“নেত্য ধোপানি কাপড় কাচে মন পবনের ঘাটে
এ বিষ পাইল কোথা সাঁতালি পর্বতে …”
যে উপন্যাস বা বই এর ব্যাপারে অতি সামান্য কিছু বলব, সেটার প্রেক্ষাপট যে কোনো হদ্দ গ্রাম এটা আশা করি উপরের পংক্তির ডায়ালেক্ট দেখেই আন্দাজ করা গেছে।
একটা কথা শুরুতে বলে রাখা ভালো, তাতে অনেকের আশাভঙ্গ হলেও হতে পারে, আবার কদাচিৎ কেউ স্বস্তিও পেতে পারেন। কোনোরকম অশ্রদ্ধা বা অবজ্ঞার ছিঁটে-ফোঁটা না রেখে খোলাখুলি বলছি, গ্রাম, গ্রামের প্রকৃতি ইত্যাদির প্রতি আমার কোনো ভাব-গদগদ দৃষ্টিভঙ্গি নেই। গ্রামকে আমি ব্যক্তিগতভাবে ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ বলে গ্লোরিফাই করতে পারব না। মাফ করবেন। যতবার গিয়েছি, একটু তলিয়ে দেখামাত্র নিজেকে ভয়ানকরকম মিস-ফিট মনে হয়েছে, এবং এ’কথা স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা নেই। এক-দুইদিন কোনো এসি রিসর্টে থেকে, গান্ডে-পিন্ডে গেলার পরে গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে কোনো র্যান্ডাম কুটীরের মাটির দেওয়ালের সামনে ভুঁড়িয়াল পোজ দিয়ে ঢলঢলে পাঞ্জাবী বা উড়ু-উড়ু উত্তরীয় পরে শখের ‘গ্রামবাজি’ করা-ই যায়, স্টেটাসে-স্টোরিতে দেওয়া-ই চলে, সাথে ঢুলু-ঢুলু চোখে দু’-চার লাইন জসীমুদ্দিন জুড়ে দিয়ে বাজার গরম করলেও বড় ক্ষতি কিছু নেই — তবে ব্যাপারটার অন্তরে হিপোক্রিসিটা থেকে-ই যায়। ব্যক্তিগত স্তর থেকে বলছি। কারণ, একটু বেশি দিন ওখানকার সাধারণ লোকেদের মত করে থাকতে বললেই আমি তো হেঁটে কলকাতা আসতেও পিছ-পা হব না। কাজেই ……
এত কথা বলার সার একটাই — গ্রাম নিয়ে লেখা এক অনতিবিখ্যাত উপন্যাসের এই অর্বাচীন আলোচনায় গ্রাম-বন্দনা সম্ভবিবে না। আর গ্রামের মায়ায় পড়ে বইটা আমার ভালো লাগেনি।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখার সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল খুব ছোটোবেলায়। তখন লেখকের নাম মনে রাখার ব্যাপারটা ধর্তব্যের মধ্যে আসেনি, সিলেবাসের বাইরের গল্প হলে তো কথা-ই নেই। মৌখিক পরীক্ষায় জিজ্ঞেস করার বালাই নেই। তার অল্প পরে কর্নেল পড়লাম কিছু। ফেলুদা শেষ করার পরে কর্নেল বিশেষ জম’ল না। এর বহু পরে জীবনে ‘হরির হোটেল’, ‘হাওয়াকল’, ‘স্টেশনের নাম ঘুমঘুমি’, ‘কেঁকড়াডিহির বৃত্তান্ত’, ‘ছক্কা মিঁঞা-র টমটম’ ইত্যাদি একে-একে পুনরাভির্ভূত হল। ছোটবেলার ভেতর থেকে ফিরে এলেন সে-ই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। এ’রকম একটা সময়ে পুরোপুরি কপালের গুণে কলেজ স্ট্রীটের এক লক্ষ্যহীন বিকেলে প্রায় বিনামূল্যে-ই আমার হাতে এসে পড়ল ‘হেমন্তের বর্ণমালা’। লেখকের নাম আর বইয়ের কন্টেন্ট এর কন্ট্রাস্ট দেখে পড়তে দেরী করি নি। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো কেকেআর-এর হয়ে কেমন খেলে সেটা না দেখলেই নয় কিনা! মানে, তখন এরকম-ই ভেবেছিলাম …
