20 Oct

গল্প হলেও সত্যি – তারিণীখুড়ো, শঙ্কু ও ফেলুদা

লিখেছেন:দেবরাজ গোস্বামী


গল্পের সময় ব্লগ

যে কোন মহান লেখকের সাহিত্যকর্মই আসলে খানিকটা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের বাস্তব  অভিজ্ঞতার সঙ্গে কল্পনার মিশ্রন। ফলে আপাত কাল্পনিক চরিত্র বা ঘটনাবলীর ভেতরে কিছু কিছু বাস্তব চরিত্রের ছাপ থেকে যাওয়া খুবই সম্ভব। সত্যজিৎ রায়ের সাহিত্যকর্মও এর ব্যাতিক্রম নয়। একই সঙ্গে সত্যজিৎ রায় চিত্রকরও বটে । ফলে তাঁর লেখা এবং অলঙ্করনের মধ্যে মাঝেমাঝেই বাস্তবের চরিত্ররা এসে উঁকি দিয়েছেন। সত্যজিতের সৃষ্ট তিনটি মুখ্য চরিত্র তারিণীখুড়ো , প্রফেসর শঙ্কু এবং ফেলুদার গল্পে অথবা অলংকরনে কিভাবে সত্যিকারের চরিত্ররা অন্য রূপে এসে উপস্থিত হয়েছেন তারই তিনটি সংক্ষিপ্ত উদাহরন এখানে পেশ করা গেল।

দা ঠাকুর থেকে তারিণীখুড়ো 

সত্যজিৎ রায়ের আঁকা তারিনীখুড়োর প্রতিকৃতি যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেইদিনই মনে হয়েছিল এই মানুষটিকে আমি আগেই কোথায় যেন দেখেছি। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে কিন্তু যখনই ছবিটা দেখেছি , সাংবাদিক রবিন চৌধুরীকে দেখে যেমন জটায়ুর চেনা চেনা মনে হত আমারও তারিণীখুড়োকে তেমন মনে হয়েছে। তারপর একদিন দৈবাৎ চোখে পড়লো দা ঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের মুখাবয়বের দু একটি পুরনো ফোটোগ্রাফ । চোখে পড়া মাত্রই হাই ভোল্টেজ স্পার্ক !  আরে! তারিণীখুড়োর ছবি আঁকার জন্য সত্যজিৎ রায় দা ঠাকুরের ফোটোগ্রাফের রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন ! কেবল গোঁফটা দিয়েছেন ছোট করে, আর ঠোঁটে বিড়ি।

ছবি-১

তবুও কনফার্ম হওয়ার জন্য প্রয়োগ করলাম ফেলুদার গুরু শার্লক হোমসের পদ্ধতি। হোমসের বকলমে স্যার কোনান ডয়েল তাঁর ‘অ্যাডভেঞ্চার অফ দি কার্ডবোর্ড বক্স’ নামক গল্পে জানিয়েছিলেন মানুষের আইডেন্টিটি বুঝতে তার ‘কান’ এর গঠন লক্ষ করা জরুরী। দা ঠাকুরের ডান কানের সঙ্গে সত্যজিতের আঁকা তারিণীখুড়োর ডান কানের লতির গঠন মিলিয়ে দেখলাম। হুবহু মিলে গেল !! আর সংশয় রইল না। ছবিটা (ছবি -১) এখানে পাঠকদের জন্য দিয়ে দিলাম।

