02 Jul

ব্রহ্মদত্যির থান,নগরী,ঘাট দুর্লভপুর

লিখেছেন:সৌমিত্রশঙ্কর সেনগুপ্ত


আমরা যখন খটঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে পৌঁছলাম, তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। খুব সকালে রওয়ানা হয়ে চার সহকর্মী এসেছিলাম ভাণ্ডিরবনে। পথপ্রদর্শক সুকুমারবাবু এখানে আমাদের বিদায় জানিয়ে লম্বোদরপুরের পথ ধরলেন। আমরা তিনজন এগোলাম নগরী গ্রামের দিকে।

মনে পড়ল, নগরী গ্রামের সবথেকে প্রভাবশালী রায় পরিবার এই গ্রামে আসার আগে ছিলেন খটঙ্গার কাছেই নডিহি গ্রামে। আঠেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নেহালচন্দ্র রায় নডিহি থেকে নগরী গ্রামে বসতি করেন। কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম, ইংরেজ রাজত্বের একেবারে শুরুর দিকে একজন মানুষ এক গ্রাম থেকে অন্য একটি গ্রামের দিকে চলেছেন নতুন ভিটের খোঁজে। কেন, তার কারণ আমরা জানি না। বংশ বড় হয়ে গেলে তরুণ প্রজন্মের কোনো উদ্যোগী যুবকের নেতৃত্বে নতুন গ্রাম পত্তন করার রীতি সাঁওতাল জনসম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তেমন কিছু, নাকি নিছকই নতুন পাওয়া সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য বাসস্থান বদল। যাই হোক, নডিহি থেকে চলতে চলতে নগরী গ্রামের উপান্তে এক নামহীন কান্দরের কাছে নতুন ভিটের বন্দোবস্ত করলেন নেহালচন্দ্র। সেই একই পথ ধরে আমরা যাচ্ছি। মাঝখানে দুই শতাব্দীর ব্যবধান।

রথীনবাবুর কথায় কল্পনাজাল ছিন্ন হলো। বড়গ্রাম পেরিয়ে আমাদের দ্বিচক্রযান ঢালু পথে নামছে কান্দরের দিকে। কান্দর পেরোলেই বাঁহাতে ব্রহ্মদত্যির থান। আমাদের গন্তব্য।

ব্রহ্মদত্যির থানের কাছেই অপেক্ষা করছিলেন মধুসূদন রায়। গ্রামের ভূমিপুত্র, জেলা কালেক্টরেটের উচ্চবর্গীয় সহায়ক। এই গ্রামেই আমার মাতুলালয়। শৈশবে কৈশোরে মধুদার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এসে ব্রহ্মদত্যির থানের সানবাধানো বেদীতে বসে গল্প করতাম। আজ আসার খবর জানতেন। তাই চলে এসেছেন।

মধুদার কাছে নেয়ালের ঢিপ -এর অবস্থান জানতে চাইলাম। বাবার থান থেকে গ্রামের দিকে একটু এগিয়ে মাঠের মধ্যে একটা উঁচু ঢিপি আঙুলের নির্দেশে দেখালেন তিনি। এই গ্রামে এসে নেহালচন্দ্র প্রথম যেখানে বাড়ি করেন দুই শতাব্দীর ব্যবধানে অনেক ঋতু অনেক বর্ষা পেরিয়ে তা এক ঢিপির চেহারা নিয়েছে। লোকমুখে তারই নাম নেয়ালের ঢিপ বা লেলির ঢিপ।

‘খোশখবর’ পড়তে ক্লিক করুন এখানে www.khoshkhobor.blogspot.com

পথ ছেড়ে মাঠের আল ধরে চললাম ব্রহ্মদত্যির থানের দিকে। থানে ঢোকার পথ নেই। আল ধরে বা মাঠের মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। এখন নগরী থেকে বড়গ্রামে যাওয়ার জন্য ক্ষেতের বুক চিরে মোরাম সড়ক হয়েছে। কান্দরের ওপর সাঁকো হয়েছে। আমাদের শৈশবে গ্রামের প্রান্তে রাস্তা শেষ হয়ে যেতো। আমরা কান্দরের ধারে কিংবা বাবার থানে আসতাম মাঠের আল ধরে। জলে পা ভিজিয়ে অথবা পাথর থেকে পাথরে লাফ দিয়ে কান্দর পেরোতাম।

