স্মৃতি কি সতত সুখের? মনে হয় নয়। আজ পড়ন্ত বেলায় সেই স্মৃতির ভান্ডার থেকেই বার বার ভেসে উঠছে নানা ছায়ামাখা ঘটনা।তার কোনওটা গভীরতায় কিছুটা ভা্রী আবার কোনওটা হালকা।কোনওটা আবেগ জড়ানো আবার কোনওটায় লেগে থাকা হালকা আবেশঘন স্মৃতি। সেই রোমন্থন পর্বই আজকের লেখা।
পর্ব ১
প্রথমদিন কলেজের নোটিশবোর্ডে টাঙানো ফিজিক্স অনার্সের রুটিন তুলতে ব্যস্ত, হঠাৎ একটা মিহি সুরেলা গলায় ‘আপনার পেনটা একবার দেবেন, বাড়ি থেকে তাড়াহুড়োয় বেরোতে গিয়ে পেনটা আনতে ভুলে গেছি’?
হ্যাঁ, হ্যাঁ নিন না! বলে পেনটা এগিয়ে দিতে মুখের দিকে তাকাতেই চমকে উঠেছিলাম,
” এতো সুন্দর মুখ হয় না কি? কোন খুঁত নেই’। বিধাতার অপরূপ সৃষ্টি। রুটিন তুলতে তুলতে আলাপ -পরিচয়। আমরা একই কলেজের ফিজিক্স অনার্সের ছাত্র-ছাত্রী। এরপরে ক্লাশে দেখা হত। কলেজ ক্যান্টিনে দেখা হত। প্রাকটিকাল ক্লাশে দেখা হত। না পারলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতাম। ধরতোও আড়ষ্টহীনভাবে।
একদিন অফ পিরিয়ডে আমরা ফিজিক্স অনার্সের বন্ধু-বান্ধুবীরা চুটিয়ে আড্ডা মারছিলাম গঙ্গার পাড়ে বসে। মনোরম পরিবেশ। প্রেমের বৃন্দাবন বলা যেতে পারে। আড্ডা মারতে মারতে কখন যে পরের ক্লাশের সময় চলে এসেছিল কেউই বুঝতে পারি নি। যখন খেয়াল হল ততক্ষণে অর্দ্ধেক সময় পার হয়ে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে ক্লাশে ঢোকার সময় এক প্রস্থ বুকনি ও অপদ্স্ত হতে হল আমাদের সকলকে। স্যার ক্লাশ নিতে ঠিক সময়ে চলে এসেছিলেন। এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে পড়া না পারার জন্যে আমি বাদে সকলকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। এবারে আমাকে আদেশ দিলেন ক্লাশের পরবর্তী অংশটা পড়াতে। এটা শাস্তি না প্রাপ্তি বুঝতে না পেরে আমি আদেশ পালন করার আগে স্যারকে অনুরোধ করেছিলাম আমার সব বন্ধু-বান্ধবীদের ক্ষমা করে দিয়ে বসার অনুমতি দিতে। স্যার দিলেন। বাদ বাকী সময়টা থার্মোডিনামিক্সের ক্লাশটা আমি স্যারের সামনে থেকে পড়িয়ে দিলাম। ক্লাশ শেষে স্যার আমার পিঠ চাপড়িয়ে চলে গেলেন। স্যার যখন পিঠ চাপড়াছিলেন সেই সময় প্রথম সারিতে বসা ওই বান্ধবীর মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকাটা আমার নজর এড়ালো না। ওই শুরু। এরপরে প্রতিদিন প্র্যাকটিকাল ক্লাশে দেখেছি সেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমাকে দেখা। প্রথম প্রথম গুরুত্ব না দিলেও পরের দিকে ওর ঘনিষ্ঠ আচরণ আমাকে দিন কে দিন দুর্বল করে দিচ্ছিল। ক্রমশঃ আমাকেও এক মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করছিল। অবসর মুহুর্তগুলোতেও ওর সুন্দর পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে মুখটা ভেসে আসতে লাগলো। একে কি বলে লাভ কামস এট দি ফার্স্ট সাইট? কলেজ ফেস্টে ওর গান শুনে ওর প্রতি আকর্ষণ আরও বেড়ে গেল। কলেজে লাইব্রেরির রিডিংরুম , ক্যান্টিন, গঙ্গার পাড়ে বসে চলতে লাগলো আমাদের আলাপচারিতা। এক একদিন তো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম এক দৃষ্টিতে। এক সুন্দর অবগাহনে সময় কোথায় যে হারিয়ে যেত বুঝতেই পারতাম না। বলতাম মনে মনে: “তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি/ প্রিয় সে কি মোর অপরাধ।”
