সালটা ৭১ কি ৭২। গোটা দেশে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ডামাডোল। কালোবাজারির দাপটে নাভিশ্বাস। এরকম একটা সময়ে মফস্বলের এক বাড়িতে চিঠিটা এলো। বাইরের ঘর, মাঝের ঘর, ভাঁড়ার ঘর, ঠাকুর ঘর পেরিয়ে উঠোন লাগোয়া নতুন ঘরে আমার ছোটকা মানে এ বাড়ির ছোট ছেলে, সেটা এনে দিলো ঠাকুমাকে। ঠাকুমা চিঠিতে চোখ বুলিয়েই শুরু করলেন হাঁউমাঁউ। সেই চিৎকারে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন বাড়ির বড় বৌমা,ছোট বৌমা। অর্থাৎ আমার মা এবং কাকিমা।ঠাকুরঘর থেকে আধা পুজো রেখে ঠাকুরদা। মেজো পিসি কলেজ যাবে বলে শাড়ী পড়ছিল ,সে এসে দাঁড়াল পেছনে। চিঠি পৌঁছে তার চিলেকোঠার গোপন ডেরায় যাচ্ছিল ছোটকা। সে আবার ফিরে এলো। বাড়ি লাগোয়া চেম্বার থেকে ডেকে আনা হলো মেজকাকাকে । ঠাকুমা হাঁউ মাঁউ করে কেঁদেই চলেছেন।সবাইকে দেখে কান্নার গতি আরও বাড়ল, ‘সব্বোনাশ হয়ে গেছে রিনিকে পাওয়া যাচ্ছেনা’ । রিনি ঠাকুমার বড় নাতনি। আমার বড় পিসির মেয়ে।পিসেমশাই বিহারে থার্মাল প্ল্যান্টে চাকরি করেন। পিসি তার চার বছরের মেয়েকে নিয়ে সদ্য কলকাতার বাসাবাড়িতে গেছে। কলকাতা তখন রীতিমত অশান্ত।এই সময়ে এত ছোট বাচ্চা নিয়ে কলকাতার বাসাবাড়িতে যাওয়া নিয়ে বাড়ির সবারই আপত্তি ছিল, ঠাকুমারতো বটেই । আর সব আশঙ্কা সত্যি করে শেষমেশ কিনা এই ভয়ানক খবর !
বাড়ির মধ্যে হুলুস্থুল বেঁধে গেল। ছোটকা সাইকেল নিয়ে ছুটল তার বড়দা মানে আমার বাবাকে ডাকতে। মুহূর্তের মধ্যেই বাবা পৌঁছে ,মেজকাকার চেম্বারের বড় হাতলওয়ালা কালো ফোন থেকে ফোন করলেন, ছোটবেলার বন্ধু ঋতেন ব্যানারজীকে । রীতেন কাকু এখন পুলিশের বড়কর্তা । তো কাকু সে সময় চেম্বারে ছিলেননা ,তাঁর পি.এ জানালো, স্যার ডিউটিতে গেছেন। এলে বলে দেবেন। ততক্ষনে পাশের পাড়া থেকে বাবাদের মেজপিসিমা, পাশের বাড়ির দীপালি জেঠিমা, এপাশ ওপাশ থেকে ঠাকুরদার খান তিন চারেক বন্ধু এসে পড়েছেন । মহিলারা ঠাকুমার সেগুন কাঠের পেল্লাই খাটে গোল হয়ে বসে ঠাকুমাকে সামলাচ্ছেন,নানা আশ্বাসবানী দিচ্ছেন । বাকিরা অন্য দিকটা দেখছেন। মেজকাকা তার এক মক্কেলকে পাঠালেন স্টেশনে। বিকেলের ট্রেনে কলকাতা যাওয়ার টিকিট কাটতে। ঠাকুরদা আর তাঁর বন্ধুরা মিলে আর কোথায় কোথায় খোঁজ নেওয়া যায় তা নিয়ে শলা পরামর্শ করছেন। বাবা তোষকের তলা থেকে একটা পুরোন ডাইরি বের করে কী যেন খুঁজছে। এই সময় ফোন বেজে উঠল । বাবা রীতিমত দৌড়ে গিয়ে রিসিভার কানে নিল। রীতেন কাকুর ফোন। কাকু ঘটনাটা শুনে, জানতে চাইল, ‘কবে থেকে ,কখন থেকে পাওয়া যাচ্ছেনা’।
তাই তো ! ঘটনার আকষ্মিকতায় সেটাই তো জানা হয়নি ! ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বলতে তো পারলেনই না , কাঁদতে কাঁদতে চিঠি কোথায় রেখেছেন তাও মনে করতে পারলেননা। এবার হন্যে হয়ে চিঠি খোঁজা শুরু হলো। অনেক খোঁজাখুঁজির পর খাটের তলা থেকে সেখান বের করে আমি ছোটকাকার হাতে দিলাম। ফ্যানের হাওয়ায় উড়ে গেছিল বোধহয়। ছোটকা কুঁথে কুঁথে পড়া শুরু করলো , ‘শ্রীচরণেষু মা, তোমরা কেমন আছো? এখানে অবস্থা খুব …।‘ থেমে গেলো।পরের শব্দটা পড়তে পারছেনা মনে হয় । বড়পিসির হাতের লেখা ভয়ানক। আগে তা নিয়ে অনেক কান্ড হয়েছে । যাইহোক , খানিকক্ষণ চিঠির দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে, শুরু করলো পরের লাইন , ‘চিনি পাওয়া যাচ্ছেনা’।
চিঠিতে আরও কিছু লেখা ছিল। কিন্তু ঠাকুমার মতই ছোটকাও বাকিটা আর পড়লোনা!
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।