বাইরে প্রথম শীতের রোদ। ব্রহ্মদত্যির থানের ভিতর নিবিড় ছায়া আর ঝুপসি অন্ধকার। অনেকটা জায়গা জুড়ে যেন এক খণ্ড বনভূমি। তার কেন্দ্রে এক অক্ষয় বট। এমন এক গাছ, যার বয়সের পাথর নেই। মূল কাণ্ডটি কবেই অদৃশ্য। অজস্র প্রাচীন ঝুড়ি আজ নিজেরাই বিপুলায়তন, প্রকাণ্ড। সজীব অক্ষয় বটবৃক্ষ নতুন নতুন ঝুড়ি নামিয়ে থানের এলাকা বাড়িয়ে চলেছে। আরো কতো যে গাছ আর আগাছা চারদিকে। মানুষ একটি গাছও কাটে না, উপড়ে ফেলে না। অবাধে জন্মায়, বড় হয় সেগুলি। ধর্মবিশ্বাসের নিরাপত্তায় এই খণ্ড বনভূমি সংরক্ষণ করে রেখেছে বিপুল জীববৈচিত্র্য। এই ধরনের থান নিয়ে তাই যত আগ্রহ লোকসংস্কৃতির গবেষকদের, ততটাই আগ্রহ জীববৈচিত্রের গবেষণাতে যুক্ত মানুষদের। গবেষকদের কাছে এর পোশাকি নাম স্যাক্রেড গ্রোভস।

আমাদের ব্রহ্মদত্যির থানের মাঝে বটগাছের পিছনে  একটা ছোট পুকুর। সঙ্গীদের দেখালাম তার পাশে তমাল গাছটিকে। এটিও ছোটবেলা থেকে আমার চেনা। সঙ্গীরা নন, এই মুহূর্তে আমিই গাইড। আবার যেন শৈশবে পৌঁছে গেছি। অনর্গল কথা বলছি। সিউড়ি থেকে আসা দুই সঙ্গী রথীনবাবু ও মানিকবাবু শুনছেন।

ব্রহ্মদত্যির থান

 

আমরা চিরকাল এটিকে ব্রহ্মদত্যির থান বলি। কিন্তু গ্রামের সকলে বলেন বাবার থান। ঠাকুর বাবা কিংবা অপদেবতা ব্রহ্মদত্যি যাই হোক না কেন, তার পরিচয় নিয়ে নানা রকমের জনশ্রুতি আছে। কোনো কোনো লোকগবেষক হিন্দু আচারঅনুষ্ঠানের থেকে এর সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। প্রবাদ আছে, বামুন মরে ব্রহ্মদৈত‍্য হয়। ভবপারে গিয়ে ব্রহ্মদৈত্য হচ্ছেন যে ব্রাহ্মণ, তিনি নিশ্চয়ই ইহজীবনে খুব ভাল মানুষ ছিলেন না। তিনি হয়তো জন্মসূত্রে পাওয়া প্রতিপত্তির বলে নিরীহ, গরীব মানুষের ওপর অকারণে নানা জোরাজুরি, হম্বিতম্বি করে দাবিয়ে রেখে, নাকাল করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করেছেন।