গ্রাম নিয়ে উপন্যাস বা কাহিনী বিস্তার করার একটা হিট-ফর্মুলা হচ্ছে, শহরের শিক্ষিত, গরীব ছেলে চাকুরি নিয়ে বা অনেকদিন পরে গ্রামে যাবে, প্রকৃতি দেখে গল-গল করে গলে যাবে, গ্রামের কোনো মেয়ের মধ্যে অসামান্য, অনির্বচনীয় ‘কিছু-একটা’ দেখে জাতিতে ‘ন্যাকা-প্রেম’ করবে, তারপরে বিয়ে হবে কিনা সেটা মোটামুটি টস করে ঠিক করা হবে। এই প্রিপারেশানটা লোকে এখনও খায়, জাঙ্কফুডের মত খেতে ভালোবাসে, খেতে-ই থাকবে। ‘হেমন্তের বর্ণমালা’ পুরোপুরি এই ছকের বাইরে — এটা বলা যাবে না। ডাল-ভাতের সস্তা হোটেলে কাতলার ঝোল আর ডিমের ঝোলের মধ্যে যতটা ফারাক, এখানেও সে’রকম। মানে, ঝোলটা (বেস) এক-ই, খালি ডিম আর মাছের প্রভেদ। তাহলে পড়ে লাভ কি হল? কেন বসেছি বকতে?
ঝাঁপুইতলা গ্রামের দৈন্যকে এখানে মহান করে দেখানো হয়নি। গ্রামের মানুষকে ধর্মপ্রাণ, ভোলা-ভালা, বঞ্চিত, একটু সুযোগ পেলে এরাও করে দেখিয়ে দিত — এ’রকম একটা প্যাকেজ দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় অনেক সময়। এখানে তেমন হয় নি। এমন কিছু কনট্রাস্ট রয়েছে যেটা অনেকটা বেশী বাস্তবানুগ। হংসধ্বজ বা ‘হাঁসুবাবু’ নিজের টাকা ব্যয় করে জনহিত করতে চান, সরকারী সাহায্য নিতে চান না নিয়মের কলে বাঁধা পড়ার ভয়ে, বয়স্কশিক্ষার মত আরও অনেক জনকল্যাণের কাজ করা তাঁর কাছে ‘মদ খাওয়ার মত’ নেশা। এদিকে ঠিক এর বিপরীতে রয়েছে পর্যাপ্ত সুযোগ থাকার পরেও গ্রামের অধিকাংশ লোকের লেখাপড়ার প্রতি বাড়তি আগ্রহের অভাব। এই অনাগ্রহ কিন্তু কারো চরিত্রগত ত্রুটি নয়, বড় বড় আইডিয়াল ছাড়া দিন-চলতি যুক্তি দিয়ে চট করে খন্ডন করা যাবে না। যে কোন একটা ‘ইজম’ বা আদর্শের পেছনে আপ্রাণ কমিটেড থাকা এবং তার সাথে সেটার গ্রাস-রুট লেভেলের প্র্যাক্টিক্যালিটি যে কতটা ফেজ-শিফটে থাকতে পারে অথচ সেটা যে কোনো পক্ষের-ই দোষ নয় — এটা বেশ ভালো করে দেখা যায় এই গল্পে।
