পালসিটে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে শেষ হওয়ার পর শক্তিগড়ে ল্যাংচা বিরতি । তখন বাসযাত্রী ও চালক কন্ডাক্টারের দশ-পনেরো মিনিটের দ্রুত অবসরযাপন । ল্যাংচা কেনা, খাওয়া এবং প্যাকেটবন্দি করে ব্যাগে ভরার বাইরেও চা-কচুরি-মুড়িমশলা-শশা-ডাব-জিলিপি । পাশাপাশি, পুরুষযাত্রীদের বেআবরু হাইওয়ের দুপাশে বেপরোয়া জলবিয়োগ । মহিলাদের কথা ভেবে দোকান সংলগ্ন ছোট ছোট টিনঘেরা টয়লেট । সেখানে শাড়ির পেছনে চুড়িদার, তার পেছনে গেঞ্জি-জিন্স, কুর্তি-লেগিংস এর লাইন । কয়েকটা মিনিটের ব্যস্ততা পটাটো চিপস-এর খালি প্যাকেটের মতন হুস করে বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে আবার বাসের গড়িয়ে চলা । পরের গন্তব্য হয় বর্ধমান নয়তো দুর্গাপুর সিটি সেন্টার । দুর্গাপুর পেরিয়েও কিছু বাস যাবে আসানসোল অথবা বাঁকুড়া । সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্পে যখন সারা ভারতের গতিবৃদ্ধির হিসেব হয়েছিল তখন এটাই ছিল প্রাথমিক ভাবনা । কিন্তু বর্ধমান পেরিয়ে যারা দুর্গাপুর, আসানসোল, সিউড়ি বা বাঁকুড়া যাবেন তাঁদের একটা মস্ত গেরো হয়ে উঠল পানাগড় বাজার । ওই সাড়ে তিন –চার কিলোমিটার রাস্তার এদিকে ওদিকে সোনালী চতুর্ভুজের মসৃণ পথ, অথচ কী মুশকিল, মাঝের ওই পথটুকুতে ঘিঞ্জি বাজার, সংকীর্ণ রাস্তা, অজস্র ভাঙাগাড়ির গ্যারেজ যার উৎস স্থানীয় সেনাঘাঁটি, বাংলা মদের দোকান, হোটেল, মোটেল, রাস্তার ওপর সবজি বিক্রেতার পসরা । মোটের ওপর সাঁই সাঁই করে পথ কেটে চলা সরকারি বেসরকারি শীততাপনিয়ন্ত্রিত অথবা বিনিয়ন্ত্রিত বাসগুলি এখানে স্থবির বা শ্লথগতি । জীবনানন্দ লিখেছিলেন : স্থবিরতা কবে তুমি আসিবে বলো তো ! বেঁচে থাকলে স্থবিরতার এক তালগোল পাকানো চেহারা তিনি দেখতে পেতেন এই মহানগর ছাড়ানো রাস্তায় । যারা এই লাইনের নিত্যযাত্রী তাঁরা জানেন পানাগড় বাজারের ওই প্রায় চার কিলোমিটারের ওপরই নির্ভর করছে তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছানোর সময়সীমা । সারিবাঁধা গাড়ির জানলা দিয়ে তাই অস্থির যাত্রীদের মুখ বার করা । কতটা ? কতটা যানজট আজ ? কত সময় লাগবে আজ এই নরকের দরজা পেরোতে ? বিরক্তি আর অধৈর্য যুগলবন্দি তোলে যাত্রীদের মুখে , শরীরী বিভঙ্গে ।
ঠিক তখনই দাঁড়িয়ে থাকা বাসের দরজা দিয়ে উঠে আসে লোকটা । মলিন পোশাক । কাঁধে একটা চেনটানা মামুলি ব্যাগ । তার থেকে বেরোয় কিছু প্লাস্টিক পাউচ ।তারই মধ্যে একটা পাউচ থেকে বেরোয় একটা ছোট্ট চামচ । সেই চামচেতে উঠে আসে হজমি গুড়োর স্যাম্পেল । অপরিসর তিন দুই সিটের বিন্যাসের ফাঁকেই যাত্রীদের মধ্যে দ্রুত গতিতে বিতরিত হতে থাকে এক চামচ করে স্যাম্পল । সঙ্গে চলে তার গুণকীর্তন । কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে গ্যাস অম্বল বদহজম সবেরই উপশমে অব্যর্থ ওই হজমিচূর্ণ । কেউ কেউ গম্ভীর মুখে বসে থাকে, ফ্রি স্যাম্পল নেয় না । অনেকেই নেয় ।তারই মধ্যে কয়েকজন কিনেও ফেলে দশ বা কুড়ি টাকার ছোট বা মাঝারি পাউচ । আট দশ প্যাকেট বিক্রি হলেই লোকটা নেমে যায় বাসের দরজা দিয়ে । এই বাসের আগে এবং পরে সারিবাঁধা বাস । পরের গন্তব্য অন্য তেমনই কোনও বাস । প্রতি বাসে আট দশ প্যাকেট বিক্রি হলেও মন্দ নয় । সারাদিনে সকাল বিকেল মিলিয়ে ঘণ্টা সাত-আট এই কাজ করলে একটা সংসার হয়তো কোনোভাবে চালিয়ে দেওয়া যায় । পানাগড় বাজারের এই অসমাপ্ত সোনালি চতুর্ভুজ তার এমন রোজগারের পথ খুলে দেবে কে জানত ?