এই ব্রহ্মদৈত্যদের কাহিনী আবার প্রায়শই কোনো এক অবিবাহিত ব্রহ্মচারী বাবার সঙ্গে যুক্ত। উপনয়নের সময় ব্রাহ্মণসন্তান আড়াই পা ফেলে ঘরে ঢোকে। ছেলে আড়াই পা ফেলতেই মা তাকে কোলে তুলে নেন। ভুলক্রমে তার আগে মাটিতে পা পড়ে গেলে সে ছেলের আর ঘরে ঠাঁই হয় না। তখন তাকে  ব্রহ্মচারী হয়ে ঘর ছাড়তে হয়। গাঁয়ের বাইরে কোনো বেলগাছ কিংবা নিমগাছের নিচে তার ঠাই মেলে। এর থেকে শাস্ত্রমাফিক পরিত্রাণের পথ থাকলেও পুরনো দিনকাল অনেক সময় গ্রামসমাজের কঠোর অনুশাসনে তার আর ঘরে ফেরা হতো না। হয়তো যৌথসম্পত্তির অংশ থেকে বঞ্চিত করার জন্য ধর্মের ব্যবহার করা হতো। এভাবেই গ্রাম-বাংলার বহু গাছের ঝোপে ব্রহ্মচারীর অধিষ্ঠান হয়েছে। ভক্তের দল তাঁর অবস্থানের গাছটি বাঁধিয়ে দিয়েছেন।  বাবার দয়ায় নিঃসন্তান দম্পতির সন্তানলাভ করে থান বাঁধিয়ে দিয়েছেন এমন কাহিনীও শোনা যায়।

অনেক চাছাছোলা ভাষায় ব্রহ্মদত্যির থানের সম্ভাব্য জন্মকাহিনী শুনিয়েছিলেন আমার মামা, নগরী সুধাংশুবদনী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধানশিক্ষক অরুণ চৌধুরী। বীরভূমের ওই অঞ্চলে অবিবাহিত ব্রাহ্মণদের বলা হয় ডেঙ্গুয়া ব্রাহ্মণ। তাঁদের মৃত্যুর পরবর্তী পরিণতি হলো দৈতত্ব প্রাপ্তি। তাঁরা হন ব্রহ্মদৈত্য। এ হেন চিরকুমারদের সামাজিক পরিচিতি গ্রামদেশে সচরাচর খারাপই হতো। তাঁরা অনেক সময় ধর্মের ষাঁড়ের ভূমিকা পালন করতেন। সামন্তসমাজের শক্তিবিন্যাসের অনিবার্য পরিণামে অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের নারীরা তাঁদের ক্ষমতা ও লালসার শিকার হতেন। গ্রামের অন্ত্যজ পল্লীতে ঘুরলে ওই চিরকুমারের মুখাবয়ব ও অন্যান্য চিহ্নযুক্ত মানবকদের খুঁজে পেতে খুব অসুবিধা হত না।

সেই ব্রহ্মদৈত্যদেরই অধিষ্ঠান বেল বা নিম গাছের নিচে। ক্রমে তার পাশে বট বা অশ্বত্থ শাখা বিস্তার করেছ। শতাব্দী পেরিয়ে আমরা দেখছি সেই বিপুলায়তন ঝোপে বাবার থানে থেকে গেছে ব্রহ্মচারীর প্রতীক কিছু শিলাখণ্ড, মাটিতে পোঁতা ত্রিশূল, কাঠের খড়ম, মাটির ঘোড়া ও চাঁদমালা। মাটি গাছ ঘোড়া সবই তো প্রজননের প্রতীক। নিঃসন্তান নারীরা সন্তানকামনায় আসে বাবার কাছে। বৃক্ষমূলে পুজো দেয়, বৈশাখে জল দেয়, অস্থানিক মুলে ঢেলা বাঁধে।

মধুদা বললেন, নগরীর ব্রহ্মদৈত্য থানের সঙ্গে মাটির নিবিড় সম্পর্ক। ফুল-ফল-মিষ্টি নয়, এখানকার ব্রহ্মদৈত‍্য পুজোর উপকরণ হলো মাটি। ভক্ত মানুষের দল তমাল গাছের লাগোয়া পুকুর থেকে হাত দিয়ে মাটি খুঁড়ে তাল পাকিয়ে মাথায় করে বয়ে এনে, কিংবা ছোট ছোট ঢেলা পাকিয়ে বটগাছের তলায় নৈবেদ্য হিসেবে নিবেদন করেন।

