20 Oct

‘রঙকানা’ রবীন্দ্রনাথ

লিখেছেন:অতনু কুমার বসু


১৯০০ সালের ৬ মার্চ কলকাতা থেকে কবিকে  লিখিত এক চিঠিতে জগদীশচন্দ্র জানাচ্ছেন  ‘ আমি সম্প্রতি একটি অত্যাশ্চর্য্য কৃত্রিম চক্ষু প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইয়াছি। এই চক্ষে অনেক আলো দৃষ্ট হয় যাহা আমরা দেখিতে পাই না। তা ছাড়া ইহা রক্তিম ও নীল আলো অতি পরিষ্কাররূপে দেখিতে পায়। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, ইহা Slightly green-bling । আপনার চক্ষু ইহা কি করিয়া অনুকরণ করিল বুঝিতে পারি না ‘। জগদীশচন্দ্র যাকে বলেছেন কৃত্রিম চোখ তা আসলে গ্যালেনা ডিটেক্টর ( galena ditector), সিসে আর গন্ধক দিয়ে নির্মিত একধরনের কেলাসাকার যৌগ পদার্থ ( lead sulphide)। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় বলা হয় ‘ মাইক্রো – ওয়েভের ঢেউ তার উপর এসে পড়লে সেই কেলাসে কম্পন তৈরি হয়। এই কম্পন থেকে তড়িতের প্রবাহ তৈরি করা যায়। সেই প্রবাহকে প্রয়োজনমতো পরিবর্ধিত করে নিয়ে যন্ত্রের দ্বারা মাপা যায়। এই বিদুৎ প্রবাহকেই বলা যেতে পারে মাইক্রো-ওয়েভ- এর উদ্দীপনায় কৃত্রিম চোখের সাড়া ‘। জগদীশচন্দ্রের এই কৃত্রিম চোখ লাল ও নীল আলোতে ভালো সাড়া দেয় অথচ সামান্য সবুজ-কানা। কৃত্রিম চোখের এই অক্ষমতা কবির চোখে ধরা পড়ায় জগদীশচন্দ্র অবাক হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে কবি যেহেতু লাল-কানা

অর্থাৎ প্রটানপ ( protanop), তাই তাঁর পক্ষে এটা ধরা সম্ভব হয়েছিল। জগদীশচন্দ্রের কবি সম্পর্কিত এই আবিষ্কারও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। চিত্রী রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ বয়সের পিয়া। তবু এটা বলাই যায় যে কবির সুদীর্ঘ জীবনে কখনোই সৃষ্টির রঙ ফিকে হয়ে যায় নি। জীবনের যে কোনো পরিস্থিতিতেই সৃষ্টি নিয়ে তিনি মাতোয়ারা ছিলেন। জীবনের রঙ লাল-নীল-সবুজ-কালো যাই হোক না কেন কবিতা – গান – গল্প – উপন্যাস – নাটক – প্রবন্ধ – চিঠিপত্র অথবা চিত্রকলা সৃষ্টির যে কোনো একটি মাধ্যমকে আশ্রয় করে সে প্রকাশিত হতোই। প্রকাশের এই প্রবল অব্যক্ত প্রসব যন্ত্রণা ও অতৃপ্তি থেকে উপশম পেতেই তিনি বিচিত্র অবলম্বনের আশ্রয় নিতেন। এই অন্বেষণই জীবন সায়াহ্নে কবি রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিয়েছিল তুলি। অবনীন্দ্রনাথের ভাষায়  ‘ কেমন করে এই মানুষের হাত দিয়ে এই বয়সে এই জিনিস বের হল। … ভলকানিক ইরাপশনের মতো এই একটা জিনিস হয়ে গেছে।… এত রঙ, এত রেখা, এত ভাব সঞ্চিত ছিল অন্তরের গুহায় যা সাহিত্যে কুলালোনা, গানে হল না – শেষে ছবিতেও ফুটে বের হতে হল – তবে ঠান্ডা। আগ্নেয়গিরি – একটা পাহাড়, যখন তার ভিতর ধাতু গলে টগবগ করে ফুটতে থাকে – পারে না আর ধরে রাখতে, ফেটে বেরিয়ে পড়ে – চারিদিকে ছড়িয়ে, তবে পাথর ঠান্ডা হয়, এত ঠিক সেই ব্যাপার ‘।