কিন্তু দীর্ঘকালের এই অসমাপ্ত বিরক্তিকর গতিরোধকারী উন্নয়নবাধা মিডিয়ার খাদ্য হবেই । ওই চড়া টোলট্যাক্স দেওয়া পথে যারা বাসে যাতায়াত করেন তাঁরা লোকাল প্যাসেঞ্জার ট্রেনের থেকে দুগুন তিনগুন বেশি ভাড়া গোনেন । তাঁদের এমন মসৃণ পরিষেবা ব্যাহত হলে, সংবাদমাধ্যমের ভাষায়, নিশ্চিত সেটা জোরদার স্টোরি । সেই গপ্পো কাগজে বহুভাবে প্রকাশিত । অথচ পানাগড় বাজারের ওই সংকীর্ণ চার কিলোমিটার রাস্তা চওড়া করতে হলে দোকান-বাজার-গ্যারেজ সব উচ্ছেদ করতে হয়, সেই ঝুঁকি নিতে যাবেন কোন সরকার ? তাছাড়া ওই অংশের আইনি-বেআইনি সব দখলদারেরই নিজস্ব লবি আছে, রাজনীতির খুঁটি আছে । পানাগড়ের সেনাঘাঁটি থেকে স্ক্র্যাপ হওয়া গাড়ি সারাই হয়ে হাতবদল হয়, তার একটা বড় বাজার আছে যার মূল কেন্দ্র ওই এলাকা । সুতরাং খোঁজ চলছিল বিকল্পের । আমি থাকি, তুই থাক । সকলেই করে খাক । অবশেষে পাওয়াও গেল । চেষ্টায় কী না হয় ! পানাগড় বাজারের ওই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় মিলেছে সম্প্রতি ।
ওই এলাকা এড়িয়ে তৈরি হচ্ছে বাইপাস । জমির সংস্থানে অসুবিধে হয়নি নিশ্চয়ই , হলে তা খবর হত, সংবাদ চ্যানেল ছেড়ে কথা বলত না । বছর চারেক আগে বহুকাল পর ওই পথে পাড়ি দিচ্ছিলাম দুর্গাপুর । পানাগড় বাজারে কী ঘটবে তা নিয়ে অবচেতনে নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তার হাতছানি ছিল । কিন্তু বাসের জানলা দিয়ে বাঁদিকে তাকাতেই যেন চিচিং ফাঁক । উন্নয়নের যাবতীয় বাধা দূর করে সবুজ ধানক্ষেতের মধ্যে কংক্রিট ঢালা রাস্তার ভ্রূণ উঁকি মারতে আরম্ভ করেছে । বড় বড় ক্রেন, এবং অন্যান্য নাম না-জানা মেশিন, মজুরদের জন্য তৈরি অস্থায়ী তাঁবু, জড়ো করা ইট-কাঠ-লোহা । এমন এক কান্ডকারখানা ঘটে গেছে গত কয়েক বছরে, সত্যি জানতুম না ।
বাসের এক সহযাত্রী আঙুল তুলে দেখালেন , ওই যে দেখছেন কাজ চলছে, ওই রাস্তাটা তৈরি হয়ে গেলে পানাগড় বাজারের এই নরকযন্ত্রণা আর সইতে হবে না । আর ওই রাস্তার আরেকটি শাখা নাকি চলে যাবে কুলটি না বার্নপুর কোথায় যেন । তাতে নাকি কলকাতা-ধানবাদের দূরত্ব আরও কমে যাবে, বলে চলেছিলেন ওই সহযাত্রী ।কী জানি হয়তো তাই হবে ! কে বলে পশ্চিমবাংলার মানুষ উন্নয়ন-বিরোধী ? উন্নয়ন মানে আসলে তো কারোর কিছু সুবিধা, কিছু প্রাপ্তি । সিঙ্গুরের গাড়ি কারখানা তৈরির সময় কত বহুফসলি জমি ধূসর হয়ে যাবে-র থেকেও বারবার উচ্চারিত হত, কত মানুষ সেখানে কাজ পাবেন, মনে আছে ? বলা হত, সিঙ্গুর নামক এক অখ্যাত জনপদ পালটে যাবে ঝকঝকে মেট্রোপলিসে ! এই নতুন সড়ক যোগাযোগ হয়তো একইভাবে নিয়ে আসবে অনেক প্রাপ্তি । আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকাই । হেমন্তের হিমেল হাওয়া সবুজের ওপর দিয়ে এসে ধাক্কা মারে চোখে মুখে ।