সঙ্গীদের এই সব তত্ত্বকথা বলতে বলতেই ভাবছিলাম ব্রহ্মদত্যির থানের ওপর আমার অমোঘ আকর্ষণের কথা। এই গ্রামে এসেছি, কিন্তু ব্রহ্মদত্যির থানে যাই নি, এমনটা কখনো হয়নি। সেকি ক্ষেতজমির নিরালায়, নামহীন কান্দরের পাশে ছায়াঘেরা নিঝুম নিস্তব্ধতার টানে? নাকি গ্রামসমাজে ওতপ্রোত মানবেতিহাসের একটি স্বল্পালোচিত অধ্যায়ের সঙ্গে আশৈশব সংযোগে?

আমার ধ্যান ভেঙে মানিকবাবু মনে করিয়ে দিলেন কয়েক সপ্তাহ পরেই এখানে বসবে পয়লা মাঘের মেলা। সূর্যের উত্তরায়ণ গতি শুরু হয় পয়লা মাঘ। আর এই দিনেই গ্রামবাংলায় অসংখ্য লৌকিক দেবতার পুজো হয়, গ্রামগ্রামান্তরে এক দিনের মেলা বসে। ১৯৭৩ সালের পর এই গ্রামের মেলা আমি আর দেখিনি। এখনো মনে গেথে আছে সারা রাত পাশের রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়ি চলার আওয়াজে, ভোর ভোর মেলাতে যাওয়ার উত্তেজনায় আধো ঘুমে রাত পার হয়ে গেছিল। মেলা মানে মাটি, লোহা আর কাঠের গার্হস্থ্য দ্রব্য; কিছু খাবারের দোকান; কিছু খেলনা, বেলুন, বাঁশি। মধুদা বললেন, এই সব জিনিসপত্র আজও মেলার মূল পসরা। অনেক আধুনিক জিনিস যোগ হয়েছে, তবু মাটি লোহা কাঠের তৈরি পণ্য আজও আসে।

২.

ব্রহ্মদত্যির থান থেকে বেরিয়ে গ্রামের দিকে এগোলাম। একটাই রাস্তা, গ্রামের বুক চিরে চলে গেছে সিউড়ি বক্রেশ্বর সড়কের দিকে।

স্থানীয় মানুষেরা মুখের কথায় বলেন লগুরি। আমাদের মনে হতে পারে, তা নগরী নামের আঞ্চলিক উচ্চারণ। ভাষাবিদ, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন অধ্যাপক সত্যনারায়ণ দাস কিন্তু লিখেছেন, লগুরি দ্রাবিড় ভাষাজাত শব্দ, যার অর্থ, ছাউনি। নামটির ঐতিহাসিক উৎস খোঁজা কঠিন। কেউ কেউ বলছেন, এখানে রাজনগরের পাঠান রাজাদের সেনাছাউনি ছিল, সেখান থেকে এই গ্রামনাম। এখন যেখানে স্কুল, সেই ডাঙাটির নামও পাঠানপাড়া। তবে এ ব্যাখ্যা মেনে নেওয়া যায় না। রাজনগরের রাজবংশের প্রতিষ্ঠা মাত্রই ষোড়শ শতকে। দ্রাবিড় গ্রামনামগুলোর উদ্ভব তার অনেক শতাব্দী আগে।

রাঢ়বাংলার গ্রামগুলির অবস্থান ও গঠনের একটা ধাঁচ আছে। এ অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ঢেউখেলানো। ঢেউয়ের মাথায় ডাঙাজমি, সেখানে গ্রামের পত্তন হয় আর নিচের জমিতে হয় চাষ। এ অঞ্চলে একটা প্রবাদ আছে: ‘বাস করো নগরে, চাষ করো আগরে।’ আগর মানে নিচু জমি, যেখানে চাষ হয়। কোনো কোনো ভাষাবিদ এই ‘আগর’ শব্দের সঙ্গে এগ্রিকালচার শব্দটির উৎসের মিল খুঁজে পেয়েছেন। যাই হোক, এই ঢালু জমি নামতে নামতে গিয়ে শেষ হবে কোন একটা জলধারায়, তারপর আবার উঠতে শুরু করবে অন্য একটা গ্রামের দিকে। এই জলধারার স্থানীয় নাম কান্দর। নগরী গ্রামের কৃষিজমি নামতে নামতে ব্রহ্মদত্যির থানের কান্দরের কাছে এসে শেষ হয়েছে। কান্দরের যত কাছের জমি তত উর্বরা; ঢালের উপরের দিকের জমির উর্বরতা কম।

