লম্বোদরপুর গ্রামের মুখেই সুকুমারবাবু আমাদের তিনজনের দলটাকে থামালেন। আজ আমার সঙ্গী সহকর্মী রথীন চক্রবর্তী আর মানিক সরকার। সুকুমারবাবুও আমাদের সহকর্মী। লম্বোদরপুরেই থাকেন। উনিশশো তিয়াত্তর সালে বালক বয়সে একবারই ভাণ্ডীরবন গিয়েছি এ কথা শোনার পর প্রায় জোর করে এই রবিবারের সকালে আমাদের টেনে এনেছেন।
ভাণ্ডীরবন সিউড়ি শহরের খুব কাছেই। কাল রাতে সিউড়িতেই ছিলাম। সকাল সকাল রথীনবাবুরা দুই বন্ধু মোটর সাইকেল নিয়ে চলে এসেছেন। এবার দুটি মোটর সাইকেলে চারজনের দল সামনের দিকে এগোলাম। বর্ষাকালের শেষ। আজকের দিনটা ভারী ঝলমলে। শরৎ শরৎ ভাব। গাছের পাতায় ধুলো নেই। মাটিঘেঁষা আগাছাও ঝকঝকে সবুজ।
আমার আন্দাজ বলছে ময়ূরাক্ষী আমাদের ডান দিকে। রথীনবাবুকে জিজ্ঞাসা করতে বললেন, ঠিক তাই। এ রাস্তা নাকি যেতে যেতে পুরনো সাঁওতাল পরগনায় ঢুকে যাবে। আমজোড় পার হয়ে এপথ যাবে দুমকার দিকে। এ অঞ্চলের সঙ্গে সাঁওতাল পরগনা আর দুমকার বহুকালের যোগাযোগ। মশানজোড়ে ড্যাম এবং তিলপাড়াতে ব্যারেজ তৈরি হওয়ার আগে এইটাই ছিল নাকি দুমকা যাওয়ার প্রধান সড়ক। এই পথের ওপর কেন্দুলি ডাঙাতে সাঁওতাল বিদ্রোহীরা থানা গেঁড়ে বসেছিল। ক্লান্ত, প্রায় নিরস্ত্র সেই জনতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল ইংরেজ বাহিনী। সেই থেকে কেন্দুলী ডাঙার আরেক নাম সাঁওতাল কাটার ডাঙা। এই সব গল্প আর আসপাশের সব গ্রামের নাম শুনতে শুনতে চলেছি। এবার রাস্তা থেকে ডানদিকে গ্রামের পথে নেমে গেল মোটর সাইকেল। বুঝলাম, ভাণ্ডীরবন এসে গেছে।
বেশ বড়ো গ্রাম। অনেকটাই রাস্তা পেরিয়ে বেশ চওড়া একটা জায়গা এল। বাঁদিকে ইঙ্গিত করে রথীনবাবু বললেন, গোপাল বাড়ি। থামলেন না। আমাদের চারজনের দল গোপাল মন্দির পেরিয়ে বাঁদিকে ঘুরে গ্রামের শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেল। এ দিকটা একটু জংলা। অনেক গাছ। আগাছা। দিঘি। দিঘির পাড়ে প্রাচীন ইঁটের অবশেষ। ঈষৎ অন্যমন আমি হঠাৎ চোখ তুলতেই দেখি এক সুউচ্চ দেউল। ছোটবেলার স্মৃতি একনিমেশে ফিরে এল।
উনিশশো তিয়াত্তরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। পৌষের শেষ। ধান কাটা হয়ে গেছে। নগরী গ্রামের বাইরে ব্রহ্মদত্যির মেলা বসবে মাঘ মাসের প্রথম দিনে। তার আগের রাতে বুড়ির ঘর পোড়ানো। সেই ঘর বানানোর আয়োজনে আমরা ছেলেমেয়ের দল কেউ হেঁটে কেউ গরুর গাড়ি চেপে শুকনো ডালপালা আনতে যাচ্ছি তসরকোটার জঙ্গলে। আমাদের সঙ্গী আদিবাসী ছাত্রাবাসের কিশোরদের কারও কারও হাতে তীরধনুক। আজ সারাদিন জঙ্গলেই কাটবে। বিকেল বিকেল ফিরবো আমরা।