মাঝে মাঝে ওই তাড়া দিত উঠে পড়ার জন্যে। সন্ধ্যে হয়ে আসছে বাড়ি ফিরতে হবে। কলেজ জীবন শেষ হওয়ার আগে আমি চলে গেলাম ডাক্তারি লাইনে। ও থেকে গেল। বি এস সি পাশ করে ও চলে গেল অস্ট্রেলিয়ায় দিদির কাছে। আমি ডাক্তারি পেশায় জড়িত হয়ে নানান পরিষেবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কালের নিয়মে যোগাযোগ ক্রমশঃ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হল। কিন্তু ভুলতে পারি নি কলেজ জীবনের সেই মুগ্ধ দৃষ্টিটার কথা। বলতে পারি নি মনের গোপন কথাটা। আজ লিখতে বসে স্মৃতির ভান্ডার থেকে বের করেই ফেললাম সেই কথাটা।
পর্ব -২
রাতের ডিউটি পড়েছে। সিনিয়র হাউস স্টাফ। নাইট ডিউটি প্রায়ই পড়ে। সারা রাত ডিউটি দেওয়ার পরে সকাল আটটায় রিলিভার এলে তবেই ছাড় মেলে। কোন কোন দিন রিলিভার আসতে দেরি করলে হাউসস্টাফ কোয়াটারসে ফিরতে দেরি হয়ে যায়। তখন কোন রকমে হাত-মুখ ধুয়ে স্নান সেরে আবার ছুটতে হয় ওয়ার্ডে। আগের দিন যারা ভর্তি হয়েছিলেন সবাইকে দেখে কেস হিস্টরি সাজিয়ে নিয়ে স্যারের ওয়ার্ড রাউন্ডে হাজির থাকতে হয় সিনিয়র হাউস স্টাফকে। সিনিয়র হাউস স্টাফেরা হল ভিজিটিং ফিজিয়ানসের বিশ্বস্ত মুখ। আগের দিন রাতে একজন সত্তোর উর্দ্ধ বয়স্ক লোক ভর্তি হয়েছিলেন অঞ্জান অবস্হায়। তিন তিনটে বিবাহযোগ্যা মেয়ের করুণ মুখগুলো মনে পড়ছিল। মা অনেক দিন আগে মারা গেছেন। অবসরপ্রাপ্ত বাবা মাথার ঊপর ছাদ হয়ে রয়েছিলেন। এখন সেই ছাদ ভেঙে পড়ার উপক্রম।অল্প বয়েসী মেয়েগুলোর করুণ মুখগুলো মনে করে দিচ্ছিল নিজের বোনের আর দিদিদের কথা।বাবা স্বল্প আয়ে সাত ভাইবোনকে খুব কষ্ট করে মানুষ করেছিলেন। দিদি বোনেরা প্রতিদিন দেড় -দু মাইল হেঁটে কলেজ যেত আর হেঁটেই কলেজ থেকে ফিরতো। সেই কষ্টের কথাটা আবার নতুন করে ভেসে উঠলো ঔই তিনটি মেয়েকে দেখে। ভেতর থেকে বারে বারে যেন কে খোচাছিল ওদের জন্যে কিছু একটা করার। ওদের মাথার ওপর ছাদটা যেন সরে না যায়। যথারীতি যা যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার রোগের কারণ খোঁজার জন্যে সবই করা হল। রিপোর্ট নিয়ে স্যারের রাউন্ডে হাজির হলাম। স্যার ভাল করে পরীক্ষা করে তেমন কিছু পেলেন না। রিপোর্ট দেখেও মিলল না কোন ক্লু। বয়স্ক ভদ্রলোকটি শুয়ে রয়েছেন অঞ্জান অবস্হায়। কোন সাড়া শব্দ নেই। বেডের একধারে মাথা নিচু করে তাঁর মেজো মেয়েটি বসে। মুখটা থমথমে, করুণ চাহনি। আগাম বিপদের আশংকা চোখে-মুখে। স্যার আরও কতকগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিলেন।সবই কিডনি ফেলিওর সংক্রান্ত। যথারীতি পরের দিন রাউন্ডে রিপোর্টগুলো নিয়ে হাজির হলাম। নিজেদের মধ্যে আলোচনায় কিছুই সুরাহা হলো না রোগের কারণ নিয়ে। একবার আমার মুখ ফসকে বলে ফেললাম, স্যার এই কেসটা সাব ডুরাল হেমাটোমা নয় তো?