গ্রামের মাঝখান দিয়ে একটি রাস্তা। দুপাশে ঘরবাড়ি। রাস্তার ধারের বাড়িগুলি সচরাচর উচ্চবর্ণের উচ্চবর্গের মানুষদের। এগুলোই গ্রামের সেরা ভিটে জমি। মূল রাস্তা বা কুলি থেকে একটু দূরে বাগদী পাড়া, বাউরী পাড়া, ডোমপাড়া কিংবা  কামার কুমোর ছুতোরদের ছোট ছোট পাড়া। গ্রামের লাগোয়া কিংবা পাশের ছোট ডাঙাতে সাঁওতালপাড়া বা মাঝিপাড়া। গ্রামে ঢোকার রাস্তায় প্রথম কয়েকটি বসতবাড়ি হবে গ্রামের প্রধান পরিবারগুলির। নগরী গ্রামের গড়ন ও এই ধাঁচের। আমরা যদি সিউড়ি বক্রেশ্বর সড়কের দিক থেকে মূল পথ ধরে এসে গ্রামে ঢুকতাম, দেখতে পেতাম প্রথম দিকের অনেকগুলো বাড়ি এই গ্রামের প্রধান পরিবার রায়বাবুদের। সঙ্গে তাঁদের দুর্গামন্ডপ, আটচালা ইত্যাদি।

নগরী গ্রামে পাঠানপাড়া নামে ডাঙা থাকলেও এই গ্রামে কোন মুসলমান বসতি নেই। এমনকি তাঁতি, কামার, কুমোর, ছুতোর ইত্যাদি শিল্পী সম্প্রদায়ের বসবাসও নিষিদ্ধ। আমার মামা মজা করে বলতেন, ব্রহ্মদত্যি বাবা নাকি বিধর্মীদের সহ্য করতে পারেন না! আর তাঁতি কামার কুমোর ছুতোরের ঠোকাঠুকিতে বাবার ঘুমের ব্যাঘাত হয়! নগরী গ্রামের উচ্চবর্গের বাসিন্দা হলেন ব্রাহ্মণ, কোঙার সদগোপ এবং  ছত্রি রাজপুত। জনসংখ্যার বেশিরভাগটাই মাল বাউড়ি বাগদি ডোম শুড়ি সম্প্রদায়ের, যাদের স্থান হিন্দুসমাজের নিম্নকোটিতে। এককালে গ্রামের অধিকাংশ জমি ছিল ঘাটোয়ালদের। পুরনো ম্যাপে দেখা যায়, নগরী গ্রামের চারপাশে ছিল অরণ্য। তার কিছু অবশেষ এখনো আছে। এই অরণ্যের জমি হাসিল করে প্রথমে চাষাবাদ শুরু করেছিল ঘাটোয়ালরা। তারা আসলে বিহার এবং পশ্চিমের মালভূমি থেকে আসা ভূমিহার বা ছত্রি। রাজনগরের রাজাদের কিংবা অন্য সামন্তদের পাইক বাহিনীর অংশ ছিল তারা। পাহাড়ের ঘাট পাহারা দিত তাই ঘাটোয়াল। ভূম্যধিকারীরা জঙ্গলের জমি হাসিল করে কৃষিজমি তৈরি করার কাজে তাদের ব্যবহার করেছিলেন।  এ সব সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ এই অঞ্চলে এসে জঙ্গল কেটে কৃষিজমি তৈরি করার অনেক আগের ঘটনা। চাষাবাদ শুরু হওয়ার পর জমি কিছুকাল নিষ্কর থাকতো, তারপরে কর আরোপ হত। এই করের বিরুদ্ধে গিয়ে উনিশ শতকের শুরুতে ঘাটোয়ালরা বিদ্রোহী হয়েছিল। বিদ্রোহ দমনের পর খাজনা পরিশোধ করতে না পেরে এই জমি তাদের হাতছাড়া হয়। ধীরে ধীরে সেই জমি অন্য উচ্চবর্ণের দখলে যায়। নগরী গ্রামের জমি এভাবেই রায় পরিবার এবং ব্রাহ্মণদের দখলে গেছে পুরনো দলিল হাঁটলে হস্তান্তরের তথ্য সে কথাই বলে।

