সুহৃদেষু,
অনেকদিন পর তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি। পুবের জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়ছে মেঝেতে। শ্বেতকরবীর গুচ্ছ হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছে তাদের ফুলেল মঞ্জরি। ভোরের আলোয় কী এক অরূপ শুদ্ধতা থাকে, না! মন আপনিই কেমন উদার হতে চায়।
কদিন হল বই পড়ছি একটা। দ্বাদশ শতকের কর্ণাটকের লোকায়ত ভাষায় বীরশৈব সাধক কবিরা যে সব ‘বচন’ রচনা করেছিলেন তাদের অনুবাদ। বচন এক বিশেষ ধাঁচের কবিতা। মুখের ভাষায়। সাধারণের জন্য। কিন্তু অসাধারণ তার আত্মবোধ। গভীর তার আধ্যাত্মচেতনা, জীবনদর্শন।
সে সময়ের বচনকাররা ধর্মের জটিল আচার বিচারের প্রতি বিমুখ হয়ে বলতে শুরু করেন নিজের মধ্যেই ঈশ্বর ধারণ করতে হয়। বলতে শুরু করেন কায়িক শ্রম ছাড়া গতি নেই কোনো। শ্রমই সাধনা। ধর্মে সর্বজনের সমানাধিকার। এদের সবার লেখাতেই ঈশ্বর বন্ধুর মতন এসে বসেছেন। প্রায় যেন এক ধুয়োর মতন এরা মূল কথার পরে নিজেদের আরাধ্যনাম জুড়ে দাঁড়ি টেনেছেন কবিতার।
নবনীতা দেবসেন এরকম একশোখানা কবিতা সংগ্রহ করে মূলভাষার সাথে সাযুজ্য রেখে অনুবাদ করেছেন এই বইয়ে। সাথে আছে কবিদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। ‘কারিগর’ প্রকাশনা থেকে ২০১৫ তে প্রকাশ পেয়েছে বইটি।
ভোরের বেলা ঝাঁক ঝাঁক পাখি ডাকে। সামনের পুকুরে ঝুঁকে পড়া গাছে দু’ডানা মেলে দিয়ে থমকে থাকে একটা ঘন কালো পানকৌড়। তার ডানায় ঝিকমিক করে রোদের কুঁচি। আক্কা মহাদেবীর কবিতা পড়ি আমি। তাঁর কথা বলতে গিয়ে নবনীতা লেখেন, ‘ কন্নড় ভাষার প্রথম কবিয়ত্রী আক্কা, এবং কন্নড় দেশের প্রথম নারী mystic’। এই ‘কবিয়ত্রী’ বিশেষনটি অমোঘ। ওঁর কবিতাই সাক্ষ্য বহন করে তার।
মীরা, আক্কা এদের কারো জীবনই সহজ ছিল না। একে নারী, তায় কবি। ঈশ্বর ছাড়া আর কেই বা তাদের কলম অনর্গল করতে পারতো! আক্কা অসামান্য সুন্দরী ছিলেন নাকি। এবং মানতেন ‘মল্লিকার্জুন শিব’ -ই তাঁর স্বামী। যদিও শাসকের দাবি মেনে একদিন বিবাহ নামক খাঁচায় আটকাতেই হল তাঁকে। সামাজিক প্রথা অনুযায়ী সকলের চোখে রাজার স্ত্রী হলেন তিনি। কিন্তু কবিতা যাকে ছুঁয়েছে একবার সে কী আর কোন বদ্ধতায় চিরকাল আটকা থাকতে পারে! তাঁর রাজার রাজা যে সত্য সুন্দর শিব, তিনি আক্কাকে ডেকে নিলেন নিজের অসীম ব্যাপ্তিতে। একদিন শিকল ছিঁড়ে গেল তাঁর। পতিকে ত্যাগ করলেন। সব বসন ভূষণ ত্যাগ করলেন। নগ্নিকা তরুণী মহাদেবী নিজের আজানুলম্বিত কেশগুচ্ছ ছড়িয়ে দিলেন শরীরে। আর কোন ভার রইলো না তাঁর। কারো তোয়াক্কা না করে এবার তিনি মগ্ন হলেন নিজের সাধনায়। কবিতা আসতে লাগলো একের পর এক।
‘কেড়ে নেবে নাও গয়না শাড়ি
নগ্নতা নেবে কী করে কাড়ি
যার অঙ্গ আবৃত দৈব কৃপায়
চেন্নামল্লিকার্জুনের বিভায়
সে দিয়েছে লোকলজ্জা পাড়ি।
কী হবে গহনা? কী হবে শাড়ি?
