরা তিলি অথবা কলু। অর্থাৎ তৈলব্যবসায়ী। সিউরের রাজা গুরুদাস সিংহ নাকি বর্গির হাঙ্গামার সময় রাজনগরের রাজাদের পাশে ছিলেন। সম্পন্ন বড় গ্রামে বর্গির হামলার ভয় ছিল বেশি। আর সেই ভয়েই তিলি জাতির পরিবারগুলি, আর কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবার সিউর গ্রাম ছেড়ে নিচু ঢালে নতুন পাড়া বসায়। সেটাই আজকের খাঁয়ের পাড়া।
কথার ফাঁকে একটা ছোট প্রবাদ শোনালেন সুনীতিবাবু: “খাঁয়ের গাঁয়ের যদু/ পায়ের গাঁয়ের মধু।” বললাম, “বুঝিয়ে বলুন।” সুনীতিবাবু জানালেন খাঁয়ের পাড়া গ্রামের যদুগোপাল মুখোপাধ্যায় নাকি বহু বিবাহ করে নাম কিনেছিলেন। পঞ্চাশের বেশি বিয়ে করেছিলেন তিনি আর ইলামবাজারের পায়ের গ্রামের মধুসূদন ভট্টাচার্য।
কথার সঙ্গে পথ চলা। পথের সঙ্গী শ্রীকুমার রায় নিয়ে গেলেন চাঁদপুর গ্রামে। রায়বাবু বীরভূমের আগুড়ি। সম্পন্ন চাষী, আবার কৃষক নেতাও। দেখালেন চাঁদপুরের প্রাচীন বটগাছ ঘিরে বড় ডাঙাজমি। ১৯৪২ সালে বীরভূম জেলার কৃষক সমিতির সম্মেলন হয়েছিল সেখানে। জেলার বাইরে থেকে গিয়েছিলেন মনসুর হবিবুল্লা, জ্যোতি ভট্টাচার্য। গান গেয়েছিলেন কলিম শরাফী। তখনো তরুণ। পূর্বপাকিস্তানে যাওয়া এবং রবীন্দ্রগানে বিশ্বজয় তখনো ভবিষ্যতের গর্ভে। পুলিসের খাতায় নাম থাকা কর্মীদের লুকিয়ে রাখা এবং যত্নআত্তির দায়িত্ব ছিল চাঁদপুরের মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির শান্তিলতা দেবীর হাতে।
চাঁদপুরে পঞ্চায়েতের অফিস। চা খাওয়ার পর সুকুমারবাবু নিয়ে গেলেন অফিসের পেছনে সর্বমঙ্গলা ডাঙায়। বিস্তৃত উঁচু ঢিবির ওপর সর্বমঙ্গলা মন্দির। শ্রীকুমারবাবুর কথায় জুতো খুলে ঢিবির উপরে উঠলাম। সাধারণ মন্দির। এই সর্বমঙ্গলারই অ-সাধারণ জুড়ি নাকি বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা। সেখানের কামান দাগার গল্প আমাদের সবারই জানা।
সাত হাট ঘুরতে ঘুরতে সন্ধে নাগাদ পৌঁছলাম শ্রীনিধিপুর গ্রামের বলরাম মণ্ডলের বাড়িতে। মিষ্টি এলো, জল, তারপর চা। একটি দু’টি প্রশ্ন করতেই গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলেন বৃদ্ধ মণ্ডলমশাই। শ্রীনিধিপুর সদগোপ প্রধান গ্রাম। শ-দুয়েক বছর আগে বোলপুরের কাছে গোয়ালপাড়া থেকে রামধন চট্টোপাধ্যায়কে এনে ব্রাহ্মণ বসান হয় গ্রামে। সেই চট্টোপাধ্যায়রা কালে কালে কান্দির রাজপরিবারের পত্তনিদার হন। একই সঙ্গে দশসালা বন্দোবস্তে কয়েকটা স্বাধীন লাটও কেনেন। তাঁরাই এদিকের জমিদার। তাঁদেরই তৈরি শ্রীধর গোপাল মন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির, পশ্চিমবাহিনী কালী মন্দির।