রায় পরিবারের আদি পুরুষ নেহালচন্দ্র রায়ের কথা আগে বলেছি। পরিবারের  সমৃদ্ধির সূচনা আঠারো শতকের শেষ দিকে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের তালুকদারী এবং নীলকুঠির সূত্রে। পরিবারের তালুকদারীর বেশি অংশটা ছিল নগরীর সন্নিহিত এলাকায়। এছাড়া ছিল পাশে রাজনগরে এবং খয়রাশোলের অর্জুনশুলি নামে এক পাথুরে অঞ্চলে। সাঁওতাল পরগনার শিকারিপারা থানাতেও তাঁদের তালুকদারী ছিল।  বোলপুরের কাছে সুরুলের সরকার পরিবারের সঙ্গে রায় পরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রেই নীলকুঠির ব্যবসার সঙ্গে তাঁদের যোগ। ইন্দ্রনারায়ণ রায় নীলকুঠির ব্যবসা শুরু করেন। এখনো রাজারপুকুর, কুমকুমা ও আরো কয়েকটি গ্রামের চৌবাচ্চাগুলি সেই নীলকুঠির অতীতের সাক্ষ্য দেয়।

এই গ্রামে কোন পুরনো ঐতিহ্যশালী দৃষ্টিনন্দন মন্দির বা স্থাপত্য নেই। এই গ্রামের সম্পদ তার মানুষ। নগরী বীরভূম জেলার নামকরা গ্রাম। শিক্ষা সংস্কৃতি রাজনীতি বিজ্ঞানচর্চার জগতের বহু খ্যাতনামা মানুষের জন্ম দিয়েছে। এই গ্রামের প্রমথনাথ রায় জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করার পর লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের সঙ্গে একই জাহাজে বিলেত পাড়ি দিয়েছিলেন। সেখানে ডাক্তারি ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসার পর সমাজের অনুশাসনে গ্রামে ঢুকতে পারেননি। বাধ্য হয়ে মার্কিন মুলুকে গিয়ে স্থিতু হন। পরবর্তীকালে এই গ্রাম আরো অনেক কৃতি মানুষের জন্ম দিয়েছে। জ্যোতির্ময় রায় স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়ে দ্বীপান্তর বাস করেছেন।  জেলার বামপন্থী রাজনীতির পীঠস্থান এই গ্রামটি। ডা. শরদীশ রায় লোকসভায় বিরোধী দলনেতা ছিলেন। নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক অরুণ চৌধুরী এবং প্রাক্তন গ্রন্থাগার মন্ত্রী তপন রায় এই গ্রামেরই মানুষ। এককালে জেলার মানুষ নগরী গ্রামকে বীরভূমের আলিমুদ্দিন বলতো। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।