কবি জীবনের অভিজ্ঞতা কী বলছে ? প্রবল সংবেদনশীল এই মানুষটার কাছে দৃষ্টির এই অক্ষমতার অনুভূতিটাই বা কীরকম? কবি একবার বিদেশে ট্রেনে যাওয়ার সময় এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তিনি চলমান ট্রেন থেকে রেললাইনের দু’ধারে অজস্র ছোটো নীল ফুল দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু বউমাদের ডেকে যখন সেই অসাধারণ দৃশ্য দেখাচ্ছেন তখনই বিপত্তি। তাঁরা সেই দৃশ্য কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। কবি বলছেন ‘আমি যত বউমাদের ডেকে ডেকে সে ফুল দেখাচ্ছি – তাঁরা দেখতেই পাচ্ছিলেন না। আর আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলুম – এমন রঙও লোকের দৃষ্টি এড়ায়’। কবি এই বিষয়ে সচেতন ছিলেন। কোনো এক ইউরোপীয় আর্টিস্টের কাছে কবির এই স্বীকারোক্তিই এই ধারণাকে আরো স্পষ্ট করে দেয়। ‘ একজন য়ুরোপীয় আর্টিস্টকে একদিন বলেছিলুম যে, ইচ্ছা করে ছবি আঁকার চর্চা করি, কিন্তু আমার দৃষ্টি ক্ষীণ বলে চেষ্টা করতে সাহস হয় না। ‘ আর সেই ইউরোপীয় বিদগ্ধ রসিক মানুষটি রসিকতার ছলে শিল্পের এক গূঢ় সত্য কথাও এই ফাঁকে স্মরণ করে দিয়েছিলেন। দৃষ্টির অক্ষমতা তখন অধিক দেখা থেকে দোষমুক্ত হওয়ার সহজ উপায়। ‘ ও ভয়টা কিছুই নয়, ছবি আঁকতে গেলে চোখে একটু কম দেখাই দরকার; পাছে অতিরিক্ত দেখে ফেলি এই আশঙ্কায় চোখের পাতা ইচ্ছে করেই কিছু নামিয়ে দিতে হয়।ছবির কাজ হচ্ছে সার্থক দেখা দেখানো ; যারা নিরর্থক অধিক দেখে তারা বস্তু দেখে বেশি, ছবি দেখে কম।’

কবি শেষ বয়সের পিয়াকে নিয়ে যখন মগ্ন থাকতেন সেই সময়ে কবিকে প্রায়ই সঙ্গ দিতেন রানী চন্দ। তাই রানীর কাছ থেকেও কবির শেষ বয়সের বিভিন্ন রকম আদবকায়দার বিষয়ে আমরা চোখ বুলিয়ে নিতে পারি। সেখানেও কবির দৃষ্টির অক্ষমতার কিছু ইঙ্গিত আমাদের চোখে ধরা পড়ে। এমনিতেই কবি মাঝে মাঝেই নিজেকে ‘ রঙকানা ‘ বলতেন আর বিশেষ করে বলতেন লাল রঙটা ঠিক তাঁর চোখে ধরা পড়ে না। অথচ নীল রঙের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বেশ ধরা পড়ত। তবু রানীও লক্ষ করেছেন যে কবির ছবিতে লালের প্রাচুর্য, পর্যাপ্ত লালের ব্যবহার কিন্তু সেই নীলের সময়েই যত কৃপণতা। আহমদ রফিক এই সম্পর্কে বলেছেন ‘ রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ ছবিতে লাল রঙ সম্ভবত কালোকে প্রতিহত করতে শাদার বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ কবি বেশ দ্রুততার সঙ্গে ছবি আঁকতেন আর রঙের শিশিতে তুলি ডোবানোর সময়েই মাঝে মাঝে ধরা পড়ত বিপত্তি। ভুল কোনো রঙের শিশি থেকে রঙ নিয়ে ব্যবহারের ফলেই সম্পূর্ণ ছবিটাকে পাল্টে ফেলতে বাধ্য হতেন কবি। এমন হয়েছে যে হলদে আকাশের জন্য রঙ নিতে গিয়ে কালো রঙের শিশিতে সেই তুলি ডোবাতে যাচ্ছেন,  সঙ্গে সঙ্গে রানী কবিকে নিরস্ত্র করতেন। কবি হেসে উঠে বলতেন,’দেখলি, আর একটু হলেই সর্বনাশ হত ।’