আমরা চলেছি মাঠের ওপর দিয়ে। মোরাম নয়, মাটির রাস্তাও নয়। যে পথে চলেছি, তাকে স্থানীয় কথায় বলে লিক। লিকপথ নয়, লিক। চাষের জমি ফসলে ঢাকা থাকে। ফসল উঠে যাবার পর শূন্যমাঠে জন্মায় ঘাস কিংবা জন্মায় না। দূর জমি থেকে ফসল আনার জন্য ক্রমাগত গরুর গাড়ি গেলে মাঠের মধ্যে চাকার দাগে পথরেখা পড়ে। লোকে বলে লিক পড়েছে। সেই লিক ধরে গরুর গাড়ি যাতায়াত করতে থাকে। কেননা মাঠে থাকে উঁচু উঁচু আল। সেই আল ক্রমাগত অতিক্রম করা শক্ত। লিক ধরে গেলে সুবিধে হয়। গরুর গাড়ির ভারি চাকার ধারে পথ ক্রমশ সুগম হতে থাকে। সেই লিক ধরে চলেছি আমরা।
ডালপালা কাঠকুটো জড়ো করা শেষ। একদল তীর ধনুক নিয়ে খেলাতে মেতেছে। আর একদল রান্নার জোগাড়ে লেগেছে। সম্বল বলতে চাল ডাল আলু পেঁয়াজ। পৌষলা বা চড়ুইভাতি নয়। সারাদিন বাইরে কাটানো। কৈশোরবেলার স্বাধীনতার উদযাপন। তারই মধ্যে যা হোক কিছু পেটে দেওয়া।
সে দিন এ সবের ফাঁকে আমরা কয়েকজন সেদিন লিক ধরে ধরে পৌঁছেছিলাম ভাণ্ডীরবনে। ভাণ্ডীশ্বর শিব নগরী গ্রামের রায়বাড়ির কূলদেবতা। সুতরাং গ্রামের সবারই পূজ্য। এতো কাছে এসে না দেখে ফেরা যায়। তাই যাওয়া। মনে আছে তখন চৌহদ্দি বেশ ঝকঝকে ছিল। নতুন রঙের পোঁচ ছিল। ঘাড় উঁচু করেও মন্দিরের মাথা দেখা যায়নি, এতো উচু! এর বেশি কোনও স্মৃতি আজ আর নেই।
চটকা ভাঙল। পাশেই সেবায়েত পরিবারের বাস। সুকুমারবাবুর ডাকে ঘরের কাজ ফেলে এক প্রৌঢ়া এসেছেন। কিছু জিজ্ঞাসা করলেন। আমার কানে ঢুকল না। উল্টে জানতে চাইলাম, এখান থেকে নগরী গ্রাম কোন দিকে। একটি দিক দেখালেন। তারপর বললেন। পাকা রাস্তায় অনেকটা দূর। কিন্তু মাঠের পথ ধরে কামারশাল হয়ে গেলে তেমন দূরের পথ নয়।
ভাণ্ডীরবনের কথা বলতে বসে নগরী গ্রামের স্মৃতিতে ফিরে যাচ্ছি কেন? এই নগরীতে আমার মামাবাড়ি। বড়মামা অরুণ চৌধুরী ছিলেন গ্রামের স্কুলটির হেডমাস্টার। আমার বাবাও পঞ্চাশের দশকে এই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। মামা বাম রাজনীতির মানুষ। মাস্টারমশাই কিংবা অরুণবাবু বললে এক ডাকে দশ গাঁয়ের লোক চিনত তাঁকে। রাজনৈতিক কাজের সমান তালে মগ্ন থাকতেন সাহিত্যপাঠে, গ্রাম দর্শনে এবং আঞ্চলিক ইতিহাসের চর্চায়। রক্তের যোগে সে সবের কিছু কিছু আমাতেও বর্তেছে।
প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মন্দির চত্বর ঢুকলাম আমরা। ঢুকেই ডানদিকে এক বিশাল গাছের নিচে বেদির ওপরে অনেক ভগ্নমূর্তি। তার একটি ভৈরব। একটি চণ্ডী। এতো সিঁদুর লেপা হয়েছে যে খুব ঠাহর না করে সনাক্ত করা যায় না। মূল মন্দিরটি রেখদেউল রীতিতে তৈরি। পোড়া ইঁটের নির্মাণ। কয়েক ধাপ সিড়ি দিয়ে উঠে মন্দিরের দরজা।
চেনা গল্প। তবু ধর্মস্থানের নিয়ম মেনে আরও একবার প্রৌঢ়ার মুখে পুরাণকথা শুনলাম। এখন যেখানে মন্দির পুরাকালে সেখানে বেদোক্ত বিভাণ্ডক ঋষির আশ্রম ছিল। কাল পাল্টায়, মানুষের বিশ্বাস পাল্টায়, আচারও বদলে যায়। এ অঞ্চলের মানুষের ধর্মচর্যার সঙ্গে তাল রেখে ঋষির তপোবন আজ শিবমন্দির। যে মন্দিরটি আমরা দেখছি, আঠেরো শতকের মাঝামাঝি সেটি নির্মাণের অর্থ দিয়েছিলেন লালা রামনাথ ভাদুড়ী। উনিশশো ঊনসত্তর সালে বিড়লা জনকল্যাণ ট্রাস্ট মন্দিরটি সংস্কার করে।