ভিক্ষা-অন্নে মেটাব ক্ষুধা
কুয়োতে, পুকুরে, মিলবে সুধা
ভাঙা মন্দিরে পাতব শয্যা
চেন্নামল্লিকার্জুন! ঢাকো হে লজ্জা—
তুমিই সঙ্গী, তুমিই রক্ষী,
তুমি যার, তার লাজ কী? শোক কী?’
শব্দকে ব্রহ্ম বলেছেন বেদকাররা। সে বোধহয় সত্যি। কবি যে শব্দের সাধনা করেন সে ঈশ্বরসমান। উপনিষদের কবিদের মধ্যে একটি মাত্র নারী কন্ঠ ছিল মৈত্রেয়ীর প্রার্থনা। আজও তার তুলনা পাই না। তেমনই এই বচনকার কবিদের মধ্যে এই এক নারী কন্ঠ অনন্য হয়ে আছে। তিনি নারী বলেই বোধহয় অন্য সাধুদের থেকে তার দৃষ্টি আলাদা। তিনি বলতে পারেন—
‘যদি বলো মায়াকে ছেড়েছি
মায়া কিন্তু তোমাকে ছাড়েনি।
মায়াকে তুমি ছাড়ো বা না-ছাড়ো
সে তোমার সঙ্গ ছাড়েনি—
মায়া যোগীর জন্য যোগিনী
শ্রমণের জন্য শ্রমণী
আর সন্ন্যাসীর জন্য স্তুতি।
তোমার ওই মায়াকে আমি কিন্তু ভয় করি না,
চেন্নামল্লিকার্জুন হে—
এই তোমার দিব্যি!’
প্রতিদিন এ সংসারে জড়িয়ে যেতে যেতে বুঝি ওই এক অনিরুদ্ধ মায়াতেই পেলব হয়ে আছে এ মনুষ্যহৃদয়। তাকে কাটিয়ে যাবার মধ্যে একরকমের নিষ্ঠুর স্বার্থপরতা আছে। গীতা তাকে কাটিয়ে উঠতেই বলে। নাহলে কুরুক্ষেত্র ঘটানো যায় না। মায়া কে ফাঁদ না ভেবে শক্তি বলে দেখতে আক্কার আগে বা পরে আর কোনো সাধককাব্যে পাইনি। এতো বছর পরেও সে কবিকে অস্বীকার করা যায় না তাই।
আক্কা আকুল হয়ে লেখেন। তাঁর প্রেম আর্তি রণিত হয় এতযুগ পার করা ভোরে।
‘দ্যাখো, দ্যাখো তাদের দুর্দশা, সেইসব পাহাড়পর্বত—
যাদের ইচ্ছে ছিল খেলা করবে গঙ্গার সঙ্গে
তাদের দুর্দশা দ্যাখো সেইসব অরণ্য বনানী —
যাদের ইচ্ছে ছিল খেলা করবে অগ্নির সঙ্গে
আর দ্যাখো ওদের দুর্দশা, সেইসব অন্ধকার রাত—
যাদের ইচ্ছে ছিল আলোকের সঙ্গে খেলা করে
তাদের দুর্দশা দ্যাখো সেইসব গভীর অজ্ঞতা —
যাদের ইচ্ছে ছিল খেলা করে জ্ঞানের সান্নিধ্যে
এইভাবে, হে পরাশিবমূর্তি হরদেব,
হে চেন্নামল্লিকার্জুন— দ্যাখো, দ্যাখো
তাদের দুর্দশা, ওই আমার অগুন্তি জন্মান্তরগুলি
তোমার জঙ্গম লিঙ্গ নিয়ে
খেলা করেছিল যারা…।’
বই হাতে নিয়ে চুপ করে থাকি। সকাল গড়িয়ে যায়। বুকের মধ্যে চৈত্র বেলার রুক্ষ পাতা ঝরে। যে বৃক্ষের শুষ্কতা বিষাদ এনেছিল তার ডালে কচি পাতার ইশারা আবিষ্কার করে আশ্চর্য বোধ করি। কোমলতা আসে প্রাণে।
এসবের থেকে অনেক দূরে গভীর বনের পথ বেয়ে তখন পাহাড় চূড়ার নির্জন কুটিরের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন আক্কা মহাদেবী। কী এক অতীন্দ্রিয় প্রেমে হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তার এলো চুল, নিরাবরণ দেহ। মগ্ন কবিতার কয়েক কলি আশ্চর্য কুসুম খসে পড়ছে তার গমনপথের ওপর। শতাব্দীর পর শতাব্দী সুগন্ধ ছড়াবে তারা।
ভালো থেকো। আবার দেখা হবে শিগগির।
ভালবাসা।
ঋভু
আলোচিত বই – শতেক বচন,নবনীতা দেবসেন
Tags: আক্কা মহাদেবীর আলো, ঋভু চৌধুরী, নবনীতা দেবসেন, বই আলোচনা, বই পাঠ, শতেক বচন
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।