কবির শেষ বয়সের সঙ্গিনী আরেক রানী অর্থাৎ নির্মল কুমারী মহলানবিশের অভিজ্ঞতাও রানী চন্দর সাথে অনেকটাই মিলে যায়। নির্মলা একেবারে সুস্পষ্ট ভাবেই বলেছেন  ‘ পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল যে উনি রঙ-কানা ছিলেন। লাল রঙটা বেশি চোখে পড়ত না, মানে লাল আর সবুজের বেশি পার্থক্য বুঝতে পারতেন না। কিন্তু কোনো জায়গায় নীলের একটু আভাসমাত্র থাকলেও সেটি তাঁর দৃষ্টি এড়াতো না ।’ সেই বিদেশে বউমাদের সাথে ট্রেনে যেতে যেতে যেমন রেললাইনের দু’ধারে নীল ফুল দেখে মুগ্ধ হয়ে বউমাদের দেখাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, শান্তিনিকেতনেও প্রায় একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন নির্মলা। বাগানে ঘাসের মধ্যে খুব ছোট্ট নীল ফুলটাও কবির দৃষ্টি এড়িয়ে যেত না। তারপর সেই ফুলটাকে যখন সবাইকে দেখানোর জন্য ছটফট করছেন তখনও সেই একই ধাঁধা। কবি ছাড়া আর কারোর নজরেই সেই ছোট্ট নীল ফুল ধরা পড়ল না।কবি বলতেন ‘ কী আশ্চর্য। এত স্পষ্ট জিনিসটা দেখতে পাচ্ছো না? ‘ এর সাথেই কবির ব্যাখ্যায় উঠে আসত লাল – নীল রঙের অসামান্য মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।  ‘ নীল রঙটা যে পৃথিবীর রঙ, আকাশের শান্তির রঙ, তাই ওটার মধ্যে আমার চোখ ডুবে যায়; আর লাল রঙটা হল রক্তের রঙ, আগুনের রঙ অতএব প্রলয়ের রঙ, মৃত্যুর রঙ – কাজেই বেশি না দেখতে পেলে দোষ কি? ‘

কবির এই নীল রঙের প্রতি পক্ষপাতিত্বের সাথেই যে মিশে আছে বন্ধু পিয়ারসনের সেই আশ্চর্য অমলিন উপহারের স্মৃতি। পিয়ারসন বিদেশ থেকে ফুলের চারা এনে উপহার দিয়েছিলেন কবিকে। উত্তরায়নে যত্ন করে বসিয়েছিলেন কবি। সেই থেকেই বিদেশি নীলমণিলতার সাথে বাংলার প্রকৃতি ও রূপলাবণ্যের সখ্য শুরু। কবির মতোই বাংলার প্রকৃতিও যেন তাদের বিদেশি বন্ধুকে বুকে করে আগলে রাখত। মুগ্ধ কবিও বন্ধুকৃত্য সুসম্পন্ন করতে বাংলার প্রকৃতির পক্ষ থেকে নতুন অতিথিকে জানালেন সুস্বাগতম।  ” তুমি সুদূরের দূতী, নূতন এসেছ নীলমণি, / স্বচ্ছ নীলাম্বরসম নির্মল তোমার কণ্ঠধনি/যেন ইতিহাসজালে/ বাঁধা নহ দেশ কালে, / যেন তুমি দৈববাণী বিচিত্র বিশ্বের মাঝখানে, / পরিচয়হীন তব আবির্ভাব, কেন এ কে জানে। ” নীলমণিলতায় বিমুগ্ধ কবি কখনো কখনো নির্মলাকে বলতেন  ‘ কি

এখনও তুমি লাল রঙ বেশি ভালো বলবে ?’ নির্মলাও বা ছাড়বে কেন ? সঙ্গে সঙ্গে কবিকে প্রশ্ন করতেন, তাহলে পলাশ কবির এতো প্রিয় কেন ? কবির উত্তরও যেন তৈরি ছিল  ‘ ঐ দ্যাখো, আবার তর্ক শুরু হল। আরে, পলাশটা কি শুধুই লাল ? ওতে কতখানি হলদে মেশানো রয়েছে, তাছাড়া ঘোর সবুজ – প্রায় কালো আর একটা রঙ আছে, এই দুই মিলিয়ে তবে তো পলাশের বাহার ? তাছাড়া পলাশের গড়নটার কথাও তো ভুললে চলবে না। ‘