ধুদাকে বিদায় জানিয়ে আমরা তিনজন সিউড়ি বক্রেশ্বর সড়কের দিকে চললাম। মোরামের রাস্তা। দুপাশে কাঁকুরে প্রান্তর, মাঝে মাঝে চাষজমি। মন কেমন করা দৃশ্যরূপ। যেন সারা বছরই উদাস চৈত্রদিনের ছোঁয়া। সিউড়ি সড়কে ওঠার ঠিক আগে ডানদিকে এক বিপুল জলাশয়, রাজার পুকুর। স্থানীয়রা অবশ্য পুকুর না বলে বাঁধ বলেন। বহুযুগ আগে মাটি কেটে তৈরি করা। জমির ঢাল যেদিকে নেমে এসেছে সেদিকে অর্ধচন্দ্রাকারে বাঁধ দেওয়া। বর্ষাকালে উঁচু ঢালের জল গড়িয়ে এসে এই বাঁধে আটকাবে এবং জলাশয়কে পুষ্ট করবে। এখান থেকে সেচ পাবে আশেপাশের সমস্ত চাষের জমি। রাঢ় বাংলায় যেখানে যেখানে ঢেউখেলানো ভূপ্রকৃতি, সেখানে এভাবেই বাঁধ দিয়ে জল আটকে জলভাণ্ডার তৈরি করা হয়। পুকুর এবং বাঁধ শব্দ দু’টি এখানে সমার্থক।

রাজার পুকুরের সংলগ্ন পল্লীতে মাহিষ্য কৃষকদের বাস। নীল চাষ এবং নীলকুঠির কাজে ইন্দ্রনারায়ণ রায়ের আমলে এরা এখানে বসতি করেন। উল্টোদিকের গ্রামটির নাম বাঁধ আগাল।  রাজার পুকুর বাঁধের নাম থেকেই এই গ্রামের নাম। আগাল অর্থাৎ আগলে রাখা বা পাহারা দেওয়া। আমার মামা অরুণ চৌধুরীর কাছে শুনেছিলাম, পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তিনি যখন নগরী গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা নিয়ে আসেন তখনো বাঁধ আগাল গ্রামের স্থপয়িতা মানুষটি বেঁচে ছিলেন।  তার নাম ছিল ধরমা মাঝি। তখনই তার বয়স সত্তর পেরিয়েছে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের গ্রাম পত্তনের বিশদ রীতি আছে। যখন কোনো একটি বসতির জনসংখ্যা বেড়ে যায়, আশেপাশের জল জমি জঙ্গলের রসদ দিয়ে সেই গ্রামের সকলের দিন চলে না, তখন কোনো উদ্যোগী যুবকের নেতৃত্বে গ্রামের একদল মানুষ নতুন বসতি খুঁজে বের করে। জল মাটি জমি যেমন দেখে, তেমনি গোষ্ঠীর আচার মেনে সুলক্ষণগুলি মিলিয়ে নেওয়া হয়। গ্রামের বাইরে শাল গাছের নিচে জাহির থান তৈরি করে। তার নিচে একটি বা দুটি পাথর। কোনও মূর্তি নেই, বৃক্ষ এবং শিলা।  সর্বপ্রাণবাদীদের ঈশ্বর। এরপর চাষ ও ঘর বাঁধার জমির বণ্টন। এভাবেই নতুন গ্রাম পত্তন হয়। ভাবছিলাম শতকের গোড়ার কোন একসময়ে ধরমা মাঝি হয়তো সাঁওতাল পরগনার কোন এক জায়গা থেকে এসে এভাবেই এই গ্রাম পত্তন করেছিলেন।

মামার কাছে শোনা গল্প বলছিলাম সঙ্গীদের। ভিনদেশ থেকে এসে ধরমা মাঝি প্রথমে আমগাছির রাবণ মুর্মুর ঘরজামাই ছিলেন। তারপর আসেন বাঁধ আগাল গ্রামে। মামা সেই সত্তরোর্ধ বৃদ্ধকে প্রথম দেখেছিলেন চারণভূমির পাশে। স্বাস্থ্যবান দীর্ঘদেহী মানুষ, বাঁশের লাঠি নিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাঠে গোটা পঞ্চাশেক গরু ও অন্যান্য পশু। তাঁর সম্পত্তি। ধরমাকে নাকি কেউ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁর টাকাপয়সা কেমন আছে। তিনি পশুর বাহিনী দেখিয়ে বলেছিলেন, তাঁর টাকাপয়সা মাঠে দৌড়চ্ছে।

দুর্লভপুরের ঘাট (রাস্তার পাশে এবং বনের মধ্যে দেখা যাচ্ছে মাটির বাঁধের অবশেষ।)

