21 Oct

বারাকপুর,জিলা যশোহর

লিখেছেন:ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়


গপ্লপের সময় ব্লগ

বাবার ঘরের কাঠের আলমারিটায় কতদিন হাত দেওয়া হয়না। পুরোন বইয়ে ঠাসা আলমারিটা এখন আর কারো দরকার হয়না। সময়ও হয়না মাঝে মধ্যে একটু খুলে দেখার। কিন্তু সেদিন হাত দিতেই হল। আলমারির গায়ে উইয়ের সারি।

বই গোছানোর কাজ শুরু করা যায়, কিন্তু শেষ করা বড় মুস্কিল। বই হাতে নিয়ে ঝেড়ে ঝুড়ে রেখে দেওয়া যায়না। রেখে দেওয়ার আগে একটু উলটে দেখতে ইচ্ছে করে। কত না-পড়া, কত অর্ধেক-পড়া বই, কিছু পড়া-বই, কিছু বইতে ছোটবেলার ছোঁয়া, কোথাও বা কারো করা আন্ডারলাইন করা মুগ্ধ মন্তব্য। কোনো বই ধূলো ঝেড়ে রাখতে গিয়ে মনে পড়ে যায় মনে দাগ কেটে যাওয়া কোনো লাইন। সেই লাইনটা তখন খুঁজতে বসে যাই। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আরও কত জায়গায় চোখ আটকে যায়। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে যায়, পেছন থেকে তাগাদা আসে- আজ কি গোছানো শেষ হবে?

এমনই সময়ে হাতে এসে গেল বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’। বইয়ের ভূমিকায় চোখ আটকাল-‘বারাকপুর,জিলা যশোহর,সন ১৯৩৫’। যশোহর মানে বাংলাদেশ, যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখলের লড়াই। কৈশোরে এপার থেকে আমরা গোলাগুলির শব্দ শুনেছি। আমরা অনেক বিপ্লবের গল্প শুনেছি, পড়েছি। কিন্তু অত্যাচারীর হাত থেকে লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে শাসন ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে একটা নতুন দেশের জন্ম-এ তো আমাদের চোখে দেখা। বইটা পেয়ে কেমন যেন একটা আবেশ কাজ করছিল। বারাকপুর, যশোহর জেলায় বসে লেখা বইটা। গল্পে শোনা পূর্বপাকিস্তানের স্মৃতি আমার মুছে গেছে বহুদিন,সে জায়গায় মন জুড়ে আছে বাংলাদেশের উত্থান। যে দেশ আমাদের চোখের সামনে জন্মেছে। যে দেশ আমার পূর্বপুরুষের দেশ।

কদিন আগে টাকি বেড়াতে গিয়েছিলাম। ইছামতির বুক চিরে আমরা ভেসে চলেছিলাম। ওপারে বাংলাদেশ,সাতক্ষীরা জেলা। আমরা মাঝিকে বলছিলাম, “এতদূর দিয়ে কেন, তীর ঘেঁসে চল”। মাঝি রাজি হচ্ছিলনা। আমাদের পিড়াপিড়িতে কিছুটা গেল, তাতেই আমরা খুশি। নদীর ধারে জেলে মাছ ধরে, চাষি চাষ করে, মা ছেলের হাত ধরে হেঁটে চলে গ্রামের পথে। এইসব সাধারণ দৃশ্য দেখে আমরা পুলকিত হই। পাহারা রত বিডিআর জওয়ানকে দেখে আমরা হাত নাড়ি,সেও প্রত্যুত্তর দেয়। কেন আমাদের এই অকারণ পুলক? অকারণ নয়, ঐ দেশটা আমাদের পূর্বপুরুষের দেশ।

