05 Mar

‘বোজ’-এর বিলেতি যাদুকথা

লিখেছেন:দীপ্তিপুত্র কৌস্তভ


যদিও সেটি তাঁর প্রথম বই, কিন্তু আমি পড়লাম অনেকটাই দেরীতে। মাত্রই বছর পাঁচেক আগে। এক হেমন্তসন্ধ্যায় একজন চেনা মানুষ বইটির বিষয়ে বললেন আমাকে। এই বইটির কথা, সত্যি বলতে কি, বহু দিন পর্যন্ত জানাই ছিল না আমার! সে একান্তই এবং অবশ্যই আমার অজ্ঞতা। ইংরাজী সাহিত্যের ছাত্র হলে হয়ত ছাত্রাবস্থাতেই জেনে যেতাম। পাকেচক্রে তেমনটা না হওয়ায় পদ্ধতিগত একটা পথ ধরে সাহিত্যপাঠ এবং চর্চা, উভয়ই আমার ক্ষেত্রে শুরু হয়েছিল অনেকটা দেরীতে। সে জন্যই হয়ত তাঁর অন্যান্য কালজয়ী উপন্যাসের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত এই সাহিত্যসৃষ্টিখানি আমার কাছে কিছু পরে ধরা দিল। কম বয়সে বিখ্যাত রচনা পড়ার ইচ্ছে আসলে ছিল বেশী। অথচ চুলে যত পাক ধরতে লাগল, খ্যাতির পাদপ্রদীপে থাকা বইগুলির থেকে সরে এসে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছে হল কিছু কম পরিচিত লেখার সঙ্গে।

বইটির প্রকৃত নাম “Sketches by “Boz,” Illustrative of Every-day Life and Every-day People”। সংক্ষেপে “Sketches by “Boz” নামেই তার পরিচয়। লেখক, স্বনামধন্য চার্লস জন হুফ্যাম ডিকিনজ। যিনি পাঠকের হৃদয়ে চার্লস ডিকিনজ নামে বিরাজমান। বইটি মূলতঃ ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে প্রকাশিত ডিকিনজের ৫৬ টি গদ্যরচনার সংকলন। লেখাগুলি চারটি পৃথক ভাগে বিভক্ত। “Our Parish”, “Scenes”, “Characters” এবং “Tales”। প্রথম তিনটি ভাগে কাল্পনিক চরিত্ররা নেই। লণ্ডনের প্রাত্যহিক জীবন থেকে উঠে আসা বিভিন্ন দৃশ্য ও ঘটনার বর্ণনা সেখানে। চতুর্থ অংশটি কাল্পনিক গল্পের। বইটিকে ছবিতে ভরিয়ে তুলেছিলেন সেই সময়ের জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট, ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী এবং ডিকিনজের আরও বহু রচনার চিত্রশিল্পী জর্জ ক্রুকশ‍্যাঙ্ক। ডিকিনজের এই লেখাগুলি সাময়িকীতে প্রকাশিত হত মাসিক ভিত্তিতে। সুতরাং, পরবর্তী লেখা প্রকাশের আগেই ডিকিনজ লেখাটির সারমর্ম পাঠিয়ে দিতেন ক্রুকশ‍্যাঙ্ককে। তিনি এই সারমর্মকে রূপ দিতেন ছবিতে।

