02 Jul

ধূমপানে বাঙালি ও বাংলা সিনেমা

লিখেছেন:ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়


শিরোনামেই যেখানে ধূমপানের সঙ্গে বাঙালি ও বাংলা ছবি যুক্ত হয়েছে তখন বাঙালির সঙ্গে অন্য প্রদেশের মানুষ এবং বাংলা ছবির সঙ্গে অন্য ছবির তুলনা আসবেই। এ কথা স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে আমাদের হাতে এমন নির্দিষ্ট তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই যা থেকে বাঙালি ও অন্য প্রদেশবাসীর ধূমপানের অভ্যাস অথবা বাংলা ও হিন্দী ছবিতে ধূমপানের প্রতিতুলনা করা যেতে পারে। তবে পাঠক বোধহয় এটা মেনে নেবেন বাঙালি যেমন বিহারের মানুষের মত খৈনী বিলাসী নয়, অসম, ওড়িশার মানুষের মত তাম্বুল বিলাসী নয় তেমনি ঐসব রাজ্যের  মানুষ বাঙালির মত ধূম্রবিলাসী নয়। ইন্টারনেটে প্রাপ্ত রাজ্যওয়ারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী মহারাষ্ট্রে ধূমপায়ীর  সংখ্যা সর্বনিম্ন, আর পশ্চিমবঙ্গ উপরের দিক থেকে তৃতীয়। এই তথ্যের বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও  এটা মেনে নেওয়া যায় যে  বাঙালি জাতির সঙ্গে ধূমপানের সম্পর্ক বোধহয় একটু বেশীই। বাঙালি ধূমপানে একটু বেশী আসক্ত। পরিসংখ্যানের কথা থাক, আমরা দুজন বিখ্যাত মানুষদের ধূমপানের বিচিত্র গল্প শুনে বাঙালির ধূমপানের পরম্পরায় একটু উঁকিঝুঁকি দিতে পারি।

কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ তখন আর্নেস্ত বিনফিল্ড হ্যভেল(১৮৬১-১৯৩৪)। তাঁরই অনুরোধ আসে অবন ঠাকুরের কাছে, তিনি যেন গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে চাকরি নেন। অবন ঠাকুর বললেন,  বেশ তো আছি পাখি-টাখি নিয়ে। মাষ্টারি চাকরি এসব তাঁর পোষাবে না। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাজি হতেই হল, চাকরিতে যোগ দিলেন। কিন্তু একা একা অফিস যাবেন কী করে? সেই সমস্যার সমাধান করলেন বেয়াই মশাই নলিন চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, তিনি ছিলেন কর্পোরেশন অফিসের ক্যাশিয়ার, কাছেই আর্ট স্কুল। তিনি যত দিন জীবিত ছিলেন, অবনীন্দ্রনাথকে অফিসে পৌঁছে দিতেন আর নিয়ে আসতেন।… এর পর এল আরেক সমস্যা, অবন ঠাকুর অফিসে তামাক খাবেন কী করে? তামাক না খেলে কাজে মন দেবেন কী করে? কথাটা অবনীন্দ্রনাথের মা সৌদামিনী দেবীর কানে গেল। ছেলের এত বড় সমস্যার সমাধান করলেন তিনি অচিরে। বেহারা বিশ্বম্ভরকে তিনি আজ্ঞা দিলেন, ওরে তামাকের সরঞ্জাম সব কিনে অফিসের বেহারাকে জিম্মে করে দিয়ে আসিস। (রোববার, প্রতিদিন, ১লা এপ্রিল, ২০১২,রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়)।

এর পরে আসি বাঙালির আরএক আইকন এর ধূমপানে আসক্তির গল্প। শঙ্কর ‘অজানা অচেনা বিবেকানন্দ’ এ লিখছেন, ‘…… এই সময়ে পাড়ার রিপোর্ট ও ভাল নয়। এক প্রতিবেশী তার বন্ধু শরৎচন্দ্রকে (পরে সারদানন্দ) বলেন, এই বাটিতে একটা ছেলে আছে, তাহার মত ত্রিপন্ড ছেলে কখনও দেখিনি। বিএ পাশ করেছে বলে যেন ধরা কে সরা দেখে। বাপখুড়োর সামনেই তবলায় চাঁটি দিয়ে গান ধরলে, পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদের সামনে দিয়েই চুরুট খেতে খেতে চললে।(পৃ-৩৭)

