20 Oct

দুই সমরেশের গল্প

লিখেছেন:অজয় বিশ্বাস


গল্পের সময় ব্লগ

অন্য সমরেশ

এক মাথা কালো কোঁকড়ানো চুল । ব্যাকব্রাশ করা। পরনের পাজামা- পাঞ্জাবি  একটু মলিন । আনন্দ বাজারের দোতলায়  দেশ’ পত্রিকার ঘরে সম্পাদক সাগরময় ঘোষের মুখোমুখি।

দেশে ককেটি গল্প  প্রকাশের শের সুবাদে প্রাথমিক পরিচয়ের আড়াল বা জড়তা ছিল না। নৈহাটি র চটকল ইউনিয়নের নেতা সুরথ বসু ততদিনে   সাহিত্যিক সমরেশ বসু হয়ে ওঠার সিঁড়িতে পা দিয়েই ফেলেছেন। কতই বয়স? মেরে কেটে তিরিশ ও হবে না! দেশ’ সম্পাদকের কাছে তাঁর আর্জি , তিনি প্রয়াগের কুম্ভ মেলায়  যেতে চান। লিখতে চান মানুষর এই মহান মিলন মেলা নিয়ে।

– তা বেশ তো, লিখবেন । খুব ভালো ভাবনা।….

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই সমরেশ বললেন, কিন্তু আমার তো এলাহাবাদ গিয়ে কুম্ভ মেলা কভার করার সামর্থ্য নেই। আপনি যদি ব্যাবস্থা করেন…..

সাগরময় ঘোষের জহুরির চোখ, টেবিলের উল্টো-দিকে বসা গভীর কালো চোখের তারার হিরের ঝলক চিনতে ভুল করেনি। তিনি সরাসরি কথা বলেছিলেন সরকার পরিবারের সদস্য সেই সময়ের আনন্দবাজারের আর্থিক দায়িত্বে থাকা কানাই লাল সরকারের সঙ্গে। কানাইলালবাবু চলে এলেন দেশ’ পত্রিকার দপ্তরে ।

কথা প্রসঙ্গে সমরেশ জানিয়েছিলেন, এই একই প্রস্তাব  ‘যুগান্তর ‘ কে দেওয়ায় তারা তাকে কিভাবে অপমানিত করে  ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আনন্দবাজার তাকে ফেরায়নি। তাঁর ঝুলি ভরে দিয়েছিল। শর্ত একটাই , তাঁর রিপোর্টাজ, তাঁর লেখা সবই আনন্দবাজারের জন্যই হতে হবে। কুম্ভের অমৃতযাত্রায় আনন্দবাজারই কালকুটের মাধুকরীর ঝুলি ভরে দিয়েছিল।

এই কথা পরে শুনেছিলাম ‘আনন্দবাজার’ এর  কৃষি – সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড ভূমিলক্ষীর  ঘরে । সরকার পরিবারেরই  আরও এক আত্মীয় কানাইলাল বসু দেখতেন এই পত্রিকা। প্রতি সপ্তাহে তারাপদ বন্দোপাধ্যায়ের বাংলার মুখ ছাপা হত। সুন্দরী কোনো রমণী বা আদিবাসী কোনো রমণীর দেহ বল্লরী। আমরা আড়ালে  বলতাম বাংলার বুক।

কানাইবসু ছিলেন আদ্যপান্ত বাবু কালচার এর মানুষ, গিলে করা আদ্ধির পাঞ্জাবি, চুনোট করা ধুতি, চোখে রিমলেস চশমা, কোলাপুরি শুঁড় তোলা চপ্পল –  আবডালে হাসিঠাট্টা করলেও সামনে সমীহ করত সকলে। করবে নাই বা কেন। তিন পয়সার অংশীদার যে! তাকে খুশি করতে অশোক সরকার একটা আস্ত ট্যাবলয়েড এর দন্ডমুণ্ডের এর কর্তা করে দেন।

১৯৮২ সালের জুলাই তে ‘ পরিবর্তন ‘ছেড়ে যোগ দিয়েছিলাম আনন্দবাজার-এর প্রস্তাবিত সংবাদ সপ্তাহিক ‘সানন্দ’-তে। সম্পাদক সন্তোষ কুমার ঘোষ! তিনি তখন অস্তাচলগামী। একদা দোর্দণ্ড প্রতাপ সাংবাদিক, বার্তা সম্পাদক, রবীন্দ্র গানের নিয়ন্ত্রক তখন  ‘ছোট্ট কুঠুরি তে বন্দী ‘!  সে সব অন্য কথা, অন্য কোন সময়ে অন্য কোথাও হবে।