এখানে মনে রাখতে হবে, ডিকিনজ জন্মেছিলেন ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে, আর এই লেখাগুলি ১৮৩৩ থেকে আরম্ভ হয়। অর্থাৎ, তাঁর বয়স তখন মাত্র ২১ বছর! এ বিষয়ে ডিকিনজ নিজে বলছেন, “They comprise my first attempts at authorship. I am conscious of their often being extremely crude and ill-considered, and bearing obvious marks of haste and inexperience.” অথচ, ইংরাজী তথা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে এত কম বয়সে লেখা এই বইটি এক নতুন ভাষ্য, নতুন আবেদন তৈরী করল। গভীর পর্যবেক্ষণের সঙ্গে অসামান্য কল্পনায় গড়ে তোলা গদ্যগুলি তুলে ধরল এমন এক লণ্ডন শহর, যার আলো ও আঁধার ডিকিনজের বড় পরিচিত, বড় আপন। তাঁর অননুকরণীয় কলম তুলে ধরল লণ্ডনের রাস্তা, সরাইখানা, টেমস নদী, আদালত, কারাগার, যানবাহনের সব জীবন্ত বর্ণনা। এর সঙ্গে যুক্ত হল ক্রুকশ‍্যাঙ্ক-এর ছবিগুলি। যেমন ধরা যাক, Scenes অংশের “The Streets-Morning” লেখাটি। প্লট বলতে যা বোঝায় তেমনটা নেই সেখানে। উত্তম পুরুষের বর্ণণায় লেখা এটি একটি গদ্য যেখানে সূর্য ওঠার একঘন্টা আগে লণ্ডনের একটি গ্রীষ্মের সকালের রূপ বর্ণিত হচ্ছে। এর সঙ্গেই এল বিভিন্ন চরিত্রের মানুষের বর্ণণা, যা একান্তই ডিকিনজের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। যেমন একজন মাতাল মানুষ। ডিকিনজ লিখলেন, “The last drunken man, who shall find his way home before sunlight, has just staggered heavily along, roaring out the burden of the drinking song of the previous night”। একজন আইনরক্ষক পুলিশের কথা এল। ডিকিনজ লিখলেন, “An occasional policeman may alone be seen at the street corners, listlessly gazing on the deserted prospect before him”। এর সঙ্গে থাকল মানানসই ছবি। আবার ঠিক তার পরের গদ্যখানি, যার নাম “The Streets-Night”, এক অংশে ছবির মত তুলে ধরল এই দৃশ্যকে: “Flat-fish, oyster, and fruit vendors linger hopelessly in the kennel, in vain endeavouring to attract customers; and the ragged boys who usually disport themselves about the streets, stand crouched in little knots in some projecting doorway…..” তিনি শব্দে লিখে চললেন দৃশ্যের পরে দৃশ্য, ছবির পরে ছবি। ক্রুকশ‍্যাঙ্ক সেই লেখাকে দিলেন গভীরতা। আর এভাবেই উঠে এল বিশাল মহানগরের এই কোণে, ওই কোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা, কখনও ভুলে যাওয়া, কখনও মনে রাখা মানুষদের কথা। সে হতে পারেন Scotland Yard রচনাটির একজন জুতো প্রস্তুতকারী অথবা, মনমাউথ স্ট্রিটের পুরনো জামাকাপড়ের দোকানদারেরা। জেলবন্দী মানুষ থেকে শুরু করে শিশুশ্রমিক এমনকি দেহোপজীবীনি….এই বইতে ডিকিনজের চরিত্ররা বড় চেনা, মাটির বড় কাছের। এই বইয়ের গল্পগুলো আদ্যোপান্ত ডিকিনজীয়। শ্রেণী সংগ্রামের চিত্র উঠে আসা ‘The Tuggs’s at Ramsgate’, অদ্ভুত ধরণের বিবাহ অনুষ্ঠানের ‘Horatio Sparkins’, নিকোডেমস ডাম্পস নামের এক কৃপণ মানুষের গল্প ‘The Bloomsbury Christening’, থেকে শুরু করে ‘Newgate Prison’ এর অন্ধকারাচ্ছন্ন ডিকিনজ, অথবা এক অশ্রুময় সমাপ্তির গল্প ‘The Drunkard’s Death’ এই সমস্ত রূপগুলিই পাঠকের কাছে আপন হয়ে থাকে। ব্যঙ্গকৌতুকের সঙ্গে মেশান করুণ রসে জারিত লণ্ডন ও তার চেনা অচেনা জীবন এভাবেই হয়ে উঠছে তরুণ ডিকিনজের সাহিত্যের কর্ষণভূমি। সেখান থেকে শুরু হচ্ছে তাঁর নিরীক্ষা, যার প্রথম সদর্থক রূপ পাচ্ছে Pickwick Papers…