মনে পড়লো, মামার কাছে রামনাথ ভাদুড়ীর কথা শুনেছিলাম। ভাদুড়ী মশাইয়ের আদি বাড়ি ছিল নাটোরে। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ। নিজ গুণে মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে প্রভাবশালী রাজকর্মচারী হয়ে ওঠেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় রাজনগরের রাজাকে সাহায্য করেছিলেন। তাতে খুশি হয়ে রাজা তাকে ভাণ্ডীরবন, রায়পুর, আড়াইপুর আর বীরসিংহপুরের রাজস্বের অধিকার দেন। ওই জায়গীরের আয় ভাদুড়ীমশাই ভাণ্ডীরবনের শিবমন্দির, গোপাল মন্দির আর বীরসিংহপুরের কালীমন্দিরের জন্য দেবোত্তর করে দেন। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে জেলা কালেক্টর সাহেব রাজনগরের নাবালক রাজা মোহাম্মদ উল জমা খাঁ র সম্পত্তি দেখাশোনার ভার পেয়ে রামনাথ ভাদুড়ীকে দেওয়ান নিযুক্ত করেন।
মন্দির চত্বর থেকে বেরিয়ে আমরা নদীর দিকে এগোলাম। বর্ষাকালের নদীতেও জল নেই। বহুদূর বালি। পারের দিকে আগাছার ঝোঁপ। ফিরে এসে মন্দির পেরিয়ে আমরা এগোলাম গোপাল মন্দিরের দিকে। পথের বাঁদিকে একটা বড় দীঘি। সামনে কিছু ভগ্নপ্রায় কাঠামো। সুকুমারবাবু বললেন, এখানে নাকি একটা রাজবাড়ি ছিল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইঁটের টুকরো তারই অবশেষ। আজ আর দৃশ্যমান কোনো প্রত্নসাক্ষ্য নেই। কিন্তু গ্রাম শহরের কোনও কোনও জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে হয় এখানে একটা হারিয়ে যাওয়া গল্প আছে। এই দীঘিটাও যেন ঠিক তেমন!
কিন্তু কোন রাজা? আসলে এ অঞ্চলে আঠেরো উনিশ শতকে অনেক ছোট ও মাঝারি ভূস্বামী ছিলেন। কেউ মুর্শিদাবাদের নবাবের থেকে জায়গীর পেয়েছিলেন, কেউ হয়তো রাজনগরের রাজার সামন্ত, কিংবা বর্ধমানের মহারাজার পত্তনিদার। স্থানীয় মানুষের কাছে সবারই একটাই পরিচয় রাজা। সুকুমারবাবু অবশ্য আমার এই ব্যাখ্যা মানতে চাইলেন না। তিনি ছোটবেলা থেকে অন্য এক আখ্যান শুনে এসেছেন। বীরভূম নামের সঙ্গে কোনও এক বীররাজার নাম জড়িয়ে আছে। পাশের গ্রাম বীরসিংহপুরও বীররাজার নামে। এই পুকুর আর ভাঙা কাঠামো নাকি তাঁরই রাজপ্রাসাদের অংশ।
ডানদিকে ঘুরেই গোপাল বাড়ি। শিবমন্দির নদী পুরনো দীঘি ঝোঁপজঙ্গল ঘিরে যে ছমছমে আবহে এতক্ষণ জড়িয়ে ছিলাম, গোপাল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎই তা উধাও হয়ে গেল। পথের পাশে অনেকটা চওড়া পরিসর। পরিচ্ছন্ন। প্রবেশদ্বারের সঙ্গে নহবত খানা। প্রশস্ত চত্বর, উঁচু স্তম্ভের ওপর নাট মন্দির, সেখানে দারু নির্মিত গোপাল মূর্তি।