প্রথম যৌবনের ধূমপানের অভ্যাস স্বামী বিবেকানন্দ পরবর্তী জীবনেও ছাড়তে পারেননি।মার্কিন দেশের সংগ্রাম ও রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠা বিবেকানন্দের শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক অবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ মার্কিন গবেষকদের দয়ায় আমাদের হাতের গোড়ায় রয়েছে। সেখানে তার অসুখ বিসুখ, খাওয়া দাওয়া  সম্পর্কেও যথেষ্ট খবরাখবর আছে।আমরা দেখেছি তার স্মোকিং বেড়েছে। (পৃ-২৫৬)

এর পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি হুঁকো, সিগারের যুগ পেরিয়ে সিগারেটে পৌঁছেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, মধ্যবিত্তশ্রেণি সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি সব কিছুর চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে। নতুন ইন্টেলেকচুয়াল শ্রেণির হাতে উঠেছে ধূমায়িত সিগারেট। সিগারেট হয়ে উঠলো বড় হওয়ার সমার্থক, স্কুলের চৌকাঠ পেরনোর সঙ্গে সঙ্গে হাতে উঠত সিগারেট । বড়দের কাছে সিগারেট হল স্টাইল, ব্যাক্তিত্ব, আধুনিকতা, রোমান্টিকতা। অভিজাত মানুষেরা ক্যাপ্সটেনের টিন হাতে আড্ডায় বসতেন আর ছোকরাদের হাতে থাকতো পানামার কুড়িটার প্যাকেট। মুখটা সামান্য ছিঁড়ে তার পাশে এক আঙ্গুলে টোকা দিলেই টক টক করে বেরিয়ে আসতো এক এক পিস। সেখান থেকে সোজা ঠোঁটে। অধূমপায়ীদের উৎসাহ দেওয়া হত – আরে পুরুষ মানুষ স্মোক লাইক চিমনি। চারমিনারের ধোঁয়ায় যখন কফি হাউস গ্যাস চেম্বারে পরিণত হত তখনই ওখানে কত  কবির মনে বিদ্যুৎপ্রভার মত ঝিলিক দিয়ে উঠত কত বিখ্যাত কবিতার লাইন। কত নাটকের,গল্পের প্লট ভেসে উঠেছিল নাট্যকার, গল্পকারদের মাথায়, কত গীতিকার কত সুরকার কত বিখ্যাত গানের অন্তরা টুকু প্রথমবার গুনগুন করেছিলেন চারমিনার হাতে নিয়ে তার হদিস কোনও দিন পাওয়া যাবেনা।

‘খোশখবর’ পড়তে ক্লিক করুন এখানে www.khoshkhobor.blogspot.com

এই পটভূমিকাতেই বড় হয়ে উঠেছেন সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল, তপন। তাই তাদের সৃষ্টিতে সিগারেট এসেছে অনায়াসে। সত্যজিতের ধূমপানে আসক্তির কথা আমাদের সকলেরই জানা।  তার ধূমপানরত অসংখ্য  ছবির সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করে।তার সৃষ্ট গোয়েন্দা ফেলুদাও ধূমপায়ী। শার্লক হোমস, ব্যোমকেশও ধূমপায়ী। আমাদের কেমন যেন একটা ধারনা আছে ধূমপানের সঙ্গে বুদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে। কিছুতেই  যখন রহস্যের জাল ভেদ করা যাচ্ছে না তখন গোয়েন্দার হাত আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় সিগারেটের প্যাকেটের দিকে। দু’চার টান দেবার পরই গোয়েন্দার কপালের ভাঁজ গুলো সোজা হতে থাকে। পাকা দাবারু যখন কিস্তিতে কিস্তিতে জেরবার হয়ে যায় তখন ভাবেন  বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়া দিয়ে নিই।কিন্তু সত্যজিতের সৃষ্ট চরিত্র তো একটু অন্যরকম হতে পারত।হলনা যদিও অন্য গোয়েন্দাদের ফেলুদার একটু স্বাতন্ত্র আছে।তার আছে একটা ইন্টেলেকচুয়াল ইমেজ।খুনের চেয়ে তার বেশী আগ্রহ প্রাচীন মুর্তি  উদ্ধারে।ফেলুদা সঙ্গীত বোঝে, পুরাতত্ব, মনস্তত্ব বোঝে।যে কোনও ঘটনার পেছনে বৈজ্ঞানিক তত্বটা খুঁজতে চেষ্টা করে। একজন অতি বুদ্ধিমান মানুষ যার সেন্স অফ রিজনিং অত্যন্ত প্রখর, শত ব্যস্ততাতেও এক ফাঁকে ব্যায়ামটা করে নিতে ভোলে না সে এই অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস করে কেন? যদিও সমস্ত পাঠকদের কাছেই সমান জনপ্রিয়, ফেলুদা সিরিজের টার্গেট পাঠক কিন্তু কিশোররা। সেই ফেলুদা ধূমপান করে কেন? ফেলুদা শুধু ধূমপান করে না চারমিনার খাওয়াকে গ্লোরিফাই করে, কেন? কিশোর, যুবকদের হিরোর হাতে কেন সিগারেট যা দেখে তারা ধূমপানে উৎসাহিত হবে?