আমার বর্তমান নিবাস গঙ্গাতীরে। চোখ মেললেই গঙ্গার ওপারে চোখ জুড়ানো সবুজ। জায়গাটা সেনাবাহিনীর অধীনে থাকায় নগরায়ন নিয়ন্ত্রিত। এ যদিও খুব বিপদজ্জনক চিন্তা তবু আমার কেন যেন মনে হল ইছামতির মত গঙ্গা পেরোলেই যদি অন্য একটা দেশে যাওয়া যেতো, যেটা আমাদের পূর্বপুরুষের দেশ- তাহলে কেমন হোতো? ‘চাঁদের পাহাড়’ বইটি একদিন আলমারিতে ঢুকে গেল, আর আমার এই অদ্ভূত ভাবনাও একসময়ে মিলিয়ে গেল মন থেকে।

#

সেদিন ভোর বেলা আকাশ পরিষ্কারই ছিল, কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে এক আকাশ কুয়াশা এসে দিকবিদিক ঢেকে দিল। পাঁচ হাত দূরের মানুষকেও দেখা যায় না। ঘন কুয়াশাতে ট্রেন, প্লেন, বাসের মতো বোট চালানোও বিপদজ্জনক। আমি অনেক মানুষের সঙ্গে পারঘাটে অপেক্ষা করছি, কুয়াশা একটু না কাটলে বোট ছাড়বেনা। আমি এই পথে রোজ অফিস যাই, অফিসের দেরি হচ্ছে। আমরা পীড়াপীড়ি করছি বোট ছেড়ে দেবার জন্যে। সোজা গেলেই তো ওপারে পৌঁছব আর ওপার মানেই তো ব্যারাকপুর। শেষে অনিচ্ছা সত্বেও মাঝি রাজি হল। ঘন কুয়াশা ভেদ করে আমরা এগোচ্ছি। নৌকায় বসে জলও দেখা যাচ্ছেনা। মাঝগঙ্গায় গিয়ে মাঝি দিশেহারা, দিক ঠিক করতে পারছে না। ইঞ্জিন বন্ধ করে মাঝি চিৎকার করে এ দুউউ…খী…। ওপার থেকে কুয়াশা ভেদ করে ক্ষীণ সাড়া আসতে থাকে। সেই শব্দ অনুসরণ করে মাঝি ধীরে ধীরে এগোয়। যাত্রীদের মধ্যেও ভয় ভয় ভাব, আমরা প্রয়োজনে জল দিয়ে যাতায়াত করি কিন্তু ডাঙায় উঠে শান্তি পাই। একটু পরে অবশ্য অনিশ্চয়তা কেটে যায়, হাল্কা একটা ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। লোকজন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় গাছপালার সবুজ আভা, নদীর বুকে বিশাল চর। ভাটার সময় চর জেগে ওঠে, চরের ওপর দিয়ে বাঁশের তৈরি পথ দিয়ে অনেকটা হেঁটে গিয়ে পারে উঠতে হয়। নৌকো ভিড়লে ধীরে ধীরে মানুষ নেমে এগিয়ে চলে।

ঘন কুয়াশা ভেদ করে ঘাটটা ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। প্রতিদিনের চেনা জায়গাটা আজ হঠাৎ অচেনা মনে হল। মনে হল যেন নতুন কোনো দেশে এলাম। অনেকদিন আগের সেই অনুভূতি-গঙ্গা পেরিয়ে বাংলাদেশের ‘যশোহর জিলা’য় এসে পৌঁছেছি। মনে পড়ল  নদীর ধারে আম কাঁঠালে ঘেরা  গ্রামদেশের গল্প। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে শীত শেষে মুকুলে-সাদা-হয়ে যাওয়া কয়েকটা আম গাছ। কুয়াশা-ঢাকা রাস্তাঘাট ঘর বাড়ি সব যেন অচেনা। আগেতো কখনও চোখে পড়েনি এসব। কাছে গেলে পাছে মায়াটা  মিলিয়ে যায় আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করি দৃশ্যটা। অচেনা শহর ‘বারাকপুর- জিলা যশোহর’।

ধীরে ধীরে দৃশ্যমানতা বাড়তে থাকে, অস্পষ্টতার মায়া কেটে যায়। পৌঁছে যাই উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ব্যারাকপুর শহরে। আমি দ্রুত পা চালাই, অফিস যেতে আজ অনেক দেরি হবে।

[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