সেবায়েত জানালেন, এই গোপাল বাড়িও তৈরি করে দিয়েছিলেন রামনাথ ভাদুড়ী। তার আগে গোপালের অধিষ্ঠান ছিল পাশে নোয়াডিহি গ্রামে। কথায় কথায় প্রতিষ্ঠার আখ্যান শোনালেন তিনি। শ পাঁচেক বছর আগে বৃন্দাবন থেকে দ্বাদশ গোপাল নিয়ে এই অঞ্চলে এসেছিলেন ধ্রুব গোস্বামী। এখানে একটি ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী হন তিনি। খটঙ্গার রাজার মেয়ে গোপন পরিণয়ে জড়িয়ে পড়েছিল এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ যুবকের সঙ্গে। রাজার পাইকরা সেই যুবক কে তাড়া করে। তিনি গোস্বামীর আশ্রয় চান। গোস্বামী অভয় দিলেও রাজার পাইকেরা তাঁর চোখের সামনেই সাত বিঘার মাঠে প্রেমিক যুবকটিকে খুন করে। বিচলিত ধ্রুব গোস্বামী দ্বাদশ গোপাল সঙ্গে নিয়ে গ্রাম ছাড়ার আয়োজন করেন। ভরা বর্ষার কাল। ময়ূরাক্ষী পেরোনোর জন্য ভেলা বাঁধেন। ভেলার ওপর একে একে এগারোটি গোপাল মূর্তি তোলা গেলেও সুন্দর গোপালের মূর্তি নাকি এতো ভারী হয়ে যায়, সেটিকে তিনি আর ভেলায় তুলতে পারেননি। এক পথিক ব্রাহ্মণের হাতে মূর্তিটি তুলে দিয়ে তিনি গ্রাম ছাড়েন। ব্রাহ্মণ, সে রাতের মত আশ্রয় নেন নোয়াডিহির ঘোষাল বাড়িতে। পরের দিন ঘোষালবাড়িতে সুন্দর গোপালকে রেখেই তিনি গ্রাম ছাড়েন। রামনাথ ভাদুড়ী ভাণ্ডীরবনে গোপাল বাড়ি তৈরি করার পর সুন্দর গোপালকে নিয়ে ঘোষাল পরিবার এখানে চলে আসেন।
আখ্যানটি শুনতে শুনতেই মনের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছিল। ধ্রুব গোস্বামী নামটি অপরিচিত নয়। কিছুকাল আগেই গিয়েছিলাম মঙ্গলডিহি। সেখানের শ্যামচাঁদের কাহিনীর সঙ্গেও তাঁর নাম জড়িয়ে আছে। আর দ্বাদশ গোপাল শব্দবন্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলা দেশে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রসারের ইতিহাস। চৈতন্যদেবের মৃত্যুর পর নিত্যানন্দের নেতৃত্বে এই ধর্মান্দোলনকে সংযত করার চেষ্টা হয়। বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামী গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মর আদি গ্রন্থ, হিরিভক্তি বিলাস লেখেন। খেতুরিতে ধর্ম সম্মেলন করে সেটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়। তার পর নিত্যানন্দের নির্দেশে বারোজন পুরোধা বাংলার বারোটি জনপদে গিয়ে পীঠ স্থাপন করে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেবার কাজে লেগে পড়েন। ইতিহাস তাঁদেরই দ্বাদশ গোপাল নামে চেনে। তাঁদের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে কিছুদিন পর দ্বাদশ উপগোপাল নামে আরও বারোজন প্রচারক অন্য বা রোটি জনপদে বৈষ্ণব পীঠ স্থাপন করেন। মনে হলো এই গ্রামের আখ্যানের দ্বাদশ গোপাল বারোটি গোপাল মূর্তি হতে পারে না। চৈতন্যের চিন্তাধারা প্রচারের ঐতিহাসিক কাহিনী পল্লবিত হয়ে অন্য এক মনোগ্রাহী আখ্যানের জন্ম দিয়েছে।