এছাড়া এই উপন্যাসের আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক হল এর সেন্সারড ডার্কনেস। আলোর অভাব যতটা ডার্কনেস, সেই অভাবকে স্বীকার করা ততটাই সততা। কমলা চরিত্রটাকেই ধরা যাক। গ্রামে সে ডাকিনী হিসেবে কুখ্যাত, তার স্বামী তান্ত্রিক অথবা ওঝা। কমলা রাতের বেলায় বিবস্ত্রা হয়ে মাথায় জ্বলন্ত ধুনি নিয়ে পুজো দিতে যায়। কমলার চরিত্র ভালো নয় — এমন কথাও গ্রামে প্রচলিত রয়েছে। সে রাতেও বন-বাদাড়ে ঘোরে। ধনো বাগদী মুকুলকে (গল্পের প্রোট্যাগনিস্ট, বয়স্কশিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষক) নিয়ে রাত্রে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে কমলার কাছে আসে মুকুলের গাত্রবন্ধন করে নিতে। কমলা করেও দেয়। সে’রাত্রে ধনো বাগদীর মৃত্যু হয় সর্পাঘাতে। সাপের কামড় অনভিজ্ঞ মুকুলের-ই খাওয়ার কথা, কিন্তু শেষে খেল কিনা জলে-জঙ্গলে বহু অভিজ্ঞ ধনো। এমনকী গভীর ক্ষেতের ভেতর দিয়ে অন্ধকারে দৌড়ানোর পরেও সেই রাত্রে মুকুল অক্ষত থাকে। কমলার স্বামী কালীপুজোর রাত্রে কমলাকে বলি দিতে গিয়েছিল যদিও তা সফল হয় নি শেষ অবধি। কমলার চরিত্রের দোষ, নাকি ঝাঁপুইতলার আদিকালের নরবলির কোনো ডার্ক লেগাসি — কোনটা যে এর প্রকৃত কারণ সেটা আমাদের জানা নেই। কমলার হাবে-ভাবে খুব সতীত্বের লক্ষণ প্রকাশ করেন নি লেখক। তবে ধনো বাগদীর মৃতদেহকে পুনরুজ্জীবিত করতে সে ত্রুটি করেনি। এই লেখার একদম শুরুতে উল্লিখিত ছড়াটার মত অনেক মন্ত্রোচ্চারণ করে অনেকটা দূর অবধি সে নাকি গিয়েছিল ধনো বাগদীর জলে-ভাসিয়ে-দেওয়া মরদেহের সাথে সাথে। মৃত্যুর আগেও তাকে বাঁচাতে বহু চেষ্টা করেছিল। কাহিনীর শেষ পর্যন্ত কমলাকে দেখা যায় বাজারের দিকে জড়ি-বুটি, কবচ ইত্যাদি বেচতে। মূলতঃ দেখার বিষয় হচ্ছে দুটো। প্রথমত, তন্ত্র-মন্ত্র ইত্যাদিকে তথাকথিত ‘কুসংস্কার’-ও বলা হয় নি, আবার বিজ্ঞানোত্তীর্ণ করেও দেখানো হয় নি। বাস্তবে বিষয়টা যেমন, সেইরকম-ই রাখা হয়েছে। লেখক কোনো পক্ষ নেন নি। দ্বিতীয়ত, একটু চেষ্টা করলেই কমলাকে ‘পুরুষতন্ত্রের শিকার’, ‘অবদমিত ও নিরুপায়’, ‘সমাজের খাঁচায় বন্দী’ ইত্যাদির উদাহরণ হিসেবে কোনো লাচার-চরিত্র করে দেখানো যেত এবং যেটা খুব বেশী ফুটেজ খেত। অথবা অন্য কোন চরিত্রের ঘাড়ে চাপিয়ে প্রেমের নামে পরকীয়ার মত একটা যাচ্ছে-তাই জিনিসের আনজাস্টিফায়েড জয়গান করা যেত — যেটা সুসম্পন্ন হলে গল্পের এডিশানের পর এডিশান তো বের হত-ই, এমনকী এতদিনে ওটিটি রিলিজ হলেও অবাক হতাম না (এই গল্পটার সেই যোগ্যতা এমনিতেই রয়েছে)। কিন্তু লেখক সে’রকম করেন নি। চরিত্রটাকে, তার আগাগোড়া ডেভেলপমেন্টকে ডার্ক রেখেছেন, সৎ ও স্বতন্ত্র রেখেছেন। এই ব্যাপারটা বেশ ইউনিক লেগেছে।