কথায় কথায় আমরা এগিয়ে চলেছি সিউড়ি বক্রেশ্বর সড়ক ধরে রাজনগরের দিকে। রাজনগর আমাদের গন্তব্য নয়, আমরা যাবো ঘাট দুর্লভপুর পর্যন্ত। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে একটি বসতি থেকে অন্য একটি বসতিতে যেতে হলে টিলা পাহাড়ের মাঝখানের যে সংকীর্ণ নিচু পথ ধরতে হয়, তাকে বলে ঘাট। এই ঘাট পাহারা দিত বলবান ঘাটোয়াল সম্প্রদায়ের মানুষেরা। সেটাই ছিল তাদের বৃত্তি। পরে এই ঘাট শব্দটির অর্থ আরো ব্যাপক হয়। ঘাট এবং পাহারা দেবার চৌকি শব্দদুটো সমার্থক হয়ে পড়ে।

রাজনগরের রাজারা রাজধানীকে সুরক্ষিত করার জন্য নগরকে বেড় দিয়ে মাঠের ওপর দিয়ে উঁচু মাটির বাঁধ দিয়েছিলেন। রাস্তার মতো চওড়া বাঁধ। তার ওপর দিয়ে পাইকরা লাঠি সড়কি হাতে একদিক থেকে অন্যদিকে যেতে পারত। চার দিকে নজর রাখত। মানুষের চলাচলের জন্য যে পথ সেখানে থাকতো ঘাটোয়ালদের চৌকি। দুর্লভপুর গ্রামে এমনই এক চৌকি ছিল। তাই গ্রামের নাম ঘাট দুর্লভপুর। বীরভূমে, সাঁওতাল পরগনায়, এমনকী কোম্পানি আমলের শুরুতেও পাহাড়ী পথের ঘাট আগলাতেন ঘটোয়ালরা। বীরভূমে আজও বহু গ্রামের সঙ্গে ঘাটোয়াল পাড়া আছে।

আমরা চলেছি দুর্লভপুরের কাছাকাছি সেই পুরনো বাঁধের অবশেষ খুঁজে বার করতে। কিংবা এক টুকরো হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের খোঁজে। দুর্লভপুর গ্রামে এসে দ্বিচক্রযান থেকে নেমে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। ঝকঝকে সকাল। চারপাশে ঝলমল করছে অনেক লড়াই করে টিকে যাওয়া দু এক খন্ড শালবন। পাশে ধানক্ষেত।

আমরা কি সেই পুরনো বাঁধ খুজে পাব? প্রথম চেষ্টায় পেলাম না। ভয় হলো,  এতকাল পরে মানুষ বাঁধ কেটে সমান করে চাষের জমি বানিয়ে নেয় নি তো! এমন তো কতোই হয়।  কিন্তু ঝলমলে সুন্দর সকাল আমাদের নিরাশ করলো না। হেঁটে ফেরার পথে দেখি সামাজিক বনের আড়ালে সে দৃশ্যমান। রাস্তার দুপাশে বাঁধের দুই প্রান্তের কাটা মাটির স্পষ্টতা। আর সোনাঝুরি বনের আড়ালে টানা উঁচু মাটির বাঁধের আভাস।

মনে হলো, আজকের সকালটা পরিপূর্ণ। ভাণ্ডিরবনের পুরাণকথার পৃষ্ঠা থেকে ব্রহ্মদত্যির থানের ছায়া মেখে এখন ঝলমলে রোদ গায়ে মাথায় নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক হৃতকাল সামন্তশাসকের নগররক্ষার ক্ষয়িষ্ণু আয়োজনের সামনে। সামন্তশাসনের দিন শেষ হয়েছে, সাম্রাজ্যের কালও। শুধু  কোথাও আলো কোথাও ছায়া আর বুক ভরা পুরাণকথা নিয়ে গ্রাম জনপদ জেগে আছে ভাবীকালের শ্রোতার জন্য। ( চিত্রগ্রাহক – সন্দীপন সেনগুপ্ত )

বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