সেই প্রস্তাবিত ‘সানন্দ’ প্রস্তাবেই আমি তখন ভাসমান । ভাসতে ভাসতেই ‘ভূমিলক্ষ্মীর’  আড্ডায়। সেখানেই একদিন কানাইবাবুর ঘরে আর্ট ডিরেক্টর বিপুল গুহর  (বিপুল আমার পূর্বপরিচিত) সঙ্গে দেখা। তার সামনেই বসে আছেন দীর্ঘদেহী ধুতি পাঞ্জাবি, রিমলেস চশমার নিপাট ভদ্রলোকটি ।

আমাকে দরজা ঠেলতে দেখেই কানাইলাল বাবু বললেন, “আরে অজয় বাবু এসো এসো। কানাইদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দি । ইনি কানাইলাল সরকার। আমাদের মাসমাইনের চাবি ওনার ই হাতে।”

আলাপ হল, কানাই বসুর স্পেশাল দুধ চা এলো, খবর থেকে রাজনীতি হয়ে আনন্দবাজার দেশ! কানাইদা বাংলা সাহিত্যে আনন্দবাজারের লেখক তৈরির প্রসঙ্গ টেনে সাগরময় বাবুর জহুরীর চোখের বিষয়ে কথা তুললেন –  এই যে সমরেশ বসু  কালকুট নামে অমৃতকুম্ভ লিখলেন, এর পিছনের কারিগরী  মানুষটি হলেন কানাই দা, তিনিই সমস্ত খরচা-পাতির ব্যবস্থা এক কথায় করে দিয়ে ছিলেন।

অমৃত কুম্ভ কালকূটের ঝুলি ভরে দিয়েছিল, সব – অর্থে – জনপ্রিয়তায়।আর পিছনে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ম্যাজিক ঘটে গিয়েছিল তার জীবনে।সেই ম্যাজিকের একটা রসময় টুকরো শুনিয়েছিল রবিবাসরীয় সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীর সহকারী দীপক রায়। দীপক  ম্যাজিসিয়ান জুনিয়ারের (পি সি সরকার) অত্যন্ত স্নেহভাজন।

পুজো সংখ্যা’র লেখার সময় সমরেশ পার্ক সার্কাসে’ মিঠাই গলিতে একটা দোতলা বাড়িতে থাকতেন।সেখান থেকেই লেখা সংগ্রহ করে আনত দীপক। হাজার শব্দ-লেখা দুটি করে এ-ফোর পৃষ্ঠা। একটিতে ‘দেশ’ অন্যটিতে ‘আনন্দবাজার’, একই সঙ্গে দুটি লেখা। উনি ফোন করলে দীপক গিয়ে নিয়ে আসত।

দীপক জানিয়েছিল, একদিন ফোন পেয়ে গিয়ে দেখি, বাইরে থেকে তালা ঝুলছে! বেল টিপে টিপে হতাশ হয়ে ফিরেই এলাম। তারপর অবশ্য আর অসুবিধা হয়নি। বেল টিপে ভিতরে গিয়ে লেখা এনেছি, ওর কাজের লোক চা দিয়েছে। সেই দিনটা যে ওরকম ব্যতিক্রম কেন হয়েছিল জানি না।

-এর কয়েক বছর পর  রমাপদবাবুর ঘরে ঢুকতেই দেখি সমরেশবাবু জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। আমাকে দেখেই হো হো করে হেসে উঠে বললেন, বুঝলেন রমাপদবাবু আপনার ম্যাজিশিয়ানকে আমিই একদিন ম্যাজিক দেখিয়ে ছিলাম। বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে আমি ভিতরে বসে জানলা দিয়ে মজা দেখছিলাম।

ও বেল বাজিয়ে চলে না গিয়ে উপরে তাকালেই আমার ম্যাজিক ধরা পড়ে যেত!

