পাট পাট করে শাড়ি পরা ঢ্যাঙা লম্বা দোহারা চেহারার পদ্মাবতীকে দেখে পাড়ার লোক ঘড়ি মেলাতো। রাজবাড়ির দেউড়িতে চালু হওয়া সেই যে প্রাথমিক স্কুলটা ছিল, সেই স্কুলের প্রাণ ছিলেন পদ্মাদিদিমনি। অভাবী ঘরের মেয়েদের ডেকে এনে খাইয়ে পড়াশুনো শিখিয়ে, বই কিনে দিয়ে বড় স্কুলে পাঠাতেন তিনি। পদ্মাদির চেষ্টাতেই ধীরে ধীরে দেউড়ির প্রাথমিক স্কুল মাধ্যমিক হল, ছাত্রীও বাড়ল। পদ্মাদির কথা বলতে গিয়ে চলে এল স্কুলের কথা। আসলে স্কুল ছাড়া তাঁর কথা আর কিই বা বলার থাকে। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে জলঙ্গীর কাছেই ছিল সাবেকি খিলান দেওয়া বারান্দার দোতলা বাড়িটা। সেই বাড়িতেই থাকতেন পদ্মাদি। তবে থাকতেন আর কতটুকু? সোম থেকে শনি প্রত্যেকদিন সকাল ৯ টায় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে শহরের আর এক প্রান্তে স্কুলে পৌঁছতেন পায়ে হেঁটে। আর স্কুল থেকে পায়ে হেঁটে ফিরতেন সাড়ে পাঁচটায়। দুবেলাই একই ছন্দে টিমে লয়ে মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে পথ চলা। সকালের পাট পাট করে প্লিট দেওয়া সাদা শাড়ির ভাঁজ এতটুকু ক্রাশড হত না। সময়েরও কোনও হেরফের হত না, তাই তাকে দেখে ঘড়ি মেলাতেন মায়েরা।
পদ্মাদিদিমনি মানে পদ্মা রায় থাকতেন তাঁদের পৈত্রিক বাড়িতেই। মা, দাদা বৌদির সঙ্গেই যৌথ পরিবারে। মফঃস্বলের স্বচ্ছ্বল পরিবারে কেন অবিবাহিতা রয়েছে কন্যাটি, একথা তাঁর মাকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি পাড়ার লোকের। এমনকি দাদা-বৌদিরাও মেয়েটিকে নিয়ে মিলেমিশে ছিলেন। দাদার মৃত্যুর পরে দুই ভাইপোকে মানুষ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন পদ্মা। তবে জমি জিরেত ছিল বলে, স্বচ্ছ্বলতা ছিল। তাই অশান্তির ছায়ার লেশ ছিল না রায় বাড়িতে৷
খুবই নিরীহ চেহারার পদ্মাদির কি কোনও বন্ধু ছিল? বোধহয় না। পাড়ার বড়রা বলত, ছোট থেকেই পদ্দ অমনই। স্কুলে ওর সমবয়সী মেয়েরা যখন গল্প করে, এ ওর গায়ে হেসে ঢলে পড়ত, ও তখন একটু দূরে একলা বসে বই পড়ত৷ হাসি-ঠাট্টায় আড্ডা জমানো? উঁহু, কেউ দেখেনি কখনও। কখনও পাড়ার কারও বাড়ি যেতেও তাঁকে কেউ দেখেনি। তবে রাস্তায় কেউ কথা বললে, অল্প হেসে মাথাটা ডানদিকে হেলিয়ে জবাব দিতো- ওই পর্যন্তই। চলার গতি তার কমত না। ওই যে স্কুল ছাড়া আর কোনও বিষয় তার উৎসাহ ছিল না। ফলে তাঁকে নিয়ে মফস্বল শহরে কথা উড়ত নিজের মতো করেই। সেসময় মফস্বল শহরের স্কুলের দিদিমনিরা বাঁধা রিকশা করে স্কুলে যাওয়া আসা করতেন। পদ্মাদিকে রিকশা চড়তে কেউ কোনও দিন দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। সাদা মাটা পাড় ওলা সাদা খোলের শাড়ি, পাড়ের সঙ্গে ম্যাচিং রঙীন ব্লাউজ, একটা কাপড়ের কাঁধ-ঝোলা ব্যাগ, বইখাতার ভারে যে ব্যাগের পেট মোটা থাকত সবসময়েই, আর একটা কালো কাপড়ের বাঁশের ডাঁটির ছাতা – এই ছিল তার সাজসজ্জা। ও হ্যাঁ-মাথার চুল টান করে একটা খোঁপা বেঁধে রাখতেন পদ্মাদিদিমনি। খোঁপায় নিশ্চয় কাঁটা গোঁজা থাকতো, তবে সেকথা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। এমন মহিলাকে নিয়ে পাড়া প্রতিবেশী রসিকতা করবে সে তো জানা কথাই। এমনকী কিপটে বুড়ি নামও জুড়ে দিয়েছিল কে যেন তাঁর ভরা যৌবনেই। এসব কথা তাঁর কানে পৌঁছত কিনা কে বলবে? অবসর নিয়েও তিনি আমৃত্যু মেয়েদের পড়াতে তিন তিন ৬ কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যাওয়া আসা করতেন সেও জানা ছিল।
অনেক অনেক বছর ধরে পদ্মাদির এই ছবিটাই সকলের মনে গাঁথা ছিল। প্রকৃত পদ্মাবতী লক্ষ্মীদেবীকে আবিস্কার করা গেল, তাঁর মৃত্যুর পরে।কিপটে বুড়ি পদ্মাদি তাঁর সমস্ত টাকা দিয়ে গিয়েছেন স্কুলকে। সেই টাকাতেই রাজার দেউড়ির ঠিকানা ছেড়ে স্কুল উঠে গিয়েছে ঝাঁ চকচকে নতুন দোতলা বাড়িতে। স্কুলের লাইব্রেরিতে দেওয়াল জোড়া আলমাড়িতে বিশ্বসাহিত্যের সেরা সম্ভার কেনা হয়েছে। অভাবী মেয়ের পড়ার জন্য বিশেষ স্কলারশিপ দেওয়া হয় তাঁর টাকাতেই। আর এসবই তিনি ইচ্ছেপত্র করে রেখেছিলেন। তিল তিল করে পয়সা জমিয়ে সমাজের জন্যে মেয়েদের শিক্ষার জন্য তা দিয়ে দিতে কতজন পারে? কিপটে বুড়ি নয়, তাঁর নাম থাকুক পদ্মাসনা পদ্মাবতী।
[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]
Tags: গল্পের সময় ব্লগ, ব্লগ, মিতালী মিত্র, রাজার দেউড়ির স্কুলের পদ্মাবতী
email:galpersamay@gmail.com
Subhalakshmi Pandey on October 25, 2023
Onobodyo lekhati. Padmadi ke khubchintam, amar maayer bondhu chhilen…chhotobalay orokom lomba, kath kath chehara kaar bhalo lagey? Tar opor didimoni! Swarnomoyee school r! Erokom byaktitwo ke bojhar jonyo bodh budhhi r dorkar hoy. Chhotobalay Tai tnake bujhini. Aaj khed hoy.
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।