এই বইটির সবচেয়ে পুরনো সংস্করণ ছিল জন ম্যাকরনের। দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। একটি ১৮৩৬ এর ফেব্রুয়ারিতে। অপরটি সে বছরেরই অগাস্টে। তবে খ্যাতিমান লেখক হওয়ার পরে ডিকিনজ এই বইটির স্বত্ত্ব ম্যাকরনের থেকে কিনে নিয়েছিলেন। চ্যাপম্যান এ্যাণ্ড হল, যাঁরা ডিকিনজের অন্যান্য অনেক বই প্রকাশ করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন প্রকাশক। আমার পড়া বইটি অবশ্য পেঙ্গুইন ক্লাসিকস এর। পরে চ্যাপম্যান এ্যাণ্ড হল প্রকাশিত বইটিও দেখেছিলাম। কিন্তু বই-এর নামটি কেন এমন অদ্ভুত?! Sketches by Boz -এ কার নাম এই “বোজ”?! ছবি তো এঁকেছেন ক্রুকশ‍্যাংকস। তাহলে এই বোজ এলেন কোথা থেকে! সে রহস্য উদ্ধার করলাম পরে একসময়। এই বই-এর একটি গল্প, “Mr Minns and his Cousin” আসলে ডিকিনজের প্রথম প্রকাশিত সাহিত্যসৃষ্টি যার আসল নাম ছিল “A Dinner at Poplar Walk”। The Monthly Magazine সাময়িকীতে ১৮৩৩ এর ডিসেম্বরে গল্পটি প্রকাশিত হয়। কথা অবশ্য সেটা নয়। কথা হল, ১৮৩৪ পর্যন্ত এই সাময়িকীতে প্রকাশিত তাঁর লেখাগুলোতে কোন নাম থাকত না। আচমকাই “The Boarding House” লেখাটির আবির্ভাব ঘটে এই “Boz” ছদ্মনামে। নামখানা তৎকালীন পাঠকসমাজে বেশ আলোড়নও ফেলে। পরে জানা গেল, এই নাম না কি স্বয়ং ডিকিনজেরই! তিনি তাঁর ছোট ভাই অগাস্টাসকে ছোটবেলায় অলিভার গোল্ডস্মিথের লেখা “The Vicar of Wakefield” রচনার একটি চরিত্রের নামে ডাকনাম দিয়েছিলেন “মোজেস”। সর্দি হওয়ায় সেই নাম নাকী সুরে বের হত “বোঁজেস” হয়ে। আর কে না জানেন যে বোঁজেস থেকে “বোজ” হয়ে যেতে বেশী সময় একেবারেই লাগে না! একসময় এই বোজ-ই হয়ে গেল ডিকিনজের ছদ্মনাম। আর এই বোজের সঙ্গে ডিকিনজ আরও কিছুটা জুড়ে নিজের ছদ্মনাম নিয়েছিলেন, “The Inimitable Boz”…অর্থাৎ, “অননুকরণীয় বোজ”। পরে আবার এই বোজ-ও বিদায় নেয়। পড়ে থাকে শুধুমাত্র অননুকরণীয়।

ডিকিনজের লেখায় ছবি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ডিকিনজ যখন লেখা শুরু করছেন, তাঁর শব্দের খ্যাতি প্রায়শই চিত্রশিল্পীদের ছবির খ্যাতির তুলনায় কিছু কম হত। বহু ক্ষেত্রে তাঁকে বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের ছবি সম্বন্ধে লেখার জন্য ভাড়া করাও হত। এঁদের সঙ্গে জুটি বেঁধে তাঁর কাজ চলত। ঊনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডে এমনই একজন জনপ্রিয় চিত্রশিল্পী ছিলেন জর্জ ক্রুকশ‍্যাংক। এমনও সময় ছিল, যখন ডিকিনজ নিজে ক্রুকশ‍্যাংকের তুলনায় কম জনপ্রিয় ছিলেন। পরে ক্রমশঃ তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জনে ক্রুকশ‍্যাংককে ছাপিয়ে যান।এতটাই জনপ্রিয়তা পান যে ডিকিনজের লেখা সামাজিক সচেতনতার ক্ষেত্রে বড় ধরণের প্রভাব ফেলে। ডিকিনজ যখন তাঁর প্রথম লেখা লিখছেন, সেই সময়ের ইংল্যান্ডে উচ্চবিত্ত শ্রেণী এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে দূরত্ব শিল্পবিপ্লবের কারণে বেড়ে চলেছে। ধনবান সম্প্রদায় অধিকতর সম্পদের অধিকারী হচ্ছেন। দরিদ্রেরা হয়ে পড়ছেন দরিদ্রতর। বুর্জোয়া সম্প্রদায় প্রভাব বিস্তার করছে দেশের অর্থনীতির ওপরে, রাজনীতির ওপরে। আর এইসব সামাজিক রূপ চিত্রিত করে চললেন ডিকিনজ তাঁর প্রথম কাজটির ওপরে। ক্রুকশ‍্যাংক ছবির মাধ্যমে। ডিকিনজ লেখার মাধ্যমে। তাঁর এই বইতে ফুটে উঠল লণ্ডনের বেঁচে থাকা। সে হতে পারে জীবন বাঁচান। অথবা সংস্কৃতি বাঁচান। অথবা নৈতিকতা। কিন্তু তাঁর এই লেখায় ডিকিনজ সমব্যথী হলেন সর্বহারা সম্প্রদায়ের দুঃখের সঙ্গে।

