05 Mar

অভিষেক উপন্যাস ‘লাল সালু’

 আমরা অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিকের কথা জানি যাঁরা আবির্ভাবেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং তাদের প্রথম রচনাকেই লেখকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে গণ্য করাহয়। সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহ (১৯২২১৯৭১) অভিষেক উপন্যাসলাল সালুতেমনই একটি সৃষ্টি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চট্টগ্রামে এক শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন।১৯৪৩ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে স্নাতক হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম পাঠরত অবস্থায় স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে যোগ দেন। দেশ ভাগের পর তিনি পাকিস্তান সরকারের বৈদেশিক বিভাগের চাকরিতে যোগ দেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে তিনি পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে ইস্তফা দেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু তিনি যা লিখেছেন তাতে তিনি কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন, মৃতপ্রায় সমাজ জীবনের চিত্র এঁকেছেন।পাশাপাশি মানুষের ভেতরের লোভ, প্রতারণা, হিংসা ঈর্ষা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিনিয়ে বিশ্লেষন প্রকাশ করেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মুশারাফ হুসেনের উত্তরসূরী প্রথম আধুনিক মুসলমান কথাসাহিত্যিক বলে গণ্য করা হয়। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে তিনিলাল সালুরচনা করেন। বছর তাঁর জন্ম শতবর্ষ

মজিদ এক দরিদ্র মুসলমান,এক দরিদ্র গ্রামে তার বাস। তাদের মাঠে ধান নেই, পেটে ভাত নেই। সেই মড়ার দেশে শস্য নেই, শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি। ভোরবেলা মক্তবে আর্তনাদ ওঠে যেন খোদাতালার বিশেষ দেশ। গোঁফ না উঠতেই কোরাণ, হেফ্জ করা সারা। খোদাতালার ওপর প্রগাঢ় ভরসা। কিন্তু শূন্য পেটে খোদার এলেমে পেট ভরে না। এরা তাই দেশত্যাগ করে।জাহাজের খালাসি হয়ে, কারখানার শ্রমিক হয়ে, বাসাবাড়ির চাকর হয়ে, ট্যানারিতে চামড়ার মিস্ত্রি হয়ে

মজিদ একদিন বেরিয়ে পড়ে ভাগ্যাণ্বেষণে। পৌঁছয় মহব্বতনগরে। গ্রামে ঢুকে তার নজরে পড়ে  বাঁশঝাড়ের তলায়, পুকুরের ধারে একটা পরিত্যক্ত কবর। এই কবরটি দেখে সে তার পরিকল্পনা ছকে নেয়।  সে গ্রামের মানুষদের তিরস্কার করে বলে সে স্বপ্ন দেখেছে এই গ্রামের মানুষ আল্লাতালার কথা ভাবে না। আল্লার নির্দেশে সে নিজের ঘর বাড়ি, জমি জিরেৎ ছেড়ে খোদার আলো ছড়াবার জন্যে এই দেশে এসেছে। এখানকার মানুষ অনপড়, কাফের। পীরের মাজারকে তাঁরা এই রকম অনাদরে ফেলে রেখেছে। শীর্ণ মানুষটি গ্রামের মানুষকে তিরস্কার করে, অনুশোচনায় দগ্ধ করে দেয়। তারা মাথা নত করে শোনে।  

সেই নাম না জানা মানুষের কবর পরিস্কার করে লাল সালু দিয়ে ঢাকা হল। আগর বাতির গন্ধ ছড়াতে লাগলো, মোমবাতির জ্বলতে লাগলো রাত দিন। গ্রাম সে গ্রাম থেকে মানুষ আসতে লাগলো। তাদের চোখের জল, আশার কথা, ব্যর্থতার কথা,অজ্ঞাত সেই মানুষটার কাছে ব্যক্ত হতে লাগলো। সঙ্গে মজিদের ঘরে আসতে লাগলো অর্থ, তার ঘরবাড়ি হল, জমি হল, সাদি হল

এই গ্রামের মানুষ ছিল পরিশ্রমী, তারা মাঠে ফসল ফলাত, গ্রীষ্মের রোদে মাঠ ফেটে গেলে তারা খোদাকে না ডাকলেও মাটি কেটে নালা বানিয়ে খাল থেকে পানি আনত। তারা দ্বিতীয়ার চাঁদের মত কাস্তে দিয়ে ধান কাটতে কাটতে গীত গাইত, মেয়েরা ঢেঁকির তালে তালে সুর ভাঁজত মজিদ ভাবতো কিসের এতো হাসি, কিসের এ্তো পুলক! মজিদ ভয় পেতো।   ভাবতো ঝালর ওয়ালা লালসালু আবৃত মাজার টা কে তাদের হাসি, গীত যেন অবজ্ঞা করছে।

 

ধীরে ধীরে মজিদ গ্রামের সরল মানুষগুলোর গলায় ধর্মের ফাঁস শক্ত করতে লাগলো। মজিদ তাদের বলল মাঠে শয়তানের মত গান ধরার সময় খোদার কথা মনে হয় নাতাদের মনে দোজাকের ভয় ঢুকলো, বেহেস্তের জন্যে আকুলতা বাড়লো। খুঁজে খুঁজে বার করতে লাগলো কাদের খৎনা হয়নি। তাদের ধরে এনে প্রকাশ্যে খৎনা করে দিল। গ্রামের মানুষ ভীড় করে দেখল। গ্রামের ধনী মানুষও মজিদকে ভয় পেতে লাগলো, সমীহ করতে লাগলো। তারা বিশ্বাস করল তাদের অর্থের বল থাকতে পারে কিন্তু মজিদের বল খোদাতালার বল। 