কারণটা এতদিনে পরিস্কার। ধূমপান যে এত ক্ষতিকারক তা সেদিন জানা ছিল না। নিরন্তর গবেষণা ও প্রচারের ফলে আজ আমরা জানি যে ধূমপানের চেয়ে পরিমিত মদ্যপান শ্রেয়। ট্রেনের কামরায় গুছিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরানো- এ অতি সাধারণ  দৃশ্য ছিল এই সেদিনও। আজ এ দৃশ্য বিরল। কিন্তু আমরা নায়ক সিনেমায় দেখি দরজা জানলা বন্ধ এসি কামরায় মহিলা, শিশু, বৃদ্ধদের সহযাত্রী নায়ক অরিন্দম ধূমপান করে চলেন। অন্যের অসুবিধার কথা তার মনে হয়না। সহযাত্রীরাও কোনও অনুযোগ করেননা।নায়কের মুখ থেকে ধোঁয়ার গোলক ভাসতে ভাসতে বাঙ্কে শোয়া মুগ্ধ সহযাত্রিনীর মুখে কাছে পৌঁছয়। এমনকি সুন্দরী সহযাত্রিনী সাংবাদিকের সঙ্গে বসেও তার ধূমপান অব্যাহত।সহযাত্রিনী হাত দিয়ে ধোঁয়া  সরিয়ে দিচ্ছেন বটে কিন্তু বিরক্ত হচ্ছেন না বা প্রতিবাদ করছেন না । এর কারণ সেই একই। ধূমপান এত ক্ষতিকর সেদিন এটা জানা ছিল না। সত্যজিৎও  সেদিন এটা জানতেন না। তাই শুধু ফেলুদা নয় সত্যজিতের সব  ছবিতেই চরিত্ররা শুধু ধূমপায়ী নয় তারা ধূম্রবিলাসী, ধূমপান তাদের প্যাশান।

এই প্রসঙ্গে আমাদের মৃণাল সেনের কথাও মনে পড়ে। হাতে সিগারেট নেই মৃণাল সেনের এমন ছবি খুঁজে পাওয়া ভার।  তাঁর ছবির চরিত্র রাও ভীষণ রকম ধূমপায়ী। বিখ্যাত ছবি ভুবন সোম এ সোম সাহেবের ( উৎপল দত্ত ) মুখে সব সময় চুরুট। এমনকি যখন তিনি ব্যায়াম করছেন, মোষের তাড়া খেয়ে দৌড়চ্ছেন তখনও।  শুধু নায়করা নয়, পঞ্চাশের বা ষাটের দশকে চরিত্রাভিনেতারাও প্রচুর ধূম্র উদগীরন করেছেন। ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, কমল মিত্র, বিকাশ রায় কারণে অকারণে সিগারেট, চুরুট, পাইপ হাতে তুলে নিয়েছেন।

কিন্তু সমসাময়িক হিন্দী ছবিতে আমরা দেখি ধূমপান অপেক্ষাকৃত কম। নায়করা পর্দায় কিছু ধূমপান করতেন বটে, কিন্তু সাধারণ ভাবে বিরহ বা হতাশা প্রকাশ করতেই নায়করা ধূমপান করতেন এবং চূড়ান্ত অবস্থায় মদের গেলাসে চুমুক দিতেন। উদাহারণ গুরু দত্তের ছবি গুলি। মোটামুটি ভাবে বলা চলে যে বাংলা ছবিতে যেখানে স্মার্টনেস, স্টাইল, ব্যাক্তিত্ব, আধুনিকতা রোমান্টিকতা, আভিজাত্য বোঝাতে ধূমপান করানো হত হিন্দী ছবিতে পর্দায় ধূমপান করতেন হতাশ অথবা নেগেটিভ চরিত্ররা।