ঊনবিংশ শতকের সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী “Sketches by Boz” এর লেখাছবিগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি, লণ্ডনের কর্মশালা এলাকার কথা যেখানে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের বসবাস। দ্বিতীয়টি, লণ্ডনের বস্তি ও অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকা যেখানে মূলতঃ খুনী, পকেটমার এমন সব অপরাধীদের বসবাস। তৃতীয়টি হল ভিক্টোরিয়ান মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়। এবারে এই লেখাগুলোতে কিভাবে সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস আসছে, সেটি দেখে নেওয়া যাক কিছু ছবির মাধ্যমে।

 

যেমন Scenes অংশের পঞ্চম গদ্য Seven Dials লেখাটি। লেখাটির ছবিতে জায়গাটি বেশ ঝামেলাপূর্ণ একটি বস্তি এলাকা যেখানে নিম্নবিত্ত মানুষদের বসবাস। সেখানে দুই নারী। হাতে তরবারি। না। ভুল হল! হাতে নয়। মুখে তরবারি। তাঁরা ঝগড়া করছেন জমিয়ে। রাস্তার মাঝখানে ঝগড়া চলছে তাঁদের। চারপাশে উৎসাহী মানুষজনের ভিড় জমে গেছে। দুজনের শারীরিক ভাষা, দাঁড়ানোর ভঙ্গী, মুখের অভিব্যক্তি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এঁরা খুব শিক্ষিত কেউ নন। তাঁদের একে অপরের দিকে তাকান, চেঁচামেচি করার সময় হাঁ হয়ে থাকা মুখ, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ান এবং সর্বোপরি তাঁরা ঝগড়ার সময়ে পরস্পরের প্রতি যে ভাষা ব্যবহার করছেন, সেই সবকিছুর মাধ্যমেই Seven Dials লেখাটিতে একটি প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এই প্রাণ উচ্চবিত্তের নয়। নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষের।

 

এবারে আসা যাক এই বই-এরই অন্য একটি লেখায়। Scenes এর নবম গদ্য। নাম “London Recreations”। এখানেও দু’জন নারী রয়েছেন। ডিকিনজের কথায়, “Some of the finery of these people provokes a smile, but they are all clean, and happy, and disposed to be good-natured and sociable. Those two motherly-looking women in the smart pelisses, who are chatting so confidentially, inserting a ‘ma’am’ at every fourth word, scraped an acquaintance about a quarter of an hour ago…..”

 

সব লেখাটুকু আর দেওয়া হল না। উৎসাহী পাঠক নিজে পড়লে ভাল হবে। কিন্তু এই লেখাটিতে যে দৃশ্য উঠে এসেছে সেটি ভিক্টোরিয়ান ইংল্যাণ্ডের ধনিকশ্রেণীর অন্তর্গত। তাঁরা একটি চা বাগিচায় একত্রিত হয়েছেন। চা পান করছেন। সঙ্গে রয়েছে সুস্বাদু কেক। বেশ কিছু উচ্চবিত্ত মানুষ পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদের সঙ্গে এক বিকেলে একত্রিত হয়েছেন সুসময় কাটানোর জন্য। এখানে উল্লিখিত দুই নারীর পারস্পরিক আলাপ Seven Dials এর মত ঝগড়ার নয়…বরং সুললিত ভাষায় জারিত। তাঁরা একে অপরকে সম্মান দিয়ে কথা বলছেন। ছবিতে দেখা যায় মানুষগুলি সুদর্শন, সুবেশা। তাঁদের ব্যবহার ভদ্র। শিশুদের পরিধানে ভাল পরিধেয়। প্রায় এমনই উচ্চবিত্ত মানুষজনের দেখা পাওয়া যায় ‘Public dinner’ লেখাটিতেও। দীর্ঘকায়, তীক্ষ্ণ নাসার অধিকারী মানুষজন, সুসজ্জিত হয়ে একটি প্রাসাদোপম বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখেই বোঝা যায়, এঁদের আনাগোণা সমাজের যথেষ্ট উচ্চস্তরে।

