রাত আড়াইটে। ঘরে এসে বিল্টু খবর দিল, “ঠাম্মি, এইবার শিগগির চলো! লাইট নিভে গেছে।” শুনে সবাই হৈ হৈ করে উঠল। “চলো, চলো…এখনই চলো।”
বিল্টুর ঠাম্মি, অর্থাৎ ঐন্দ্রিলা দেবী হাত তুলে শান্তভাবে চোখ, মুখ নাচিয়ে বললেন, “দাঁড়া বাছা! এখনই কী?! এখনও সময় হয় নি। আরও কিছুক্ষণ যাক। রস জমুক।” তারপর বিল্টুকে তাড়া দিয়ে বললেন,”তুই শুতে যা দিকিনি এবার। যাঃ! বড়দের মাঝে থাকতে হয় না।” ধমক শুনে বিল্টু সুড়সুড় করে শুতে চলে গেল।
“আর কত দেরী করবেন মা? এরপর তো ঘুমিয়ে পড়বে! সারাদিন ধকল তো ওদেরও কম যায় নি।”, বড় বৌ মৃদুলা বললে।
“ঘুম থেকে তোলা হবে। বাড়ির রীতি-আচার বলে তো একটা কথা আছে। তোমাদের সময়টা কী ভুলে গেলে নাকি?!”, ঐন্দ্রিলা গম্ভীরভাবে ঘোষণা করলেন। মৃদুলা মুখ বেঁকিয়ে চুপ করে গেল।
“আরে ধুর! নিকুচি করেছে সময়ের! আমাদেরও তো ঘুম পাচ্ছে, এটা বোঝো! চলো তো সবাই।”, ঐন্দ্রিলা দেবীর একমাত্র মেয়ে অনিন্দিতা বলে উঠল। সবাই আবারও, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলো তো…চলো” বলে হৈ হৈ করে উঠল।
আর কী আশ্চর্য! এবারে ঐন্দ্রিলা এককথায় রাজী হয়ে গেলেন। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “বেশ। চলো তাহলে।” বলে রূপোর বাটিখানা হাতে তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন। মৃদুলাও যেতে যেতে, মনে মনে মুখ বেঁকিয়ে বললে, “হুঁঃ ! ন্যাকামি!!”
ঘোষপাড়ার নামকরা মুখার্জ্জী পরিবারের সর্বময়ী কর্ত্রী ঐন্দ্রিলা দেবীর তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার ছোটছেলে সম্রাটের বৌভাত আজ। খাওয়াদাওয়ার পালা চুকে গিয়েছে। অতিথি, অভ্যাগতরাও বিদায় নিয়েছেন বহুক্ষণ। এবারে বিশেষ এক উদ্দেশ্যে বাড়ির মহিলা সদস্যরা, ঐন্দ্রিলা দেবীর নেতৃত্বে হানা দিতে চললেন নবদম্পতির ঘরে।
সম্রাটের ঘরের আলো সত্যিই নিভে গেছে। যদিও সম্রাট ও মীনাক্ষি দু’জনেই জেগে। ইচ্ছে করেই আলো নিভিয়ে দিয়েছিল সম্রাট। এতবছরের অভিজ্ঞতায় সে জানে এই পরিবারের নিয়ম। মায়েরা আসবেই। মীনাক্ষিকে সে ব্যাপারটা খুলে বলে নি। সুতরাং, মীনাক্ষি জানে, আরও একটা স্ত্রী আচার এখন হবে। জানলেও সে বিরক্ত খুবই। তার চোখ ঘুমে টানছে।
ঐন্দ্রিলা দরজার কড়া নাড়লেন। সম্রাট “যাআআই” বলে, আলো জ্বেলে দরজা খুলে দিল। খুলতেই আটজন মহিলা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল।
ঐন্দ্রিলা ঘরে ঢুকে, ফুলে সাজান খাটের দিকে এগিয়ে এসে, রুপোর বাটিটা বিস্মিত মীনাক্ষির কপালে, বুকে ও পায়ে তিনবার ঠেকালেন। তারপর খাটে বসে বাটির ওপরের ঢাকনাটা সরিয়ে মীনাক্ষিকে বললেন, “নাও মা। এই বাটির মধ্যে থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে কপালে ঠেকাও তো।” ততক্ষণে বাকীরাও অনেকে খাটে বসে পড়েছে। যারা জায়গা পায়নি তারা খাট ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
মীনাক্ষি একটা কাগজ তুলে নিয়ে কপালে ঠেকাল। ঐন্দ্রিলা দেবী বললেন, “এবারে কাগজটা খোলো দেখি। কি লেখা আছে পড়বে জোরে।”
মীনাক্ষি ভাঁজ খুলে দেখল ওপরে লেখা আছে, “ভগবানের আশীর্বাদ”। নিচে লেখা, “তিলোত্তমা”। জোরে পড়ল পুরোটা। তারপর দেখল খুড়শাশুড়ি উদ্বাহু হয়ে ধেই নৃত্য করছেন আর বলছেন, “আমার নাম উঠেছে! আমার নাম উঠেছে!” মীনাক্ষি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ঐন্দ্রিলার দিকে তাকাল।
ঐন্দ্রিলা বললেন, “বিয়ে মানে নতুন জীবনে পা ফেলা। তাই আমাদের পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী আজ থেকে তোমার নতুন নাম হল তিলোত্তমা। আগামীকাল এফিডেভিট হবে। এ বাড়িতে আমরা যারা বিয়ে হয়ে এসেছি, তাদের সবাইকে এই নিয়ম মানতে হয়েছে। আপত্তি করিনি। তোমাকেও মানতে হবে। জীবনে সুখী হও মা।”
মীনাক্ষি কথাটা শুনে চুপ করে রইল। তার সামনে সে দেখতে পেল অনেকগুলো মুখোশ! কিছুক্ষণ বাদে সে বলল, “কোন নতুন নাম আমি নিতে পারলাম না। চেষ্টাও করবেন না। পস্তাবেন।”
শুনে ঐন্দ্রিলা ভ্রূ কুঁচকে, মনে মনে মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “হুঁঃ! ন্যাকামি!!”। আর মৃদুলা? সে সামান্য হাসল।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।