আসলে ঠিক তখনই বাসের দরজা দিয়ে নেমে যায় ওই লোকটা । মলিন পোশাক । কাঁধে একটা চেন টানা মামুলি ব্যাগ । তার ভিতরে হজমিগুড়োর পাউচপ্যাক । এর পরের বার যখন এই পথে আসব তখন ওই বিকল্প সড়ক পথে হয়তো আরো দ্রুত পৌছে যাব দুর্গাপুর । পিচঢালা ছ্য় লেনের ঝকমকে সড়ক । হু হু করে বাস ছুটছে দুর্গাপুর আসানসোল সিউড়ি বাঁকুড়া । কিন্তু ওই লোকটার কী হবে ? যদি বাস আর আটকে না পড়ে পানাগড় বাজারের জ্যামে । যারা উচ্ছেদ হওয়া থেকে বেঁচে গেলেন তাঁদের সাম্রাজ্য আরও বড় । কিন্তু ওই লোকটার হজমিগুড়োর স্যাম্পেল কে চেখে দেখবে ? কারা তারই মধ্যে থেকে কিনবে ওর দশ বিশ টাকার প্যাকেট ? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে খেতে বাস গড়িয়ে চলে সামনে । পানাগড় বাজার পেরিয়ে দার্জিলিং মোড় । তারপর আবার চওড়া রাস্তায় গতি বাড়ানোর হাতছানি নিয়ে চালক প্রস্তুত হয় আক্সিলেটরে চাপ দিতে, গিয়ার বদল করতে । ওই লোকটা তখন হয়তো উঠে পড়েছে পরের সারির কোনো আটকে থাকা বাসে । চেন খুলে বার করেছে হজমিগুঁড়োর স্যাম্পল । কেউ নিচ্ছে, কেউ নিচ্ছে না । কেউ কিনছেন, কেউ কিনছেন না । কিন্তু গড়পড়তা দশ বিশ প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে । সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে লাভের হিসেব কষে মেলাতে চেষ্টা করবে আয়-ব্যায়ের হিসেব । সংসার হয়তো চলে যায় । কে জানে আমরা কি আর ওই লোকটার খবর রাখি । বড়জোর আমাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের উপশম হলে ওর হজমিকে বাহবা দিই ।
বহুকাল ওই পথে আর যাতায়াত নেই। কিন্তু উন্নয়ন ঘড়ির কাঁটার মতোই এগিয়ে চলে তার নিয়মে। একেবারে সম্প্রতি খবর পেলাম ইদানিং ওই পানাগড় বাজারের বিভীষিকা ভ্যানিশ, বাস এখন মসৃণ পথে গড়িয়ে যাচ্ছে সদ্যনির্মিত বাইপাস দিয়ে। মানুষের সময় বাঁচছে, টেনশন কমছে, বেশি গাঁটের কড়ি খরচ করে যাত্রীদের গতিহীন হয়ে যাওয়ার ক্রোধ প্রশমিত। উন্নয়ন মানে তো আসলে গতি, আরও গতি, আরও আরও। পানাগড় বাজারের ওই স্থবিরতা উধাও হয়েছে আজকাল। গতিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পালা অস্তমিত। ব্যস্ত দুনিয়ায় মানুষের হাতে সময় কম, সে কি অমনভাবে অপচয় করা যায় নাকি? পানাগড় বাজারকে এড়িয়ে যে নতুন সড়কের উদ্বোধন ঘটে গেছে এরই মধ্যে — ওই লোকটিকে সেখানে কেউ ডেকেছিল কি ? ওই লোকটার তাহলে কী হবে ?
[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।