সাব ডুরাল হেমাটোমা হলো মস্তিষ্ককে ঘিরে রাখে যে ছিল্লির পর্দা তার ও মাথা সহ শিরদাড়াঁর মাঝে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া। এর জন্যে যে খুব বড় ধরণের চোট-আঘাত লাগার দরকার হয় তা নয়, দেওয়ালে সামান্য মাথা ঠুকে যাওয়া, চলন্ত বাসে থাকাকালীন হঠাৎ করে ব্রেক কষলে বাসের রেলিংএ মাথা ঠুকে যাওয়া ইত্যাদি কারণে ঘটতে পারে। অনেক সময় ছোট ঘটনাগুলো মনেও থাকে না, ভুলে যান অনেকে। এইসব ট্রিভিয়াল ইনজুরিতে সাব ডুরাল হেমাটোমা হতে দেখা যায়। বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ঘটনা পরম্পরা দেখে কেমন যেন মনে হচ্ছিল ওনার হয়তো সাব ডুরাল হেমাটোমা হয়েছে। আমার আশংকার কথা শুনে এক্কেবারে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে স্যার বলে উঠলেন, আরে না না, ওসব কিছু নয়, তুমি বরং এইসব পরীক্ষাগুলো করে ফেল – বলে হাবিজাবি কতকগুলো অপ্রাসঙ্গিক পরীক্ষার নির্দেশ দিয়ে রাউন্ড শেষ করলেন।
যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে আজকের দিনের উন্নত প্রযুক্তি যেমন সিটি স্কান, এম আর আই স্ক্যান তখন হাসপাতালে চালু হয় নি। রুটিন পরীক্ষ.নিরীক্ষা আর ক্লিনিকাল অবজারভেশনের উপর নির্ভর করে রোগের চিকিৎসা চলতো। যাই হোক স্যারের আদেশকে শিরোধার্য করে স্যারের কথামত পরীক্ষায় ধ্যান দিলাম। একদিন দুদিন কেটে গেল। রোগীর অবস্হা দিন কে দিন খারাপ হতে থাকল। বিকেলে সিস্টারদের জরুরী কল বুক পেয়ে রোগীর অবস্হা দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বয়স্ক লোকটির শ্বাস পড়ছে খুব দ্রুত গতিতে। বুঝলাম শেষ সময় আসন্ন। বারে বারে ভদ্রলোকের অসহায় তিনটি মেয়ের মুখ মনে পড়ে যাচ্ছিল। কিছুই করতে পারছিলাম না আমার নিজেকেও অসহায় বোধ হচ্ছিল। শ্বাসকষ্ট দেখে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে অক্সিজেন দিতে কিছুটা উন্নতি হল। মুখ দিয়ে ঘড়ঘড়ে আওয়াজটা বন্ধ হল। শ্বাস প্রশ্বাস কিছুটা ছন্দে ফিরলো। ওই অবস্হায় সিদ্ধান্ত নিলাম একজন স্নায়ুচিকিৎসকের মতামত নেওয়ার।
আমাদের হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের ওপরের ওয়ার্ডটা ছিল নিউরো-মেডিসিন ওয়ার্ড একদিকে আর একদিকে নিউরো-সার্জারি ওয়ার্ড। ওদের আর এম ও চন্দ্রকান্তদার সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে আলাপ ছিল। চন্দ্রকান্তদার সঙ্গে দেখা করে সব খুলে বললাম। আমার কথা শুনে নিজেই চলে এলেন রোগীকে দেখতে। দেখে-শুনে বললেন ইমিডিয়েট রোগীকে নিউরো-সার্জারীতে ট্রান্সফার করার জন্যে। আমি বললাম, স্যারের পারমিশান নিতে হবে। চন্দ্রকান্তদা প্রতুত্তরে জানালেন, ওসব ফরমাল কাজ করতে গেলে রোগী হাতের বাইরে চলে যাবে। ওসব পরে করে নেওয়া যাবে। আমি বললাম অন্তত রোগীর বাড়ির লোকজনকে তো জানাতে হবে।
সেটা ফোন করে জানিয়ে দে। বলবি খুব সিরিয়াস অবস্হা। এখুনি ওটি করতে হবে। বললাম, তাহলে তো লিখিত কনসেন্ট নেওয়ার দরকার আছে।