উপরোক্ত সিদ্ধান্তের সমর্থনে একটি ছবির কথা আলোচনা করব যেটি একই পরিচালকের দ্বারা নির্মিত বাংলা ও হিন্দী ছবি। অসিত সেন পরিচালিত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ও ‘খামোশী’। ছবি দুটিতে  হাসপাতালের অধ্যক্ষ-চিকিৎসকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যথাক্রমে পাহাড়ি সান্যাল ও নাজির হোসেন। বাংলা ছবিতে পাহাড়ি সান্যাল নিজের চেম্বারে, ওয়ার্ডে, অন্যান্য ডাক্তার নার্সদের সঙ্গে আলোচনারত অবস্থায় সর্বক্ষ্ণণ  ধূমপান করে চলেছেন। মনে হয় তাঁর হাতের পাইপ কর্ণের কবজকুন্ডলের মতই অচ্ছেদ্য। অন্যদিকে হিন্দী ছবিটিতে নাজির হোসেনের হাতে একটি পাইপ দেখা গেলেও তাতে কখনও অগ্নিসংযোগ করা হয় না। আমরা ইতিমধ্যে দিলীপকুমার, রাজকাপুর, দেবানন্দের যুগ পেরিয়ে শাম্মীকাপুর, ধর্মেন্দ্র, শশিকাপুর, রাজেশ খান্না,অমিতাভের যুগে। এই সময়ে আমরা দেখি পর্দায়  ধূমপান আরও কম। ব্যাতিক্রম বাদ দিলে নেগেটিভ চরিত্ররাই সাধারণ ভাবে ধূমপায়ী।

নব্বই এর দশকে এসে আমরা দেখি ধূমপানের দাঁত নখ বেড়িয়ে পড়েছে। ধূমপান আর  স্মার্টনেস, স্টাইল, ব্যাক্তিত্ব, আধুনিকতা রোমান্টিকতা, আভিজাত্যের প্রতীক নয় বরং তা ক্যান্সার, ফুস্ফুসের অসুখ, হৃদরোগ, অকাল বার্ধক্য ও আরও অনেক অসুখের জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী। নতুন শতাব্দীতে পৌঁছে আমরা দেখি চিকিৎসক, বিজ্ঞানী,  পরিবেশবিদরা ধূমপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছেন। ট্রেনে, অফিসে-আদালতে, ধূমপান নিষিদ্ধ হয়েছে, এমন কি নিজের বাড়িতে ধূমপান করলেও স্ত্রী নালিশ করলে ধূমপায়ীর শাস্তি হবে।অফিস আদালতে আগে যেখানে সত্তর ভাগ মানুষ ধূমপান করত এখন হয়তো তা  ত্রিশ ভাগ।

ধূমপান ইদানিং একটি চর্চিত বিষয়। কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ধূমপান ও অন্যান্য তামাক জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার খর্ব করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন সরকার চায় সিগারেটের প্যাকেটের সত্তর ভাগ ধূমপান বিরোধী সাবধান বাণী  প্রচার করতে হবে। শুধু ‘ধূমপান মৃত্যুর কারণ’ বা ‘ধূমপান ক্যান্সারের কারণ’ই যথেষ্ট নয়।ওরাল ক্যান্সার বা   ধূমপান ঘটিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত বিভিন্ন রোগীর ভীতিজনক ছবি সিগারেটের প্যাকেটে থাকতে হবে। কিন্তু আমদের এই গনতান্ত্রিক দেশে মন্ত্রীর ইচ্ছেই শেষ কথা নয়। তাঁকে সাংসদদের নিয়ে কমিটি গড়তে হয়েছে।সেখানে প্রশ্ন উঠেছে ধূমপান থেকেই যে ক্যান্সার হয় তা কি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমানিত? কারণ বহু মানুষ ধূমপান করলেও ক্যান্সারে আক্রান্ত হননি।ডাক্তাররা নাকি ধূমপান কে একশ ভাগ কারণ বলে সার্টিফিকেট দিতে পারেননি। তা ছাড়া জানা গেল সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান নাকি বিরট বিড়ি ব্যবসায়ী। তিনি তো আর নিজের ব্যবসায়ে লাল বাতি জ্বালাবার জন্যে সাংসদ হননি! সুতরাং যতদূর খবর পাওয়া গিয়েছিল বিষয়টি নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ইত্যাদিতেই পথ হারিয়ে ছিল।