সবচেয়ে অসামান্য লেগেছে বসন্তবাবুকে। বসন্তবাবু মানসিক ভারসাম্যহীন, তিনি নিজেকে মাঝেমাঝে পাঁচুগোপাল মনে করেন এবং নিজের প্রকৃত নাম (অর্থাৎ বসন্ত) ধরে ডাকাডাকি করেন। বসন্তকে খুঁজে বেড়ান আদাড়ে-বাদাড়ে। খুঁজে না পেয়ে গালাগালি দেন। ওই অসুস্থতার সময়ে নিজের একমাত্র মেয়েকেও চিনতে পারেন না। নিজেকে হারিয়ে ফেলা মানুষদের প্রতিনিধি এই চরিত্রটা। দুর্দান্ত সৃষ্টি।
রমেন ও ঝিমি চরিত্রগুলো সাধারণ। সাধারণ বলতে সাদা-মাটা বা দুর্বল নয়, এমন মানুষ এরা যাদের সাথে আর পাঁচটা লোকের মিল পাওয়া যায়। বেশী বিশেষত্ব নেই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের মতি আর কুমুদের সাথে আমি এদের তুলনা করতে পারি। উপন্যাসে এদের উপস্থিতি কেন রাখেন লেখক আমি জানি না, হয়ত ‘গল্প’-এর সঙ্গে ‘বাস্তব’-এর যুগলচলনের সাথে সাথে তাদের অন্তর্নিহিত বৈপরীত্যের আভাস দিতে-ই রাখেন। নিশ্চিত নই।
গল্পের তথাকথিত নায়িকা চিমনি ওরফে কুন্তলা। বিপত্নীক বসন্তবাবুর একমাত্র মেয়ে। বলিষ্ঠ চরিত্র। নায়িকাসুলভ পেলবতার চেয়ে সংযম কিছুটা বেশী। বাস্তবিক। পরিস্থিতির সাথে সে লড়াই করতে জানে। মুকুলকে সে ভালোবাসে কিনা সেটা পরিষ্কার করেন নি লেখক। বিদায়ের আগে মুকুল কথা দিয়েও তার সাথে দেখা করতে যায় নি। কিছুই না পাওয়ার কষ্ট হয়ত অল্প পেয়ে হারানোর বেদনার চেয়ে কিছু কম। চিমনির সাথে মুকুলের সম্পর্কটা একটা টাইম-স্পেস জোনে যেন চিরকালের মত জমে রইল। কোনোদিন যেন এর রূপ বদলাবে না। বহু দূরে যাওয়ার আগে শেষবার যখন বাড়ির দিকে তাকানো যায়, যেভাবে বাড়ির প্রিয়জনকে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় — বহুদিন পরেও মুকুল যদি মনে-মনে ফিরে তাকায়, কুন্তলাকে সে হয়ত ওইভাবেই দেখতে পাবে। হয়ত দুজনেই পাবে। আজীবন। হয়ত না।
কাহিনীর শেষটা আমার খুব তাড়াহুড়ো করে করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। এটাই একমাত্র আক্ষেপ।
জীবনানন্দ দাশের কথা ধার করে বলতে হয়, ‘হেমন্তের বর্ণমালা’-র ভেতরে একটা ‘অঘ্রানের ঘ্রাণ’ রয়ে গেছে। অনেক বিস্মৃত সময়ের হিজিবিজি ছবি আঁকতে জানে বইটা। যে ঋতুতেই পড়ি না কেন, মনের ভেতরে এক চিরকালীন হেমন্ত উঁকি মারে। এটাই বইটার সবচেয়ে বড় ম্যাজিক বলে মনে হয় আমার।
আলোচিত বই – ‘হেমন্তের বর্ণমালা’ /সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]
Tags: পূষন, বই আলোচনা, বই পাঠ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, হেমন্তের বর্ণমালা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।