চিনি তৈরির ব্যবসাও ছিল চাটুজ্জেদের। দেশীয় পদ্ধতিতে চিনি তৈরির বর্ণনা দিচ্ছিলেন বলরাম মন্ডল। আখশাল বসানো, ঝুরঝুরে আখের ওপর পাটাপোকা ছেড়ে দিয়ে কীভাবে লালচে মোটা দানার চিনি তৈরি হতো শৈশবের স্মৃতি থেকে সেই কথাগুলো খুঁজে খুঁজে আনছিলেন বৃদ্ধ মণ্ডল মশাই। মনে পড়ল ছোটবেলায় পড়া হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘প্রাচীন বাংলার গৌরব’ বইটির কথা সেখানে পেয়েছিলাম এই দেশীয় পদ্ধতিতে চিনি তৈরির কথা । এদিকে মণ্ডলমশাই বলে চলেছেন তাঁর গল্প। সেই দেশি চিনি বিক্রি হত পাশেই আমডহরার হাটে। সে হাট আর নেই। তন্ময় কথকের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল তিনি হয়তো এই মুহূর্তে আমডহরার হাটের কোলাহল শুনতে পাচ্ছেন।
রাত ঘন হয়ে আসছে। শিশির। একটু শীত শীত ভাব। গ্রামদেশে রাত আটটা মানে একটা দিনের শেষ হয়ে আসা। সময় কমে আসছে। জানতে চাইলাম চারপাশে আপাত অর্থহীন এত দ্রাবিড় এবং অস্ট্রিক গ্রামনামের মধ্যে তাঁদের গ্রামের নাম শ্রীনিধিপুর কেন হল। তন্ময়তা ভেঙে উজ্জ্বল হাসিমুখে নিয়ে মণ্ডল মশাই বললেন, “সে আরেক গল্প।”
“গল্প শুনতেই তো এসেছি।”
মণ্ডলমশাই বললেন, “এই আমাদের গ্রামের একটু পাশেই কোপাই নদী। ওপারে সর্পলেহনা গ্রাম। আর আমাদের গ্রামের পাশে আছে হরিপুর গরুড়পুর। কয়েকশো বছর আগে সর্পলেহনা গ্রামের চতুষ্পাঠীর পণ্ডিত প্রভুরাম ওঝা পুরাণকাহিনী থেকে এই সব গ্রামের নাম দিয়েছিলেন। পুরাণের গল্প মনে আছে তো আপনার?”
“মনে আছে; কিন্তু আপনার মুখে আর একবার শুনতে চাই।”
“এই যে কোপাই নদী সে হল কোপবতী। সমুদ্রমন্থনে অমৃত উঠল। সে যে লক্ষ্মীর ধন – শ্রীনিধি। তার অধিকার নিয়ে ঘোরতর লড়াই বাঁধল দেবতা আর নাগের মধ্যে। দেবতারা মন্থন করেছেন, কিন্তু মন্থনের রজ্জু ছিলেন মহানাগ বাসুকি। তাই নাগেদেরও অমৃতের ভাগ চাই। অনেক কথার পর দেবতারা সম্মত হলেন। ভগবান বিষ্ণু শ্রীহরি গরুড়ের পিঠে চেপে নাগদের জন্য অমৃত নিয়ে এলেন। হরিকে পিঠে নিয়ে গরুড়ের অবতরণের পুরাণকাহিনীর চিহ্ন থেকে গেছে হরিপুর গরুড়পুর এই দুটি গ্রামের নামের মধ্যে। আর পুরাণকথার অমৃত ধারণ করে আছে আমাদের শ্রীনিধিপুর। দেবতাদের তো ছলের অভাব নেই! শ্রীবিষ্ণু নাগদের অমৃত পরিবেশন করলেন কুশ গাছের পাতায়। সেই অমৃত লেহন করতে গিয়ে ধারালো কুশাগ্রে সাপের জিভ চিরে গেল। কোপাইয়ের ওপারের গ্রামটির নাম তাই সর্পলেহনা।”
একটানা গল্প বলে থামলেন বলরাম মন্ডল। তাঁর দাওয়া ঘিরে জড়ো হওয়া অনেকেই হয়তো এ কাহিনী আরো বহুবার শুনেছেন। আর আমি নেহাতই কৌতুহলের বশে গ্রামনাম খুঁজতে গিয়ে পুরাণকথার নতুন পাঠ নিলাম।
[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]
Tags: গল্পের সময় ব্লগ, গ্রাম ছুঁয়ে গ্রামের গল্প, সৌমিত্রশঙ্কর সেনগুপ্ত
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।