মজিদ বিশ্বাস করে তাঁর শক্তি এসেছে ওপর থেকে। তার সমস্ত শক্তি ওই লাল সালু জড়ানো এক অজ্ঞাত মানুষের কবর। ওই মাজার তার শক্তির উৎস। কিন্তু এর পাশাপাশি মজিদ নিজেও মাঝে মাঝে ওই মাজারের দিকে তাকিয়ে ভীত হয়না তা নয়। তার মনে হয় খোদাতালার নাম নিয়ে সে কিছু অন্যায় করছে না তো? কিন্তু সে মনকে বোঝায় সেও খোদার বান্দা, নির্বোধ জীবনের প্রতি অন্ধ। তার করুণা অপার, বান্দার ভুল ভ্রান্তি তিনি নিশ্চয় মাপ করে দেবেন

কাহিনী এগিয়ে চলে।  এরই মধ্যে পাশের গ্রামে এসে হাজির হন এক পীর সাহেব। খড়্গনাসা গৌরবর্ণ সেইপীরের পূর্ব পুরুষ মধ্যপ্রাচ্যের কোন  দেশ থেকে এসে ছিলেন, তা তাঁর চেহারাতেই মালুম হয়। দলে দলে মানুষ তার দর্শন লাভের আশায় ছুটে যায়। এই জাঁদরেল পীররা কাছাকাছি ডেরা গাড়লে মজিদ শঙ্কিত হয়ে ওঠে।অন্য কেউ বৃহৎ মায়াজাল সৃস্টি করলে সবাই একে একে তাতে জড়িয়ে পড়বে। মাজারে আসা মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে আর হাওয়ায় ভেসে আসে পীর সাহেবের নতুন নতুন কার্যকলাপের কথা। মজিদ পীর সাহেবের আত্মার শক্তিতে বিশ্বাস করেনা। কারণ সে নিজেও জানে কী ভাবে এক পরিত্যক্ত কবর কে ঘীরে নিজের ভাগ্যকে গড়ে নিয়েছে।কিন্তু যখন একদিন তাঁর স্ত্রী জিজ্ঞাসা করে পীর সাহেব নাকি মরা মানুষকে বাঁচাতে পারে তখন মাথায় রক্ত উঠে                                                  যায়। সে স্থির করে একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার। গ্রামের মানুষদের তাঁর সম্মোহনী বাক চাতুরী দিয়ে পীর সাহেবের কাছে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দেয়। 

গ্রামের এক শিক্ষিত  যুবক গ্রামে একটি স্কুল খুলতে চায় মজিদ গ্রামের মানুষকে বোঝাতে সফল হয় যে ইস্কুলে গিয়ে ইংরাজি  শিখলে ছেলেরা আর আল্লার নাম নেবে না। যুবক গ্রামের মানুষের সমর্থন পায় না। 

মজিদ নিসন্তান। নিসন্তান মহিলাদের সন্তান লাভের  জন্য মজিদ মাজারে তার বিহিত করত। কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে সে তা করে না।স্ত্রী রহিমাকে দ্বিতীয় স্ত্রী আনার ইচ্ছার কথা জানায়। রহিমার কাছে স্বামীর ইচ্ছাই সিদ্ধান্ত। মজিদ    স্থির করে ছিল এমন একটি বৌ আনবে যে খোদাকে ভয় পাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। মধ্যবয়সী মজিদ তাঁর সদ্য কৈশোর উত্তীর্না নতুন বৌকে বলে , “মুসলমান মাইয়ার হাসি কেউ কখনও হুনে না। তুমার হাসিও যানি কেউ হুনে না।”

কিন্তু জমিলার হাসি থামে না। বরঞ্চ হাস্তে হাস্তে  লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।বিচিত্র ভাবে জীবন্ত সেহাসি। ঝর্ণার অনাবিল গতির মত ছন্দময় দীর্ঘ সমাপ্তি হীন ধারা।সে নমাজ পড়তে চায়না, নমাজের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। খোলাখুলি অগ্রাহ্য করে স্বামীর রক্তচক্ষু। মজিদ ভেবে পায়না কীভাবে শিক্ষা দেবে একরত্তি মেয়েকে। মহব্বতনগরে তাঁর দীর্ঘ রাজত্ব কালে আপন হোক পর হোক কেউ তাঁর হুকুম অগ্রাহ্য করেনি।আজ তাঁর ঘরের একরত্তি বৌ………… সে আরও কঠোর হয়ে শিক্ষা দিতে গেলে  সে একদিন মজিদের মুখে থুতু দিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে মজিদের সব আত্মবিশ্বাস চূর্ণ হয়ে যায়

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁরলালসালুউপন্যাসে বাংলার গ্রামের দরিদ্র মুসলমান সমাজের যে ছবি এঁকেছেন বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা মেলা ভার। এই অবস্থার হয়তো অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে তবু বইটি এখনও প্রাসঙ্গিক। কারণ  ধর্ম নির্বিশেষে দরিদ্র পেছিয়ে পড়া মানুষ নিজেদের নেতাদের দ্বারা শোষিত হয়ে চলেছে। এই উপন্যাসের ভাষা এক অপরূপ সম্পদ।চরিত্রদের মুখে পূর্ব্বাংলার কথ্যভাষা, সেখানে মুসলমান সমাজের খুঁটিনাটি এবং লেখকের বর্ননায় সুখপাঠ্য আধুনিক গদ্য বইটির অন্যতম আকর্ষণ। ঘটনার বিবরণ ছাড়াও প্রতিটি চরিত্রের অন্তর্জগত লেখক যে নিপুনতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তা পাঠককে মুগ্ধ করে। 

লালসালুবইটি ইন্টেরনেট পাওয়া যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জন্ম শতবর্ষে পাঠকরা বইটি পড়ে লেখককে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। 

[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