বিগত কেন্দ্রীয় সরকারের আমলেও তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ধূমপানের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ছিলেন। তিনি কিছু বিখ্যাত ধূমপায়ী মানুষদের কাছে আবেদন করে ছিলেন তারা যেন ঘোষণা করে ধূমপান ত্যাগ করেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন আমাদের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী তিনি সরাসরি ‘না’ বলে দিয়েছিলেন। ঘোষণা করে দিয়ে ছিলেন তিনি ধূমপান ত্যাগ করতে পারবেন না। এর ফল কী হয়েছে তা আমাদের সকলেরই জানা।পাশাপাশি অমিতাভ বচ্চনকে চুরুট হাতে একটি ছবির বিজ্ঞাপনে দেখা যাওয়ায় কয়েক বছর আগে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।  সুভদ্র অমিতাভ তৎক্ষনাৎ ক্ষমা চেয়ে নেন এবং জানান যে তিনি ধূমপান করেন না,ভবিষ্যতে তিনি পর্দাতেও ধূমপান করবেন না। কয়েক বছর আগে বলিউডের বাদশা শাহরুক খান টি-টোয়েন্টি খেলা দেখতে দেখতে এসি এনক্লোজারে বসে ধূমপান করেছিলেন। এ ছাড়াও হিন্দুস্থান টাইমস এর একটি আলোচনা সভায় ধূমপানরত শাহরূকের ছবি টেলিভিশনে দেখা গিয়েছিল।  ন্যাশানাল অরগানাইজেশন ফর টোব্যাকো এরাডিকশন নামে একটি সেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁকে আইনী নোটিশ পাঠিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে। কারণ শাহরুক একজন বিখ্যাত ব্যাক্তি এবং তাঁর কাজে কিশোর যুবকরা প্রভাবিত হতে পারে।

ভারতে পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক সিনেমা তৈরি হয়, বছরে এক হাজারেরও বেশী। হু এবং কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতরের সমীক্ষায় প্রকাশ ৭৬% ছবিতে ধূমপানের ব্যবহার দেখা যায় এবং ৫২.২% শিশু কিশোর তাদের প্রথম ধূমপানটি  করে কোনও সিনেমা দৃশ্যের  দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। যেহেতু কিশোর, যুবকরা রুপালি পর্দার নায়কদের দ্বারা সব চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় তাই কেদ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক পর্দায় ধূমপান নিয়ন্ত্রণ করায় সচেষ্ট। তবে একথা সত্যি যে চরিত্রের প্রয়োজনেও কখনও ধূমপান দেখানো যাবেনা এটা বাস্তব সম্মত নয়। তাই একটি মাঝামাঝি রাস্তা বার করা হয়েছে। যখনই পর্দায় ধূমপান বা তামাকের ব্যবহার দেখান হবে তখন বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণও পর্দায় ভেসে উঠবে। আমরা দেখি পর্দায় কোন চরিত্র ধূমপান করলেই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণও পর্দায় ভেসে ওঠে। কিন্তু এসবের মূল উদ্দেশ্য যে পর্দায় ধূমপানদৃশ্য যথা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা তা হিন্দী ছবি দেখলে কিছুটা বোঝা গেলেও বাংলা ছবি দেখে বোঝা যায় না। এই পটভূমিকায় আমরা বাংলা ছবির অবস্থাটা আলোচনা করব।