এটা বলা হয় যে, চোখের এই বিশেষ ধরণের অক্ষমতার কথা প্রথম বলেন জাপানী চক্ষু বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী ইশিহারা-সান। তিনি প্রোটানপ রোগের বিচিত্র ধরণের কথা বলেছেন। রোগী যে সবসময় রবীন্দ্রনাথের মতো লাল রঙ দেখতে পান না তা নয়, কালো, নীল বা সবুজও কোনো কোনো রোগীর চোখে ধরা পড়ে না। এর পরিবর্তে তারা অন্য রঙ দেখেন। অতএব বিভিন্ন রোগীর ক্ষেত্রে রঙের তারতম্য ঘটে। তাই কোনো একটি বিশেষ রঙ অর্থাৎ লাল রঙ দেখার অক্ষমতার জন্য প্রোটোনোপিয়া বলা হলেও, যেহেতু ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে রঙের তারতম্য হয়, সেইজন্য রোগীর রেটিনা পরীক্ষা না করে কোন রঙের ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিশক্তির অক্ষমতা সেটা বোঝা যায় না।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এই রোগ সংক্রান্ত বেশ কিছু আকর্ষণীয় তথ্য আমাদের হাতে উঠে এসেছে। প্রোটানোপিয়াকে বলা হয় বংশগত রোগ। সম্ভবত কবির মাতামহর এই দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা ছিল। বিজ্ঞানীরা এটাও দেখেছেন যে সমগ্র মানব প্রজাতির মধ্যে পুরুষরা শতকরা ৮ ভাগ এবং নারীরা শতকরা ৪ ভাগ এই দৃষ্টিজনিত অক্ষমতার শিকার হন।কিন্তু পুরুষ ও নারীর মধ্যে এই তারতম্যের ব্যাখ্যাটি বিজ্ঞানীরা মানবজাতির বিবর্তনের ধারার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন। আদিম সমাজে পুরুষেরা ছিল মূলত শিকারি আর নারীরা ছিল সেই শিকারের পরীক্ষক ও সংগ্রাহক। তাই নারীদেরই ফলের বর্ণ ও গন্ধ পরীক্ষা করে বিচার করতে হত কোন ফলটি বিষাক্ত, কোনটি উপকারী, কোনটি সুমিষ্ট, কোনটি দ্রুত পচনশীল ইত্যাদি এবং এটা যথাযোগ্য বিচার করার পরই নারীরা সেই ফল শিশুদের বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের খাওয়ার অনুমতি দিতেন। আদিম সমাজ থেকে নারীদের এই বিচক্ষণতাই তাদের দৃষ্টিশক্তি পুরুষদের তুলনায় প্রখর করে তুলেছে।  জিনগত বিশ্লেষণেও দেখা গেছে যেহেতু মেয়েদের দেহকোষ দুটি ( XX) ক্রোমোজোম দিয়ে গঠিত আর পুরুষদের ( XY) , তাই দুটি একই ক্রোমোজোমের জন্য নারীদের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক রিসেসিভ জিনটি থাকলেও, তার প্রকট হওয়ার সম্ভাবনা পুরুষদের তুলনায় অনেকটাই কম।