দ্বাদশ গোপাল বা উপগোপালের তালিকায় অবশ্য ধ্রুব গোস্বামীর নাম পাওয়া যায় না। কিন্তু এই গোপালেদের তো আরও সঙ্গীসাথী ছিলেন, যাঁরা প্রচারের কাজে তাদের সাহায্য করতেন। গোপাল মূর্তি নিয়ে গ্রামে এসে কারও অতিথি হওয়া এবং সেই পরিবারের হাতে গোপাল তুলে দিয়ে নিত্যপূজার বন্দোবস্ত করা হয়তো নতুন ধর্মভাবনা প্রসারের পরীক্ষিত কৌশল। ঠিক এমন গল্প তো বাংলার গ্রামে গ্রামে শোনা যায়। এই প্রচারকরা বেশ খোঁজখবর নিয়েই গ্রামে আসতেন। যেমন, এই আখ্যানের ঘোষাল পরিবারের বিষ্ণু মন্দির ছিল। সুতরাং তাঁদের হাতে গোপাল তুলে দিলে দেবতার অমর্যাদা হবে না। গোপাল ঠাই পাবেন বিষ্ণু মন্দিরে। বাস্তবে হয়ে ছিলোও তাই। শুধু একটি নিয়ম পাল্টে গেছিল। ঘোষাল বাড়ির মেয়েরা বিষ্ণুর ভোগ রান্না করতে পারতেন। সুন্দর গোপালের সঙ্গে যেহেতু রাধা ছিল না, তাঁর ভোগ রান্নাতে মেয়েদের অধিকার থাকল না। এই অদ্ভুত নিয়ম সমাজভাবনার অন্য দিকে আমাদের নিয়ে যেতে পারে। আপাতত সেই পথে আমরা যাচ্ছি না।
সেবায়েত মশাইকে আমার ভাবনার কথা বললাম। তাঁর বিশ্বাস যাতে আহত না হয় সেই সতর্কতা নিয়েই ইতিহাসের সত্য তাঁর সামনে আনলাম। জানালাম, আমি শ্রীরামপুরের মানুষ। বললাম, মাহেশের কমলাকর পিপলাই, চাতরার কাশীশ্বর পণ্ডিতের মতো প্রসিদ্ধ দ্বাদশ গোপাল ও উপগোপালের প্রসঙ্গ।
সেবায়েত মশাই মাহেশ ও জগন্নাথের নাম উচ্চারিত হতেই যুক্তকর কপালে ছোঁয়ালেন। কিন্তু তাঁর শরীরী ভাষাতে আমার কথা না মানার স্পষ্ট প্রকাশ। সুভদ্র মানুষ। তর্ক করলেন না। শতবর্ষ প্রাচীন কাহিনীর ওপর আস্থা তো টলবে না। আমি নিজেও মনে হয় সেটা চাই না। পাথুরে ইতিহাস এসে আখ্যানকে সরিয়ে দিলে আমাদের পরে যাঁরা আসবেন, পথের পাশে এইসব গল্প তাঁরা আর কুড়িয়ে পাবেন না। আমি চাই পথের গল্প, গ্রাম জনপদের গল্প নিজের প্রাণশক্তিতে বেঁচে থাকুক। ইতিহাসবিদেরা নতুন কালে, নতুন সময়ে ইতিহাসের কষ্টিপাথরে সেই আখ্যান ঘষে মেজে নতুন সত্যের মুখে এসে দাঁড়ান।
সেবায়েত মশাইকে করজোড়ে ধন্যবাদ জানিয়ে মন্দির চত্বরের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সকাল এখনও যায়নি। আসন্ন শরতের রোদ ঝলমল করছে। আমার ছোটবেলার অস্পষ্ট স্মৃতির ওপর নতুন ছবির প্রলেপ। আমরা আজ এখান থেকে নগরী গ্রামের দিকে যাবো। এখন মাঠভরা জল। ছোটবেলার মতো লিক ধরে মাঠ পেরিয়ে নয়। আমাদের সঙ্গে দ্বিচক্রযান আছে। আমরা যাবো পাকা সড়ক ধরে পাথরা, বাতাসপুর হয়ে। নগরী গ্রামের উপান্তে রোদ ঝলমলে মাঠের মধ্যে ব্রহ্মদত্যির থান হাজার বছরের নিঝুম নিস্তব্ধতা নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
[চিত্রগ্রাহক সন্দীপন সেনগুপ্ত]
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।