15 Apr

এসো হে বৈশাখ…

লিখেছেন:অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়


আজকাল ইংরেজি নববর্ষ পালনের ঘটা তো ঘনঘটায় পরিণত হয়েছে। অথচ চৈত্র শেষের দিনটা কবে যাচ্ছে আর বৈশাখের প্রথম দিনটা কবে আসছে সেসব নিরুচ্চারই রয়ে যায়।বাংলা বর্ষবরণ বা বাংলা ভাষা নিয়ে পাগলামির জায়গা গুলো আজকাল নেহাৎই সংকুচিত হয়ে আসছে।সন্ধিক্ষণে দুম দাম বাজি ফাটিয়ে, উদ্দাম ডি জে-র ছন্দে মাতোয়ারা হয়ে বা শ্যাম্পেনের ফোয়ারা স্নাত হয়ে তো বাংলা নতুন বছরের সূচনা হয় না।যেমনটা হয় ইংরেজি বর্ষবরণে। আশি, নব্বই-এর দশকেও দূরদর্শনের সরকারি চ্যানেলে নতুন বছরের ভোর থেকে একটা বেশ মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান হত। দীর্ঘ সেই অনুষ্ঠানে শিক্ষা-সাহিত্য জগতের বহু বিশিষ্টজনেদের আলাপচারিতার সঙ্গেই নাচ, গান, কবিতা ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ের নিবেদন হত। স্বনামধন্য, প্রয়াত রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কন্ঠে নিধু বাবুর টপ্পা, গাজনের গান এবং নানাবিধ গানতো এক রকম বাঁধা ছিল।‘বেলা যুঁই ছড়িয়ে দিলাম বৈশাখেরই সকাল বেলা…’ রামকুমার বাবুর যাদু কণ্ঠে এই গান ছিল বৈশাখের সূচনার এক, যাকে বলা যায়, ‘সিগনেচার গান’। ঠিকই তো; বেল ফুল, যুঁই ফুলের গন্ধে ম’ ম’ করা সকাল না এলে কি বৈশাখের শুভারম্ভ হয়? আর আছে দাবদাহ। চৈত্র শেষের থেকে জ্যৈষ্ঠের মাঝে পড়ে বৈশাখের তো একদম স্যান্ডুইচ অবস্থা! বাঁচোয়া এই, এ সময়ে মাঝে মধ্যে কাল বৈশাখীর তাণ্ডবে ধরণী  আবার নির্মল, শান্ত হয়। তবে বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানার খাওয়া দাওয়া, ভুরিভোজই মাস পয়লা বৈশাখের মূল আকর্ষণ।

এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে গেল। আশির দশকের শেষার্ধে এই অধম তখন ‘টেক্সম্যাকো’ কোম্পানির আগরপাড়া রোলিং স্টক বিভাগে সদ্য যোগদান করেছি। সেখানে তো কারখানায় ঢোকা আর  বের হওয়া একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে। সকাল আটটায় ঘড়ি গেটে টাইম মেশিনে পাঞ্চ করে ঢুকতে হয় আর বিকেল পাঁচটায় আবার ওই যন্ত্রে পাঞ্চ করে তবেই রেহাই। মেশিনের হাতল ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে এক ফালি কাগজ ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকত। ফালি কাগজের ওপরে সেই নির্দিষ্ট সময়টা ছাপার অক্ষরে লেখা। সময় খচিত ওই টুকরো কাগজটায় এমপ্লয়ী আই ডি লিখে,সই করে একটা বাক্সে ফেলে দিলেই হাজিরা নথিবদ্ধ হত।বলা বাহুল্য, যন্ত্রও ভুল করে মাঝে মধ্যে। এহেন ঘড়ি যন্ত্রে কচিৎ কদাচিৎ সময়ের হেরফের হত।ব্যাপারটা এই রকম। ধরা যাক কোনো একদিন সকাল আটটায় যে ফালি কাগজটা যন্ত্র থেকে বারিয়ে আসছে তাতে সময় দেখাচ্ছে সাতটা পঞ্চাশ। কোনো দিন কারও হাজিরায় আধ ঘণ্টা দেরী হয়েছে। অথচ কপাল গুণে যন্ত্র থেকে যে কাগজটা সে পেল তাতে দেখাচ্ছে আটটা। এই রকম আরকি। এহেন যন্ত্র ছিল চার পাঁচটি। কিছু বজ্জাত ছেলে ছোকরারা তাই কাগজটা পুরো বার করার আগে প্রতিটা যন্ত্রে ছানবিন করে দেখে নিত যদি সময়ের কিছু মাইলেজ পাওয়া যায়। তাতে রেকর্ডটা ভালো থাকে। ক্রমাগত দেরী হতে থাকলে কিছু প্রাপ্য ছুটি কাটা যাবে, সেই হেতু।