সন্ডার্স নাকি ক্লেয়ার 

প্রফেসর শঙ্কুর বিভিন্ন অভিযানের মধ্যে একটা মজার ব্যাপার আছে। শঙ্কুর প্রথম গল্প ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ আসলে তাঁর অন্তিম অভিযান , আবার শঙ্কুর শেষ গল্প স্বর্ণপর্ণী আসলে শঙ্কুর প্রথম অ্যাডভেঞ্চার । এই গল্পেই আমরা দেখতে পাই যে বিজ্ঞানী সন্ডার্সের সঙ্গে শঙ্কুর চিঠি লেখালিখির মধ্যে দিয়ে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে এবং এই সন্ডার্সের আমন্ত্রনেই জীবনে প্রথমবার, ১৯৩৭ সালে শঙ্কু লন্ডনে যাত্রা করছেন। অল্প কয়েক লাইনে শঙ্কু বর্ণনা করেছেন তাঁর প্রথম লন্ডন যাত্রার গতিপথ এবং সেখানে গিয়ে বন্ধু সন্ডার্সের বাড়িতে অতিথি হয়ে  থাকার কথা । যখন শঙ্কুর এই গল্পটি লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়, প্রায় একই সময় তিনি লিখছিলেন তাঁর সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী ‘অপুর পাঁচালি’ বা মাই লাইফ উইথ অপু।  এই বই পড়ে আমরা জানতে পারি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতায় পোস্টেড ব্রিটিশ বাহিনীর ইন্টালিজেন্স বিভাগের এক তরুণ কর্মী নর্মান ক্লেয়ারের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ক্লেয়ার আবার লন্ডনে ফিরে যান । এদিকে ১৯৫০ সালে কলকাতার ডি জে কিমার বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মী সত্যজিৎ রায়কে তাদের লন্ডন অফিসে কাজ করবার জন্য পাঠানো হয়। সেটাই ছিল সত্যজিতের প্রথম বিদেশযাত্রা। অপুর পাঁচালি বইতে সত্যজিতও তাঁর যাত্রার গতিপথ ও লন্ডনের বাসস্থানে পৌঁছনোর বর্ণনা দিয়েছেন। শঙ্কুর প্রথম লন্ডন যাত্রার বর্ণনা এবং সত্যজিতের প্রথম লন্ডন যাত্রার বর্ণনা পাশাপাশি পড়ে তুলনা করে দেখা যেতে পারে। শঙ্কু লিখছেন “ ২৫ অক্টোবর ১৯৩৭ আমরা বোম্বাই থেকে পি এন্ড ও কোম্পানির জাহাজ ‘ এস এস এথিনা -তে ইংলন্ড রওনা দিলাম। ১৬ই নভেম্বর পোর্টসমাউথ বন্দরে জাহাজ থেকে নেমে ট্রেনে এলাম লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশনে। সেখান থেকে টিউব অর্থাৎ পাতাল রেলে চড়ে গেলাম হ্যাম্পস্টেড। এই হ্যাম্পস্টেডেই উইলবি রোডে সন্ডার্সের বাড়ি”।  অপুর পাঁচালি বইতে সত্যজিৎ রায় লিখছেন “ আমার ২৯ তম জন্মদিনের এক সপ্তাহ আগে, মালপত্র নিয়ে সস্ত্রীক আমি রেলগাড়িতে উঠে কলম্বোর পথে রওনা হই। ঠিক ছিল যে সেখান থেকে পি অ্যান্ড ও কোম্পানির জাহাজ ‘মালোজা’য় উঠে আমরা লন্ডনে যাত্রা করব। … একটা বুধবারে আমরা পোর্টসমাউথে পৌঁছই। সেখান থেকে ট্রেনে উঠে হ্যাম্পস্টেডে এসে নামি। এর আগে নর্মান ক্লেয়ারের কথা বলেছি। সে-ই ব্যবস্থা করে রেখেছিল যে, গেস্ট হিসেবে আমরা তার মায়ের বাড়িতে থাকব। বাড়িটা উইলবি রোডে”।  এই দুটি লেখা একসঙ্গে পড়লে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে শঙ্কুর প্রথম লন্ডন যাত্রার ঘটনা গল্প হলেও পুরোটা কল্পনা নয়। তার মধ্যে মিশে আছে অনেকটা সত্যি। শঙ্কুর প্রথম জীবনের বন্ধু সন্ডার্স আর সত্যজিতের বন্ধু নর্মান ক্লেয়ার আসলে একই লোক।

চার ইয়ারি কথা 

“…………… ফেলুদা কাগজটা আমার হাতে দিল। তাতে খবর রয়েছে – ‘মোর ভ্যান্ডালিজম’। তার নীচে বলছে – মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহোতে ত্রিংশ শতাব্দীর কান্ডারিয়া মেহাদেও মন্দিরের গা থেকে একটা মেয়ের মূর্তির মাথা কে বা কারা যেন ভেঙ্গে নিয়ে গেছে। বরোদার এক আর্ট স্কুলের চারজন ছাত্র মন্দিরটা দেখতে গিয়েছিল, তারাই নাকি প্রথম ব্যাপারটা লক্ষ করে”। কৈলাসে কেলেঙ্কারি নামক ফেলুদার উপন্যাসে ঠিক এইভাবে খবরের কাগজে প্রকাশিত একটি খবরকে উপস্থাপান করেছেন সত্যজিৎ রায়। এখন কথা হচ্ছে এই যে আর্ট স্কুলের যে ছাত্ররা মন্দিরটা দেখতে গিয়েছিল তারা সংখ্যায় চারজন কেন? তিনজন বা পাঁচজনও তো হতে পারত। কিন্তু লেখক কেন এই চার সংখ্যাটা বেছে নিলেন। আসলে এই ছাত্ররা কারা? এর উত্তর পেতে গেলে ফিরে যেতে হবে সেই চল্লিশের দশকে। শান্তিনিকেতনের কলাভবনে চারজন ছাত্রর একটি ছোট্ট দল ছিল। এরা সবসময় একসঙ্গে ঘোরাফেরা, ছবি আঁকা, শিল্প নিয়ে আলোচনা, কিচেনে খেতে যাওয়া ইত্যাদি করত। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন কলাভবনের বার্ষিক ভ্রমণ দুমকায় হবে বলে ঠিক হল তখন এই চার বন্ধু মাস্টারমশাই নন্দলাল বসুকে গিয়ে জানালো তারা দল বেঁধে অজন্তা, ইলোরা, এলিফ্যান্টা এবং খাজুরাহো দেখতে যেতে চায়। মাস্টারমশাই সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন এবং এই ছাত্রদের জন্য স্টুডেন্ট কনশেসন পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।

ছবি-২

খাজুরাহোতে মন্দিরগুলো তন্নতন্ন করে দেখার পর থাকার যায়গা না পেয়ে এঁদের রাত কাটাতে হয়েছিল এক গোয়ালঘরে। অসংখ্য স্কেচ এবং ফটোগ্রাফিক ডকুমেন্টেশান ইত্যাদি করে পূজোর ছুটির পর দলটি শান্তিনিকেতনে ফিরে এল। এই দলের চারজন সদস্য ছিলেন যথাক্রমে দিনকর কৌশিক, পৃথ্বীশ নিয়োগী, সত্যজিৎ রায় এবং মুত্থুস্বামী (ছবি -২)। সুতরাং বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না যে ফেলুদার গল্পে যখন সত্যজিৎ রায় চারজন ছাত্রের উল্লেখ করেন তখন মনে মনে তিনি নিজের ছাত্রজীবনের বন্ধুদের কথাই ভেবেছিলেন।

[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