অতসীপিসী আমার দূরসম্পর্কের পিসীমা ছিলেন। তাঁর ছোটভাইয়ের সংসারে তিনি প্রায় গোটা জীবনটাই কাটিয়েছিলেন । তাঁকে কোনোরকম অশ্রদ্ধা বা অসন্মান করার ক্ষমতা কারো ছিলনা। এই উচ্চাসন তিনি নিজের যোগ্যতায় অর্জন করেছিলেন। প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী মৃদুভাষী এই মানুষটি আমার মাকে ভীষণ ভালোবাসতেন ।আমার মায়ের থেকে বয়সে অনেকটা বড়ো হলেও নিজের মনের সব কথা বলতেন।
নব্বই বছর পেরিয়ে যখন উনি চলে গেলেন আমার বয়স তখন তিরিশ। পিসীমার জীবনে একটা অসম্পূর্ণতা ছিল যা আমি বড়ো হয়ে জানতে পেরেছিলাম। যৌবনে অপূর্ব সুন্দরী এই পিসীমার বিয়ে হয়েছিল বহুদূরে সম্ভ্রান্ত এক ধনী পরিবারের অত্যন্ত সুপুরুষ এক যুবকের সঙ্গে। সবাই খুশি, বললো একেবারে রাজযোটক ।
কিন্তু ফুলশয্যার রাতেই সে নতুন বৌকে জানিয়ে দিলো তার এক রক্ষিতা আছে এবং তাকে নিয়েই সে থাকবে। বাড়ির সবাই নাকি ব্যপারটা জানে। ঘটনাটা বাইরে জানাজানি হতে বেশিদিন লাগেনি। খবর শুনেই পিসিমার বাবা পত্রপাঠ মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ঐ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে এলেন। এই ঘটনার দশ বছর পরে তিনি মারা যাবার সময় ছেলেকে বলে যান দিদির সব দায়িত্ব এবার থেকে তার এবং আমরা জানি সে দায়িত্ব তাঁর ছেলে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন।
এরপরও অতসীপিসী দীর্ঘ অনেকগুলি বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি চলে যাবার মাসখানেক আগে আমার মা একদিন তাদের বাড়িতে গিয়ে শুনলেন সকাল থেকেই অতসীপিসী নাকি ঠাকুরঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। মা গিয়ে ডাকতেই কিন্তু খুলে দিলেন।
মা দেখলেন জলচৌকির ওপরে একটি অসাধারণ রূপবান যুবকের পুরোনো ছবির সামনে মুগ্ধ হয়ে বসে আছেন অতসীপিসী। মাকে বললেন, জানিস, আমার বাবা মারা যাবার পর সে এসেছিল। বারবার এসেছিলো, আমি যাইনি।
মা চমকে উঠেছিলেন ।
– সেকি ,কেন গেলেনা দিদি ?
– দীর্ঘ সময় ধরে পুষে রাখা সেই প্রথম অপমানের জ্বালা আর তীব্র অভিমান।
– তারপর ?
অতসীপিসী চুপ করে বসে,আস্তে আস্তে বললেন,অনেকবছর পরে তার মৃত্যুসংবাদ পাওয়া গেলো। কেঁদেছিলাম কিনা মনে পড়েনা ।
তারপর হঠাৎ আমার মাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন সেই নবতিপর বৃদ্ধা। সব গাম্ভীর্য ভেঙে খানখান। শিশুর মতন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুইতো আমার বন্ধু, মনের সব কথা শুধু
তোকেই বলি। বলতো, সেদিন তাকে ফিরিয়ে দিয়ে কি ভুল করেছিলাম ?
মা কোনো উত্তর দেননি। নিস্তব্ধ পুজোর ঘরে একটি যুবকের ছবির সামনে এক বৃদ্ধার কান্না আর ধুপের গন্ধ হাওয়ায় মিশে যাচ্ছিলো।
Tags: অণু গল্প, অনিলেশ গোস্বামী, নিভৃত সংলাপ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।