আসলে এত গৌরচন্দ্রিকা করতে হল এক বৈশাখের প্রথম দিনের একটা ঘটনা বলার কারণে। কোম্পানিতে ছুটিছাটা ভীষণ কম। তায় আবার সেই বছরই সদ্য কিছুদিন হল নতুন কাজে যোগ দিয়েছি। প্রথম বছর আইনত পাওনা ছুটিও কিছু নেই। এসবের মাঝেই বৈশাখের প্রথম দিনটা এসে পড়ল। আলাদা উৎসব না হলেও বাড়িতে এইদিন ভালো মন্দ খাওয়া দাওয়ার আয়োজন বাঁধা ছিল। মায়ের হাতের পোলাও, কালিয়া, মুড়ি ঘন্ট নানাবিধ নিরামিষ পদ, আমের চাটনি, পায়েসের সঙ্গেই দমদম রোডস্থ স্থানীয় চণ্ডী মিষ্টান্ন ভান্ডারের অসাধারণ পয়োধি, রসগোল্লা এবং মিল্কোস সন্দেশ। আর পান। ঠান্ডা সরবৎও সম্ভবতঃ থাকত। সেসব বাদ দিয়ে আজ তাহলে কুপন কেটে কোম্পানির ক্যান্টিনে ভ্যাদ ভ্যাদে সব খাওয়া দাওয়া? তাও আবার বছর পয়লা? তাও আবার আগরপাড়া থেকে পায়দল বেলঘরিয়া গিয়ে? হ্যাঁ ক্যান্টিনটা ছিল টেক্সম্যাকো বেলঘরিয়ার প্ল্যান্টে। কোম্পানির ভিতর দিয়েই রাস্তা।বেলা একটা থেকে দেড়টা টিফিন আওয়ার। যাওয়া আসার জন্য আগে পরে আরও পনেরো মিনিট জুড়ে দিয়ে পুরো এক ঘণ্টাই মোটামুটি নিতাম।

ঠিক করলাম, সেদিন ওই এক ঘণ্টার সঙ্গে আরো আধ ঘন্টা জুড়ে দিয়ে কেটে আসতে হবে বাড়িতে। দমদম থেকে আগরপাড়া ট্রেন যাত্রা, দমদম স্টেশন থেকে বাড়ি আসা যাওয়া ইত্যাদি ধরে ওই আরও আধ ঘন্টা আরকি। সে সময় দমদম স্টেশন থেকে মিনি বাস, ৩০বি, ১১এ বাস চলত। অটো ছিল না। টানা রিক্সা ছিল। সম্ভবতঃ সাইকেল রিক্সা কিছু কিছু চলতে শুরু করেছিল – সঠিক মনে নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল ঘড়ি যন্ত্রের মাধ্যমে এত কান্ড করে প্রবেশ ও প্রস্থান এড়িয়ে পালাব কেমন করে? দুষ্টু লোকের মস্তিষ্কে অনেক ফন্দি ফিকির থাকে।একই সঙ্গে একাধিক প্রবচন মনে ভীড় করে এল। “যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই………”, “বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো”, “আইন যেমন আছে, আইনের ফাঁকও আছে” ইত্যাদি ইত্যাদি। সঠিক সময়ে, সঠিক স্থানে এই সব শুভ প্রবচনের প্রয়োগ এতাবধি করে উঠতে পারিনি ঠিকই। কিন্তু বাংলা নতুন বছর উদযাপনের কারণে না হয় একটা মরিয়া প্রচেষ্টা করাই গেল! কয়েক দিন ছানবিন করে দেখলাম ঘড়ি গেট ছাড়াও আগরপাড়া স্টেশনের দিকে আরেকটি গেট আছে যেখানে যন্ত্র ঘড়ি নয়, কার্ড পাঞ্চ করে আসা যাওয়া করতে হয়। মূলতঃ শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত সেটি। সেখানে হাতল দেওয়া,ঘোরানো গেটের তলার ফাঁক দিয়ে সুড়ুৎ করে গলে বেরিয়ে যাওয়া যাবে। আবার ওই ভাবেই ঢুকে পড়া। সেই মত নির্ধারিত দিনে একটু তক্কে তক্কে থেকে, ওই গেটে পাহারাদার ইত্যাদির অনুপস্থিতিটা লক্ষ্য রাখতে রাখতে একটা শুভ মুহূর্ত এসে পড়ল। আমিও সেই অবসরে সুড়ুৎ।তারপর তড়িৎগতিতে স্টেশন হয়ে বাড়ির পথে। যা করতে হবে ওই দেড় ঘন্টার মধ্যেই। আবারও তো ফিরে এসে সেঁধিয়ে যেতে হবে অন্দরে। কারণ, বৈশাখের সেই সকাল বেলায় ভদ্রলোকের মতই পদ্ধতিগত ভাবে হাজিরা দিয়েছি। সুতরাং ভদ্রলোকের মতই বেরিয়ে যাওয়াটাও নথিবদ্ধ করতে হবে। মাঝের এই আসা যাওয়াটা চোরাগোপ্তা, বেআইনি এবং অবাঞ্ছিত। কিন্তু পয়লা বৈশাখের ভোজন বিলাসের কারণে আমি নাচার। আলু চচ্চড়ি, লুচি, মোহন ভোগ, চমচম ইত্যাদিতে সাজানো সকালের  জল খাবার পর্বটি তো চৌপাট  হয়েই গেছে আজ। অতএব মেন কোর্স দুপুরের ভোজন ছাড়া যাবে না একদম।

কিন্তু থিয়োরি আর প্র্যাক্টিকালের ফারাক তো থাকবেই।পলায়ন পর্বের দেড় ঘণ্টা,যেটা তাত্ত্বিক ভাবে নির্ণয় করা হয়েছিল, প্রকৃত প্রস্তাবে দাঁড়িয়ে গেল প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টায়। অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশী দেরি।কি আর করা; ভিতরে ঢুকতেই অনেকের কৌতূহলী দৃষ্টি তীব্র জরিপ করল আমাকে। কেউ কেউ তো সরাসরি জিজ্ঞেস করেও বসল,‘বাড়ি থেকে ঘুরে এলে নাকি?” এহেন প্রশ্নের উত্তর হয় না, কেবলমাত্র মোনালিসার চিলতে হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে দেওয়া ছাড়া।

শেষ বিকেলে দূরবর্তী কোনো পাড়ার জলসা থেকেই সম্ভবত ভেসে আসছিল রবী ঠাকুরের সেই গানের সুর, “ এসো হে বৈশাখ এসো এসো…………”।

Tags: , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