…………

আর এক সমরেশ 

দু ‘হাজার সালের প্রথম দশকের মাঝামাঝি কোন একটা সময় হবে ।সময়টা গল্পের, তাই সন- তারিখের কচকচিতে না গিয়ে সোজাসুজি গল্পেই উঁকি মারা যাক।

আনন্দবাজার’ এর তিন তলার করিডোরে লিফট থেকে চোখ পড়েছিল মাথায় এক ঝাঁক কোঁকড়া চুল ,পাটভাঙা সাদা  পাঞ্জাবি – পায়জামা পরা দীর্ঘ দেহী মানুষটিকে। মুখ ঘোরাতেই দেখলাম চেনা মুখ ।হালকা একটু হাসি বিনিময়, আমি  আনন্দবাজারের নিউজ ডেস্কে।

কিছুক্ষণ পরে যখন রাইটার্সের জন্য পা বাড়িয়েছি, সেই সময় দেখলাম তিনি পায়চারি করছেন, এবারে সামনে গিয়েই দাঁড়ালাম। ‘সমরেশ বাবু আপনি কাউকে খুঁজছেন? আমাকে বলতে পারেন। জলপাইগুড়ির ছেলে, শক্তিব্রত (মজুমদার) আলাপ করিয়ে দিয়েছিল!’

মনে পড়তেই কিছুটা সহজ হলেন সমরেশ মজুমদার, ‘ভালোই হলো, আমাকে  রমাপদ বাবুর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দেবেন ভাই। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা…।’ আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম ‘ রবিবাসরীয়’- র বন্ধ দরজার বাইরে। রামাপদ চৌধুরী গল্পের  পাতা দেখতেন।

বললাম,  একটু দাঁড়ান । আমি দেখছি। বলেই রবিবাসরের দরজা ঠেলে উঁকি মারতেই দেখি ভিতরে তখন চাঁদের হাট! হিমানীশদা ( গোস্বামী)  পৃথুল শরীর দুলিয়ে কি একটা রসিকতা করে হাসছেন। একপাশে দিব্যেন্দু পালিত আর আমার পাশ দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।শেখর বসু আগেই বসে ছিলেন।শীর্ষেন্দুদা বললেন,  “তুই কাকে খুঁজছিস?”।  রমাপদবাবু ধুতির খুঁটে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বললেন, “আপনি কিছু বলবেন ?”

আমি দীপক রায় কে দেখিয়ে বললাম ওর সঙ্গে একটু দরকার। দীপক উঠে এল। রবিবাসরীয় দীপক ছাড়া অচল। শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকার গল্প উপন্যাস লেখকদের বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করা। তা ছাপানো প্রুফ দেখা সব কিছুই সে এক হাতে সামলাত।দীপক বাইরে এলে সমরেশবাবুর সঙ্গে আলাপ করতে গেলে ও বলল আমি চিনি, ওকে কে না চেনে বলুন তো ।

আমার কাজটা সহজ হয়ে গেল। আমি সমরেশ বাবুর ইচ্ছার কথা ওকে জানালাম। দীপক আশ্বস্ত করল চিন্তা করবেন না ,দুটো দিন সময় দিন।সমরেশবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন,”আমি অন্য কোথাও একটা পার্সোনাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাই একান্তে কথা বলব।”

হাসিমুখেই দীপক কথা দিল। আমি অফিসের গাড়ি নিয়ে রাইটার্স।

ঠিক দিন কয়েকের মাথায় দীপক খবর দিল সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে। পরশুদিন  প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে আমাদেরই অফিসের উল্টো দিকের রেস্টুরেন্টে (এখন আর নেই) ওরা বসবেন। রমাপদ বাবু আপনাকেও ডেকেছেন।

সেই দিন ঠিক তিনটের সময়ে পৌঁছে গেলাম। সমরেশবাবু অনেক আগেই এসে গিয়েছিলেন!  কোঁচানো ধুতি, সোনালী রেশমের পাঞ্জাবি, রিমলেস চশমা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, একটু হয়তো নার্ভাস! কে জানে !

দীপক এর সঙ্গে রমাপদ বাবু এলেন। সেই আদি অকৃত্রিম ধুতি পাঞ্জাবি । ভিতরে ঢুকতেই চিনে রেস্তোরাঁর  লাল ড্রাগনের সামনে ছাত থেকে টেবিলের ওপর নেমে আসা  আবছা আলোর নীচে সাজানো প্লেটে নানান চিনে ডিশ। আর একটা অদ্ভুত মায়াবী ঝাঁঝালো সুঘ্রাণ।

আমি আর দীপক মিনিট পনেরো ছিলাম । রমপদ বাবু এক চামচ সুপ নিয়ে আমাদের বললেন আপনারা খেয়ে নিন।

কয়েক মিনিট পর আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম সেই একান্ত আলাপ একান্ত গোপনই রয়ে গেল।

Tags: ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