দেখ আমি তো তোর পাশে আছি। এই দাদাটার ওপর একটু ভরসা রাখ। রোগীর জীবনের কাছে আইনী কূট-কাচালির কথা ভাবলে চলবে? আমাদের কাজ জীবন দেওয়া, জীবন নেওয়া নয়। চন্দ্রদার কথার মধ্যে কি ছিল জানিনা, চার্জড হয়ে কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করে, বাড়ির লোককে ফোন করে ডেকে এনে চললাম নিউরো-সার্জারি ওয়ার্ডে। চন্দ্রদা কাল বিলম্ব না করে ওটি শুরু করে দিলেন। আমায় বললেন, এক বোতল রক্ত ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে আনিয়ে রাখতে। যদি প্রয়োজন হয় চালানো হবে। ইতিমধ্যে ওনার তিনজন মেয়ে চলে এসেছেন। সব কথা জানাতে, ওরা বলল আপনি যেটা ভাল বুঝেছেন আমাদের সেটাতেই সম্মতি আছে। কাগজপত্র কি আছে দিন, আমরা সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর দিয়ে দিচ্ছি। এখনকার মতন এতটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ গড়ে ওঠে নি সে সময়ে।
আধঘন্টা পরে চন্দ্রদা হাসতে হাসতে ওটি থেকে বাইরে এসে বললেন, তোর রোগীর ঞ্জান ফিরে এসেছে। আমরা বেডে দিয়ে দেব। উনাদের আত্মীয়রা কথা বলতে পারবেন, তবে কিছুক্ষণের জন্যে। উনার এখন কিছুটা মানসিক রেস্ট দরকার। আরও বললেন, তোর ডায়গোনসিস একশো শতাংশ ঠিক। সাব ডুরাল হেমাটোমা হয়েছিল। আমরা বারহোল করে বের করে দিয়েছি। সেজন্যই জ্ঞান তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। ব্লাডটা রাখা আছে, দরকার পড়ে নি।
ও টি থেকে নিউরো-সার্জারি বেডে দেওয়ার পরে বাবা-মেয়েদের সে এক কান্না-হাসির ছবি। মন ক্যামেরায় স্মৃতি হয়ে আছে আজও। পরের দিন রাউন্ডে বেরিয়ে স্যার জিঞ্জাসা করলেন, অমুক বেডের রোগী কেমন আছে? টিকে আছে না মারা গেছে? মনে পড়লো চন্দ্রদার সেই কথাটা, আমাদের কাজ জীবন দেওয়া, জীবন নেওয়া নয়। বিনীতভাবে স্যারকে সব ঘটনার কথা জানালাম। এও বললাম আপৎকালীন ঘটনায় না জানাতে পারার জন্যে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও ক্ষমাপার্থী। আমার কথা শুনে কিছুটা উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন, আমার আন্ডারে রোগী ভর্তি হয়েছে আর আমাকে না জানিয়ে এত বড় ডিসিসান নেওয়া হয়ে গেল? আরও বেশ কিছু ভৎর্সনা শুনতে হলো আমাকে।
ইতিমধ্যে পুরো ঘটনাটা সারা ওয়ার্ডে ছড়িয়ে গেছে। সবাই হতবাক স্যারের ওই ধরণের মানসিকতা দেখে। সবাই মুখিয়ে আছে এর একটা যুৎসই প্রতিবাদের জন্যে। আমি বারণ করলাম, বললাম আমরা এখানে শিখতে এসেছি। যতটা পারবো এখান থেকে শিখে মানুষের সেবার কাজে লাগাবো।তবে জীবনের পড়ন্ত বেলায় চন্দ্রকান্তদার ওই কথাটি বেদবাক্য বলে মেনে নিয়েছি, “চিকিৎসকেরা জীবন দিতে পারে, জীবন নিতে পারে না।”
[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]
Tags: কত স্মৃতি যত কথা, ডা. প্রদীপ কুমার দাস, ব্লগ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।