তবে কবির প্রোটানোপিয়া অর্থাৎ লাল রঙ দেখার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার বিষয়ে বিপরীত মতামতও অনেকসময় উঠে এসেছে। ডাক্তারী শাস্ত্রকে মাথায় না রেখে শুধুমাত্র চিত্র সমালোচক হিসেবে কবির ছবির দিকে দৃষ্টি আরোপ করে তাঁরা বলেছেন যে তাঁর তুলিতে ফুল বা অন্যত্র যে পর্যাপ্ত লাল রঙের প্রয়োগ দেখা যায় তাতে দৃষ্টিজনিত কোনো সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ে না। এছাড়াও চিত্রী রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন ও বিচিত্র বর্ণ ব্যবহারের উৎসাহ এবং প্রয়োগও তাঁদেরকে বিস্মিত করেছে। কখনো প্রতীকী হিসেবে, কোথাও ভারসাম্য রক্ষার্থে আবার কোথাও সংকর্ষ সৃষ্টির জন্য সেইসব রঙ ব্যবহৃত হয়েছে। এই প্রয়োগ ক্ষমতাকে পশ্চিমী বিশেষজ্ঞরা বলেন  ‘ free use of colour ‘. এই প্রয়োগ নৈপুণ্য যাঁর তুলিতে উঠে এসেছে তাঁর দৃষ্টিশক্তির অক্ষমতার কথা বিবেচনার মধ্যে আনা বেশ কষ্টকর। সোমেন্দ্রমাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সুদীর্ঘ গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার নিরিখে বলেছেন  ‘ তবে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর বিচিত্র সৃষ্টির সঙ্গে সারাজীবনের নিবিড় পরিচয়ের ভিত্তিতে এইটুকু বলতে পারি যে ছেলেবেলায় এবং পরেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর দৃষ্টিক্ষীণতা বা দৃষ্টির সীমাবদ্ধতার কথা মুখে বা লিখে কখনো কখনো বললেও তাঁর সৃষ্টিগুলিতে ( ভাষিক বা অভাষিক) তার সমর্থন মেলে না। … ছবিতে লাল রঙের ব্যবহার তো আছেই, দেখা যায় ব্যবহারের বিচিত্র চেহারাও। … নিজের চোখে ঐ রঙ না দেখলে অমন বিশেষণ প্রয়োগ কী করে সম্ভব। ‘

কবি যেমন তাঁর দৃষ্টির অক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, সেরকম এই বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা – সমালোচনাও সম্ভবত তাঁর নজর এড়িয়ে যায় নি।সচেতন কবির তাই নির্মল স্বীকারোক্তি ” তোরে আমি রচিয়াছি রেখায় রেখায় / লেখনীর নটন লেখায়। / নির্বাকের গুহা হতে আনিয়াছি / নিখিলের কাছাকাছি, / যে সংসারে হতেছে বিচার / নিন্দা – প্রশংসার। / এই আস্পর্ধার তরে / আছে কি নালিশ তোর রচয়িতা আমার উপরে। ”

কবির এই স্বীকারোক্তি তো তাঁর শেষ বয়সের পিয়াকে উদ্দেশ্য করেই। অসীম নিখিলের প্রান্ত থেকে ‘ নিন্দা – প্রশংসার ‘ সংসারে যাকে টেনে এনেছেন , জানতে চেয়েছেন তার কবির প্রতি কোনো ‘ নালিশ ‘ আছে কিনা।  তারপর পিয়াকে প্রবোধ দিয়েছেন, যে আস্পর্ধায় তাকে অসীম নিখিলের কোল থেকে কাছে টেনে এনে আপন করতে চেয়েছেন সে পুনরায় প্রকাশের ভ্রম – ত্রুটি অগ্রাহ্য করে সেই অব্যক্ত্যের পারেই মিশে যাবে। এখানে কবির হাত ধরেছেন দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ।  ” প্রকাশের ভ্রম কোনো / চিরদিন রবে না কখনো। / রূপের মরণ ত্রুটি / আপনিই যাবে টুটি / আপনারি ভারে , / আর বার মুক্ত হবি দেহহীন অব্যক্তের পারে। ”

আমরা জানি না প্রোটানোপিয়া এই ‘ প্রকাশের ভ্রম ‘- এর জন্য কতোটা দায়ি।

________

তথ্যঋণ: 

  • রবীন্দ্রনাথ ও প্রযুক্তি : সুব্রত ঘোষ।
  • রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান : দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়।
  • রবি ঠাকুরের ছবি ছবি – আঁকিয়ের চোখে : সুশোভন অধিকারী।
  • চিঠিপত্র ( ৬) : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
  • আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ : রানী চন্দ।
  • সাহিত্যের পথে : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
  • চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর বর্ণান্ধতা প্রসঙ্গ : অভিজিৎ রায়। ( প্রবন্ধ )
  • রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প : আহমদ রফিক।
  • রবীন্দ্র – চিত্রকলা : রবীন্দ্রসাহিত্যের পটভূমিকা :  সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
  • রবীন্দ্র – চিত্রকলা : মনোরঞ্জন গুপ্ত।
  • বাইশে শ্রাবণ: নির্মল কুমারী মহলানবিশ ।
  • রবীন্দ্র রচনাবলী ( অষ্টম খন্ড ) : বিশ্বভারতী।
  • অনালোচিত রবীন্দ্রনাথ : অতনু কুমার বসু।
  • ২৫ রবীন্দ্র সরণি : অতনু কুমার বসু।

[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