অপরদিকে এই বইয়েরই ‘Meditations in Monmouth Street’ লেখাটিতে, ছবি এবং শব্দের অমোঘ ব্যবহারে উঠে আসছে লণ্ডনের আরও একটি নিম্নবিত্ত সম্প্রদায়ের বসবাসকারী এলাকার কথা। “We have always entertained a particular attachment towards Monmouth-street, as the only true and real emporium for second-hand wearing apparel. Monmouth-street is venerable from its antiquity, and respectable from its usefulness.” ছবিতে ও লেখায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একটি ব্যস্ত রাস্তার দৃশ্য। সেখানে পুরনো জামাকাপড়ের দোকান বসেছে। অনেকগুলি চরিত্র আঁকা। তারা নানারকম কাজে ব্যস্ত। শিশুদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তারা নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। নর্দমার ধারে পথে বসে শিশুরা নিজেদের মধ্যে খেলা করছে। যেমন কেউ ছিপ বানিয়ে নর্দমায় মাছ ধরতে ব্যস্ত। কয়েকজন দল গড়ে পুতুল খেলছে। পথের কুকুরও তাদের সঙ্গী হয়েছে। কাপড় ব্যবসায়ীরা চেয়ারে বসে বা পাশে দাঁড়িয়ে ধূমপানরত। তাঁদের আশেপাশে বিভিন্ন রকমের জামাকাপড় ঝুলছে। একটি দোকানের নাম P. Patrick Boot & Shirts। সেটিও একটি জামাকাপড়ের দোকান। সেই দোকানের ওপরে Clipe Tailor নামের একটি বোর্ড। সম্ভবতঃ সেখানে কোন দর্জি বসেন। দোকানে যে ধরণের পোশাক রয়েছে, দোকানদারদের পরিধানেও প্রায় একই পোশাক। এতে মনে হয়, যে সব পুরনো পোশাক তাঁরা বিক্রি করেন, সেখান থেকেই কিছু তাঁরা নিজেরাও ব্যবহার করেন। চরিত্রগুলির শরীরী ভাষায় Seven Dials এর নারীদের উগ্রতা যদিও নেই, অথবা নেই London Recreations এর মত আভিজাত্যও….কিন্তু দেখে বোঝা যায় তাঁরা শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ। এঁদের মধ্যে একজন নারী তাঁর শিশুকে নিয়ে পথেই বসে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে সেটি মূল রাস্তা থেকেও কিছুটা নিচের দিকে, একটি গর্তের মধ্যে। ছবির মানুষগুলিকে দেখে, তাঁদের আর্থিক দৈন্য দেখে পাঠকের করুণাও উদ্রেক হতে পারে।

 

বইটি পড়ে আমার খুব মনে হয়েছিল, এই বই যতটা ডিকিনজের, ঠিক ততটাই যেন ক্রুকশ‍্যাংকেরও। ছবিগুলি যেন বইটির আত্মা হয়ে উঠেছে। ডিকিনজের শব্দচয়ন অতুলনীয় তো অবশ্যই। সেই সঙ্গে ছবিগুলিও বিষয়বস্তুর সঙ্গে জুড়ে গেছে ওতপ্রোতভাবে। আমার নিজের ছবি আঁকতে ভাল লাগে। তার সঙ্গে ডিকিনজের শ্লেষাত্মক রচনা, চরিত্রচিত্রণ তথা বিষয়গত ও বিবরণগত গভীরতাও খুবই পছন্দের, সেই কারণে এই বইটি পড়া আমার কাছে এক অসামান্য অভিজ্ঞতা ছিল। আর উপরি পাওয়া ছিল অন্য একটি দেশের, অন্য এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের ইতিকথা…যাকে আমি চেষ্টা করলেও ধরতে পারতাম না কখনও, যদি ডিকিনজের এই লেখা না পড়তাম, যদি ক্রুকশ‍্যাংকের ছবি না দেখতাম।

[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