‘খোশখবর’ পড়তে ক্লিক করুন এখানে www.khoshkhobor.blogspot.com

বর্তমানে এক ঝাঁক তরুণ পরিচালকের হাত ধরে একই সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত ও বানিজ্যিক ছবি তৈরী হচ্ছে। শিক্ষিত বাঙালি দর্শক আবার হল মুখো হয়েছে। কিন্তু এই ঘুরে দাঁড়ানো ছবি গুলো দেখে মনে হয় কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সিনেমার পর্দায় ধূমপান নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা বোধহয় বাংলা ছবির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। হিন্দী ছবিতে যখন ধূমপান কমছে বাংলা ছবিতে শুধু বাড়ছে না মহিলাদের ধূমপান ব্যাপক ভাবে চালু হয়েছে। সমাজে আমরা এতদিন মহিলা মাছ বিক্রেতা, অবাঙালি মহিলা শ্রমিক,উচ্চবিত্ত মহিলা বা বারবনিতা দের ধূমপান করতে দেখতাম। সিনেমাতেও তাঁর প্রতিফলন দেখা দিত।কিন্তু এখন আমরা দেখি বাংলা ছবিতে মহিলারা চরিত্রের কোনও প্রয়োজন ছাড়াই ধূমপান করছে। শুভ মহরত ছবিতে নন্দিতা দাশ কেন প্রতিটি দৃশ্যে ধূমপান করে তা আমাদের বোধগম্য হয় না। চরিত্রটি শিক্ষিতা, আধুনিকা এবং স্বাধীনচেতা বোঝানোর জন্যে আর কোনও ট্রিটমেন্ট কি পরিচালকের জানা ছিল না? আমরা কত ছবি দেখেছি যেখানে নায়িকার একাকীত্ব, হতাশা নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সিগারেট না নিয়েই, অথছ ‘ইতি মৃণালিনী’ ছবিতে মৃণালিনী হাতে জ্বলন্ত সিগারেট তুলে নেয় যা অবশ্য কদাচিৎ ঠোঁটে ওঠে। মৃণালিনী যে সিগারেট খেতে অভ্যস্ত তা অভিনয়ে ফুটে ওঠেনা।

কোনও কিছু খেতে খেতে অভিনয় করা বিশেষ অভ্যাসের দাবী রাখে। ধূমপানের ক্ষেত্রেও তাই।হাতে বা ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে অভিনয়ের সৌন্দর্য্য আমরা উত্তমকুমার বা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অনেক ছবিতে দেখেছি। পাঠক ‘নায়ক’ ছবিটি একবার স্মরণ করতে পারেন। আমরা অনেক অভিনেত্রীকে পর্দায় ধূমপান করতে দেখি যারা অনভ্যস্ত হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, কখনও বা ঠোঁটে ঠেকান, মুখ থেকেই ধোঁয়া ছেড়ে দেন। পরিচালক বোধহয় আধুনিকার ব্যাঞ্জনা আনতে ধূমপান ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না।  আমরা ইদানিং কালের মার কাটারি ছবি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ এর কথা স্মরণ করব।ছবির শুরুতেই সহকারী পরিচালক (মহিলা) আড়ালে গিয়ে ধূমপান করে আসে, ফিরে এলে পরিচালক বলে সিগারেট খেতে হলে সামনে খেলেই হয়, আড়ালে যাবার দরকার কী। দৃশ্যটির প্রয়োজন আমরা বুঝতে পারিনা। উদাহারণ বেশী বাড়িয়ে লাভ নেই। পাঠক অসংখ্য বাংলা সিনেমা,বাংলা সিরিয়ালে এই বক্তব্য মিলিয়ে নেবেন।

এবার আমরা গোড়ার কথায় ফিরে আসি। হিন্দী ছবিতে যেখানে ধূমপান যথা সম্ভব কম দৃশ্যায়িত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত বাংলা ছবিতে দিন দিন তা বাড়তির পথে।এহ বাহ্য, মহিলা চরিত্ররা পর্দায় অকারণ ধূমপান করে চলেছে।কেন্দ্রীয় সরকারের আইন কি বাংলায় প্রযোজ্য নয়?

আইনের কথা থাক। ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা ‘থেটার লোকশিক্ষে দেয়’ কথাটা আপ্তবাক্যের পর্যায়ে পৌঁচেছে। বিপরীত মেরুর মানুষ উৎপল দত্ত ‘বাবা তারকনাথ’ সিনেমাকে অপসংস্কৃতি বলেছিলেন কারণ সিনেমাটি সাপে কাটা রোগীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবার শিক্ষা দেয় না। লোক শিক্ষার দায় যদি বাংলা সিনেমা নাও নিতে চায় কুশিক্ষা দেয় কেন? সিনেমা তো সমাজকে প্রভাবিত করে। স্বভাবতই আমরা দেখতে পাই থিয়েটার হলের বাইরে গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেত্রীদের হাতে, ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রীদের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। অধ্যাপকরা পাশ দিয়ে গেলেও হুঁশ নেই। মেয়েদের ধূমপানের নৈতিক দিক নিয়ে আলোচনা করা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য ন্য।শুধু মনে প্রশ্ন আসে চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদরা যখন ধূমপানের বিরুদ্ধে সক্রিয় এবং তাদের লড়াইয়ে যখন অবাঙালি রাজনৈতিক নেতারা সামিল, বলিউড সামিল তখন বাংলার চিন্তাবিদরা কোথায়, টলিউড কোথায়?

বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব  

Tags: ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